আল্লাহ হাফিজের দেশে (৩য় পর্ব)
আকাশ মালিক

শহর থেকে বের হওয়ার পথে কীন ব্রিজ পার হতে সুরমা মার্কেট পয়েন্টে আমাদের গাড়ি এসে থামলো। বাম দিকে সার্কেট হাউস, ডান দিকে সারদা হল আর ব্রিজের নিকটেই আলী আমজাদের ঘড়ি। এখানে এসে বহুদিনের পুরনো একটি জীবনমরণ সন্ধিক্ষণের ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। সেদিন ঠিক এই জায়গায় আমি উপস্থিত ছিলাম সাথে আদিলকে নিয়ে। ঘটনাটি পরে আরেকদিন বলবো।

kingbridge

কিন ব্রিজ (Keane bridge)পাড়ি দিয়ে গাড়ি এবার চলেছে আমার জন্মস্থান গ্রাম বাংলার পথে, আমার আপন ঠিকানায়। কাকতালীয়ভাবে ড্রাইভারের ক্যাসেটের দ্বিতীয় গানটা ছিল-

একবার যেতে দে না
আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়।।
যেথায় কোকিল ডাকে কুহু
দোয়েল ডাকে মুহু মুহু
নদী যেথায় ছুটে চলে
আপন ঠিকানায়।।

এমন সময়ে সাঝের পাখিরাও ফিরে চলেছে আপন বাসায়। সারা দিনের প্রখর রৌদ্রতাপে তপ্তহাওয়া শীতল হয়ে আসছে। গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে বয়ে আসছে মৃদু ঠান্ডা বাতাস। দিনের শেষে বিদায়ের বেলা সূর্য পশ্চিমাকাশে রক্তরাঙ্গা আবীর ছড়িয়ে তার সবটুকু সুন্দর যেন উজাড় করে দিয়েছে বাংলা মায়ের চরণে।

sunset

আর সেই সুন্দরের অলংকার সর্বাঙ্গে মেখে ভুবন মোহিনী এক অপরূপ রুপে সজ্জিত হয়েছে বাংলাদেশ। বহুদিন হয় গোধুলীর এই পবিত্র লগ্ন আমি প্রত্যক্ষ করিনি।

গাড়ি চলেছে কখনও উল্কা বেগে, কখনও মন্থর গতিতে। ডানে বামে সামনে পেছনে অগণিত সবুজের ছড়াছড়ি, মাঝে মধ্যে ডোবা-পুকুর, তার ওপর স্বর্ণালী সূর্যকীরণ। রাস্তার পাশে এই সেই বড়ই গাছ, নদীর পাড়ে এই হিজল গাছ, স্কুলের আঙ্গীনায় এই কৃষ্ণচুড়া, মসজিদের পুকুর পাড়ে ঐ তালগাছ, কালণী বাড়ির উঠোনের কুমড়ো ফুল, বটবৃক্ষের এই দোলনা, এই কাশবন এই বকুলতলা সবই আছে, ঠিক পঁচিশ বছর আগে যেমন ছিল। এখানে ছিলাম না শুধু আমি। টের পাচ্ছি আবেগে আনন্দে চোখ ভারী হয়ে আসছে অশ্রুজলে। পুরানো সেই দিনের কথা, কৈশোরের সকল স্মৃতি এসে জড়ো হয়েছে মনের মানসপটে। এ অনুভুতি ব্যক্ত করার ভাষা আমার জানা নেই, এ কেবল অন্তরের ভেতরেই ঝড় তোলে, প্রকাশিত হয় না। আজ ওরা সকলেই যেন আমাকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিতে চায় , সবাই যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে-

আয় আর-একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।
মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়–
বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়।

http://i1088.photobucket.com/albums/i332/malik1956/flower%20collage_zpsodjqw4qf.png

বাড়ি পৌছিলাম রাত আটটায়। বিদ্যুৎলাইন, লাইটবাল্ব, লাইটসুইচ সবই আছে নেই শুধু আলো। পরিবারের সব চেয়ে বেশি দায়ীত্বশীল ব্যক্তি হাজেরার মা (কাজের বুয়া) দৌড়ে এসে বললেন ‘ ঐ এট্টু আগে ক্যারেন্ট ছইলা গেল গা মামা’। বড় ভাই বললেন ‘তুমি শান্ত হও হাজেরার মা, আমরা জেনারেটর চালিয়ে দিব’। গ্রামে প্রবাসীদের প্রায় সকলের ঘরেই জেনারেটর আছে। পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে সন্তানদের বললাম ‘এই সেই ঐতিহাসিক পুকুর যার কথা তোমাদের বলেছিলাম, কাল ভোরে ঘাটপাড়ে বসে আমরা একটা মিটিং করবো’। আলো থেকে আসা শিশুদের অন্ধকার দেখলে তাদের আনন্দ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ঘরে হ্যারিকেনের আলো, বাহিরে চাঁদের আলো, আলো আঁধারে আম-কাঁঠালের ছায়াঘেরা এই পথ, এই দৃশ্য তারা আগে কোনদিন দেখেনি।

আমি জানি এ বাড়িতে কাক ডাকা ভোরে, সুর্য্যি মামা জাগার আগে আমিই প্রথম জেগে উঠবো। না, এবার আমার আগে আরেকজন জেগে উঠেছে, হাজেরার মা। সময়টা ছিল বোধ হয় চৈত্র মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। একা একা হেঁটে হেঁটে বাড়িটা দেখছি। বারান্দার পাশের লেবু গাছে ফুল ধরেছে, উঠোনের পূর্বপারে বেশ কয়েকটি আমগাছে মুকুল এসেছে। লেবুফুলে নাক লাগিয়ে গন্ধ শুঁকতে যাবো এমনি সময়ে হাজেরার মা বলে উঠলো-

– নাক লাগাইয়েন না মামা, ফুলে পিঁপড়া থাকে।
– তুমি হাজেরার মা?
– জি।
– নাম কী তোমার?
– হাজেরার মা।
– তো, হাজেরা কোথায়?
– হাজেরা নাই।
– নাই মা’নে?
– আমার কোন ছেলে সন্তান নাই।
– তো ‘হাজেরার মা’ হলে কী ভাবে?
– কাজের বুয়াদের নাম এই রকমই হয়। হাজেরার মা, কমলার মা, ভানুর মা এই আর কী? মাইনষের ঘরে কাম কাজ করলে কারো না কারো মা হইতে হয়।
– ও। তো আমি তোমার মামু হলাম কী ভাবে? ভাইও তো হতে পারতাম।
– না না, কী যে বলেন মামা। ঘরের মালিক মামু, আর ঘরের বুয়া ভাগিনী, এইটাই নিয়ম।
– তাই নাকি? নিয়মটা যে বানাইছে সে একজন বুদ্ধিমান হবে।
– আমরা বানাইছি মামা, হক্কল বুয়ারা মিল্লা বানাইছি। আমরার বুয়া সমিতি আছে না?
– ভাল করেছ।
– চা দিমু মামা?
– তুমি কি সকলের চা-নাস্তা তৈরী করো?
– শুধু চা-নাস্তা না, রান্না-বান্না, কাপড় ধুয়া, ঝাড়ু দেয়া সব আমার দায়ীত্ব, আমি একাই করি। মামীকে বলবেন, ধুয়ার কাপড় চোপড় থাকলে ঘরের কোণায় রাইখা দিতে। গোসল কইরা আপনারা কাপড় বাথরুমে রাইখা আইয়েন আমি ধুইয়া দিব।
– হাজেরার মা।
– জি, মামা।
– আমাদের কারো কাপড় এমন কি বাচ্চাদের কাপড়ও তুমি ধুইবেনা, তোমার মামী তোমাকে ধুইতে দিবেনা। আমরা আমাদের কাপড় নিজ হাতে ধুই, বুঝেছ?
– জি বুজছি।
– হাজেরার মা। এটা জাল না? এ রকম জাল তো আগে কোনদিন দেখিনি।
– ওটা ক্যারেন্টের জাল মামা। এটা দিয়ে মাছ ধরা হয়।
– ক্যারেন্টের জাল! ক্যারেন্টের বাংলা কী?
– ক্যারেন্টের বাংলা ক্যারেন্ট।
– ক্যারেন্ট এর অর্থ কী?
– ক্যারেন্ট অর্থ, অর্থ হইল গিয়া বাত্তি। আমাগো দেশে দিনে কতবার ক্যারেন্ট যায় আর আসে মামা জানেন? আফনাগো দেশে হুনছি ক্যারেন্ট কোনদিন যায় না।
– হাজেরার মা, আমার দেশ কোনটা?
– লন্ডন।
– আর তোমার দেশ?
– ******** জেলায়।
– আচ্ছা শোন, আমি এবার একা একা ঘুরে সারা বাড়িটা দেখবো। তারপর একটা মিটিং আছে ঘাটপাড়ে। আজ পুকুর ঘাটে তোমার কোন কাজ নাই, বুঝলে? তুমি এবার যাও, আল্লাহ হাফিজ।

প্রত্যেক কিশোর কিশোরীর জীবনে বিশেষ করে ছাত্র জীবনের রঙ্গীন সময়ে গল্প-উপন্যাস পড়া বোধ হয় একটা ফ্যাশন হয়ে আসে। আমাদের সময়ে কিছু বই বেশ জনপ্রীয় ছিল যেমন, শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘মাসুদ রানা’ রোমেনা আফাজের ‘দস্যু বনহুর’ ইত্যাদি। এই ঘাটপাড়ে বসে বই পড়া ছিল আমার নিত্যদিনের অভ্যেস। সিড়িতে বসে ধ্যানমগ্ন বকের মত জলের ওপর চোখ রেখে আনমনে শৈশবের সুন্দর রঙ্গীন দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করে চলেছি। ধ্যান ভাঙ্গলো বড় মেয়ে শ্যামলীর ডাকে-

– ওহ, দেয়ার ইউ আর। আব্বু, তোমাকে কত সময় ধরে খুঁজছি।
– বস, সবাই সিড়িতে বস।
– আব্বু, এই তোমার হিষ্টরিক্যাল পন্ড?
– হুম। এর পেছনে ইতিহাস আছে বিরাট ইতিহাস।

মিটিং শুরু হওয়ার পূর্বমুহুর্তে স্ত্রী রাহেলা এসে উপস্থিত হলেন। স্বহাস্যচিত্তে মৃদুস্বরে বললেন-

– ইশ, পুকুরের জল দেখলে মনটা কেমন কেমন করে। মন চায় জলে নেমে এক্ষুণি একটা ডুব দেই।
– তো দাও না, কে মা’না করছে?
– পঁচিশটা বছর বাথট্যাবের বদ্ধজলে গোসল হয়েছে, এখন সাঁতারটাই বোধ হয় ভুলে গেছি।
– আরে এত চিন্তা কিসের? শ্যামলী আর কাকলিকে নিয়ে তুমি এক্ষণি নেমে পড়ো। সুমনকে নিয়ে আমি পরে আসবো।
– দরকার নেই, সেটা হবেনা। এই দিন আর সেই দিন নেই। ভাবসাব যা জানতে পেরেছি, এ বাড়ির কোন মহিলা ঘাটে আর আসেন না, বাথরুম, টয়লেট ঘরের ভেতরেই আছে। ঘাটে শুধু বুয়ারা আসে হাড়ি-বাসন মাজন করতে। এই পুকুরে বাড়ির চাকর-চাকরাণীরাই শুধু গোসল করে। আপনি চা-নাস্তা সেরে বদরুল ভাইয়ের কাছে একটা ফোন করেন না, এক কাপড়ে তিনটা সন্তান নিয়ে কতদিন থাকা যায়?
– ফোন করা লাগবেনা, বদরুল নিজেই ফোন করেছিল। ঢাকা থেকে পরবর্তি ফ্লাইট না আসা পর্যন্ত কিছু বলা যাবেনা।
– কিন্তু আমাদের ল্যাগেজ তো ঢাকা নামানোর কথা না। আমরা নামলাম না, প্লেইন বদল হলোনা, ল্যাগেজ নামলো কীভাবে? আমাদের ফ্লাইট তো ছিল এয়ারবাসের ডাইরেক্ট হিথরো টু সিলেট। আপনি বড় ভাইয়ের সাথে আলাপ করে একটা কিছু করেন প্লিজ।
– জানো, বড় ভাই, মেজো ভাই সকলেই ল্যাগেজ নিয়ে আমাদের চেয়ে বেশী চিন্তিত। তারা যে কী অস্থিরতায় আছেন তা তুমি দেখ নি। যাও, চা-নাস্তা করো, বাড়িটা ঘুরে দেখো, ল্যাগেজের জন্যে চিন্তা করে মনঃক্ষুন্ন হয়ে বসে থেকোনা। আমরা একটা জরুরী মিটিংয়ে আছি, ইচ্ছে করলে তুমিও যোগদান করতে পারো। আর যদি বলো তো, আমাদের মিটিং মুলতবি রেখে পঁচিশ বছর আগে শুরু করা অসমাপ্ত বেহুলা লখিন্দরের কাহিনিটি তোমাকে আবার শোনাই। সেদিন আমার সময় ছিলনা, শ্রোতা ছিলে তুমি একজন, এখন আমার সময় আছে, শ্রোতা আরো তিনজন। শুরু করবো?
– এখন আমার সময় নেই, আপনি মিটিং করতে থাকুন আমি গেলাম।
– ওকে, আল্লাহ হাফিজ।

মাকে চলে যেতে দেখে মেয়ে একজন বললো-

– আব্বু, হিষ্টরিকেল পন্ড।
– ইয়েস, এই পুকুরের কথাই বলেছিলাম। এমন বড় পুকুর দ্বিতীয়টি আমাদের গ্রামে আর নেই। আগেকার দিনে পাশের বাড়ির মহিলারা ভোর বেলা কলসি কাঁখে আমাদের পুকুরে আসতেন খাবার জল নিতে। এই সেই পুকুর যার-

গলায় গলায় জল,
এপার হতে ওপার গিয়ে
নাচে ঢেউয়ের দল।
দিনে সেথায় ঘুমিয়ে থাকে
লাল শালুকের ফুল,
রাতের বেলা চাঁদের সনে
হেসে না পায় কূল।

আচ্ছা, শালুকের কথা পরে হবে। পেছনে তাকিয়ে দেখ পুকুরের ঐ ঈশাণ-পূর্বকোণে কিছু ফুল দেখা যাচ্ছে। ওগুলোর নাম কী জান? এদের নাম কচুরিপানা, আমাদের গ্রামের ভাষায় জার্মুনি ফুল। দেখতে ময়ুরপুচ্ছের মত, মাথার চুলের মত এদের জড় বা শেকড় অনে—ক লম্বা হয়। ছোটবেলা বৃষ্টিঝরা এক অমাবশ্যার অন্ধকার রাতে কচুরিপানার শুকনো জড় দিয়ে তৈ্রী করে হেই মোটা ঝাকড়া চুল আর লম্বা দাড়ি লাগিয়ে তোমাদের এক গ্রান্ড-মাকে পীরাকি দেখিয়েছিলাম। ভয়ে মহিলা তার ঘরের সকল স্বর্ণালংকার আমাকে দান করে দিয়েছিলেন। আমি অবশ্য তা ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।

http://i1088.photobucket.com/albums/i332/malik1956/water5_zps51355f48.jpg
পুকুরের দক্ষিণ-পূর্বকোণে একটি বিরাটাকারের শিমুল গাছ ছিল। বহুকাল আগে দানব-দেশের লিডার টাইপের বড় বড় দৈত্য-দানবেরা এসে নিশীতরাতে এই গাছে বসে মিটিং করতো আর তাদের সাথে এক জলপরী এই ঘাটে স্নান করতে আসতো।
– সাউন্ডস লাইক এ বেডটাইম স্টোরি। (মেজো মেয়ে কাকলীর হাই তোলা উক্তি)
– আরে না, বেডটাইম স্টোরি না। গ্রামের মানুষেরা তখনও বিশ্বাস করতেন, এখনও অনেকেই করেন। দানবেরা যখন আসতো, ধন-দৌলত, সোনা-দানা ভর্তি পিতলের ডেক-ডেকছি নিয়ে আসতো। তারা এই পুকুরের জলে তা লুকিয়ে রাখতো। আমার এক চাচী একদিন সূর্য ওঠার আগে পুকুরঘাটে স্নান করতে এসে দেখেন, বড় একটি তামার কলসী জলে ভেসে বেড়াচ্ছে, কলসীর ভেতরে প্রচুর কাঁচা টাকা।
– ইউ মিন কয়েন?
– ইয়েস, আমরা বলি রৌপ্যমুদ্রা। চাচী কলসী নিয়ে ঘরে চলে যান। কিন্তু দানবের টাকা তার কোন কাজে আসলোনা। ঐ টাকা শুধু দানব দেশেই চলে। এর পর থেকে এই পুকুরের নাম হল ‘টাকার মার পুকুর’।
– এখন আর কলসী ওঠেনা?
– না, ওঠবে কী ভাবে? জৈন্তা পাহাড় থেকে বড় এক পীর ডেকে আনা হলো। পীর সাহেব জীন-ভুত, দৈত্য দানব, জলপরী সকলকে তাড়িয়ে দিয়ে গাছটি কেটে ফেলার হুকুম দিলেন। এর পর থেকে তারা আর এই বাড়িতে আসেনা, জলপরীও এই পুকুরে স্নান করেনা। এবার বলো, কেমন লাগলো ইতিহাসটা?
– ইতিহাস হলে তো বইয়ে থাকার কথা, বই আছে?
– না, তবে সকলেই যখন বিশ্বাস করতো তখন—-
– সকলে বিশ্বাস করলেই তো একটা জিনিস সত্য হয়ে যায়না আব্বু। (বড় মেয়ের উক্তি)
– কেন, তোমাদের বিশ্বাস হয়নি বুঝি?
– নউপ। ইংল্যান্ডে মাটির অনেক গভীরে সাকসান, রোমানদের ফেলে যাওয়া বহু পিতলের কলসী পাওয়া গেছে, আমরা তা মিউজিয়ামে দেখেছি। সত্যি যদি কলসী ভেসে ওঠে থাকে, বাংলাদেশের আর্কিওলজিষ্টদেরকে দেখান উচিৎ ছিল। তারা কলসী ও মুদ্রা দেখে বলতে পারতেন এদের বয়স কত আর কার যুগের।
– কিন্তু একেবারে মিথ্যে হলে গ্রীকরা জলপরীদের নাম পেল কোথায়?
– তো জলপরী গ্রামের অন্যান্য পুকুরেও আসে, নাকি শুধু এই পুকুরে?
– হ্যাঁ, এইখানেই তো আসল ঘটনা। লাল শালুকের ফুল বড় পুকুর, বড় বিল ছাড়া কোথাও হয়না, আর দানবেরা বড় গাছ ছাড়া কোথাও বসেনা। এই শাপলার সাথে জলপরীর সম্পর্ক আছে। শুন, শাপলা ফুলের কাহিনিটা এবার বলি। শাপলাকে সাধারণভাবে ইংরেজিতে বলা হয় Water Lil। সাদা শাপলার বৈজ্ঞানিক নাম Nymphaea nouchali, এটি Nymphaeaceae পরিবারভুক্ত। প্রাচীন যুগে গ্রিকরা এ ধরনের ফুল Nymph বা জলপরীদের উদ্দেশে উৎসর্গ করত। সেখান থেকেই এই Nymphaea শব্দটি এসেছে। লাল শাপলার বৈজ্ঞানিক নাম Nymphaea rubra.

http://i1088.photobucket.com/albums/i332/malik1956/newones3_zps026916b9.png

তবে সাদা শাপলা হল বাংলাদেশের জাতীয় ফুল। সাদা আর লাল ছাড়াও বহু রঙের শাপলা বাংলাদেশে দেখা যায়। আমার ছোট বোন অর্থাৎ তোমাদের ছোট ফুফু আম্মা একদিন আবদার করলো তাকে একটা শাপলা ফুল তুলে দিতে। বাহাদুর সাঁতাড়ুর ভঙ্গীতে আমি ততক্ষণাৎ জলে ঝাপ দিয়ে পড়ি। যেইমাত্র একটি ফুলে হাত দিব অমনি একটি সোনালী রঙের ছোট্ট ব্যাঙ লাফ দিয়ে আমার নাকের ডগায় এসে বসে গেল। ফুল তোলা হলোনা, এক দৌড়ে ঘরে গিয়ে হাপাতে হাপাতে বাবার কাছে অত্যাশ্চার্য ভয়ংকর ঘটনাটা বললাম। বাবা হেসে হেসে আমাকে একটা ধাঁধাঁ শুনালেন, বললেন-‘হরির ওপরে হরি, হরি বসে তায় / হরিকে দেখিয়া হরি হরিতে লুকায়’। আচ্ছা তোমরা কি জানো এই হরি অর্থ কী?
– নউপ।
– হরি অর্থ জল, হরি অর্থ শালুক পাতা, হরি অর্থ ব্যাঙ, হরি অর্থ সাপ। এবার তোমরাই কল্পনা করো ঘটনাটা কী? দুই তিন সপ্তাহ পরে আমরা আবার সিলেট বেড়াতে যাবো তোমাদের খালায় বাসায়, তখন তোমাদেরকে একজন বড় আউলিয়া অর্থাৎ হারমিট এর কবর দেখাবো। মনে আছে সিলেট শহর থেকে বেরুবার পথে ব্রিজের ওপর থেকে একটা নদী দেখেছিলে? এই হারমিট, ভরা জলের নদীতে জায়নামাজ বিছিয়ে তার সঙ্গী ৩৬০ জন লোককে নিয়ে নদী পার হয়েছিলেন। নদীর ওপারে গৌড়গোবিন্দ নামে এক রাজা বাস করতেন। এপার থেকে হারমিট যখন আজান দিলেন, ওপা্রে রাজা গৌড়গোবিন্দের সাত তালা বিল্ডিং ধড় ধড় করে ভেঙ্গে পড়ে যায়। দরবেশের ভাগিনা কবুতরের পালক দিয়ে জীবন্ত কবুতর সৃষ্টি করতে পারতেন। আর হারমিট বাঘের সাথে কথা বলতে পারতেন। হারমিটের কবরের পাশে একটি ইন্দিরা আছে ওখানে সোনার কই-মাগুর থাকে।
– ইন্দিরা মা’নে কী?
– সামথিং লাইক ফিসট্যাঙ্ক।
– ও, আর সোনার কই মাগুর মা’নে, গোল্ড ফিস?

ঠিক এই মুহুর্তে হাজেরার মা ডাক দিলেন, নাস্তা রেডি।

চলবে-

১ম পর্ব-

২য় পর্ব-

৪র্থ পর্ব