(শিরোনামটি মায়াকোভস্কি’র একটি কবিতার একটি পংক্তির অনুবাদ)

আমার মত যারা দেশের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক ইত্যাদি নানা ধরণের হোচট খেয়ে দেশের জন্য ভালো কিছু করার জন্য হাল ছেড়ে দিয়েছেন, তাদের কাছে অভিজিৎ রায় ঈর্ষনীয়ভাবে শ্রদ্ধার পাত্র।আমার দুর্ভাগ্য তার মত কোন বন্ধু আমার জীবনে আসেনি। এছাড়া ক্যাডেট কলেজের মত বদ্ধ একটি পরিবেশে বড় হয়ে চিরকালই মানসিকভাবে পঙ্গু আমি কারো খুব কাছাকাছি যেতে পারিনি কখনোই, যদি পারতাম ২০০৮ পরবর্তী সময়ে এই মুক্তমনায় তার সাথে একটি বন্ধুত্ব হতে পারতো, অভিজিৎ এর কিছু বাড়তি স্মৃতি আমি চিরকাল যত্ন করে রাখার সুযোগ পেতাম।তীব্র একটি অনুশোচনা বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে আমি সেই চেষ্টা করিনি বরং আমার দুরবর্তী প্রিয় লেখকদের মত তাকে শুধু শ্রদ্ধা,ভালোবাসা,অনুরাগ আর ঈর্ষার একটি অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি দিয়ে অনুসরণ করেছি কেবল।

এই সব অনুভূতিকে সুতোর মতো বেধে রেখেছিল তার প্রতি আমার একটি কৃতজ্ঞতাবোধ। যে অনুভূতিটি আমি সুযোগ পেলেই তাকে প্রকাশ করেছি।এই কৃতজ্ঞতাবোধ প্রথমত মুক্তমনার মত একটি প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য।তারুন্যে এমন কোন প্ল্যাটফর্ম আমার জীবনকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে পারতো।আমি আশ্বস্ত হই এখন, এই মুহুর্তে, আমার মত হয়তো কেউ তার তারুণ্যে মুক্তমনায় প্রশ্নের উত্তর খুজছে, আত্মবিশ্বাসী হয়ে সুন্দর করে গড়ে তুলছে তার জীবন। অদ্ভুত এই অনুভূতি। মুক্তমনায় যারা লিখছেন তাদের প্রত্যেকের প্রতি এই অনুভূতিটি সম্প্রসারিত। মুক্তমনায় আমি দীর্ঘদিন কিছু লিখিনি – লেখার শরুর অভিজ্ঞতাটা আমার ভালো নয়; উপরন্তু আত্মবিশ্বাস, জ্ঞানের ঘাটতি, যুক্তি ব্যবহারের অদক্ষতা, লেখার সাবলীলতা ইত্যাদি নানা কারণে আমি লেখক না বরং রুপান্তরিত হই নিয়মিত পাঠকে। খুব কম দিনই গেছে আমি এই অভিজিৎ রায় ও তার প্রিয় সহযোদ্ধাদের এই দূর্গে প্রবেশ করিনি।

আমার কাছে অভিজিৎ রায় নামের এই প্রানচঞ্চল, মেধাবী তরুণটি মুক্তমনার সমার্থক।দেশের বাইরে আসার পর যখন ইন্টারনেট সহজলভ্য হয়েছিল, তখন একদিন ইন্টারনেটে সার্চ করতে গিয়ে মুক্তমনার সন্ধান পেয়েছিলাম। কাকতলীয় ভাবে আমার সেই সার্চ ওয়ার্ড ছিল ‘ দি গড ডিল্যুশন এর বাংলা অনুবাদ’; আজকের প্রজন্মের বহু তরুণই হয়তো অনুভব করতে পারবেন না যে, তারা ঠিক কতটা ভাগ্যবান, এমন কোন একটি প্রতিষ্ঠিত ফোরাম আছে, যা তাদেরকে প্রশ্ন করার সুযোগ করে দিতে পারে… আমাদের অনেকেরই যে পথটি পার হতে বহু পরিশ্রম করতে হয়েছে। অভিজিৎ রায় ও তার কাছের মানুষগুলো তাদের অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতায় সেই আলোকময় পৃথিবীর দরজাটা খুলে দিয়েছেন মুক্তমনার মাধ্যমে, তার লেখনীর মাধ্যমে। কাজের অবসরে বহু মিনিট আমি সেই ব্লগে কাটিয়েছি, তরুণদের কাছ থেকে শিখেছি অনেক কিছু। তার কাছে আন্তরিকভাবে আমি কৃতজ্ঞ এবং তাকে নিয়ে গর্ব বোধ করি।

এবারের বইমেলায় যখন আমার এবং আসমা সুলতানা মিতা’র অনূদিত দুটি বই (রিচার্ড ডকিন্স এর দি গড ডিল্যুশন ও জন বার্জার এর ওয়েজ অফ সিইং) নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন, আমি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাকে ইমেইল করেছিলাম, তাৎক্ষনিক উত্তরও পেয়েছিলাম, গভীর বেদনায় আক্রান্ত করে তার ইমেইল এর সেই শব্দগুলো, যদি আপনি সতর্ক হয়ে নীচের ইমেইলটি ( ৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৫) লক্ষ্য করেন তাহলে নজর এড়াবেনা.. তার সহমর্মিতা, মুক্তমনার প্রতি তার ভালোবাসা, অনুপ্রাণিত করার মত তার অসাধারণ ক্ষমতাকে। নিজের মেধা, লেখার ক্ষমতা ছাড়াও এই বৈশিষ্টগুলোই তাকে অনন্য করেছে বহু মানুষের মধ্যে।

কাজী মাহবুব হাসান,
অনেক ধন্যবাদ আমাকে ইমেইল করার জন্য। সড়ক দুর্ঘটনার কথা শুনে খারাপ লাগলো। আশা করব দ্রুত সুস্থ হয়ে লেখালিখিতে ফিরে আসবেন। মুক্তমনায় অনেক দিন ধরেই লিখছেন না। আপনার এবং মিতা উভয়েরই লেখালিখির জন্য মুক্তমনা আদর্শ স্থান হবার কথা ছিল। আবার ফিরে আসবেন এই কামনা করছি। ফেসবুকেও আসুন। আপনার গুরুত্বপূর্ণ স্ট্যাটাসগুলো সত্যই মিস করছি। বিজ্ঞান, যুক্তি, শিল্প এবং নান্দনিকতায় সমন্বিত মানুষ চারপাশে বেশি দেখি না, লেখালিখিতে আরো কম। আপনাদের দুজনেরই থাকাটা দরকার।
দেশ থেকে আপনাদের বইগুলো যোগাড়ের চেষ্টা করব। আশা করছি মেলায় পাওয়া যাবে সামনে।
ভাল থাকুন, সুন্দর থাকুন।
অভিজিৎ

আমরা যারা অর্ধেকটা জীবন কাটিয়ে ফেলেছি তারা কেউই আশাবাদী হতে পারবেন না আমরা অভিজিৎ রায়ের মত কাউকে আবার ফিরে পাবো।যারা তাকে হত্যা করেছে তারা জানে এই মানুষটাকে ক্ষতি করলে বাংলাদেশের অনেক বড় ক্ষতি করা সম্ভব। শুধু একটি পরিবারই না বহু পরিবারের জন্য সুন্দর একটি বাংলাদেশে গড়ার পথ তিনি একটি একটি করে ইট বিছিয়ে নির্মান করছিলেন। আজ আমরা সংখ্যায় কম নেই, আমাদের অনেক কিছু করতে হবে। আমাদের লেখার মাধ্যমে তো বটেই, তাছাড়ও হয়তো মুক্তমনার সংগঠকরা ভাবছেন কিভাবে আমরা তার স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখবো, হয়তো পুনরাবৃত্তি হয়ে যাবে, তারপরও কিছু প্রস্তাব করতে পারি:

প্রতি ফেব্রুয়ারীতে মুক্তমনায় প্রকাশিত প্রবন্ধ নিয়ে অভিজিৎ রায় স্মারক গ্রন্হ প্রকাশ করা যেতে পারে।
অভিজিৎ স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করা যেতে পারে, যার বিষয়বস্তু হবে বিজ্ঞান ও যুক্তি।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একটি বিষয় ভিত্তিক রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে , যেখানে বই এবং অর্থমুল্য দিয়ে পুরষ্কারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

হয়তো আরো অনেক প্রস্তাবনা আছে সবার মনে।যে কোন প্রস্তাবনায় সবারই মত সহযোগিতা করতে আমি প্রস্তুত।

১৯৮৮ সালে মাঝামাঝি কোন একদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ এর অ্যানাটমি বিভাগে চামড়ার নীচে কোথায় কি আছে জানতে কম্পমান হাতে মৃত শরীরের স্কালপেল ছুইয়েছিলাম।সেই বড় রুম , ফরমালিনের তীব্র ঝাঝ এর কথা এখনও স্মরণ করতে পারি, তবে মনে নেই কে ছিল সেই মানুষটি যার শরীরে প্রথম চামড়া, মাংশ ছড়িয়ে প্রথম ফিমোরাল সিথ এর মধ্য ফিমোরাল ধমনী,শিরা আর নার্ভ দেখেছিলাম, সেদিন সেই রুমের প্রায় ১৫০ জন তরুণ তরুনীদের, আমরা মত দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া – প্রায় সবাই জীবনে সফল চিকিৎসক হয়েছে, দেশে বিদেশে ছড়িয়ে আছে তারা। আমাদের প্রিয় অভিজিৎ সজ্ঞানে তার দেহ দান করে গেছে, তাকে স্পর্শ করে আরো এক ঝাক চিকিৎসক তাদের যাত্রা শুরু করবে – একটা মানুষ যখন এভাবে তার জীবন ও মরণে সব কিছু দিয়ে যায় কখনোই সে সাধারণ মানুষ হতে পারেনা। তার প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার কোন ব্যতিক্রম চিরকালই হীনমন্যতার পরিচয় বহন করবে।

তা্র এই অকাল মৃত্যু যে শুন্যস্থান সৃষ্টি করেছে তা কোনদিনও কেউ পূরণ করতে পারবেনা, তবে আমরা চেষ্টা করে যাবো এই অন্ধকার কূপমুন্ডক পৃথিবীর একটি বিকল্প সৃষ্টিতে, তার স্মৃতির প্রতি সন্মান রেখে এই প্রতিশ্রুতি আজ রেখে গেলাম। ইসলামবাদী জঙ্গীরা যারা তাকে হত্যা করেছে, আহত করেছে তার সহধর্মিনীকে, তাদের জঘন্য কাপুরুষোচিত আচরণের প্রতি নিন্দা জানাবার ভাষা খুজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। জানিনা এই হত্যাকারীদের বিচার হবে কিনা, তবে সেই দাবী জানাই দ্বিধাহীন প্রতিবাদের সাথে। আর আমাদের পুর্বপুরুষরা যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম যে হিংস্র মতবাদ নীরিহ শিশুদের মনে গেথে চলেছে অন্ধ বিশ্বাসে, মানবিক নৈতিকতার মানদন্ডে আজ সেটি পুরো মানবজাতির ব্যর্থতা, আজ তারা আয়নায় তাদের নিজেদের নির্লজ্জ মুখ দেখুক।