ব্যাকরণ সংবাদদাতা প্রশ্ন রাখছেনঃ সেমিকোলনের মৃত্যুর জন্য দায়ী কে?

এটি আসলে ব্রেকিং নিউজ নয়; বরং তার উল্টোটা বলা যায় – অনেক বড় একটা ঘটনা, কিন্তু সেটা ঘটেছে এত ধীরে ধীরে যে কারো প্রায় চোখেই পড়ে নি। যতি চিহ্ন পরিবারের সবচেয়ে সুক্ষ, অভিজাত ও চৌকষ যে সদস্য, যাকে ছাড়া ক্ল্যাসিকাল বাংলা গদ্যের অনেক অনুচ্ছেদ তার সুর ও স্বর কিম্বা দ্যোতনা হারাবে, সেই সেমিকোলন আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কমা আর কোলনের মাঝে নিজের একটা আলাদা অবস্থান নিয়ে দশকের পর দশক (শতকের পর শতক বললাম না, কারণ বাংলা গদ্যের বয়সই মাত্র দুইটি শতক) বাক্যে অর্থের দোলচালের যোগান দিয়ে গেছে এই সেমিকোলন। আজকে আমরা সাদামাটা হাইফেন, কোলন বা বন্ধনী দিয়ে তাকে প্রতিস্থাপন করেছি। বাংলা গদ্যে সেমিকোলন মারা গেল অপ্রাসঙ্গিকতা ও অপব্যবহারজনিত জটিলতায় ভুগে, মাত্রই দেড়শো বছর বয়সে। ইংরেজী ভাষাতে অবশ্য তার বয়সটা আরেকটু বেশী, সাড়ে চারশো বছরের মত। সেমিকোলনকে গ্রীকরা প্রশ্নবোধক চিহ্ন হিসেবেব ব্যবহার করত। ১৫০০ সালের দিকে প্রিন্টিং প্রেসের ফন্টে যুক্ত হবার পর সেমিকোলন পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। লন্ডনে সেমিকোলনের আমদানী হয় ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে বলে জানা যায়। সে সময় অবশ্য সেমিকোলন বা অন্যান্য যতি চিহ্নের প্রকারভেদ করা হত কথা বলবার সময় কতক্ষণ থামতে হবে তার উপরে – কমা মানে এক মাত্রার বিরতি, সেমিকোলনে দুই মাত্রা, কোলনে তিন, আর দাঁড়িতে চার মাত্রার বিরতি। ধীরে ধীরে ব্যাকরণ জটিলতর হয়, সেমিকোলন ব্যবহারের নানা নিয়মকানুন তৈরী হয়।

বাংলা ভাষার বয়স মেরেকেটে সেই চর্যাপদ থেকে আজ পর্যন্ত এক হাজার বছর, আর বাংলা কাব্যের বয়সও প্রায় একই। তবে বাংলা গদ্য এই সেদিনও নিতান্তই নাবালক ছিল। এখনো দুশো বছর হয়নি আধুনিক বাংলা গদ্যের বয়স। মূলতঃ ব্রিটিশদের হাতে পড়ে কেজো ভাষা হয়ে উঠতে গিয়েই তার বয়োসন্ধি এসেছিল, রবীন্দ্রনাথের হাতে এসেছিল যৌবন। কাজেই তার শরীরের বাঁকে বাঁকে ইংরেজীর ছিঁটেফোঁটা গন্ধ – কি যতির ব্যবহারে, কি বাক্যের গঠনে, কি নতুন শব্দ আহরণে। উনিশ শতকের প্রারম্ভে বাংলা গদ্যের নমুনা দেখুনঃ – সেখানে দাঁড়ি এবং মাঝে মাঝে দু-একটি কমা ছাড়া আর কিছুই নেই। বাংলা গদ্যের শক্তি বেড়েছিল ইংরেজীর যতিচিহ্ন আত্তীকরণের মাধ্যমে, এবং এই নতুন শতকেও বাংলা গদ্য আবারো ইংরেজীর ‘প্লেইন ইংলিশ’ মুভমেন্টকে ফলো করেই হয়তোবা সেমিকোলনকে বিসর্জন দিয়েছে!

‘এ বঙ্গভূমিতে রাজা চন্দ্রকেতু প্রভৃতি অনেক২ রাজাগণ উদ্ভব হইয়াছিলেন কিন্তু কদাচিত তাহারদের কেবল নাম মাত্র শুনা যায় তদব্যতিরেকে তাহারদের বিশেষ বিশেষণ কি মতে বৃদ্ধি কি মতে পতন নিরাকরণ কিছুই উপস্থিত নাহি তাহাতে যে সমস্ত লোকেরা এ সমস্ত প্রশঙ্গ শ্রবণ করে আনুপূর্বক না জাননেতে ক্ষোভিত হয়। সংপ্রতি সর্বারম্ভে এ দেশে প্রতাপাদিত্যনামে এক রাজা হইয়াছিলেন তাহার বিবরণ কিঞ্চিত পারস্য ভাষায় গ্রন্থিত আছে সাঙ্গ পাঙ্গ রুপে সামুদাইক নাহি আমি তাহারদিগের স্বশ্রেণী একেই জাতি ইহাতে তাহার আপনার পিতৃ পিতামহের স্থানে শুনা আছে অতএব আমরা অধিক জ্ঞাত এবং আর২ অনেকে মহারাজার উপাখ্যান আনুপূর্বক জানিতে আকিঞ্চন করিলেন এ জন্য যে মত আমার শ্রুত আছে তদানুযায়ী লেখা যাইতেছে।’ (রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র, রাম রাম বসু, ১৮০২)

পুরাতন স্মৃতি আরেকটু নেড়েচেড়ে দেখা যাক। রবীন্দ্রনাথের ক্ষুধিত পাষাণ গল্পের এই অনুচ্ছেদটি পড়িঃ

‘আমার বক্ষের মধ্যে একপ্রকার কম্পন হইতে লাগিল; সে উত্তেজনা ভয়ের কি আনন্দের কি কৌতূহলের, ঠিক বলিতে পারি না। বড়ো ইচ্ছা হইতে লাগিল, ভালো করিয়া দেখি, কিন্তু সম্মুখে দেখিবার মতো কিছুই ছিল না; মনে হইল, ভালো করিয়া কান পাতিলেই উহাদের কথা সমস্তই স্পষ্ট শোনা যাইবে-কিন্তু একান্তমনে কান পাতিয়া কেবল অরণ্যের ঝিল্লিরব শোনা যায়। মনে হইল, আড়াই শত বৎসরের কৃষ্ণবর্ণ যবনিকা ঠিক আমার সম্মুখে দুলিতেছে, ভয়ে ভয়ে একটি ধার তুলিয়া ভিতরে দৃষ্টিপাত করি-সেখানে বৃহৎ সভা বসিয়াছে, কিন্তু গাঢ় অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না।’

অথবা তার ছুটি গল্পের প্রথম কয়েকটি বাক্যঃ

‘বালকদিগের সর্দার ফটিক চক্রবর্তীর মাথায় চট্ করিয়া একটা নূতন ভাবোদয় হইল; নদীর ধারে একটা প্রকাণ্ড শালকাষ্ঠ মাস্তুলে রূপান্তরিত হইবার প্রতীক্ষায় পড়িয়া ছিল; স্থির হইল, সেটা সকলে মিলিয়া গড়াইয়া লইয়া যাইবে। যে ব্যক্তির কাঠ, আবশ্যক-কালে তাহার যে কতখানি বিস্ময় বিরক্তি এবং অসুবিধা বোধ হইবে, তাহাই উপলব্ধি করিয়া বালকেরা এ প্রস্তাবে সম্পূর্ণ অনুমোদন করিল। কোমর বাঁধিয়া সকলেই যখন মনোযোগের সহিত কার্যে প্রবৃত্ত হইবার উপক্রম করিতেছে এমন সময়ে ফটিকের কনিষ্ঠ মাখনলাল গম্ভীরভাবে সেই গুঁড়ির উপরে গিয়া বসিল; ছেলেরা তাহার এইরূপ উদার ঔদাসীন্য দেখিয়া কিছু বিমর্ষ হইয়া গেল। একজন আসিয়া ভয়ে ভয়ে তাহাকে একটু-আধটু ঠেলিল, কিন্তু সে তাহাতে কিছুমাত্র বিচলিত হইল না; এই অকাল-তত্ত্বজ্ঞানী মানব সকল প্রকার ক্রীড়ার অসারতা সম্বন্ধে নীরবে চিন্তা করিতে লাগিল।’

তার বিপরীতে আপনি ২০১৫ সালের একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হওয়া কোন গদ্যগ্রন্থের পাতা উল্টান, অথবা কম্পিউটারের শরণাপন্ন হোন। যদি কোন সেমিকোলন খুঁজে পান, সেটা একটা ব্রেকিং নিউজ। আমার হাতে আছে ২০০৬ সালে প্রকাশিত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচনাসমগ্র। হ্যারিকেন দিয়ে খুঁজেও সেমিকোলন পাচ্ছি না সেখানে। একই বছর প্রকাশিত গল্পগুচ্ছের একটা সংস্করনে পাতায় পাতায় সেমিকোলনের ছড়াছড়ি। শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, হুমায়ুন আহমেদ কিম্বা আহমদ ছফার গদ্যেও সেমিকোলন বিরল বস্তু। হুমায়ুন আজাদ আর শহীদুল জহিরের গদ্য অবশ্য ব্যতিক্রম – তারা এখনো সেই পুরাতন স্টাইলে দীর্ঘ বাক্যের মধ্যে একাধিক লুপ তৈরী কিম্বা একই লেখায় নানা গতির বাক্য গঠনে ওস্তাদ ছিলেন। এই কমিউনিকেশানের যুগে বেশীরভাগ গদ্য লেখকই ছোট ছোট বাক্য লিখছেন, যেখানে অর্থের সুস্পষ্টতাই লেখার প্রধানতম ফোকাস। সেমিকোলনের চেয়ে তাই কোলন, কমা ও হাইফেন কাজ দেয় বেশী।

টেক্সটিং, ইমেইল, ফেসবুক স্ট্যাটাস, টুইট কিম্বা ইমোটিকসের যুগে দীর্ঘ বাক্য কিম্বা দীর্ঘ অনুচ্ছেদ, দুটোরই প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এখন কাজ হয় বুলেট পয়েন্টে, ছোট ছোট বাক্যে। ফলতঃ সেমিকোলনের দিন ফুরিয়েছে বেশ আগেই। কিছু কিছু পুরাতন দিনের লোকেরা হয়তো এখনো একে পুরোপুরি ভুলে যান নি, তবে তারা এটা ব্যবহার করেন কালেভদ্রে। যাকে দাঁড়ি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা যায়, কিম্বা কমা/কোলন দিয়ে, তাকে নিয়ে এত ভাববার সময় কই? একসময় দুটো পূর্ণ বাক্যকে কমা দিয়ে যুক্ত করলে মাস্টারেরা সেখানে লাল কালির দাগ দিতেন, কারণ একমাত্র সেমিকোলনেরই ক্ষমতা আছে দুটো পরিপূর্ণ বাক্যকে যুক্ত করার। আজকাল কোন মাস্টার ততটা কঠোর হলে ছাত্ররা তেড়ে আসবেন এই বলে – ‘ভাষার কাজ তো মনের ভাব প্রকাশ, নাকি? বুঝতে পারলেই হল!’। আজকাল অনেককে দেখি বাংলায় ন/ণ, ই-কার/ঈ-কার অথবা উ-কার/ঊ-কার নিয়েও বিরক্ত – তারা সহজ বাংলার পক্ষের লোক। শ, স এবং ষ তাদের কাছে অতিরিক্ত মনে হয়, একটা থাকলেই তো কাজ চলে যেত!

শুধু বাংলায় নয়, ইংরেজীতেও একই অবস্থা। একটা গবেষণায় দেখা গেছে যে, ষাটের দশকে লিখিত গদ্যের প্রতি মিলিয়ন শব্দে যেখানে সেমিকোলন ছিল ১৭২টি, আশির দশকে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ১১৫তে। বাংলাতে এরকম পরিসংখ্যান পাওয়া যায় কি না জানি না; পেলে ভাল হোত। এমনকি সেমিকোলনের অভয়ারণ্য – আইনের টেক্সট, সেখানেও আজ বুলেট পয়েন্টের রাজত্ব। তবে আমার মনে হয় সৃজনশীল গদ্যে সেমিকোলনের একটা পাকাপোক্ত জায়গা থেকেই যাবে আরো অনেকদিন – যেখানে কিনা ভাবনার প্রকাশটা এমন হবে যে, বিষয়গুলো পরস্পর সম্পর্কিত না হলেও শুধু সেমিকোলন ব্যবহারের কারণে পাঠকের কাছে তা পরস্পর সম্পর্কিত মনে হবে, এবং তা এক নতুন অর্থের জন্ম দেবে। ছোট ছোট বাক্য তাড়াতাড়ি পড়া যায়, তার অর্থ নিখুঁতভাবে ধরা যায় – কিন্তু লেখক যদি ইচ্ছা করেই অর্থ পরিস্কার না করতে চান, কিম্বা পাঠককে একটা অনুচ্ছেদে নানা অর্থের দোলচালে ফেলে দীর্ঘ সময় ধরে ভাবাতে চান, তখন সেমিকোলনের বিকল্প আছে কি?

সেমিকোলনের মৃত্যুতে যারা সবচেয়ে খুশী, সেই নব্য LOL প্রজন্মের কাছেও সেমিকোলন কিন্তু একেবারে ব্রাত্য নয়। প্রোগ্রামিং ভাষায় তার এখনো আধিপত্য, আর ইমোটিকনেও সে চুপেচাপে রয়ে গেছে।

int main() {
int x, y;
x = 1; y = 2;
printf(“X + Y = %d”, x + y);
return 0;
}

আগের সেই রাজপাট আর নেই, কিন্তু তবুও একেবারে নিশ্চিহ্ন তো হয়ে যায় নি! এই ব্যাপারে আমার প্রতিক্রিয়া জানতে চান? ;*(