বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের মৃত্যুর পর, বিশ্বের সব পত্রিকায়ই একটি অগোছালো ডেস্কের ছবি ছাপা হয়। ডেস্কটি স্বয়ং আলবার্ট আইনস্টাইনের। ডেস্কের ছবির সাথে পত্রিকার শিরোনাম করা হয়, “The unfinished manuscript of the greatest work, of the greatest scientist of our time”। পুরো বিশ্বই তখন এই কিংবদন্তী বিজ্ঞানীর আলোচনায় মুখর। কিন্তু বিজ্ঞানে আগ্রহী যেকোনো লোকেরই কৌতূহল জাগবে, কি সেই অসমাপ্ত কাজ ? আর কেনই বা তার মত একজন কিংবদন্তী বিজ্ঞানী তা শেষ করে যেতে পারলেন না ? আইনস্টাইন তার জীবনের শেষ ৩৫ বছর এই অসমাপ্ত কাজ শেষ করার চেষ্টা করে গেছেন, কিন্তু কোনভাবেই কুল-কিনারা করতে পারেন নি। সাধারণ মানুষের কাছে তাই সবচেয়ে বড় ধাঁধা ছিল, কি এমন কাজ যা আইনস্টাইনের মত একজন বিজ্ঞানী তার জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত চেষ্টা করেও সফল হতে পারলেন না !

আইনস্টাইন বেচে থাকতেই তার নামে অনেক মিথ প্রচলিত ছিল। বেশিরভাগ মানুষেরই ধারনা ছিল, তিনি মহাবিশ্ব সম্পর্কে এমন কিছু বুঝতে সক্ষম যা সাধারণ মানুষ কখনই বুঝতে পারবে না। তার আপেক্ষিক তত্ত্ব নিয়েও অনেক কল্পকাহিনী প্রচলিত ছিল। তবে এটিও সত্য যে, সে সময়ে তার “আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব” বোঝার মত লোক খুব কমই ছিল।বিজ্ঞানী এডিংটন ছিলেন তার আপেক্ষিক তত্ত্বের একজন জোরালো সমর্থক। জনপ্রিয় বিজ্ঞান ও আপেক্ষিক তত্ত্বের বক্তৃতা দিয়ে ততদিনে তার বেশ সুনামও হয়ে গেছে। একদিন এডিংটনকে বলা হল, “ আপনি সহ মোট তিনজন ব্যক্তি আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব বুঝতে পারে ”। একথা বলার পর এডিংটন কিছুক্ষণ কোন কথা বললেন না। তখন সবার মনে হয়েছিল, এডিংটন বুঝি বিনয় দেখিয়ে চুপচাপ আছে। বিষয়টি বুঝতে পেরে এডিংটন বলল, “ আসলে আমি ভেবে পাচ্ছিনা, তৃতীয় ব্যক্তিটি কে ? ” ।

image001
চিত্র: আলবার্ট আইনস্টাইনের ডেস্ক।

এডিংটনের পরবর্তী সময়ের কারো মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, কেমন সেই তত্ত্ব, আইনস্টাইনের মত লোকও যার সমাধান করতে চেয়ে কোন সুবিধা করতে পারেন নি ! তিনি যে তত্ত্বের জন্য তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন তার নাম , ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরি(Unified Field Theory) বা “সমন্বিত ক্ষেত্র তত্ত্ব” । তিনি এমন একটি তত্ত্ব গঠন করতে চেয়েছিলেন, যা প্রকৃতির জানা সকল বল ও ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে পারে; এমন একটি সমীকরণ, যা দিয়ে প্রকৃতির সবকিছু বর্ণনা করা যায়। আইনস্টাইনের বিশ্বাস ছিল, এমন একটি তত্ত্ব অবশ্যই আছে, যা দিয়েই প্রকৃতির সবকিছু বর্ণনা করা যাবে। কিন্তু সে সময়ের বিজ্ঞানীরা তার এই চিন্তাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেননি। তারা মনে করেছিল, এমন কোন তত্ত্বের সন্ধান করা সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই না।

আসলে আইনস্টাইন ছিলেন তার সময়ের চেয়ে অনেক অগ্রগামী ।তার সময়ের বিজ্ঞানীরা সে সময় এমন একটি তত্ত্বের গুরুত্বই বুঝতে পারে নি। কিন্তু আইনস্টাইন মারা যাবার দশক দুয়েক পরেই বেশ কিছু বড়সড় পরিবর্তন আসে। ষাটের দশকের শেষের দিকে বিজ্ঞানীরা এমন একটি তত্ত্বের প্রয়োজন অনুভব করেন। তখন নতুন নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে পরমাণুর জগত ও মহাকাশের অনেক অজানা রহস্য উন্মোচিত হতে থাকে। এসময় তাদের প্রধান লক্ষ হয়ে দ্বারায় এমন একটি তত্ত্ব নির্মাণ করা, যা প্রকৃতির সবগুলো বলকে একীভূত করতে পারে। মূলধারার গবেষকরা বুঝতে পারেন, প্রকৃতিতে যে চারটি মৌলিক বল আছে তাদের একীভূত না করতে পারলে নতুন নতুন সমস্যার সমাধান করা সম্ভব না। আর প্রকৃতিকেও বোঝা সম্ভব না। আইনস্টাইনের স্বপ্নের “ ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরি ” তখন বিজ্ঞানীদের বাস্তব প্রয়োজন হয়ে দ্বারায়।

রহস্যময় গুপ্ত পদার্থ ও রহস্যময় শক্তি

কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আমাদের মহাবিশ্বের সবকিছু কি দিয়ে গঠিত? তাহলে সবাই বলবে, কেন পরমাণু দিয়ে গঠিত! যারা বিজ্ঞান সম্পর্কে অল্পকিছু জানে তারা বলবে- ইলেকট্রন , প্রোটন আর নিউট্রন দিয়ে সকল পরমাণু গঠিত, তাই সবকিছুই এই ইলেকট্রন-প্রোটন-নিউট্রন দিয়েই গঠিত। এতসব কথা আমরা জেনেছি সেটি কিন্তু খুব বেশি দিন আগে নয়। দার্শনিক এরিস্টটল(৩৮৪-৩২২ খ্রিঃপূঃ) মনে করতেন, আমাদের মহাবিশ্বে যা কিছু আছে তা সবই “মাটি”, “পানি”, “আগুন” আর “বাতাস” এই চারটি মৌলিক জিনিস দিয়ে গঠিত। তিনি এমনই প্রভাবশালী দার্শনিক ছিলেন যে, তার মৃত্যুর পরও প্রায় দুই হাজার বছর মানুষ এই কথাই মেনে নিয়েছিল। তবে ভিন্ন মত যে একেবারেই ছিলনা তা নয়।ডেমোক্রিটাস নামে এক গ্রিক মনে করতেন ব্যাপারটি এমন নয়। তিনি ভাবতেন, কোন পদার্থকে ভাঙ্গলে দেখা যাবে এরা খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দিয়ে গঠিত । তিনি আরও প্রস্তাব করেন যে, এসব কণাকে আর ভাঙ্গা যাবে না।তিনি এসব অবিভাজ্য কণার নাম দেন এটম বা পরমাণু। কিন্তু এরিস্টটল বা ডেমোক্রিটাস কারও কথার পক্ষেই কোন প্রমাণ ছিল না।

১৯১১ সালে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড নামে একজন পদার্থবিজ্ঞানী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটি পরমাণু মডেল প্রস্তাব করেন ।পরবর্তীতে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেই মডেলের উন্নতি করা হয়। আর একথাও প্রতিষ্ঠিত হয় যে, সকল পদার্থই পরমাণু দিয়ে গঠিত; তবে এসব পরমাণুও অবিভাজ্য নয়। পরমাণুগুলো ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন নামে মৌলিক কণিকা দিয়ে গঠিত।
প্রকৃতিকে প্রথমে যতটা সহজ সরল বলে ভাবা হয়েছিল, দেখা গেল ব্যাপারটা মোটেই সেরকম না। বিজ্ঞানীরা দেখতে পেলেন, কোন সহজ উপায়েই পরমাণুর ভেতরে থাকা অতি-পারমানবিক কণাদের আচরণ ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। গবেষণা চলতেই থাকল। পরবর্তী গবেষণায় বেরিয়ে এলো আরও আশ্চর্য তথ্য। প্রোটন, নিউট্রনকে আমরা যেমন অবিভাজ্য ও মৌলিক কণা বলে ভেবে এসেছি, সেগুলো আসলে অবিভাজ্য না। প্রোটন ও নিউট্রনগুলো “কোয়ার্ক” নামে এক ধরনের কণা দিয়ে গঠিত। তিনটি কোয়ার্ক মিলে তৈরি হয় একটি প্রোটন বা নিউট্রন। পার্টিক্যাল এক্সিলারেটরের ভিতর পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে ভেঙ্গে আরও অনেক অস্থায়ী অতি-পারমানবিক কণিকার অস্তিত্ব পাওয়া গেল। তবে এরা সবাই কিন্তু পদার্থের কণিকা। এটুকু আমরা জানতে পারলাম, সকল প্রকার পদার্থ পরমাণু দিয়েই গঠিত আর এসব পরমাণু বিভিন্ন অতি-পারমানবিক কণা দিয়ে দিয়ে তৈরি।

ব্যাপারটি কিন্তু এমন না যে, শুধু আমাদের পৃথিবী বা অন্য গ্রহগুলো এই মৌলিক কণিকা দিয়ে গঠিত। বিজ্ঞানীরা দেখলেন আমাদের সৌরজগৎ, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি এমনকি মহাবিশ্বে যত নীহারিকা,ধূমকেতু বা মহাজাগতিক ধূলিকণা আছে তার সবকিছুই আমাদের চেনাজানা পদার্থ দিয়েই গঠিত। দূর মহাকাশের কোন নক্ষত্র থেকে আসা আলোর প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বলে দিতে পারেন সেই নক্ষত্রটিতে কি কি উপাদান আছে।তার মানে দাঁড়াচ্ছে, আমাদের মহাবিশ্বে যা কিছু আছে তা মূলত এই পরমাণু বা তার অতি-পারমাণবিক কণিকার সমন্বয়েই গঠিত।

সবকিছু ঠিকই ছিল। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকের প্রথম দিকে, ভেরা রুবিন নামে একজন বিজ্ঞানী আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ঘূর্ণন নিয়ে গবেষণা করার সময়, একটি আশ্চর্য জিনিস দেখতে পেলেন। রুবিন দেখলেন, আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে দূরবর্তী নক্ষত্রগুলোর গতি যেমন হবার কথা, সেগুলোর গতি মোটেই সে রকম না। মূলত নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র অনুসারে গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে যত দূরে যাবার কথা, নক্ষত্রগুলোর গতিও তত কমে যাওয়া উচিত। কারণ কোন বস্তু থেকে যত দূরে যাওয়া যায়, মহাকর্ষ বলের পরিমাণ ততই কমতে থাকে। তাই একটি নক্ষত্র গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে যত দূরে হবে, তার গতিবেগও তত কম হবে। আমাদের সৌরজগতের ক্ষেত্রে কিন্তু সেটাই ঘটে। আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্রে আছে সূর্য। আর যে গ্রহ সূর্য থেকে যত বেশি দূরে, তার গতিবেগও তত কম। তাই আমাদের গ্যালাক্সির ক্ষেত্রেও এমনই হবার কথা।কিন্তু রুবিনের পর্যবেক্ষণ থেকে দূরবর্তী নক্ষত্রগুলোর গতিবেগ তো কম পাওয়া গেলই না, বরং দেখা গেল একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের পর সব নক্ষত্রের বেগই প্রায় একই রকম। প্রথমে মনে করা হয়েছিল রুবিনের গণনায় হয়ত কোন ভুল আছে। কিন্তু পরে দেখা গেল শুধু আমাদের মিল্কিওয়েই না, আমাদের পাশে এন্ড্রোমিডা নামে যে সর্পিল গ্যালাক্সিটি আছে তার অবস্থাও একই রকম। এই রহস্যময় গতি লক্ষ্য করার পর বিজ্ঞানীরা এই বিষয়টি নিয়ে আরও অনেক অনুসন্ধান করতে থাকলেন। পরবর্তীতে গ্যালাক্সির ঘূর্ণন, এদের ছড়িয়ে পরার বেগ, গ্যালাক্সি ক্লাস্টার, মহাকর্ষীয় লেন্সিং , মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ করে বোঝা গেল, গ্যালাক্সির ভিতরে আমাদের চেনাজানা পদার্থের বাইরেও বিপুল পরিমাণ রহস্যময় কোন পদার্থ আছে। এদের নাম দেওয়া হল “ডার্ক ম্যাটার” বা গুপ্ত পদার্থ।

ডার্ক ম্যাটার শুধু নামেই ডার্ক না, এরা আসলেই পুরোপুরি অদৃশ্য। কোন ভাবেই এদের পর্যবেক্ষণ করার কোন উপায় নেই।তাদের উপস্থিতি জানার একমাত্র উপায় হল তাদের মহাকর্ষ বল। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে যে পরিমাণ ডার্ক ম্যাটার আছে তাদের মহাকর্ষ বল এতো বেশি যে, আমাদের গ্যালাক্সির সমস্ত গ্রহ নক্ষত্র মিলিয়ে তার দশ ভাগের এক ভাগও না(৯৫% ডার্ক ম্যাটার, ৫% পদার্থ)। তাহলে বোঝা যাচ্ছে কি বিশাল পরিমাণ ডার্ক ম্যাটার লুকিয়ে আছে আমাদের মহাবিশ্বে। বিজ্ঞানীদের বর্তমান গবেষণা বলছে আমাদের মহাবিশ্বের মোট শক্তি ও পদার্থের ২৩% ই হল এই ধরনের ডার্ক ম্যাটার। বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে গ্যালাক্সির মধ্যে কোথায় কোথায় এই ডার্ক ম্যাটার আছে তার একটি ত্রিমাত্রিক মানচিত্রও তৈরি করে ফেলেছেন।
image002

চিত্র: ডার্ক ম্যাটারের ত্রিমাত্রিক মানচিত্র ।

যদিও বিজ্ঞানীদের গণনা অনুসারে বর্তমান মহাবিশ্বের মোট ভরের প্রায় ২৩% এই রহস্যময় গুপ্ত পদার্থ, কিন্তু তারা এটাও ধারনা করছেন- মহাবিশ্ব সৃষ্টির শুরুর সময়গুলোতে এই ডার্ক ম্যাটারের পরিমাণই ছিল বেশি, প্রায় ৮০ থেকে ৯০ ভাগ। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির শুরুর দিকের সবকিছু ভাল মত বোঝার জন্য এই রহস্যময় জড় পদার্থগুলোর আচরণ বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।

এত গেল রহস্যময় গুপ্ত পদার্থের কথা। কিন্তু সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা আরও এক ধরনের রহস্যময় বিষয় আবিষ্কার করেছেন। আইনস্টাইনের দেওয়া সূত্র অনুযায়ী বিজ্ঞানীরা জানেন যে, মহাকর্ষ বল ক্রিয়াশীল থাকলে আমাদের মহাবিশ্বের প্রসারণের তীব্রতা এক সময় কমে আসবে। এই প্রসারণ কতটা দ্রুত বাড়ছে বা কমছে তার উপরই নির্ভর করছে আমাদের মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ। ১৯৯৮ সালে বিজ্ঞানীদের দুটি ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ, সুপার নোভা বিস্ফোরণ নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তাদের গবেষণায় এক আশ্চর্য বিষয় বেরিয়ে আসল। তারা লক্ষ্য করলেন আমাদের মহাবিশ্বের প্রসারণের হার তো কমছেই না বরং দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে ! মহাকর্ষ বল সবসময়ই আকর্ষনধর্মী। আর সে কারণেই মহাকাশের ছড়িয়ে থাকা হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম তাদের নিজেদের মধ্যে আকর্ষণের কারণে নিজেদের উপরই চুপসে পড়ে। এভাবে চুপসে যাবার ফলে তাদের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়, ফলে তাপমাত্রাও বাড়তে থাকে। এই তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে যখন নিউক্লীয় বিক্রিয়া হবার মত উপযোগী তাপমাত্রায় পৌছায়, তখনই জন্ম নেয় নক্ষত্র। আমাদের সূর্যও ঠিক এভাবেই মহাকাশের জমে থাকা হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের ধূলিকণা থেকে জন্ম নিয়ে এখন একটি সাম্যাবস্থায় আছে।এর হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের মহাকর্ষ শক্তির প্রভাবে নিজের ভিতরে চুপসে যাচ্ছে, আর ভিতরের ঘটতে থাকা নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া, সব কিছুকে বাইরের দিকে ঠেলে একে সাম্যাবস্থায় রেখেছে। নিউক্লীয় বিক্রিয়ার ভর ক্ষয় হতে হতে যখন মহাকর্ষের টান কমে যাবে, তখন ভিতরের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার ফলে তৈরি হওয়া শক্তির পরিমাণ যাবে অনেক বেড়ে। তাই সে তখন আর সাম্যাবস্থায় থাকবে না। সুপার নোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে তার জ্বলজ্বলে জীবন শেষ করে ফেলবে।

আবার কোন বস্তুকে পৃথিবী থেকে উপরে ছুড়ে দিলে দেখা যায়, ধীরে ধীরে তার বেগ কমে আসছে। বস্তুটির উপর মহাকর্ষ বল কাজ করে বলেই তার বেগ কমতে থাকে। আমাদের মহাবিশ্বের সব বস্তুগুলোও একটি বিস্ফোরণের ফলে চারদিকে ছুটে যেতে শুরু করেছিল। আর এই মহাকর্ষের কারণেই মহাবিশ্বের প্রসারণে হারও ধীরে ধীরে কমে আসা উচিত। কিন্তু বিজ্ঞানীরা দেখলেন ব্যাপারটি আসলে তেমন ঘটছে না। কোন এক রহস্যময় শক্তির প্রভাবে মহাকর্ষের আকর্ষণ কাটিয়ে, মহাবিশ্ব তার প্রসারণের হার বাড়িয়েই চলেছে। পরবর্তীতে আরও পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা এই রহস্যময় শক্তির ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন। এই রহস্যময় শক্তির নাম দেওয়া হয়েছে “ডার্ক এনার্জি” । সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হল, কোন ভাবেই এই “ডার্ক এনার্জি” বা গুপ্ত শক্তির প্রকৃতি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। আরও অবাক করা তথ্য হল, আমাদের মহাবিশ্বের ৭৩% ই গঠিত এই ডার্ক এনার্জি দিয়ে !

image003

চিত্র: ডার্ক এনার্জির কারণে মহাবিশ্বের প্রসারণের হার দিন দিন বাড়ছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি মহাবিশ্বের ২৩% “ডার্ক ম্যাটার” আর ৭৩% “ডার্ক এনার্জি” হয় তাহলে পদার্থের পরিমাণ কতটুকু ?
বিজ্ঞানীদের বর্তমান পর্যবেক্ষণ ও গণনা অনুযায়ী মহাবিশ্বের মোট পদার্থ ও শক্তির ৭৩% ই হল “ডার্ক এনার্জি”, ২৩% “ডার্ক ম্যাটার”, ৩.৬% মুক্ত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম(মহাজাগতিক ধূলিকণা) ও ০.৪% পদার্থ(যা দিয়ে উপগ্রহ,গ্রহ, নক্ষত্র,ধূমকেতু ইত্যাদি গঠিত )।
image004

চিত্র: মহাবিশ্বের কেবল শতকরা ৪% ভাগ আমাদের চেনাজানা পদার্থ দিয়ে গঠিত। আর বাদবাকি সবই, “ডার্ক ম্যাটার” ও “ডার্ক এনার্জি” ।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমরা যাকে পদার্থ বলি তা মহাবিশ্বের মাত্র ৪ শতাংশ। আর বাদবাকি ৯৬% শতাংশই রহস্যময় গুপ্ত পদার্থ আর গুপ্ত শক্তি দিয়ে ভর্তি। আসলে আমরা মহাবিশ্বের দিকে তাকিয়ে যেসব জায়গাকে শূন্য বলে ভাবছি সেগুলো আসলে আক্ষরিক অর্থেই শূন্য না। আমাদের চেনা জানা পদার্থ দিয়ে তৈরি গ্রহ-নক্ষত্রগুলোই বরং এই অজানা বস্তুগুলোর মধ্যে ছোট্ট দ্বিপের মত নগণ্য কিছু !

কারো কৌতূহলী মনে যদি প্রশ্ন জাগে ডার্ক ম্যাটার আসলে কেমন ? কেমন এই রহস্যময় শক্তি ? তাহলে উত্তর দেওয়াটি কিন্তু একটু কঠিন হবে। কারণ গতানুগতিক পদার্থবিদ্যার সাহায্যে এর উত্তর দেওয়া মুশকিল।পদার্থবিজ্ঞান এতদিন শুধু আমাদের চেনাজানা পদার্থ নিয়েই কাজ করে এসেছে। তাই আমাদের এমন একটি তত্ত্ব প্রয়োজন, যা আইনস্টাইনের “ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরির” মত এই মহাবিশ্বের সকল পদার্থ ও শক্তির ব্যাখ্যা করতে পারে। । পদার্থবিজ্ঞান যে এসব গুপ্ত পদার্থ ও শক্তির ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করছে না এমন নয়, কিন্তু গতানুগতিক তত্ত্ব দিয়ে এসব পদার্থের ব্যাখ্যাগুলো মোটেই আশানুরূপ নয়।
আইনস্টাইন তার আপেক্ষিক তত্ত্বের সফলতা নিয়ে খুশি ছিলেন না। তার ইচ্ছা ছিল প্রকৃতিকে আরও গভীর ভাবে বুঝতে পারা। প্রায় সময়ই বলতেন, তিনি ঈশ্বরের মন বুঝতে চান। তার সময়ে জানা দুটি মৌলিক বলকে ব্যাখ্যা করার জন্য দুটি তত্ত্ব ছিল। তড়িৎ-চুম্বক বলকে ব্যাখ্যা করার জন্য ছিল ম্যাক্সওয়েল তড়িৎ-চুম্বক তত্ত্বের সমীকরণ। এই সমীকরণগুলো স্থানের যেকোনো বিন্দুতে এই বলের প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে পারত। আর মহাকর্ষ বল ও স্থান-কালের প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করার জন্য ছিল আইনস্টাইনের নিজের “আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব”। কিন্তু এই দুটি তত্ত্বকে কোনভাবেই একটির সাথে অন্যটিকে সমন্বিত করা যাচ্ছিল না। দুটি তত্ত্বই পৃথকভাবে খুবই সফল, কিন্তু দুটিকে এক করার কোন উপায় তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। আইনস্টাইনের বিশ্বাস ছিল এই দুটি তত্ত্বকে এক করতে পারলে আমরা আরও মৌলিক কোন তত্ত্ব পাব।যার সাহায্যে প্রকৃতির আরও গভীরের প্রবেশ করা যাবে। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, সেই তথাকথিত “ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরি” গঠন করা সম্ভব হলে তিনি ঈশ্বরের মন বুঝতে পারবেন। আমরা পরে জানব তার সময়ে এটি কোনভাবেই সম্ভব ছিল না।

এখন প্রশ্ন হল, আমাদের হাতে কি এমন কোন একক তত্ত্ব নেই যা ডার্ক ম্যাটারের মত অজানা বস্তু সহ সকল প্রকার পদার্থ ও শক্তির ব্যাখ্যা দিতে পারে? উত্তর হল হ্যাঁ। আমাদের কাছে এমন একটি তত্ত্ব আছে; আর সেটিই হল- স্ট্রিং থিওরি(String Theory) বা তার তত্ত্ব। স্ট্রিং থিওরিই একমাত্র তত্ত্ব যা প্রকৃতির সকল বস্তুকণার আচরণ ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি প্রকৃতিতে বিদ্যমান চারটি মৌলিক বলকেও একীভূত করতে পারে।

এই তত্ত্ব শুধু সকল প্রকার পদার্থ ও শক্তিকে বর্ণনাই করে না, পাশাপাশি এই মহাবিশ্ব কেন আছে তারও উত্তর দেয়। আরেকভাবে বললে বলা যায়, স্ট্রিং থিওরি আমাদের “বিগ ব্যাঙ” বা মহাবিশ্ব সৃষ্টিরও আগে নিয়ে যায়। এই তত্ত্ব সেইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে চায়, হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ যার খোজ করে যাচ্ছে। কেন এই মহাবিশ্ব ? কেন কোনকিছু না থাকার বদলে কিছু আছে? এখানে আমি দেখানোর চেষ্টা করব স্ট্রিং থিওরির এমন সব বৈশিষ্ট্য আছে যাতে এটি নিজেকে সবকিছুর তত্ত্ব বা “Theory of Everything” বলে দাবি করতে পারে। আর এটিও বলতে পারে কেন এই মহাবিশ্ব ?

স্ট্রিং থিওরি

প্রথমে স্ট্রিং তত্ত্বের মূল বিষয়টি একটু আলোচনা করা যাক। আমরা যদি কোন বস্তু যেমন: একটি আপেলকে ভেঙ্গে টুকরো করতে থাকি তাহলে একসময় এসে পরমানুতে পৌছব। এবার এই পরমাণুকেও যদি আবার ভাঙ্গা হয় তাহলে ইলেকট্রন ও কোয়ার্কের মত মৌলিক কণিকা পাওয়া যাবে; যাদের আর ভাঙ্গা সম্ভব নয়।পদার্থবিদ্যার প্রচলিত ধারনা অনুসারে এসব মৌলিক কণিকাদের আমরা মাত্রা-বিহীন বিন্দুর মত ভাবি। আর স্ট্রিং তত্ত্বের পার্থক্যটা ঠিক এখানেই।স্ট্রিং তত্ত্ব বলছে আমরা যাদের গোল বিন্দু বলে ভাবছি তারা আসলে বিন্দু নয়, আমাদের দৃষ্টির সীমাবদ্ধতার কারণে এদেরকে আমরা বিন্দু হিসেবে দেখি।যদি এদেরকে কোন সুপার মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে বহুগুণে বিবর্ধিত করা সম্ভব হয় (প্রায় বিলিয়ন বিলিয়ন গুন বেশি) তাহলে আমরা এদেরকে একমাত্রিক লম্বা তার আকারে দেখব। স্ট্রিং তত্ত্ব অনুসারে প্রকৃতিতে প্রাপ্ত সকল মৌলিক কণিকাই আসলে এরকম তার। এসব তার আবার বিভিন্ন কম্পাঙ্কে কাঁপছে। এসব তারের কম্পাংকের ভিন্নতার কারণে বিভিন্ন রকম বৈশিষ্ট্যের মৌলিক কণিকা সৃষ্টি হয়। তারের কম্পনের পার্থক্যই এসব কণিকার আধান, ভর নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে। আর এসব তারের বলবিদ্যা স্টাডি করে অন্য বৈশিষ্ট্যগুলোও বের করা যাবে। সহজভাবে বললে গিটারের তারের কম্পাঙ্কের পার্থক্যের কারণে যেমন চিকন মোটা সুর বের হয় (ভিন্ন ভিন্ন নোট বাজে) তেমনি এসব স্ট্রিং এর কম্পনের পার্থক্যের কারণে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কণিকার দেখা মিলছে।

image005
চিত্র: পদার্থের গঠনের মৌলিক একক স্ট্রিং।

এই তারগুলোর দৈর্ঘ্য অস্বাভাবিক রকম ক্ষুদ্র, ১০^-৩৩ সে.মি.। এই ক্ষুদ্র তারগুলোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এদের কম্পনের ধরন। ইলেকট্রনের তারগুলো হয়ত একভাবে কাঁপছে, আবার কোয়ার্কের তারগুলো হয়ত ভিন্নভাবে কাঁপছে। এখানে একটি বিষয় বলে রাখা ভাল, প্রত্যেকটি মৌলিক কণিকাদের জন্য কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন তার বরাদ্দ নেই।মানে ইলেকট্রনের তারগুলো একরকম, নিউট্রিনোর তারগুলো আরেক রকম, এমন কিছু নয়। বরং একই তার ভিন্ন ভিন্ন ভাবে কেপে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কণিকা হিসেবে দেখা দিচ্ছে।

সব মৌলিক কণিকাই যদি স্ট্রিং হয় তাহলে আমাদের চেনাজানা বাস্তবতার চিত্রটাই কিন্তু পাল্টে যাবে। এই চিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুসিদ্ধান্ত হল, মৌলিক কণিকা বলে আসলে কিছু নেই। কারণ কোয়ার্ক বা নিউট্রিনোর মত সব মৌলিক কণিকাই আসলে অভিন্ন স্ট্রিং দিয়েই তৈরি। তাই একমাত্র মৌলিক স্বত্বা হল স্ট্রিং, যা থেকেই মহাবিশ্বের সকল বস্তু ও শক্তির সৃষ্টি।
উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে বস্তুজগতে আমরা যা কিছু দেখছি তার সবকিছুই মূলত খুব ক্ষুদ্র একধরনের তারের সমষ্টি। স্ট্রিং তাত্ত্বিক ড. মিচিও কাকুর মতে, আমাদের মহাবিশ্বের গঠন সঙ্গীতের সাথে অনেক সঙ্গতিপূর্ণ।তার ভাষায় , “আমাদের দেখা প্রতিটি অতি-পারমানবিক কণিকাই এক একটি মিউজিক্যাল নোট, আমরা হাজার বছর ধরে পদার্থবিজ্ঞানের যে সূত্রগুলো আবিষ্কার করেছি এগুলো যেন তারের কম্পনের ফলে বাজানো হারমোনি, রসায়নের সূত্রগুলো অনেকটা: তার দিয়ে বাজানো সুন্দর কোন মেলোডি, আর পুরো মহাবিশ্বটা যেন একটি সিম্ফোনি। ”

2015-01-18 17_45_20-1 Einstein desk - Microsoft Word

স্ট্রিং তত্ত্বে এই তার ছাড়াও “ব্রেন” নামে আরেক ধরনের মৌলিক স্বত্বার কথা বলা হয়েছে। ব্রেন শব্দটির পূর্ণরূপ মেমব্রেন বা ঝিল্লী। একটি ঝিল্লীর ভেতর যেমন কোন কিছু আটকে থাকতে পারে, তেমনি কোন স্ট্রিংগুলোও এই ব্রেনের ভিতর আটকে থাকতে পারে।স্ট্রিংগুলো একমাত্রিক হলেও ব্রেনগুলো কিন্তু একমাত্রিক না। একটি ব্রেনের মাত্রার সংখ্যা ২ থেকে ১০ এর মধ্যে যেকোনোটি হতে পারে। একটি দ্বিমাত্রিক ব্রেনকে ২-ব্রেন বলা হয়। দ্বিমাত্রিক ব্রেনের মত ৩-ব্রেন বা ৫-ব্রেনও সম্ভব । যদিও আমাদের মত ত্রিমাত্রিক জগতের কারও পক্ষে একটি পাচমাত্রিক বস্তু কল্পনা করা অসম্ভব, তবে স্ট্রিং তাত্ত্বিকরা গাণিতিকভাবে একটি পাচমাত্রিক ব্রেনকে খুব ভালমতোই সংজ্ঞায়িত করতে পারেন ।

স্ট্রিং থিওরিতে মাত্রার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কণাবাদী পদার্থবিদ্যার মতে মৌলিক কণিকারা হোল মাত্রাহীন বিন্দুর মত। ঠিক যেমনটি জ্যামিতিতে শেখানো হয়েছিল , “যার দৈর্ঘ্য প্রস্থ ও উচ্চতা নেই তাকেই বিন্দু বলে”। যে কণার দৈর্ঘ্য,প্রস্থ ও উচ্চতা নেই , আসলে তার কোন মাত্রাও নেই(এই দৈর্ঘ্য,প্রস্থ ও উচ্চতাই হোল স্থানের তিনটি মাত্রা )। তো, কণাবাদী পদার্থবিদ্যার মতে মৌলিক কণিকারা হোল মাত্রাহীন । স্ট্রিং থিওরির তারগুলো মাত্রা-বিহীন না, বরং এক মাত্রিক । একটি তারের যেমন শুধু দৈর্ঘ্য আছে ঠিক তেমনি।এই একমাত্রিক তারগুলো দুই থেকে দশ যেকোনো মাত্রার ব্রেনের সাথে যুক্ত থাকতে পারে।
স্ট্রিং তত্ত্ব শুধু কণিকাদের আচরণই ব্যাখ্যা করে না, বরং স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্থান-কালের গঠনকেও ব্যাখ্যা করতে পারে। বিজ্ঞানীরা যখন প্রথমবারের মত স্ট্রিংগুলোর আচরণ নিয়ে গবেষণা করছিলেন তখন দেখতে পেলেন , স্থান-কালের মধ্যে স্ট্রিংগুলো ইচ্ছা মত চলাফেরা করতে পারে না। বরং সুনির্দিষ্ট কিছু গাণিতিক নিয়ম মেনে এরা স্থান-কালের মধ্যে কিছুর জটিল গতির সৃষ্টি করে। স্ট্রিংগুলোর এসব গতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তো বিজ্ঞানীদের চোখ একেবারে কপালে। আর তা হবেই বা না কেন ? স্ট্রিংগুলোর আচরণ থেকেই আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সমীকরণ এমনিতেই বেরিয়ে আসছে ! আমরা জানি শুধুমাত্র আপেক্ষিক তত্ত্বই স্থান-কালের আচরণ ব্যাখ্যা করতে পারে। অনেক দিন ধরেই বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাহায্যে স্থান-কালের আচরণ ব্যাখ্যা করতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু কোনভাবেই তা সম্ভব হচ্ছিল না । যখনই কোন কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাহায্যে স্থান-কালের আচরণ ব্যাখ্যা করা হয় তখন গাণিতিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ ও অসীম ফলাফল পাওয়া যায়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে দেখলেন স্ট্রিংগুলোর আচরণ থেকেই স্থান-কালের আচরণ ব্যাখ্যাকারী আপেক্ষিকতার সমীকরণগুলো বেরিয়ে আসছে। আরও স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, আইনস্টাইন যদি কখনো আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আবিষ্কার না’ও করতেন তবুও স্ট্রিং তত্ত্ব থেকে আমরা তা জানতে পারতাম। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে আপেক্ষিক তত্ত্বও আসলে মৌলিক কোন তত্ত্ব নয়। আইনস্টাইন সম্ভবত নিজেও এটি বুঝতে পেরেছিলেন।

শুধুমাত্র আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্যেই যেকোনো ভৌত ঘটনার ব্যাখ্যা করা যায়। গ্রহ-নক্ষত্র,গ্যালাক্সির ঘূর্ণন,ব্ল্যাক হোল,হোয়াইট হোল,ওয়ার্মহোল বা বিগ ব্যাঙ, এমনকি স্থান-কালের নিজের প্রকৃতি সহ বৃহৎ যেকোনো কিছুই সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের সাহায্যে বর্ণনা করা সম্ভব। অন্যদিকে পরমাণু, অতি-পারমানবিক কণিকা ও এদের আচরণ ব্যাখ্যা করার জন্য বিজ্ঞানীরা “স্ট্যান্ডার্ড মডেল”(Standard Model of Particle Physics) নামে একটি তত্ত্বের সাহায্য নিয়ে থাকেন। স্ট্যান্ডার্ড মডেল অতি-পারমাণবিক কণিকাদের আচরণ ব্যাখ্যা করার ব্যাপারে খুবই সফল। এখন মজার বিষয় হল, আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের মত স্ট্যান্ডার্ড মডেলকেও শুধুমাত্র স্ট্রিং তত্ত্বের নীতিগুলো থেকেই প্রতিপাদন করা যায়।

আমরা আগেই জেনেছি স্ট্রিংগুলো স্থান-কালের মধ্যে ইচ্ছেমত চলাফেরা করতে পারে না।বিজ্ঞানীরা যখন স্ট্রিংগুলোর আচরণ গাণিতিকভাবে বিশ্লেষণ করে দেখছিলেন, তখন তারা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, স্ট্রিংগুলো স্থানের দশটি মাত্রার মধ্যে চলাফেরা করে। এই তথ্যটির তাৎপর্য কিন্তু অনেক গভীর। স্ট্রিংগুলো স্থানের দশ-মাত্রার মধ্যে চলাচল করার অর্থ হল, আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বও দশ মাত্রিক ! কিন্তু আমরা সবাই দেখে আসছি আমাদের পরিচিত জগতটি খুব নিখুঁতভাবে ত্রিমাত্রিক।
সাধারণভাবে ভাবলে স্ট্রিং থিওরির ধারনাগুলো আমাদের পরিচিত জগতের সাথে খাপ খাবে না।পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো মৌলিক কণিকার সাহায্যেই পদার্থের সকল আচরণ ব্যাখ্যা করে থাকে।কিন্তু আমরা প্রথমেই জেনেছি এই তত্ত্ব মতে মৌলিক কণিকা বলে আসলে কিছু নেই। সবকিছুই অভিন্ন স্ট্রিং দিয়ে তৈরি।আবার এখন দেখা যাচ্ছে আমাদের পরিচিত ত্রিমাত্রিক জগতটি আসলে দশ-মাত্রিক। এখন অনেকেই প্রশ্ন করবে,যদি আমাদের জগতটি দশ-মাত্রিক হয়েই থাকে, তাহলে বাকি মাত্রাগুলো কোথায় ? আমরা তাদের দেখতে পাচ্ছি না কেন?স্ট্রিং তাত্ত্বিকরা বলছেন, বাকি মাত্রাগুলোকে আমরা দেখতে পাচ্ছিনা, কারণ তারা খুব ক্ষুদ্র আকারে জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছে।

একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। একটি লোহার দণ্ডের কথা ভাবা যাক। এই দণ্ডটিকে যদি চিকন করতে করতে একটি সুতার মত করে ফেলি, তাহলে এটিকে একমাত্রিক তার বলেই মনে হবে।

2015-01-18 17_46_04-1 Einstein desk - Microsoft Word

যেহেতু দণ্ডটির দৈর্ঘ্য কমানো হয় নি, শুধু ব্যাস কমানো হয়েছে, তাই এর ব্যাসটি খুব ক্ষুদ্র আকারে পেঁচিয়ে আছে। খুব ক্ষুদ্র হলেও দণ্ডটির কিন্তু ব্যাস ঠিকই আছে। তাই আমরা একথা বলতে পারি, যদিও দণ্ডটিকে একমাত্রিক তার বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু খুব সূক্ষ্মভাবে দেখলে এটি ব্যাস-যুক্ত একটি ত্রিমাত্রিক বস্তু। স্ট্রিং তত্ত্বের মতে আমাদের জগতের তিনটি দৃশ্যমান মাত্রার পাশাপাশি বাকি মাত্রাগুলোও এরকম খুব ক্ষুদ্র আয়তনের মধ্যে জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছে।

এই অতিরিক্ত মাত্রাগুলো কিন্তু ইচ্ছামত জড়িয়ে পেঁচিয়ে থাকতে পারে না। “ক্যালাবি ইয়ো ম্যানিফোল্ড(Calabi Yau manifold)” নামে একটি বিশেষ গাণিতিক উপায়ে এরা বিভিন্ন ভাবে পেঁচিয়ে থাকতে থাকে। স্ট্রিং তত্ত্বের ভাষায় মাত্রাগুলোর পেঁচিয়ে থাকাকে কম্প্যাক্টিফিকেশন(Compactification) বলা হয়।

এই মাত্রাগুলো কতটা ক্ষুদ্র তা বোধহয় অনেকে কল্পনাও করতে পারবে না। এক সেন্টিমিটারের বিলিয়ন বিলিয়ন গুণেরও বেশি ছোট(১০^-৩৩ সে.মি.) জায়গার মধ্যে এগুলো পেঁচিয়ে আছে।আমরা যদি কোনভাবে এরকম ক্ষুদ্র আকার ধারণ করতে পারি তাহলে কিন্তু আমরা ঠিকই দশটি মাত্রাই দেখতে পাব। স্ট্রিংগুলো যেহেতু এতটাই ক্ষুদ্র, তাই এরা দশ মাত্রার মধ্যে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই চলাফেরা করে।

অনেকের মনে হতে পারে এসব মাত্রার জড়িয়ে পেঁচিয়ে থাকার কি দরকার ছিল ? এভাবে না থাকলে তো আমাদের মহাবিশ্বটাই দশ মাত্রার হয়ে যেত। ত্রিমাত্রিক জগতের চেয়ে দশ-মাত্রিক জগতটি নিশ্চই আরও সুন্দর ও বৈচিত্র্যময় হবে ! তবে কেন আর কিভাবে এই মাত্রাগুলো এত ছোট্ট জায়গার মধ্যে পেঁচিয়ে আছে এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু খুব সোজা না। এর উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মহাবিশ্বের জন্ম ও পদার্থবিদ্যার নিয়মগুলোর রহস্য।

স্ট্রিং তত্ত্ব ও মহাবিশ্ব

এতক্ষণ আমরা জানলাম স্ট্রিং তত্ত্ব কিভাবে পদার্থ ও স্থান-কালকে বর্ণনা করে। এখন জেনে নেওয়া যাক এ তত্ত্ব অনুযায়ী মহাবিশ্বের ধারনাটি কেমন। পদার্থবিদ্যার আধুনিক ধারনা অনুসারে একটি মহাজাগতিক স্ফীতির মধ্য দিয়ে আমাদের মহাবিশ্বের শুরু।স্ফীতির ঠিক পরেই একটি বড়সড় বিস্ফোরণের(বিগ ব্যাং) মাধ্যমে মহাজাগতিক বস্তুগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে পরতে থাকে। আর আমরা সেই বিস্ফোরণের অনেক পরের একটি সময়ে অবস্থান করছি।মহাবিশ্ব সম্পর্কে এই ধারনা চিত্রের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য করুন।এই চিত্র অনুযায়ী আমাদের মহাবিশ্ব একটিই ।আর পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলো মহাবিশ্বের সর্বত্র একই রকম, বা অন্যভাবে বলা যায়, পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলো শুধুমাত্র একই রকম হতে পারে।

কিন্তু স্ট্রিং থিওরি বলছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। এই তত্ত্ব মতে একদম শূন্য থেকে অসংখ্য মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। তাই আমাদের মহাবিশ্বই যে একমাত্র মহাবিশ্ব এমন ভাবার কোন কারণ নেই। আর বিষয়টি এমন নয় যে, কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই মহাবিশ্বগুলো সৃষ্টি হয়েছিল। এভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টির ব্যাপারে সময়ের কোন নির্দিষ্ট পরিমাপ নেই। কেননা আমাদের দুনিয়ার সময়ের সাথে সেই সময়ের কোন যোগাযোগ নেই। সৃষ্টির এই প্রক্রিয়ায়, আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টি হবার আগেও যেমন অসংখ্য মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে তেমনি আমাদের এই স্থান-কালের বাইরে শূন্য থেকেই আরও বিশ্ব সৃষ্টি হয়েই চলেছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। আর এই প্রতিটি মহাবিশ্বের পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলি যে আমাদের মত সেটিও না। আমাদের মত নিয়ম সমৃদ্ধ মহাবিশ্বও যেমন আছে, তেমনি সম্পূর্ণ আলাদা নিয়মের মহাবিশ্বও আছে অসংখ্য।

প্রতিটি আলাদা নিয়মের মহাবিশ্বগুলো কেমন হবে, তা নির্ভর করে স্ট্রিং তত্ত্বের অতিরিক্ত মাত্রাগুলো কিভাবে পেঁচিয়ে আছে তার উপর।আমরা আগেই জেনেছি স্ট্রিং তত্ত্বের অতিরিক্ত মাত্রাগুলো চাইলেই ইচ্ছেমত জড়িয়ে পেঁচিয়ে থাকতে পারে না। অন্তর্বর্তী জগতের মাত্রাগুলোর প্যাঁচ নিয়ন্ত্রিত হয় কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে। এই অন্তর্বর্তী জগতের প্যাঁচের আকার-আকৃতিই বিভিন্ন ভৌত ধ্রুবক যেমন, ইলেকট্রনের চার্জ, মৌলিক কণিকাগুলোর পরস্পরের সাথে মিথস্ক্রিয়া ইত্যাদির মান নিয়ন্ত্রণ করে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলা যায়, এই প্যাঁচের আকৃতিই প্রকৃতির দৃশ্যমান নিয়ম গুলো নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে দৃশ্যমান নিয়ম বলতে, মৌলিক চারটি বল ও তাদের পরস্পরের সাথে মিথস্ক্রিয়ার ধরন, মৌলিক কণিকা যেমন, কোয়ার্ক বা নিউট্রিনোর ভর, আধান ইত্যাদির কথা বোঝানো হচ্ছে। আর এসব দৃশ্যমান নিয়মগুলো আবার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে স্ট্রিং তত্ত্বের নিজস্ব নিয়মগুলো থেকে।অর্থাৎ স্ট্রিং তত্ত্বের নিয়মগুলোই হল প্রকৃতির সবচেয়ে মৌলিক নিয়ম, যেগুলোর উপর ভিত্তি করে পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক নিয়মগুলোর উদ্ভব ঘটে।

এভাবে স্ট্রিং তত্ত্বের নিজস্ব নিয়মগুলো থেকে আমাদের মহাবিশ্বের মত প্রাকৃতিক নিয়মযুক্ত, বিভিন্ন ধরনের মহাবিশ্ব উদ্ভব হতে পারে। শুধুমাত্র প্রতিটি মহাবিশ্বের অন্তর্বর্তী জগত ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে পেঁচিয়ে থাকবে। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন, স্ট্রিং তত্ত্বের অন্তর্বর্তী জগতের মাত্রাগুলো প্রায় ১০^৫০০ উপায়ে পেঁচিয়ে থাকতে পারে। অর্থাৎ এই তত্ত্ব মতে ১০^৫০০ সংখ্যক আলাদা আলাদা পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম সমৃদ্ধ মহাবিশ্ব সম্ভব । এই সংখ্যাটি কতটা বড় সেটি বুঝতে চাইলে এমন একজন বিজ্ঞানীর কথা ভাবুন যিনি স্ট্রিং তত্ত্বের সমাধান থেকে কোন শক্তিশালী কম্পিউটারের সাহায্যে প্রতি সেকেন্ডে ১০০০ টি নিয়ম বিশ্লেষণ করে দেখতে পারে। এত ক্ষমতা সম্পন্ন যন্ত্র থাকার পরও তিনি যদি তিনি বিগ ব্যাঙের পর থেকে আজ পর্যন্ত হিসেব করতে থাকেন, তাও মাত্র ১০^২০ টি মহাবিশ্বের নিয়ম গণনা করতে পারবেন। আর এমন প্রতিটি নিয়মের মহাবিশ্ব সংখ্যাও অগণিত।

প্যারালাল ইউনিভার্স(Parallel Universe) বা সমান্তরাল মহাবিশ্ব

স্ট্রিং তত্ত্বের এরকম সমাধানের পর মহাবিশ্বের ধারনা বদলে মাল্টিভার্স(Multiverse) বা বহুবিশ্বে রূপ নিয়েছে। এরকম অসংখ্য মহাবিশ্বের ভিতর এমন অনেক মহাবিশ্ব আছে যেগুলোর পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলো হয়ত হুবহু আমাদের মত। আর এদের ভিতর অনেকেই আবার আকার আয়তন সবদিক থেকেই দেখতে আমাদের মহাবিশ্বের মত। এদেরকে বলা হয় প্যারালাল ইউনিভার্স(Parallel Universe) বা সমান্তরাল মহাবিশ্ব। এরকম সমান্তরাল মহাবিশ্বের সংখ্যা যেহেতু অগণিত, তাই এমন কিছু মহাবিশ্ব পাওয়া যাবে যেগুলোর সবকিছুই হুবহু আমাদের মহাবিশ্বের মত।যেন ঠিক যমজ ভাই-বোন। ঠিক আপনার মতই আরেকজন আপনি হয়ত আরেকটি সমান্তরাল মহাবিশ্বে বসে ঠিক এই বইটিই পড়ছে।

image012

চিত্র: উপরের প্রতিটি গোলকই এক একটি আলাদা মহাবিশ্ব,এদের মধ্যে কিছু আবার আছে হুবহু আমাদের মহাবিশ্বের মতই দেখতে।

সমান্তরাল মহাবিশ্বের কথা শুনতে হয়ত অনেকের কাছে আজগুবি মনে হতে পারে। কিন্তু স্ট্রিং তত্ত্ব ছাড়াও মহাবিশ্বের জন্ম রহস্য বর্ণনাকারী- ইনফ্লেশন তত্ত্বও একই রকম কথা বলে। কেওটিক ইনফ্লেশন তত্ত্ব অনুসারে বিজ্ঞানী আঁদ্রে লিণ্ডে কম্পিউটার সিমুলেশন করে দেখেছেন, এই ধরনের স্ফীতি তত্ত্বও স্ট্রিং তত্ত্বের মত আলাদা ধরনের পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম কার্যকর অসংখ্য মহাবিশ্বের কথা বলছে। এমআইটির( MIT) কসমোলজিস্ট ম্যাক্স টেগমার্ক আমাদের পরিচিত গণিতের সম্ভাবনার সাহায্যে হিসেব কষে দেখিয়েছেন, আমাদের এই মহাবিশ্ব থেকে প্রায় ১০^১০^২৮ মিটার দুরেই হয়ত হুবহু আপনার মত দেখতে একজন সমান্তরাল মহাবিশ্ব নিয়েই ভাবছে।কিন্তু সমস্যা হল আপনি বা আপনার টুইন কেউই কারও সম্পর্কে জানতে পারবেন না।
টেগমার্ক বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব থেকে পাওয়া সিদ্ধান্ত অনুসারে চার রকম প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা বলেছেন । লেভেল ওয়ান প্যারালাল ইউনিভার্স হল সবচেয়ে মজার। বলা যেতে পারে আপনি যদি আপনার বর্তমান অবস্থান থেকে যথেষ্ট দূরে ভ্রমণ করতে পারেন তাহলে আপনি আবার আপনার বাসাতেই ফিরে যাবেন। সেখানে দেখা যাবে হুবহু আমাদের পৃথিবীর মত গ্রহে আপনার মতই একজন বসে স্ট্রিং তত্ত্বের কোন বই পড়ছে। শুনতে অবাক লাগবে, বহুবিশ্বের কথা বিবেচনা না করলেও, এরকম প্যারালাল জগত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ ইনফ্লেশন তত্ত্বের বিশ্লেষণ থেকে আমরা জানি মহাবিশ্বকে আগে যতটুকু বড় মনে করা হত এটি তার থেকে ঢের বেশি বড়। আক্ষরিক অর্থেই অসীম বলা যেতে পারে।বিজ্ঞানীরা গাণিতিক সম্ভাবনার সাহায্যে হিসেব কষে দেখেছেন, এই অসীম মহাবিশ্বে আমাদের সৌরজগতের একটি টুইন খুঁজে পাবার সম্ভাবনা বেশ প্রবল।একই রকম এসব মহাবিশ্বকে লেভেল-1 প্যারালাল ইউনিভার্স বলা হয়।

স্ট্রিং তত্ত্বের সমীকরণ বিশ্লেষণ করে একদল বিজ্ঞানী বলছেন আমাদের মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল দুটি ব্রেনের সংঘর্ষের কারণে। দুটি ব্রেনের এরকম সংঘর্ষের ফলেই ইনফ্লেশনের সৃষ্টি হয়। এরকম সংঘর্ষ কিন্তু কোন নির্দিষ্ট একটি স্থানে হয় না, বরং আমাদের মহাবিশ্বের বাইরের শুন্যতায় এরকম সংঘর্ষ হয়েই চলেছে, ফলে সৃষ্টি হয়ে চলেছে অসংখ্য মহাবিশ্ব। এই অসংখ্য মহাবিশ্বের ভিতর আমাদের মহাবিশ্বের মত কোন একটি থাকা খুবই সম্ভব। ব্রেনের সংঘর্ষের কারণে এভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টির এই তত্ত্বকে ইকপাইরোটিক থিওরি(Ekpyrotic Theory) বলা হয়। এই তত্ত্ব ঠিক হলে আমাদের মহাবিশ্বের মত দেখতে আরও কোন মহাবিশ্ব থাকাটা বাধ্যতামূলক। এরকম মহাবিশ্বগুলোকে লেভেল-2 প্যারালাল ইউনিভার্স বলে।

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সম্ভাব্যতা ও এর বর্ণনাকারী ওয়েব ফাংশনকে ব্যাখ্যা করার জন্য আরেক ধরনের প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা বলা হয়।এ ধরনের মহাবিশ্বের কথা বুঝতে চাইলে “হিলবার্ট স্পেস” নামে এক ধরনের তাত্ত্বিক ও বিমূর্ত স্থানের কথা ভাবতে হবে। এই তাত্ত্বিক স্পেস অসীম-মাত্রিক এবং একটি কোয়ান্টাম জগত এই হিলবার্ট স্পেসের সাপেক্ষে বিভিন্নভাবে ঘুরতে পারে। এই তত্ত্ব মতে যে ধরনের মহাবিশ্বের কথা বলা হয়, সেগুলো প্রত্যেকটি একই জায়গায় এবং একই সময়ে সহ-অবস্থান করছে, কিন্তু প্রত্যেকে আলাদা ডাইমেনশনে অবস্থিত বলে কেউ কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। যোগাযোগ করতে না পারলে কি হবে,প্রতিটি মুহূর্তে নেয়া আপনার সিদ্ধান্তগুলো হয়ত আপনার মত অসংখ্য আপনার হুবহু প্রতিরূপের সাথে মিলিত ভাবেই নেওয়া হচ্ছে। আপনার নাকের ডগায়ই হয়ত একটি সমান্তরাল মহাবিশ্ব রয়েছে, শুধু আলাদা মাত্রায় অবস্থিত বলে তাকে ধরা ছোঁয়া যাচ্ছে না। এই তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতারা মনে করেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অদ্ভুত নিয়মগুলোর উৎপত্তি আসলে এরকম অসীমসংখ্যক প্যারালাল ইউনিভার্সের যোগাযোগের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। এ ধরনের সমান্তরাল মহাবিশ্বগুলোকে লেভেল থ্রি প্যারালাল ইউনিভার্স বলা হয়।

image013
চিত্র: শিল্পীর কল্পনায় হিলবার্ট স্পেস

স্ট্রিং তত্ত্বে অন্তর্বর্তী জগতের মাত্রাগুলো বিভিন্ন ভাবে পেঁচিয়ে থাকার কারণে বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক নিয়মাবলী সমৃদ্ধ মহাবিশ্বের উদ্ভব হতে পারে। এ রকম আলাদা আলাদা নিয়মের মহাবিশ্বগুলোর সবকিছুই আলাদা। এমন সব মহাবিশ্বের বেশিরভাগই প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তা বিকাশের জন্য অনুপযোগী। যদিও আমরা এমন মহাবিশ্বের প্রমাণ পাইনি, কিন্তু তাত্ত্বিকভাবে এরকম মহাবিশ্বের সংখ্যা প্রায় অসীম, ১০^৫০০।আর এর ভিতর আমাদের মহাবিশ্বের মত নিয়ম যুক্ত মহাবিশ্বের সংখ্যাও অগণিত। বর্তমান প্রযুক্তির ধরা ছোঁয়ার বাইরে হলেও, ভবিষ্যতে কোন দিন হয়ত আমরা এমন মহাবিশ্বের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হব। এমন বিভিন্ন নিয়ম যুক্ত মহাবিশ্বকে বলা হয় লেভেল-4 প্যারালাল ইউনিভার্স।

উপরে চার ধরনের প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা বলা হয়েছে।স্ট্রিং তত্ত্বের সমাধানগুলো শুধু লেভেল-3 ছাড়া বাকি সবগুলোর অস্তিত্ব দাবি করে। স্ট্রিং তত্ত্বের সমাধানগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় অবশ্যই কোথাও আমাদের মহাবিশ্বের মত অন্য মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে। এই তত্ত্ব আমাদের সামনে সৃষ্টির যে চিত্র তুলে ধরে তাতে বহুবিশ্ব ও সমান্তরাল মহাবিশ্বের অস্তিত্ব খুবই বাস্তব।

ওয়ার্মহোল (Wormhole)

আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুসারে স্পেস বা স্থানকে আমরা যেরকম সমতল বলে ভাবি, স্পেস আসলে তেমন না, বরং এটি বাঁকানো। আলো যখন মহাশূন্যের(স্পেস) ভিতর দিয়ে ভ্রমণ করে, তখন এই বাঁকানো স্পেসের ভেতর দিয়ে একটি বাঁকানো পথে চলতে বাধ্য হয়।কিন্তু এই বাঁকা পথের পাশাপাশি একটি সংক্ষিপ্ত রাস্তাও আছে। এই সংক্ষিপ্ত পথকেই ওয়ার্মহোল বলা হয়। ওয়ার্মহোলকে অনেক সময় আইনস্টাইন-রজেন ব্রিজ নামেও ডাকা হয়ে থাকে।দুটি স্থানে যাবার এই বিভিন্ন রাস্তা থাকার কারণে গণিতবিদরা একে বহুভাবে সংযুক্ত স্থান(Multiply connected spaces) বলেন। কিন্তু পদার্থবিদরা একে ওয়ার্মহোল বলেন কারণ, একটি পোকা যেমন মাটি খুড়ে পৃথিবীর এই প্রান্তের সাথে অন্য প্রান্তের একটি সংক্ষিপ্ত রাস্তা তৈরি করতে পারে, তেমনি একটি ওয়ার্মহোলও মহাবিশ্বের দুটি স্থানের ভিতর একটি বিকল্প সংক্ষিপ্ত রাস্তা তৈরি করে।
আমাদের সূর্যের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রপুঞ্জ হল আলফা সেন্টরাই। সৌরজগৎ থেকে আলোর বেগে ভ্রমণ করলেও পার্শ্ববর্তী এই নক্ষত্রপুঞ্জে যেতে আমাদের কমপক্ষে ৪.৩ বছর সময় লাগবে(বাস্তবে যা অসম্ভব,কেননা কোন কিছুর পক্ষেই আলোর বেগে ভ্রমণ সম্ভব নয়)।কিন্তু যদি কেউ একটি ওয়ার্মহোল দিয়ে যেতে পারে তবে ডিনার করতে করতেই আলফা সেন্টরাই থেকে ঘুরে আসা সম্ভব।

image014

চিত্র: সৌরজগৎ ও আলফা সেন্টরাই এর মাঝে ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে সৃষ্ট সংক্ষিপ্ত রাস্তা।

আইনস্টাইনের তত্ত্ব আমাদের মহাবিশ্বের দুটি ভিন্ন স্থানের মধ্যে ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে ভ্রমনের কথা বললেও, স্ট্রিং তত্ত্বের সমাধান অনুযায়ী আমরা যদি একটি ওয়ার্মহোল তৈরি করতে পারি তা আমাদের মহাবিশ্বের যেকোনো গ্যালাক্সির পাশাপাশি অন্য মহাবিশ্বে ভ্রমনের সম্ভাব্যতার কথাও বলে।এমনকি একটি ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে শুধু দুটি ভিন্ন মহাবিশ্বেই নয়, এমনকি অতীত ও ভবিষ্যতেও ভ্রমণ করা সম্ভব। স্ট্রিং তত্ত্ব যে অতিরিক্ত মাত্রার কথা বলে, আমরা যদি সেই অতিরিক্ত মাত্রাগুলো দিয়ে একটি আন্তঃমাত্রিক ভ্রমনের পথ তৈরি করতে পারি, তাহলে খুব কম সময়েই অন্য মহাবিশ্বের অন্য সময়ে গিয়ে উপস্থিত হতে পারব। অনেক পদার্থবিজ্ঞানী মনে করেন, আমাদের মহাবিশ্ব যখন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পরবে, তখন আন্তঃমাত্রিক ভ্রমনের মাধ্যমে আমরা অন্য মহাবিশ্বে পাড়ি দিয়ে আমাদের সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে পারব।

স্ট্রিং ফিল্ড থিওরির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ড. মিচিও কাকু একটি হাইপোথিটিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট ডিজাইন করেছেন। এতে আমরা স্থান-কালের দেয়াল ভেদ করে ওয়ার্মহোল দিয়ে অন্য মহাবিশ্বে পাড়ি দিতে পারব।পদ্ধতিটি খুব বেশি জটিল না। প্রথমে আমাদের যেকোনো একটি নক্ষত্রকে বেছে নিতে হবে।তারপর একটি শক্তিশালী গামা-রে গান দিয়ে সেই নক্ষত্রের চারিদিকে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে গামা-রে গুলোকে আবার নিজেদের উপরে ফেলতে হবে। এরকম শক্তিশালী রশ্নি নিজের উপর চক্রাকারে উপরিপাতন হবার ফলে শক্তির পরিমাণ বাড়তেই থাকবে।একসময় প্রচুর শক্তি সৃষ্টি হলে, স্থান-কালের দেয়ালে একটি ওয়ার্মহোল তৈরি হবে। এখন এই ওয়ার্মহোলকে নিয়ন্ত্রণ করে অন্য মহাবিশ্বে পাড়ি দেয়া যাবে!

image015

চিত্র: স্ট্রিং ফিল্ড থিওরির কো-ফাউন্ডার ড. মিচিও কাকু

সুপারসিমেট্রি(Supersymmetry)

স্ট্রিং থিওরির একটি অন্যতম ভিত্তি হল এই সুপারসিমেট্রি। বাংলায় একে মহাপ্রতিসাম্যতা বলা যেতে পারে। এই প্রতিসাম্যতা প্রকৃতির ভিন্ন ধরনের মৌলিক কণিকাদের মধ্যে এক ধরনের আন্তঃসম্পর্কের কথা বলে। প্রকৃতিতে যত রকম মৌলিক কণিকা পাওয়া যায় তাদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ধরনের কণিকাদের বলা হয় বোসন আর অন্যদের বলা হয় ফার্মিওন। এমনিতে এই দুই ধরনের কণিকার বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ বিপরীত। কিন্তু সুপার সিমেট্রি অনুসারে- প্রকৃতিতে প্রাপ্ত সব বোসনের জন্য একটি করে ফার্মিওন কণা রয়েছে,আবার সব ফার্মিওনের জন্যই একটি করে বোসন কণা রয়েছে । এসব কণিকাদের বলা হয় সুপারপার্টনার। এই ধারনা গ্রহণ করার ফলে আমাদের মৌলিক কণিকার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে ! স্ট্রিং তাত্ত্বিকদের মতে, একটি একীভূত তত্ত্ব গঠন করার জন্য সুপারসিমেট্রির কোন বিকল্প নেই। সুপারসিমেট্রির ধারনা গ্রহণ করার পর স্ট্রিং তত্ত্বের নাম হয়ে গেছে- “সুপারস্ট্রিং তত্ত্ব”।

হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল(Holographic principle)

বিজ্ঞান আমাদের অনেক রকম বাস্তবতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে আমরা জেনেছি এমনকি সময়ও ধীর হয়ে যায়। কিন্তু স্ট্রিং থিওরির এমন কিছু অনুসিদ্ধান্ত আছে যা সকল প্রকার কল্পকাহিনীকেও হার মানায়।এমন একটি অনুসিদ্ধান্তের নাম হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল। এই তত্ত্ব মতে আমি, আপনি, আপনার এই বই সহ পুরো মহাবিশ্বটিই একটি বিশাল হলোগ্রাফিক চিত্র ছাড়া আর কিছু না। অর্থাৎ, আমরা যাকে চিরন্তন বাস্তব বলে ভেবে আসছি তা তেমন কোন পরম বাস্তবতা নয়। এই প্রিন্সিপল আমাদের বলে যে- আমাদের মহাবিশ্বের ত্রিমাত্রিক স্থানে যা কিছু ঘটছে, তার সব তথ্যই একটি মহাজাগতিক দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠে জমা করা আছে। আর সেই পৃষ্ঠ থেকে এক ধরনের হলোগ্রাফিক প্রতিফলনের প্রকাশই হল- আমি, আপনি ও আমাদের এই মহাবিশ্ব ।

এখন প্রশ্ন জাগছে, তাহলে আমরা এই যে দিব্যি ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছি, কত রকম অনুভূতি হচ্ছে এসব কি করে মিথ্যা হয় ? এই তত্ত্ব মতে, আমারা যা কিছু দেখছি এগুলো আসলে এক ধরনের উচ্চ মাত্রার বাস্তবতার(High order of reality) প্রতিফলন। সেই দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠকে কোন তত্ত্ব দ্বারা বর্ণনা করা হলে, সেই তত্ত্ব আর আমাদের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের তত্ত্ব, সমতুল্য হবে। তাই আমাদের বাস্তবতাকে বেশি বাস্তব বলাটা কোন ভাবেই ঠিক হবে না। বরং আমরা যে বাস্তবতায় বাস করি তার সাহায্যে ব্ল্যাক হোলের কিছু বিষয় সহ অনেক কিছুই বর্ণনা করা যায় না। হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল সত্য হবার পেছনে বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই বেশ কিছু তাত্ত্বিক প্রমাণ পেয়েছেন। এই তত্ত্ব বিজ্ঞানী মহল সহ, সমগ্র পৃথিবীর বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের মাঝে বাস্তবতা নিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে। ১৭ জানুয়ারি, ২০০৯ নিউ সায়েন্টিস্টের কাভার ফটোতে লিখা হয় “Are you a hologram… projected form the edge of universe”

image016
চিত্র: ১৭ জানুয়ারি, ২০০৯ নিউ সায়েন্টিস্ট কাভার ফটোতে হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল ।

Ads/CFT correspondence

এই তত্ত্বের নামটি খটোমটো দেখে ভয় পাবার কিছু নেই। দেখতে একটু কাঠখোট্টা হলেও মূল বিষয়টি খুব সহজ। এখানে বলা হয় , দুটি তত্ত্ব দেখতে সম্পূর্ণ ভিন্ন মনে হলেও কিছু নির্দিষ্ট শর্তের ভিতর তারা একই রকম আচরণ করতে পারে। ভিন্ন ধরনের তত্ত্ব দুটির একটি হল কোয়ান্টাম থিওরি, আর অন্যটি হল স্ট্রিং থিওরি। এই তত্ত্ব দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। যতগুলো কোয়ান্টাম তত্ত্ব আছে তার সবগুলোতেই স্থান-কালের ধারনা স্ট্রিং তত্ত্বের থেকে একদম আলাদা। তাই আপাত দৃষ্টিতে এদের কোনভাবেই মেলান সম্ভব নয়। কিন্তু Ads/CFT correspondence মতে, কিছু বিশেষ শর্তের ভিতর এই দুটি তত্ত্বই একই রকম ফলাফল দেখাবে।

এরকম যোগাযোগ(correspondence) , প্রকৃতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের নতুন করে ভাবাচ্ছে। বেশিরভাগ বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন এই correspondence স্ট্রিং থিওরির একটি মৌলিক নীতি। উপরে যে হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, তার একটি প্রমাণ হল এই তত্ত্ব। এছারাও কোয়ান্টাম জগতের অনেক রহস্যময় ঘটনার ভেতরের কারণ বোঝার জন্য এই তত্ত্বটি অনেক সাহায্য করবে বলে ভাবছেন বিজ্ঞানীরা ।

পদার্থ থেকে সুপারস্ট্রিং

ধরা যাক আমাদের রান্না ঘরে প্রেসার কুকারের মধ্যে এক টুকরো বরফ রাখা আছে। স্টোভটি জ্বেলে দিলে কি হবে আমরা সবাই আন্দাজ করতে পারি। কিন্তু ভাবুন তো, একে যদি ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডিগ্রি তাপমাত্রা পর্যন্ত গরম করতে থাকি, তাহলে কি ঘটবে ?

যদি বরফ টুকরোটি গরম করতে শুরু করা হয় প্রথমে এটি গলে পানিতে পরিণত হবে। এর মানে বরফ টুকরোটি তার দশা পরিবর্তন করে কঠিন থেকে তরলে পরিণত হল। এখন পানিটুকু ফুটতে শুরু করার আগ পর্যন্ত যদি তাপ দেওয়া হয়, তাহলে এটি আবারও একটি দশা পরিবর্তনের মাধ্যমে তরল থেকে বাষ্পে পরিণত হবে। এখন যদি আমরা তাপমাত্রা বাড়াতেই থাকি তাহলে একসময় পানির অণুগুলো ভেঙ্গে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের আলাদা পরমাণুতে পরিণত হবে। পানির অণুগুলো যে শক্তি দ্বারা নিজেদের মধ্যে যুক্ত ছিল, তার থেকে বেশি শক্তি প্রয়োগ করায় এটি তখন আর পানি থাকবে না। বরং এটি অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের একটি মিশ্র ও উত্তপ্ত গ্যাসে পরিণত হবে।

এখন যদি তাপমাত্রা ৩০০০ K পর্যন্ত বাড়ানো হয়, তাহলে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের পরমাণুগুলোও ভাঙতে শুরু করবে। ইলেকট্রনগুলো পরমাণুর ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে। এটি তখন এক ধরনের উচ্চ তাপমাত্রার আয়নিত গ্যাসে পরিণত হবে।পদার্থের এই অবস্থাটি প্লাজমা নামে পরিচিত।কঠিন, তরল, বায়বীয় এই তিনটি দশার পাশাপাশি পদার্থের এই প্লাজমাকে অনেকে পদার্থের চতুর্থ অবস্থা বলে থাকে। যদিও দৈনন্দিন জীবনে আমরা পদার্থের এই প্লাজমা অবস্থার সাথে পরিচিত না, তবে আমাদের সূর্যের দিকে তাকালেই আমরা প্লাজমা দেখতে পাব। মূলত সূর্যের মত সব নক্ষত্রগুলোতে পদার্থ এই প্লাজমা আকারেই থাকে।আর আমাদের মহাবিশ্বের বেশিরভাগ পদার্থই প্লাজমা আকারে আছে।

এখন আমাদের স্টোভের তাপমাত্রা আর একটু বাড়িয়ে ১ বিলিয়ন ডিগ্রি কেলভিন করে ফেলব। এই তাপমাত্রায় অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসগুলো ভেঙ্গে গিয়ে নিউট্রন ও প্রোটনের গ্যাসে পরিণত হবে। পদার্থের এই অবস্থাও কিন্তু আমাদের মহাবিশ্বে অচেনা না। নিউট্রন স্টার বা পালসারের ভিতর পদার্থগুলো এই অবস্থায়ই থাকে।
এই নিউট্রন ও প্রোটনের গ্যাসকে যদি ১০ ট্রিলিয়ন কেলভিন তাপমাত্রায় নেওয়া যায়, তাহলে এই অতি-পারমানবিক কণিকারা ভেঙ্গে গিয়ে কোয়ার্কে পরিণত হবে। এখন আমাদের হাতে যা আছে তা হল, কোয়ার্ক আর লেপটনের(ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো) মিশ্র গ্যাস। এই তাপমাত্রায় আমরা কোয়ার্ক, ইলেকট্রন আর নিউট্রিনোগুলো স্বতন্ত্র কণা হিসেবে পাব।
আমরা তাপমাত্রা বাড়াতেই থাকব। এবার কোয়ার্ক-লেপ্টনের গ্যাসের তাপমাত্রা যখন ১ কোয়াড্রিলিয়ন পর্যন্ত উঠবে, তড়িৎ-চুম্বক বল ও নিউক্লিয়ার দুর্বল বল এক হয়ে যাবে। এদেরকে আর আলাদা বল হিসেবে সনাক্ত করা যাবে না। এই তাপমাত্রায় SU(2) X SU(1) সিমেট্রি তৈরি হবে। অন্যভাবে বললে বলা যায়, তখন নতুন একটি প্রতিসামতা প্রকাশ পাবে, ফলে এই দুটি বলের প্রকৃতি হবে একই রকম। এই দুই বলের একীভূত রূপকে বলা হয় তাড়িৎ-দুর্বল বল।

এবার যখন তাপমাত্রা বাড়িয়ে ১০ ^ ২৮ ডিগ্রি কেলভিন করা হবে, তখন সবল নিউক্লিয়ার বল ও তাড়িৎ-দুর্বল বল একীভূত হয়ে GUT সিমেট্রি দেখা দেবে [ SU(5) , O(10) অথবা E(6)] । এই প্রতিসাম্যতা তৈরির পর নিউক্লিয় বল বলে আলাদা কিছু থাকবে না।

সবশেষে যখন ১০^৩২ ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রায় মহাকর্ষ বল, GUT বলের সাথে একীভূত হবে তখন দশ-মাত্রার সুপারস্ট্রিং জগতে তৈরি হবে, দেখা দেবে সব প্রতিসাম্যতা । এখন আমাদের স্টোভের ভিতর যা আছে তা হল সুপারস্ট্রিং-এর গ্যাস।(এই তাপমাত্রায় প্রকৃতির সকল প্রতিসাম্যতা দেখা দেবে ফলে স্ট্রিংগুলো তাদের সুপার পার্টনারের সাথে মিলিত হয়ে সুপারস্ট্রিং গঠন করবে )। এই বিশাল তাপমাত্রায় স্থান-কালের মাত্রা পরিবর্তন হয়ে যাবে। পরিচিত চতুর্মাত্রিক জগত আর কোঁকড়ানো ছয় মাত্রার জগত মিলে দশ-মাত্রার সুপারস্ট্রিং এর জগত তৈরি হবে। সুপারস্ট্রিং গ্যাসের মধ্যে, ইন্টার-ডাইমেনশনার ট্রাভেল করা যাবে, হয়ত চোখের সামনেই দেখা যাবে একটি সুন্দর ওয়ার্মহোল। তবে এই পরিস্থিতিতে ঐ রান্নাঘর থেকে যত তাড়াতাড়ি বের হওয়া যায় ততই মঙ্গল !

কেন স্ট্রিং থিওরি ?

পুরো বিশ্বজগতকে ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদের হাতে এখন দুটি তত্ত্ব আছে। একটিকে বলা যায় বড়দের তত্ত্ব; আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব। অন্যটিকে বলা যায় ছোটদের তত্ত্ব; কোয়ান্টাম মেকানিক্স। আপেক্ষিক তত্ত্বের সাহায্যে বৃহৎ জগতের সবকিছুই নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। গ্রহ-নক্ষত্র, সৌরজগৎ, ছায়াপথ, নীহারিকা, ব্ল্যাক হোল, হোয়াইট হোল,মহাবিশ্বের প্রসারণ এমনকি বিগ ব্যাং । আর পরমাণু, অতি-পারমানবিক কণিকা- ইলেকট্রন, কোয়ার্ক, নিউট্রিনো, মেসন সহ আরও অনেক অতিক্ষুদ্র কণিকাদের জগতকে ব্যাখ্যা করে কোয়ান্টাম মেকানিক্স।
দুটি তত্ত্বই আলাদা ভাবে মহাবিশ্বের সকল ভৌত ঘটনার ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু দুটি একসাথে কখনোই নয়। মূলত এই দুটি তত্ত্ব সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারনার উপর গড়ে উঠেছে। দেখলে মনে হবে যেন, একটি সঠিক হলে অন্যটি সঠিক হতে পারে না। কিন্তু দুটো তত্ত্বই সকল প্রকার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় ইতিমধ্যেই নির্ভুল প্রমাণিত । বিজ্ঞানীরা যখন অতিক্ষুদ্র কোন কিছুর আচরণ ব্যাখ্যা করেন তখন তারা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্য নেন। আবার বড় থেকে শুরু করে অতি-বৃহৎ কিছুর আচরণ ব্যাখ্যা করার জন্য আপেক্ষিক তত্ত্বকে কাজে লাগান।

সমস্যা হল, এভাবে কিন্তু সব কিছুর ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। যেমন, ব্ল্যাক হোলের কথাই ধরা যাক। ব্ল্যাক হোলের কেন্দ্রে কি ঘটছে তা জানার জন্য আমাদের আপেক্ষিক তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম মেকানিক্স দুটোই ব্যাবহার করতে হবে। কারণ ব্ল্যাক হোলের প্রচণ্ড ভর, স্থান-কালকে এমনভাবে বাকিয়ে দেয় যে, সেখানে আপেক্ষিক তত্ত্বের সমীকরণ ভেঙ্গে পরে। আর ব্ল্যাক হোলের ভেতরটায় পদার্থ কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে না; ভেঙ্গে চুরে এমন অবস্থায় থাকে যে, কোয়ান্টাম মেকানিক্স ছাড়া সেই অবস্থা ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। তবে এত বিশাল ভরের বস্তুকে ব্যাখ্যা করার জন্য’তো আপেক্ষিক তত্ত্বেরও দরকার। ফলে এমন পরিস্থিতিতে আমাদের একই সাথে কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও আপেক্ষিক তত্ত্ব দুটোরই প্রয়োজন হয়।

আবার সৃষ্টির একদম শুরুতেও আপেক্ষিকতার তত্ত্ব কাজ করে না। শুরুটা ছিল একই সাথে একটি কোয়ান্টাম ঘটনা ও স্থান-কালের বক্রতার সৃষ্ট । সেই সময়টা ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদের দুটি তত্ত্বকে একইসাথে প্রয়োগ করতে হবে।
আর দুটি তত্ত্ব এমনই যে এদের একসাথে কোথাও প্রয়োগ করা যায় না। এই তত্ত্ব দুটি শুধু ভিন্ন বিষয়ই ব্যাখ্যা করে না,এদের মূল ধারনাগুলোও একদম বিপরীত। আপেক্ষিক তত্ত্বে বলকে ব্যাখ্যা করা হয় স্থান-কালের জ্যামিতির সাহায্যে। সেখানে কোয়ান্টাম মেকানিক্স মতে বলগুলো কার্যকর হয় কিছু ক্ষুদ্র কণিকার বিনিময়ের দ্বারা। আপেক্ষিক তত্ত্বের সাহায্যে যেকোনো গ্রহ নক্ষত্রের গতি ও অবস্থান একদম নিখুঁতভাবে ভবিষ্যৎবাণী করা যায়। আর কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটি মূল নিয়ম হল অনিশ্চয়তা নীতি। ফলে বোঝাই যাচ্ছে এদের সবকিছুই একদম বিপরীত। কোয়ান্টাম জগতে সাধারণ পদার্থবিজ্ঞানের কোন নিয়মই প্রযোজ্য নয়, আবার বস্তু জগত ও মহাবিশ্বের বৃহৎ মাত্রিক গঠন ব্যাখ্যা করতে গেলে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ধারণাগুলোর কোন দামই নেই। তাই প্রকৃতিতে আসলে কি ঘটে চলছে আমরা সত্যিই জানি না।

ব্ল্যাক হোল বা সৃষ্টির মুহূর্ত সম্পর্কে ভালমতো জানতে হলে, কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও আপেক্ষিক তত্ত্বকে সমন্বিত করা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু কাজটি কিন্তু মোটেও সহজ নয়। বিজ্ঞানীরা অনেক চেষ্টা করেও তা করতে পারছেন না। তবে একমাত্র স্ট্রিং থিওরিই পারে কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও আপেক্ষিক তত্ত্বকে সমন্বিত করতে।

এই দুটি আপাত বিরোধী তত্ত্বকে কেন সমন্বিত করা যাচ্ছে না তা বুঝতে হলে , প্রকৃতির চারটি মৌলিক বল, কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও আপেক্ষিক তত্ত্ব সম্পর্কে ভালমতো জানতে হবে। বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে তিনটি বলের জন্য কোয়ান্টাম তত্ত্ব গঠন করে, এদের সমন্বিত করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু এই তিনটি বলের সাথে মহাকর্ষ বলকে কোনভাবেই একীভূত করা যাচ্ছে না। ফলে পদার্থবিজ্ঞানের পরবর্তী পদক্ষেপ হবে, মহাকর্ষের জন্য একটি কোয়ান্টাম তত্ত্ব গঠন করে প্রকৃতির চারটি মৌলিক বলকে একীভূত করা।

মূলত মহাকর্ষের জন্য একটি কোয়ান্টাম তত্ত্ব গঠন করাটাই আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন প্রকৃতির বলগুলোকে একীভূত করে একটি চূড়ান্ত তত্ত্ব গঠন করতে পারলে আমরা মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য জানতে পারব। শুধুমাত্র এই একটি তত্ত্ব দিয়েই মহাবিশ্বের সকল ভৌত ঘটনার ব্যাখ্যা করা যাবে। এজন্য এই তত্ত্বকে বলা হয় সবকিছুর তত্ত্ব(Theory of Everything)।

স্ট্রিং থিওরিকে বোঝা মানে আমরা যে বাস্তবতায় বাস করি তার মুল সুরটাকে বুঝতে পারা। আমরা যে মহাবিশ্বে বাস করি এর পাশাপাশি কি প্যারালাল ইউনিভার্স বা সমান্তরাল মহাবিশ্বের অস্তিত্ব আছে? প্রকৃতিতে কি শুধুমাত্র এক সেট নিয়ম কার্যকর নাকি অসীম সংখ্যক ? আমাদের মহাবিশ্বে কেন এই নিয়মগুলোই খাটে, কেন অন্য কোন নিয়ম নয় ? ভবিষ্যৎ বা অতীতে ভ্রমণ কি সম্ভব ? আমাদের মহাবিশ্বে কতগুলো মাত্রার অস্তিত্ব আছে? পদার্থবিদরা মূলত এইসব প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে যাচ্ছে। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে আমরা দেখব, কিভাবে মহাকর্ষকে অন্য বলগুলোর সাথে সমন্বিত করে একটি সবকিছুর তত্ত্ব গঠন করা হয়েছে। আর এই তত্ত্ব সত্যিই সবকিছুর তত্ত্বের দাবীদার কিনা ! তবে তার আগে আমাদের প্রকৃতির চারটিও মৌলিক বল, আপেক্ষিক তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম মেকানিক্স সম্পর্কেও ভালমতো জেনে নিতে হবে ।

বিঃদ্রঃ লিখাটি মূলত স্ট্রিং থিওরি নিয়ে একটি বইয়ের জন্য লিখা। তাই আকারে একটু বড় হয়ে গেল। সময়ের অভাবে ব্লগ পোস্ট উপযোগী করে দিতে না পারার জন্য দুঃখিত। পরবর্তী পোস্টে নিউটনের তত্ত্ব ও আপেক্ষিক তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা থাকবে।