অনেক খুঁজে বের করলাম, মুক্তমনায় লিখতে অনুরোধ জানিয়ে অভিজিৎ রায় আমাকে প্রথম ই-মেইল করেন ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০০৬। সে থেকে ২০০৮ পর্যন্ত প্রায় প্রতি সপ্তাহে কিংবা প্রতি দু’সপ্তাহে একটি করে লেখা দিতাম মুক্তমনায়। এ দীর্ঘ সময়ে আমার মন্দ-ভাল, চটুল-ভারী, ভুল-শুদ্ধ, অপ্রিয়-প্রিয় হরেকরকম লেখা প্রকাশিত হয়েছে মুক্তমনায়। কবিতা,প্রবন্ধ, ভ্রমনকথা,সংগীত কিংবা বই নিয়ে আলোচনা-কী না লিখছি তখন?

সবে পড়াশুনা শেষ করে চাকুরীতে ঢুকেছি বিদেশে। যতখানি মনোযোগ দেয়া দরকার কর্মক্ষেত্রে,সেটা না দিয়ে অধিক মনোযোগ দেই মুক্তমনায়। সে এক কঠিন নেশা। মুক্তমনা্ময় জীবন যেন। ওয়াইফাই তখনও এত সহজলভ্য নয়। অফিসের ফাঁকে কিংবা ছুটি কাটানোর সময়েও জোগাড়যত্ন করে মুক্তমনায় এক পলক চোখ বুলাতে না পারলে প্রচন্ড এক অতৃপ্তি ভর করে মনে।

এখন যেমন সে সময়েও মুক্তমনা প্রগতিশীল যুক্তিবাদী মানুষের কাছে তেমনি সমান জনপ্রিয়। মুক্তমনার আর্কাইভের লেখক-তালিকা থেকেই ধারণা করা যায় মুক্তমনার এ জনপ্রিয়তার কারণঃ
http://www.mukto-mona.com/new_site/mukto-mona/muk-authors.htm

একঝাঁক গুনী লেখক তো বটে মুক্তমনার এ জনপ্রিয়তার পেছনে আরেকটি কারণ এর সম্পাদকীয় ও মডারেটর পরিষদ; যাঁদের মধ্যমণি ছিলেন অভিজিৎ রায়। তখন অভিজিৎ নিজের লেখালেখির চেয়ে মুক্তমনার উৎকর্ষ সাধনের দিকেই বেশী মনোনিবেশ করেছিলেন বলে আমার মনে হয়েছে। আর তাঁর এ চেষ্টা যে নিস্ফল হয়নি, তার প্রমান প্রতিক্রিয়াশীলদের বিপক্ষে মুক্তমনার আজকের এ শক্ত অবস্থান এবং যার পরিণতিতে অভিজিৎ রায়ের নৃশংস ও কাপুরুষোচিত এ হত্যাকাণ্ড।

২০০৮ এর পরে ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে মুক্তমনায় আর নিয়মিত লেখা হয়ে ওঠেনি আমার। তবে মুক্তমনা ছিল মনের নিভৃত গহবরে। এমন দিন খুব কমই গেছে যে দিন মুক্তমনায় একটি বারের জন্যেও ঘুরে আসা হয়নি; বিশেষ করে প্রিয় কোন লেখকের লেখা হ’লে তো কথাই নেই, গো-গ্রাসে গিলে ফেলি এখনও। লিখিনি তাই বা বলি কী করে? এই তো সেদিন অভিজিতের অনুরোধেই লিখেছিলাম রম্যরচনা “অরক্ষিত বাংলাদেশ”; শুরু করছিলাম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস “ চন্দ্রমুখী জানালা”, আবার ৫-৭টি অধ্যায় লিখে বন্ধ করে দিই কাউকে না বলেই।

গত বছর মীজান রহমান, মীজান ভাইয়ের সাথে কথা বলছিলাম মুক্তমনায় আবার নিয়মিত হবো এ আশ্বাসে। মীজান ভাইয়ের কাছে পাঠিয়েছিলাম অভিজিৎ ও বন্যার জন্য “বিভক্তির সাতকাহন”, যার প্রায় পুরোটাই মুক্তমনায় প্রকাশিত হয় ২০০৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত। আমাকে বিষ্মিত করে একদিন পরেই অভিজিতের ই-মেইল; অভিজিৎ লিখেছেন,
“মীজান ভাইয়ের সাথে পাঠানো বিভক্তির সাতকাহন বইটার জন্য ধন্যবাদ। লেখাগুলো অনলাইনে আগেই পড়েছিলাম। নতুন করে পড়তে গিয়ে আবারো ভাল লাগল। ভূমিকায় মুক্তমনার কথা লিখেছেন সেজন্যও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বইয়ে আপনার সাক্ষর থাকলে খুশি হতাম অনেক।
জানি সময়টা ভাল নয়, তবুও আশা করব ভাল থাকবেন, শারীরিক এবং মানসিক – দুভাবেই।”

সময়টা ভাল নয় বুঝেছিল অভিজিৎ। আর এই ভাল না-থাকা দুঃসহ সময়েই শারীরিকভাবে চলে গেলেন অভিজিৎ হাজার-লক্ষ মুক্তমনা মানুষকে মানসিকভাবে ভাল না রেখেই।

আজ একটি কথা বড় মনে পড়ছে, আজ থেকে প্রায় ৪ শ’ বছর আগে গ্যালিলিও বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমান দিয়ে জোর গলায় বলেছিলেন, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। প্রচন্ড শক্তিশালী খ্রিষ্টান ধর্মগুরুদের ভয়ভীতির কারণে, গ্যালিলিও বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, সূর্যই পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। কিন্তূ খুব গোপনে তাঁর ছাত্র আন্দ্রেয়ের হাতে ‘ডিসকোর্সি’ নামক পান্ডুলিপিটা দিয়ে যান তিনি। তার প্রায় ৩৮৮ বছর পর ১৯৯৮ সনে সেই খ্রিষ্টান ধর্মগুরুরাই গ্যালিলির মতবাদকে স্বীকার করে নিলেন।এ নিয়ে সুন্দর একটা কবিতা আছে ওপার বাংলার কবি বীরেন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের,নাম ‘পৃথিবী ঘুরছে’। কবি বলেছেন,
‘চোখ রাঙালে না হয় গ্যালিলিও
লিখে দিলেন, ‘পৃথিবী ঘুরছে না।’
পৃথিবী তবু ঘুরছে,ঘুরবেও
যতই তাকে চোখ রাঙাও না।’

গ্যালিলিওকে বন্দি করে,তাঁকে ভয়ভীতি দেখিয়ে লিখে নিলেই কিন্ত সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘোরা বন্ধ করা যায়নি। এ যুগের অর্বাচীন ধর্মদস্যুরা এসব ইতিহাস জানে না, তাই হুমায়ুন আজাদ কিংবা অভিজিৎ রায়কে হত্যা করে তারা ভাবছে প্রগতির চাকা পেছন দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে পৃথিবীকে নিয়ে যাবে অন্ধকার গুহায়। কিন্তু মানুষের চিন্তার স্বাধীনতাকে রুখে দেবে সে শক্তি কার? মুক্তমনাদের কলম চলছে, চলবে… যে কোন মূল্যেই।

কবে যেন লিখেছিলাম, সেখান থেকে একটি লাইনই সব সময় মনে হয়, শক্তি পাই এ রকম প্রিয়জন-হারানো দুঃসহ সময়ে,” মেরে কেটে ভয় দেখাচ্ছিস? ভয় খাব না…”।