(প্রথমে এই কথা বলে নেয়া আমার জন্যে নিরাপদ যে, ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম। যেহেতু সেটা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে উক্ত মতবাদ লালনকারীরা আমার অগ্রজকে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে, আহত করেছে আমার বোনকে।)

লোকটার লেখালেখির সাথে আমার পরিচয় ৬-৭ বছরের বেশি হবে, ২০১১তে ফেসবুক বন্ধুতালিকায়। ছবি দেখে অবাক, ”আমি তো আপনেরে আরো বয়স্ক ভাবছিলাম! লেখা পড়ে তো এতো অল্পবয়স্ক কেউ মনে হয় না”! তার মন খারাপিয়া উত্তর, ”সবাই আমারে বুইড়া ভাবে ক্যান?”
প্রথম দেখা ২০১২-এর বইমেলায়। কী নির্মল হাসি, তীক্ষ্ণ সেন্স-অব হিউমার, অনেকক্ষণ আড্ডা হলো, খাওয়া-দাওয়া হলো, ‘অবিশ্বাসের দর্শন’, ‘ভালোবাসা কারে কয়’ কিনলাম। তারপর দেখা এই বইমেলায়, ২৩ তারিখ সোমবার, ছিলেন মাহবুব লীলেন, রণদীপমদা, আরিফ জেবতিক, সুহান রিজওয়ান, হাসান মুরশেদ, শুভজিত, অর্চিতা, হিল্লোলদা, আরো অনেকেই। সময় কম ছিলো, দেখি বন্যাদি আর অভিজিতদা গায়ে বাতাস লাগিয়ে একজন শাড়ি আরেকজন পাঞ্জাবী পরে মেলায় ঘুরছেন। সিনটা একটু বেঠিক ঠেকেছিলো বটে, একবার ফিসফিস করে বললামও, ভাইসাব, একটু সাবধানে থাকা উচিত। স্মিত হেসে বোঝালেন, মাথায় আছে। বন্যাদির সাথে এই প্রথম সাক্ষাত, মিষ্টি হেসে করমর্দন করে জানালেন, ”আবার দেখা হবে”।

তাদের মাথায় ছিলো না, একেবারেই ছিলো না নিশ্চিত, তারা বিশ্বাস করেছিলেন, অনলাইনের চিল্লা-চিল্লি, মৃত্যুর হুমকি এসব বাস্তব জীবনে খুব সিরিয়াস ম্যাটার না’ও হতে পারে। সেই বিশ্বাস থেকে এক মেরুদন্ডহীনদের দেশে, এক ঝাক হিংস্র পশুর দেশে, এক পতিত প্রতিষ্ঠানের বইমেলায় এসেছিলেন, প্রাণ দিয়ে গেলেন।

বৃহস্পতিবার রাত থেকে ফোনের পর ফোন, ফেসবুকে মেসেজ (এদিকে আমার ল্যাপটপ নষ্ট হয়ে পরে আছে দোকানে)। সবাই সাবধান করে, সব ছেড়েছুড়ে দিতে বলে, প্রোফাইল ডিয়েক্টিভেট করে রাখতে বলে। বেঁচে থাকতে বলে, বেঁচেই থাকতে কেবল…আর বেঁচে থেকে কী হবে?

আমার আর প্রাণের মায়া নাই, একজন অধ্যাবসায়ী নিবেদিত প্রাণ মানুষ, আমার অগ্রজ, একজন প্রথম শ্রেণীর স্কলার, নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন, আমার বেঁচে থাকা আর কত ম্যাটার করে!

কী সুখে লিখতে গেছিলেন? বাংলায়? এই বাংলাকে হাজারো কুসংস্কার থেকে তুলে এনে বিজ্ঞানভিত্তিক যৌক্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্ন কেন দেখতে গেলেন?
প্রাণ খুলে চিৎকার করেছি, অসংখ্য মানুষের আর্তচিৎকার ফোনের পর ফোনে, শুনেছি। কয়েকটা রাত কেঁপে-কেঁপে উঠেছি ঘুমের মাঝে, নিজের হৃদপিন্ডের শব্দে আঁতকে উঠেছি বারবার। শুক্রবার সকালে টিএসসির প্রতিবাদ সমাবেশে যাবার পথে রিক্সায় বসে মানুষ দেখছিলাম রাস্তার, সাদাসিধে জীবনযাপন বরাবরের মতো, কেউ হাসছে, কেউ কথা বলছে, খেলছে, যাচ্ছে, জীবনমুখী ব্যস্ততা, উদ্বিগ্নতা, বা আনন্দ। ভাবছিলাম তাঁদের মতো আমিও যদি স্বাভাবিক থাকতে পারতাম! কোন আম্রিকা প্রবাসী মরে গেলো এতে আমারও কিছু আসতো-যেতো না!

তবু আসে যায়, দুনিয়াতে একেকজন মানুষ একেক বিষয়ে কৌতুহলী হন, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে, একেকজন মানুষ একেকটা সমস্যা দেখেন, তা নিয়ে ভাবেন, কথা বলেন, কেউ লিখেন। সৃষ্টিতত্ত্ব ভুল না শুদ্ধ, এই প্রশ্নে ধর্মের শুরু থেকেই অনেক মানুষ বিতর্কে গিয়েছেন, যাচ্ছেন, যাবেন। কারো আগ্রহ যাবে শিল্পকলায়, কেউ চিকিৎসা বিজ্ঞানে, পদার্থবিজ্ঞানে, সমাজতত্ত্বে, শ্রমে, কৃষিতে, ব্যবসায়, রাজনীতিতে, ঈশ্বরের আরধনায়, ফিলসফিতে, সংগীতে, সাহিত্যে, প্রেমে, যার যেখানে ইন্টারেস্ট। দশজন মানুষকে জিজ্ঞেস করে দেখুন বাংলাদেশের মুল সমস্যা কী? দশজনে দশরকম সমস্যা তুলে ধরতে পারেন, এমন নানামুনির নানামত নিয়েই দুনিয়া চলে এসেছে। এমনই এক শ্রেণির মানুষ মনে করে, সৃষ্টিতত্ত্বে ভুল আছে, যার আরাধনায় একটা আদিম সংস্কৃতি লালন করা হচ্ছে কেবল, যেটা আধুনিক বিশ্বে নেতিবাচক প্রভাব রাখছে, তার বদলে চাই বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিবাদের ডেপথ। নিছক সরল-বস্তুবাদী-সাদামাটা ভাবনা। এ ভবনা লিখে তুলে ধরলে এতোটাই তার প্রাণ-সংহারী শক্তি যে আক্রান্ত বোধ করে এতোগুলি মানুষ! হত্যা মিশনে রত হয় একটা বিশাল জনগোষ্ঠী, কেউ অস্ত্র নিয়ে, কেউ লিখে হত্যাকে জায়েজ করে, কেউ করে উল্লাস! আর কোন মিডিয়ামের আলোচনা-সমালোচনায় তো কেউ কাউকে মারতে যাচ্ছে না! ধর্ম নিয়ে লাইনের পর লাইন লেখা হয়ছে জীবনভর! প্রচন্ড শক্তিশালী সব ব্যাঙ্গচিত্র, স্যাটায়ার, গান, কবিতা, প্রবন্ধ, গাদা-গাদা পুস্তক রচিত হয়েছে, এই আধুনিক কালে এসে এক ইসলাম ধর্ম ছাড়া আর কোন ধর্মের লোকজন তো ফেইথ ইস্যুতে খুন-খারাপী করছে না! (শুরুতেই বলেছিলাম, ইসলাম একটা শান্তির ধর্ম, প্রশ্নগুলি শুনে আপনারা সেটা ভুলে যাবেন না।)

জানি এসব প্রশ্নের উত্তর নাই, সুশীল সমাজ, পতিত বুদ্ধিজীবি, জনপ্রিয়তালোভী মিডিয়া কর্মী, ত্যানা হাতের লেখক, চিন্তক, আদিম সংস্কারে পরাজিত সৈনিক, কেউ, কেউ এ প্রশ্ন তুলে এগিয়ে যাবেন না কেন ইসলামের অনুসারীরা এতো অসহিষ্ণু হচ্ছে দিন-দিন, কেন প্রতিদিন বিশ্বের কোন না কোন জায়গায় এদের হাতে নিরিহ মানুষ মারা পরছে, সমস্যাটা কোন জায়গায়, নাকি কয়েক জায়গায়! কেবলই অর্থনৈতিক, বৈশ্বিক রাজনৈতিক, নাকি ফিলসফিতেও।
তারা সেই সমাধানে যাবেন না। কারণ সেখানে গেলে জনপ্রিয় হওয়া যায় না। কানার হাট-বাজারে এই প্রসঙ্গে জনপ্রিয় হবার দুইধরণের টেকনিক, এক, ধর্ম কত বৈজ্ঞানিক, ত্যানা পেঁচিয়ে উদ্ভট আইডিয়া বের করে লিখো, হাজারো মানুষ লাইক দিবে, দুই, ধর্মী ভাইদের কারণে কিঞ্চিত গিল্টি ফিলিং-এ আক্রান্ত বা ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সের শিকার জনগোষ্ঠীর কুপমন্ডুকতার সাথে সাপোর্টিভ কিছু লিখে অন্যপক্ষ্যের দোষ ধরে সান্ত্বনা দাও, লাইকের বন্যা বয়ে যাবে।

এ কাজটাই এখন অনেকে করছে, অভিজিৎ রায় নীতিগতভাবে ঠিক ছিলেন না, ধর্মের বিরুদ্ধে লেখা ঠিক না, প্রগতিশীলতার নাম কোনটা, অভিজিৎ ইসলাম বিদ্বেষী ছিলেন ইত্যাদি জিকির তুলে হত্যাকারীদের মুক্তি দিচ্ছেন, এবং হত্যাকান্ডের সাপোর্টিভ জনগোষ্ঠীতে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
তারা ইচ্ছাকৃতভাবে চেপে যাচ্ছেন, অভিজিৎ রায় কখনও কোন ধর্ম নিয়ে গালাগালি করতেন না, বাজে বকতেন না, উপযুক্ত রেফারেন্স ছাড়া কোন লেখা লিখতেন না, ”ঈদ মুবারক” লিখে স্ট্যাটাস দিতেন রোজার ঈদে। গোপন করছেন অভিজিৎ রায়ের আরো নানামুখী লেখার কথা, চেপে যাচ্ছেন স্বামী বিবেকাননন্দের হিপোক্রেসি, কিংবা নরেন্দ্র মোদীর বেদবাক্যে সাইন্সের উপস্থিতির দাবি নিয়ে বিডিনিউজের বিশাল সব লেখা, তার চেপে যাচ্ছেন বাঙালি হিন্দুর কুপমন্ডূকতার বিবিধ উদাহরণ টেনে চাচাছোলাভাবে হিন্দু-জনগোষ্ঠীর নানান ত্রুটি তুলে ধরার কথা, রবীন্দ্রনাথকে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত করা সেই লেখা যা তুমুল আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিলো দুই-বাংলায়। কারণ সেসব তুলে ধরলে ইসলাম বিদ্বেষী আখ্যা দিয়ে কুপমন্ডুক জনগোষ্ঠীর লাইক কামানো যায় না।

অতো লাইক কামানোর বুদ্ধি নিয়ে আমি জন্মাইনি, দরকারও বোধ করি না। আমার খালি মনে পরে যায় রক্তাক্ত বন্যাদির চিৎকার, পাশে বিজ্ঞানের ইতিহাসে দুই-দুইটা প্যাটেন্টের মালিক কোরবানীর গরুর মতো পরে থাকা নিথর অভিজিৎ রায়, এ দৃশ্য আমাকে ঘুমাতে দেয় না। আমি স্মরণ করার চেষ্টা করি সেই মিষ্টি হাসি, দুইদিন পরপর ইনবক্সে এসে ধমক, ‘সিরিয়াসলি লেখো না ক্যান মিয়া’? শাহবাগ আন্দোলনে শিবিরের বিরুদ্ধে ফেসবুকে লেখার পর ডেকে নিয়ে মুক্তমনায় একাউন্ট করে দিয়ে সেই লেখা মুক্তমনায় পোস্ট দেয়ানো, কৌস্তুভের দুষ্টুমী ছবি পোস্ট যাতে দেখা যাচ্ছিলো ‘হিন্দু’ অভিজিৎ রায় বাসায় গরুর মাংস রান্না করছেন।
আমার মনে পরে যায় সেই মুক্তমনার কথা, যার বাসায় কেউ ধর্মপালনকারী না থাকলেও মুসলমান বন্ধুদের সুবিধার্থে একটা জায়নামাজ কিনে রাখার কথা, যাতে অভিজিতের বন্ধুরা এসে নামাজ পড়তেন, কেবলা দেখিয়ে দিতেন তিনি নিজেই।
আমার মনে পরে ধর্ম ও বিজ্ঞান ছাড়াও চিত্রকলা, রাজনীতি, সংস্কৃতি, গল্প, কবিতাসহ প্রায় সব বিষয়ে এক তুমুল কৌতুহলী বইপড়ুয়া লোকটির কথা, যাকে ফাইজলামী করে মাঝে-মাঝেই ডাকতাম ”সায়েব দেশের অভিজিট্রয়”, তৃষা আহমেদ নামের সেই প্রতিভাবান বাচ্চা মেয়েটির বাবা, যিনি মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, নাস্তিক হয়ে যাওয়া মানেই ভালো মানুষ হয়ে যাওয়া নয়, আনলেস ইউ হ্যাভ এ সেন্সিটিভ ইনার ফিলিং ফর এভ্রিথিং।

”এ কী দুঃখভার,
কী বিপুল বিষাদের স্তম্ভিত নীরন্ধ্র অন্ধকার
ব্যপ্ত করে আছে তব সমস্ত জগৎ
তব ভূত ভবিষ্যৎ!
প্রকান্ড এ নিষ্কলতা
অভ্রভেদী ব্যাথা
দাবদগ্ধ পর্বতের মতো
খররৌদ্রে রয়েছে উন্নত
লয়ে নগ্ন কালো শিলাস্তূপ
ভীষণ বিরূপ”