বর্তমানের আধুনিক মানবগোষ্ঠী যে ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আদিম মানবগোষ্ঠিরই বিবর্তিত উন্নত রূপ তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না | এই কালের বুদ্ধিমান মানুষ নিরন্তর বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করে চলছে অভুতপূর্ব সব নতুন প্রযুক্তি আর উন্নত কলা-কৌশল ! এখন মানুষের জীবনযাত্রা বিবিধ প্রকারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রযুক্তি-নির্ভর ! তবে একদিকে যেমন মানুষ আধুনিক প্রযুক্তিকে গ্রহণ করছে তাদের জীবন-যাত্রায় আরাম-আয়েস বর্ধন সহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে, সেই সাথে বেশিরভাগ মানুষই আবার তাদের ইহগাগতিক জীবনের সমৃদ্ধি লাভের আশায় আর কল্পিত পারলৌকিক জীবনের মঙ্গল কামনায় কোন না কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মেরও সমর্থক ও প্রতিপালক! এই পৃথিবীতে মানুষের উৎপত্তির ইতিহাসের তুলনায় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলির উৎপত্তির ইতিহাস খুবই নবীন হলেও কোন অতিপ্রাকৃত, মহাক্ষমতাশালী দৈব নিয়ন্ত্রকের প্রতি মানুষের আস্থাশীলতার ইতিহাস বহু প্রাচীন !

উন্নত মস্তিষ্কের কারণে মানুষ অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় অধিক সংবেদনশীল ! এই সংবেদনশীলতার কারণে মানুষের সমস্যাও অন্তহীন ! এই অন্তহীন সমস্যায় জর্জরিত অসহায় মানুষ একসময় কল্পনা করেছে অতিপ্রাকৃত সব সমস্যার সমাধানকারী মহাক্ষমতাবান দেবতার – যাদের নাম ঈশ্বর, আল্লাহ, ভগবান বা জিহোভা ! আর পরবর্তীকালে এই সকল দেবতাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সব ধর্মমত (যদিও গৌতম বুদ্ধের প্রচারিত দর্শন ছিল ঈশ্বর নিরপেক্ষ কিন্তু কালক্রমে তার অনুসারীরা তাকে ঈশ্বর বানিয়ে তাঁর দর্শনকে এক প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে পরিণত করেছে) ! প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম সম্বন্ধে বিখ্যাত মানবতাবাদী দার্শনিক বার্ত্র্যান্ড রাসেল (Bertrand Russell)-এর একটি উক্তি খুবই প্রণিধানযোগ্য, “Religion is something leftover from the infancy of our intelligence. It will fade away as we adopt reason and science as our guidelines”. বাংলায় এর আক্ষরিক অনুবাদ: ” আমাদের বুদ্ধির শৈশাবস্থার পরিত্যেক্ত কিছুই হল ধর্ম ! যখন আমরা যুক্তি এবং বিজ্ঞানকে আমাদের চালিকাশক্তি হিসাবে গ্রহণ করব তখন এটি ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে”| মানব বিবর্তনের ইতিহাসে এমন সময় অতিক্রান্ত হয়েছে যখন মানুষের মধ্যে যুক্তিবাদের চর্চা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছিল অনুপস্থিত – তখন মানুষের বুদ্ধি ছিল অঙ্কুরিত অবস্হায়, বা অন্যভাবে বলা যায় যে তখন ছিল মানববুদ্ধির শৈশাবস্থা ! কিন্তু তখনও কিছু মানুষ তাদের চারপাশের জগৎ ও জীবনকে কোন না কোন ভাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে, কিন্তু তাদের সেই ব্যাখ্যার ভিত্তি ছিল যুক্তি ও বিজ্ঞানের পরিবর্তে কিছু মানুষের মনগড়া কল্পনা – তাই বর্তমানের বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলির মধ্যে নানা বিষয়ে ব্যাখ্যার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান দেখা যায় ! বার্ত্র্যান্ড রাসেল তাঁর এই উক্তিটির মাধ্যমে বলতে চেয়েছেন যে মানুষ যখন কোন ঘটনা বা বিষয়ের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মনগড়া কল্পনার পরিবর্তে যুক্তি ও বিজ্ঞানকে ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করবে তখন ক্রমশ এই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলির বিলুপ্তি ঘটবে !

তবে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলির ভিত্তি যতই যুক্তিহীন বা কল্পনানির্ভর হোক না কেন এই বর্তমান যুগেও অধিকাংশ মানুষের কাছেই এই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলির কোন একটি তাদের জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত ! যেহেতু প্রায় সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তা হলো “ঈশ্বর”, তাই কোন একটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসী একজন মানুষ একই সাথে ঈশ্বরবিশ্বাসীও ! এখনো এই পৃথিবীর বহু দেশেই এই অদৃশ্য -অপ্রমাণিত-কাল্পনিক ঈশ্বরের প্রতি অবিশ্বাসকে অপরাধ বলে গন্য করা হয় ! উদাহরণ হিসাবে সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশের তিন ব্লগারের গ্রেপ্তারের ঘটনা উল্লেখযোগ্য ! কয়েক বৎসর পূর্বে দাউদ হায়দার ও তসলিমা নাসরিনকে দেশ থেকে বিতারিত করা হল! তাদের অপরাধ ছিল যে তারা ধর্ম ও ঈশ্বর নিয়ে কিছু যোক্তিক প্রশ্ন তুলেছিল !

১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইন-এর বিবর্তনবাদ প্রচারের আগ পর্যন্ত মানুষ মনে করত (দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এখনো কিছু মানুষ তা মনে করে !) যে মানবজাতি অন্যান্য প্রাণী থেকে বিচ্ছিন্ন স্বতন্ত্র এক অতি উন্নততর প্রাণী এবং তারা ঈশ্বর কর্তৃক ঈশ্বরের আদলে সৃষ্ট ! কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে আমরা এখন জানি যে মানুষের মৌলিক শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ অন্য সকল প্রাণীর সাথে সম্পর্কযুক্ত ! কেবল মানুষের উন্নততর মস্তিষ্কের কারণে তারা অধিকতর চিন্তাশীল প্রাণী, আর তার এই চিন্তাশীলতা তাকে অন্যান্য প্রাণী থেকে কিছুটা স্বাতন্ত্র দান করেছে! মানব বিবর্তনের ইতিহাসে মানুষের মনে চিন্তাশীলতার উন্মেষের সাথে সাথে তার মনে তার চারপাশের জগৎ ও তার নিজের জীবনকে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছ! সেই সময়ের কিছু বুদ্ধিমান মানুষ কল্পনার আশ্রয় নিয়ে সেই অজানার উত্তর দিতে চেষ্টা করেছে – তার চারপাশের জগৎ সৃষ্টির কারণ হিসাবে এক মহাশক্তিধর ঈশ্বরের সৃষ্টি করেছে – মানুষের অজানার অনেক কল্পিত উত্তর সেই সময়ের সেই চতুর মানুষেরা ঈশ্বরের প্রেরিত বাণী বলে প্রচার করেছে এবং কালক্রমে তাহাই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে পরিণত হয়েছে ! কিন্তু সমাজের সেই কিছু সংখ্যক চতুর লোকের বিপরীতে সব সময়েই কিছু মানুষ ছিল যারা একদিকে যেমন ছিল সুক্ষ পর্যবেক্ষনশীল ও বুদ্ধিমান অপরদিকে ছিল সৎ (সত্যের প্রতি নিষ্ঠাবান )! তারা তাদের চারপাশের জগৎকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ এবং সেই সাথে নানা বিষয়ে কিছু কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে শুরু করেন! এইভাবে ক্রমে ক্রমে কল্প-কাহিনী আর অন্ধ বিশ্বাসের বিপরীতে যুক্তি (কার্য-কারণ) ও পরীক্ষা নির্ভর (বিজ্ঞান) জ্ঞানের উন্মেষ ঘটতে শুরু করল ! মানুষ একসময় পৃথিবীর বয়স জানতে বাইবেলের আশ্রয় নিত এবং বাইবেল অনুসারে পৃথিবীর বয়স হল মাত্র ৬ হাজার বৎসর ! কিন্তু এখন ভূতত্ববিজ্ঞানের ক্রম উন্নতির ফলে আমরা জানি পৃথিবীর বয়স ৪৫০ কোটি বৎসর ! বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারের পূর্ব পর্যন্ত মানুষের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ ছিল না – কেবল অন্ধ বিশ্বাসের উপর ভর করেই জীবন চলত, আর এখন পৃথিবীব্যাপী প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন! বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির বিকাশের পূর্বে খাদ্যের অপ্রতুলতা আর চিকিৎসা বিজ্ঞানের অঙ্কুরাবস্থায় মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৩০ বৎসর, আর এখন খাদ্যের প্রাচুর্য আর চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে (যদিও পৃথিবীব্যাপী অসাম্যের কারণে এখনো অনেক মানুষ পর্যাপ্ত খাদ্য আর আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত) মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭০ বৎসর ! এই সবই সম্ভব হয়েছে অন্ধবিশ্বাসের বিপরীতে সমাজের কিছু সংখ্যক মানুষের মুক্তবুদ্ধির চর্চার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করাতে !

মানুষ কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করে ?
হাতিয়ার বিহীন মানুষ আত্মরক্ষায় অন্যান্য অনেক প্রাণীর তুলনায় অনেক বেশি অসহায় ! প্রাচীনকালে অসহায় আদিম মানুষ প্রায়শই অন্যান্য হিংস্র প্রাণীর আক্রমনের শিকার হয়ে তাদের খাদ্যে পরিণত হত ! প্রাচীন মানুষ তাকে ভাগ্য হিসাবে মেনে নিত ! প্রাকৃতিক নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা তাদের আন্দোলিত করত ! এই সকল ঘটনা মানুষ ব্যাখ্যা করতে পারত না ! তারা ক্রমশ ধারণা করতে শুরু করল যে কোন অদৃশ্য অতিপ্রাকৃত সত্বা এই সকল কার্যকলাপের নিয়ন্ত্রক ! এই অদৃশ্যমান কাল্পনিক নিয়ন্ত্রককে মানুষ এক সময় ঈশ্বর রূপে ভাবতে শুরু করল ! মানব বিবর্তনের লক্ষ লক্ষ বৎসরের পথ পরিক্রমায় এই ঈশ্বরের ধারণা ক্রমে ক্রমে মানব মস্তিষ্কের অংশ বিশেষে পরিণত হয়ে যায় ! কালক্রমে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের কাছেই এই “ঈশ্বর”-এর ধারনাটি শ্বাস -প্রশ্বাস গ্রহণ বর্জন বা একটি শিশুর কাছে তার মাতৃভাষা শিক্ষার মতই একটা সহজাত বিষয়ে পরিণত হয়ে যায় ! ” আপনি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?” – এই প্রশ্ন কাউকে করলে এখনো অধিকাংশ মানুষই একে এক আজগুবি প্রশ্ন হিসাবে বিবেচনা করবেন এবং অবাক হবেন – আবার অনেকে হয়ত উত্তরে বলবেন ” ঈশ্বর আছেন বলেই তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন” ! কিন্তু প্রশ্ন হল – সত্যই কি ঈশ্বর বলে এমন কোন অতিপ্রকৃত সত্ত্বার অস্তিত্ব আছে যিনি এই বিশ্বের সবকিছুর নিয়ন্ত্রক – যাঁর খেয়াল-খুশি অনুসারে এই জগৎ-সংসারের সব কিছু ঘটে থাকে? যিনি কখনো কোন মানুষের প্রতি অকাতরে করুণা বর্ষণ করেন আবার কারো প্রতি অকারণেই রুষ্ট হন ? যাঁর কাছে অর্ঘ্য নিবেদন করে বা প্রার্থনা করে তাঁর কৃপা-দৃষ্টি লাভ করা যায় ? যুক্তি আর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নির্মোহভাবে এই জগতের যাবতীয় ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে এমন কোন ক্রিয়াশীল ঈশ্বরের অস্তিস্বের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানো সত্যিই কঠিন কাজ বৈ কি ? ধরা যাক বিভিন্ন ধর্মে বর্ণিত ঈশ্বরের কথা – হিন্দুধর্মের ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর – যাঁদের বলা হয় সৃষ্টি, স্থিতি আর বিনাশের দেবতা – তার সাথে আছে আরো কোটি কোটি উপদেবতা- হিদুরা তাদের পূজা করে, তাদের কাছে হৃদয়ের সবটুকু আবেগ দিয়ে প্রার্থনা করে – কিন্তু সত্যিই কি ঈশ্বর সাড়া দেন তাদের সেই আবেদন আর নিবেদনে? একসময় বাংলাদেশে কলেরা আর গুটিবসন্ত মহামারী আকারে দেখা দিত -গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত – ঈশ্বর বিশ্বাসীরা (প্রায় সব মানুষ) মনে করত এটি রুষ্ট দেবতার মানুষের প্রতি বিরাগের বহি:প্রকাশ! হিন্দুরা গ্রামে গ্রামে শীতলা দেবীর পূজা করত, মুসলমানেরা মসজিদে মসজিদে আল্লার কাছে করুণা ভিক্ষা করত! কিন্তু কোন ঈশ্বর বা আল্লাহ কি এই রোগের বিনাশ করেছেন? মানুষ কলেরা থেকে মুক্তি পেয়েছে বিশুদ্ধ পানীয় জলের সুব্যবস্থার ফলে, আর পৃথিবী থেকে গুটি বসন্তের নির্মূল হয়েছে এডওয়ার্ড জেনার (Edward Jenner)-এর গুটি বসন্তের টিকা আবিষ্কারের কল্যাণে ! বর্তমানকালে ক্যান্সার এক মারাত্বক ব্যাধি যার যথাযথ চিকিৎসা মানুষ এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি ! এই ভয়ঙ্কর ব্যাধিতে যখন কোন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে – মায়ের শোকের মাতমে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয় – চারপাশের সাধারণ মানুষের হৃদয়ও বেদনায় বিদীর্ণ হয় – কিন্তু সেখানে কল্পিত কোন ঈশ্বরের সাহায্য মিলে কি? ঈশ্বর বলে কোন কিছুর অস্তিস্ত্ব থাকলে নিশ্চয় তার দয়া মিলত !

কোন বিশ্বাসী হিন্দুর কাছে শ্রীরামচন্দ্র আর শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের মনুষ্য রূপ – তারা বিশ্বাস করেন এই দুইজন পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন মানুষের মঙ্গল তথা মানুষের মধ্যে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে – কিন্তু মানুষের ভগবান শ্রীরামচন্দ্র আর শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে অবহিত পৃথিবীর কয়জন মানুষ? এটি যেকোন চিন্তাশীল মানুষকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে যে সাড়া বিশ্বের মানুষের অবতার হয়ে যে কৃষ্ণ এই পৃথিবীতে এলেন আর তিনি কেবল নিজেকে আবদ্ধ রাখলেন মথুরা আর বৃন্দাবনে, আর মানুষের মঙ্গল সাধনের নিমিত্তে সময় ব্যয় করার পরিবর্তে কেবল শ্রী মতি রাধারানী আর হাজারো গোপিনীর সাথে লীলাখেলা করে জীবন কাটিয়ে দিলেন ? সবজান্তা ভগবান শ্রীরাম চন্দ্র জানতেই পারলেন না তাঁর স্ত্রী সীতারানীকে যখন অপহরণ করে নিয়ে গেল লঙ্কার পাপিষ্ঠ রাক্ষসরাজা রাবন, ভগবানের স্ত্রী সীতাকে উদ্ধারের জন্য সর্বশক্তির অধিকারী শ্রীরামকে রাবনের সাথে যুদ্ধ করতে হল বানর সৈন্য সঙ্গী করে – আর তিনি হলেন মানব মুক্তির সাক্ষাৎ অবতার, এটি যুক্তিমান যে কোন মানুষের পক্ষেই মেনে নেয়া কষ্টকর নয় কি ?

সর্বশক্তিমান মহান আল্লার প্রেরিত পয়গম্বর হিসাবে দাবিদার মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) সমস্ত পৃথিবীর মানুষের হেদাহেতের উদ্দেশ্যে এসে সারাজীবন কেবল যুদ্ধ করে কাটালেন মক্কা আর মদিনায় ! তিনি দাবি করেন আল্লাহ তাঁর ফেরেস্তার মাধ্যমে তাঁর কাছে পাঠিয়েছেন মানুষের জন্য সব মহান বাণী যা পরবর্তী কালে প্রকাশিত হল আল কোরান নামে ! কিন্তু যে কোন মুক্তবুদ্ধির মানুষের মনে এই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে আল্লাহ কেন তাঁর বাণী পাঠালেন শুধু মাত্র একটি দেশে (সৌদি আরবে), একটি ভাষায় (আরবি)এবং কেবলমাত্র একজন মানুষের কাছে ? সর্বশক্তিমান আল্লাহ কি পারতেন না পৃথিবীর সকল প্রান্তে একজন করে নবী পাঠিয়ে বিভিন্ন ভাষায় তাঁর সেই বাণী পাঠাতে? তাহলে প্রত্যেকটি মানুষ তাদের নিজের ভাষায় অবিকৃতভাবে এই মহান আল্লার বাণী বুঝতে পারত ? আর আল্লার পক্ষ কি এই কাজটি করা খুব কঠিন ছিল ? এতে করে কারো মনে কি এই প্রশ্ন জাগা অস্বাভাবিক যে মহানবী মুহাম্মদ ((স) যাকে আল্লার বাণী বলে প্রচার করলেন তা কি সত্যিই মহান আল্লার পাঠানো বাণী নাকি তা মহানবীর নিজের তৈরী করা কাহিনী ?

এটা যে কোন মুক্তবুদ্ধির মানুষের মনে প্রশ্নের জন্ম দিবে যে, যে যিশু খ্রিস্ট খ্রিস্টানদের কাছে ইশ্বরের পুত্র রূপে পরিগণিত সেই যিশু খ্রিস্টকেই ঈশ্বরদ্রোহীতার অপরাধে অপরাধী করে ক্রুশে বিদ্ধ করে হত্যা করবে আরেকদল ঈশ্বর বিশ্বাসী (ইহুদি ধর্মের) মানুষ, আর পুত্রের হত্যাকান্ডে পিতা ঈশ্বর স্বর্গে বসে নীরব দর্শকের ভুমিকা পালন করবেন ?

মহামতি বুদ্ধদেব জীবন আর জগতের রহস্য উদঘাটনের নিমিত্তে স্ত্রী -পুত্র পরিত্যাগ করে পথে পথে ঘুরে বেড়ালেন, সুকঠিন শারীরিক ত্যাগের সাধনা করতে গিয়ে ভারতের উরুবেলা এলাকার সেনা গ্রামের পার্শ্বে নিরঞ্জনা নদীর তীরে মৃত্যুমুখে পতিত হন এবং সেখানে সুজাতা নাম্নী এক গ্রাম্য বালিকার খাদ্যদানে তাঁর জীবন রক্ষা পায় ! সেদিন সেখানে যথা সময়ে সেই খাদ্য না পেলে হয়ত বুদ্ধদেব সেখানেই দেহ ত্যাগ করতে পারতেন আর তিনিই পরবর্তীকালে বৌদ্ধদের কাছে হয়ে গেলেন ভগবান বুদ্ধ, সেটি যেকোন বিশ্লেষণ ধর্মী মনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে এটাই স্বাভাবিক নয় কি ?

পৃথিবীব্যাপী ধর্ম বনাম মুক্তবুদ্ধি চর্চার সার্বিক চিত্র !
যদিও এখনো বিশ্বের কোন কোন দেশে (বিশেষ করে মুসলিম প্রধান অনেক দেশে) ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান লক্ষ্য করা যায় তবে সার্বিকভাবে পৃথিবীর অনেক দেশেই (বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক দেশে এবং অস্ট্রেলিয়ায়) প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অযৌক্তিক অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্ত ইহজাগতিক (secular) মানসিকতার (মুক্তবুদ্ধির) মানুষের সংখ্যা ক্রমাগতই বাড়ছে ! সেখানে মানুষ নিজেদের তথা সমাজের সার্বিক কল্যাণের জন্য কল্পিত ঈশ্বরের করুণা ভিক্ষা করার পরিবর্তে নিজেদের সুপ্ত শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে জাগতিক কর্ম-কান্ডে নিজেদেরকে নিরলস ভাবে নিয়োজিত করছে ! সেখানে অলৌকিক ঈশ্বর বা কল্পিত পরকালে বিশ্বাস স্হাপনের পরিবর্তে মানুষ ইহজাগতিকতা (secularism) কে ক্রমে ক্রমে ব্যক্তিগত ও সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠা করছে ! সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম একেবারে বিলুপ্ত না হয়ে গেলেও তা ক্রমে ক্রমে মানবিক ধর্মের রূপ লাভ করছে! উদাহরণ হিসাবে পৃথিবীর অন্যতম মুক্তচিন্তার দেশ যুক্তরাজ্যে সাম্প্রতিক কালে প্রতিষ্ঠিত ধর্ম-নিরপেক্ষ গীর্জার কথা উল্লেখযোগ্য ! সেখানে প্রচলিত ধর্মে ও ঈশ্বরে অবিশ্বাসী দুই বিখ্যাত কমেডিয়ান Sanderson Jones ও Pippa Evans খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি রবিবারের গির্জার সম্মিলনের ধর্মীয় দিকটি বাদ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ঈশ্বর বিহীন সম্মিলন (godless congregation) – যার সাধারণ উদ্দেশ্য হল মানুষের বেঁচে থাকার আনন্দকে উদযাপন করা আর বিশেষ উদ্দেশ্য হল ধর্ম নিরপেক্ষভাবে মানুষের সুপ্ত শক্তির সর্বোচ্চ বিকাশ ও প্রয়োগের মাধ্যমে একটিমাত্র মানব জীবনকে সর্বোত্তম ভাবে উপভোগ করার জন্য মানুষকে সাহায্য করা ! রবিবারের সেই সম্মিলনে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের উন্নতির লক্ষ্যে কোন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, কোন বিশেষ লেখকের লিখা থেকে পাঠ করা হয়, কিছু সময়ের জন্য তারা আত্ম-নিমগ্ন চিন্তা (contemplation)-য় নিয়োজিত হন, সেখানে আনন্দ বর্ধনকারী সঙ্গীত পরিবেশিত হয়, এবং শেষে থাকে হালকা খাবার পরিবেশনার সাথে সকল অংশগ্রহণকারীর মিথস্ক্রিয়ার ব্যবস্থা ! ধম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মত ও পথের মানুষের জন্য এই মানব সম্মিলনের দ্বার থাকে উন্মুক্ত ! মাত্র ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ধর্ম নিরপেক্ষ ( religion- neutral) ও ইহজাগতিক (secular) মানব সম্মিলনের শাখা এখন যুক্তরাজ্য, আয়ার্ল্যান্ড, আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়ার ২৮ টি শহরে বিস্তৃত !

যারা প্রচলিত ধর্মের কোন একটিকেও যুক্তি বা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মেনে নিতে পারছেন না তারা এর থেকে বের হয়ে এসে নানা মত আর পথের সন্ধানে ব্যস্ত ! সেই দলে আছেন একেবারে পুরাপুরি নাস্তিক (Atheists) থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইহজাগতিক মানসিকতার মানুষ ! একত্রে এই সকল মানুষদের বলা হয় “nones” , অর্থাৎ তারা হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান, বাহাই, শিখ ইত্যাদি কোন ধর্মেরই অন্তর্ভুক্ত নন বা কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকেই পরোয়া করেন না (Apatheists) – এক কথায় তারা মুক্তমনা বা মুক্তবুদ্ধির মানুষ্ ! বর্তমানে সারা বিশ্বব্যাপী এই ধরনের মানুষের সংখ্যা কোন কোন প্রধান প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অন্তর্ভুক্ত মানুষের সংখ্যার চেয়ে বেশি ! সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে যে যুক্তরাজ্যের ৫০ শতাংশ মানুষ কোন একটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অন্তর্ভুক্ত নন ! পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এই ধরনের মুক্তমনা মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলছে ! আজ থেকে এক দশক আগেও পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ মানুষ নিজেদেরকে ধর্মীয় (religious) বলে দাবি করত, বর্তমানে তারা ৬০ শতাংশ, এবং বর্তমানে পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ দেশেই যারা কোন ধর্ম মানেন না (nones) এমন লোকের সংখ্যা ধর্মীয় লোকদের সংখ্যার চেয়ে বেশি ! আয়ার্ল্যান্ডের মত দেশে যেখানে এক সময় ধর্মের প্রভাব ছিল প্রচন্ড, সেখানে এখন nones দের সংখ্যাধিক্য ! ২০০৫ সালের জরিপে দেশটির ৬৯ শতাংশ মানুষ বলেছিল তারা ধার্মিক, কিন্তু বর্তমানে তাদের সংখ্যা মাত্র ৪৭ শতাংশ! যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে পশ্চিম ইউরোপের অংশ বিশেষ (যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স), অস্ট্রেলিয়া, ক্যানাডা, নিউজিল্যান্ড ইহজাগতিক দেশে পরিণত হয়েছে কিন্তু বাকি দেশগুলোতে তখনও ধর্মীয় অনুভুতির প্রাধান্য বিদ্যমান ছিল, এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত ও প্রচারিত (যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন) নাস্তিকতাও সাধারণ মানুষকে তেমনভাবে ছুঁতে পারেনি ! এমনকি বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকেও বিভিন্ন দেশে মৌলবাদ আবার মাথাঝাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে, অনেক দেশে ইসলাম এক রাজনৈতিক শক্তিরূপে জেগে উঠে, এমনকি আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রেও ধর্মকে জিয়িয়ে রাখে ! কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে গত ২০ বৎসরে পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি সমাজে ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমতে শুরু করেছে ! যদিও বর্তমান স্থানে স্থানে মৌলবাদ আবারও প্রবল হচ্ছে কিন্তু সার্বিকভাবে আগে যেখানে (ব্রাজিল, আয়ার্ল্যান্ড, এমনকি আফ্রিকার অনেক দেশে) ধর্ম ছিল প্রবল শক্তিশালী সেখানে এখন ইহজাগতিকতা (secularism) ক্রমেই প্রাধান্য বিস্তার করতে শুরু করেছে !

ক্যানাডার ভ্যাঙ্কুভারের ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্বের অধ্যাপক ড: আরা নরেন্জায়েন (Ara Norenzayan) এর মতে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ইহজাগতিকতার (secularization) এক শক্তিশালী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে , পশ্চিম ইউরোপ (যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন), উত্তর ইউরোপ (ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যাণ্ড), ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান এবং চীনে ইহজাগতিকতার চর্চা ক্রমেই বেড়ে চলছে ! এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশ যেখানে খ্রিস্টধর্ম গভীর শিকড় গেড়ে আছে সেখানেও ধর্মের সাথে যাদের সম্পৃক্ততা নেই এমন মানুষের সংখ্যা যেখানে ১৯৭২ সালে ছিল মাত্র ৫ শতাংশ বর্তমানে তাদের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০ শতাংশ, এবং ৩০ বৎসরের নিচে তরুণ-তরুনীদের মধ্যে এই সংখ্যা প্রায় ৩৩ শতাংশ ! তবে তাদের মধ্যে যদিও সবাই এমন নয় যে তারা ধর্ম একেবারেই মানেন না ( যেমন কিছু কিছু মানুষ প্রচলিত ধর্মে বা ধর্মের ঈশ্বরে বিশ্বাস না করলেও তারা অধ্যাত্বিকতায় বা ধর্ম নিরপেক্ষ কোন এক মহাশক্তিতে আস্থাশীল), তবে যারা নিজেদেরকে একেবারে নাস্তিক বলে দাবি করেন পৃথিবীজুড়ে এমন লোকের সংখ্যাও বর্তমানে ১৩ শতাংশ এবং সেই হিসাবে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ কোটি মানুষ কোন ধর্ম বা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না এবং প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ যেকোন কারণেই হোক নিজেদেরকে অধার্মিক (irreligious) বলে দাবি করেন ! আজ থেকে এক শতাব্দী আগেও এমনটি কল্পনাও করা যেত না ! সমাজ বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা বিজ্ঞানী এমিল ডুরখিম (Emile Durkheim) ও ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber) প্রত্যাশা করেন যে বৈজ্ঞানিক চিন্তার (scientific thinking) বিকাশের মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে ধর্মের ক্ষয় হতে হতে এক সময় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলির মৃত্যু ঘটবে! এই বিজ্ঞানীদ্বয় বর্তমানে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে মানবতাবাদী (humanist), যুক্তিবাদী (rationalist) ও মুক্তচিন্তার (free thought) প্রসারের নিমিত্তে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিষ্ঠার মধ্যে বিশ্বব্যাপী ইহজাগতিকতার বিপ্লব (secular revolution) দেখতে পাচ্ছেন !

ধর্মে আস্থাহীনতা বা ঈশ্বরে অবিশ্বাস কি মঙ্গলজনক বা অমঙ্গলজনক ?
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে বা ধর্মবিশ্বাসীরা মনে করে থাকেন যে ঈশ্বরে বা ধর্মে বিশ্বাস না করলে এই পৃথিবী দুঃখ-দারিদ্র, অমঙ্গল আর অশান্তিতে ভরে যাবে এবং মানুষের মাঝে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে, কিন্তু বাস্তব চিত্র কি বলে ? বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, যে সকল দেশে ক্ষুধা-দারিদ্র-দূর্নীতি-অপরাধ বেশি সে সকল দেশে ধর্ম- ও ঈশ্বরে-বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যাও বেশি! বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় – যেখানে অভাব-দারিদ্র বেশি সেখানে মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করে সান্তনা পেতে চেষ্টা করে, আবার এটাও ঠিক যেহেতু ঈশ্বরে বিশ্বাস সাধারণত মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি তাই মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাসী হয়েও দূর্নীতি বা অপরাধে লিপ্ত হতে দ্বিধাবোধ করে না! আবার তারা পরকাল ও ঈশ্বরে বিশ্বাসের কারণে এই জগতের, এই জীবনের উন্নতির প্রতি থাকে নির্লিপ্ত ! তারা চেষ্টা বা পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থার পরিবর্তনের পরিবর্তে ঈশ্বরের কাছে আরাধনার মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টায় নিমগ্ন হয় – ফলে নিজের উন্নতি- দেশের উন্নতি কোনটাই হয়ে উঠে না! অপরদিকে যে সকল দেশে যুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষায় মানুষ শিক্ষিত সেখানে মানুষ অলৌকিক ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীলতার পরিবর্তে আত্মশক্তির বিকাশ ও প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে সচেষ্ট হয় – এবং সেই সকল দেশ আজ সব দিক থেকেই উন্নত ! কাজেই সত্যিকারের বিজ্ঞান আর বিশ্লেষনাত্বক শিক্ষার মাধ্যমে যে দেশে মানুষ সত্যিকার ভাবে শিক্ষিত হয় সেখানে স্বাভাবিক ভাবেই ধর্মে ও অলৌকিক ঈশ্বরের প্রতি মানুষের আস্থা ধীরে ধীরে কমে যায় (তবে জোর করে মানুষকে ধর্মে অবিশ্বাসী বানালে তার ফলাফল ঠিকসই হয় না, যেমনটি হয়ে ছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে) এবং স্বভাবতই তারা ভাল মানুষে পরিনত হয়! পৃথিবীর যে সকল দেশে মানুষের দৈহিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক নিরাপত্তা কম সেখানে ধর্ম- বা ঈশ্বর-বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা বেশি – একই ভাবে এটি কোন কাকতালীয় ঘটনা নয় যে পৃথিবীর সবচেয়ে কম ধার্মিক দেশগুলিতে মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা সবচেয়ে বেশি ! উদাহরণ হিসাবে ডেনমার্ক, সুইডেন ও নরওয়ের নাম উল্লেখযোগ্য! এই তিনটি দেশ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে অধার্মিক (irreligious) দেশ হিসাবে পরিচিত, কিন্তু তারা সেখানে সর্বসাধারণের জন্য সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য সেবা (universal healthcare) এবং উদার সামাজিক নিরাপত্তা (generous social security) নিশ্চিত করার মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী, স্থিতিশীল ও নিরাপদ দেশ হিসাবে পরিগণিত হয়েছে ! অপরদিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ধার্মিক দেশগুলি দরিদ্রতম দেশগুলির মধ্যে অন্যতম এবং বৈশ্বিক ধর্ম ও নাস্তিকতার সূচক (global index of religion and atheism) অনুসারে সেই সকল ধার্মিক দেশের দরিদ্রতম জনগোষ্ঠী হলো সবচেয়ে বেশি ধার্মিক ! সামাজিক গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে যে যখন কোন দেশে মানুষের মাঝে দারিদ্র, মানুষে মানুষে বৈষম্য ধীরে ধীরে কমতে থাকে, এবং মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পেতে থাকে সেখানে ধীরে ধীরে মানুষ ইহজাগতিকতার দিকে ঝুঁকতে থাকে! সাধারনভাবে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে যখন কোন সমাজে মানুষের সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত ভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে সেখানে ইহজাগতিকতাও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে ! উদাহরণ হিসাবে আয়ারল্যান্ডের নাম উল্লেখযোগ্য, সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে ধর্মের চর্চা কমতে শুরু করে! গত ২০ বৎসরে যুক্তরাষ্ট্রে আস্তে আস্তে ধর্মে অবিশ্বাসীদের সংখ্যা বাড়ছে ! এমনকি রাশিয়াতে সমাজতন্ত্রের পতনের পর ধর্ম বিশ্বাসীদের সংখ্যা বাড়লেও এখন মানুষ আবার ইহজাগতিকতার দিকে ধাবিত হচ্ছে ! ২০০৮ সালের এক জরিপে দেখা গেছে যে সেখানে ৮২ শতাংশ মানুষ ধার্মিক কিন্তু বৈশ্বিক ধর্ম ও নাস্তিকতার সূচক অনুসারে এই সংখ্যা ২০১২ সালে ছিল মাত্র ৫৫ শতাংশ !

ধর্মতত্ত্ববিৎ (Stephen Bullivant)-এর মতে মা-বাবার ধর্মমত দ্বারা সন্তান প্রভাবিত হয় ! ধার্মিক বাবা-মার সন্তান ধার্মিক হবার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ, কিন্তু যার মা-বাবা ধার্মিক নয় সেই সন্তানের ধার্মিক হবার সম্ভাবনা মাত্র ৩ শতাংশ ! তিনি আরো বলেন ধর্মে অবিশ্বাসী বাব-মার সন্তান ধর্ম বিশ্বাসী হবে এমন সম্ভাবনা প্রায় অসম্ভব, কিন্তু ধর্মে বিশ্বাসী মা-বাবার সন্তান ধর্মে অবিশ্বাস বা ইহজাগতিকতা বেঁচে নিবে এমন ঘটনা মোটেও অস্বাভাবিক নয় ! দেখা গেছে যে যুক্তরাষ্টে যারা এক খ্রিষ্টধর্মের কোন এক সম্প্রদায়ের সাথে একবার সম্পর্ক ছেদ করেছে তাদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ আবার অন্য কোন আর এক সম্প্রদায়ের সাথে যুক্ত হয়েছে ! বুলিভান্ট আরো বলেন একজন মানুষের ২৫-৩০ বৎসর বয়সের মধ্যেই নির্ণীত হয়ে যায় সে কতটা ধর্মবিশ্বাসী হবে ! কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের ৩০ শতাংশ তরুণ -তরুণী যারা ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত নন ভবিষ্যতে তাদের ধর্ম-বিশ্বাসী হবার সম্ভাবনা খুবই কম এবং তারা তাদের উত্তরসুরিদের মধ্যে তাদের এই ইহজাগতিক ধ্যান-ধারণার বিস্তার ঘটাবে ! সমাজ বিজ্ঞানী নরেন্জায়েন মনে করেন এই ভাবে ধীরে ধীরে পৃথিবীর সকল মানুষ একদিন ইহজাগতিকতা (secularism) বেঁচে নিবে !

এখন প্রশ্ন হল একদিন যদি পৃথিবী ধর্মশূন্য বা ঈশ্বর-বিহীন হয়ে যায় তখন এর পরিণতি কি হবে ? যদিও অনেকে এমনটি মনে করে থাকেন যে ধর্ম অনেকটা নৈতিক আঠা (moral glue)-র মত এই মানব সমাজকে একত্রে বেঁধে রেখেছে এবং এই ধর্ম থেকে মানুষের বিচ্চ্ছেদ ঘটলে সমাজে ধ্বস নামবে, কিন্তু পৃথিবীর বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণ করলে অন্য এক চিত্র ভেসে উঠে ! সমাজ বিজ্ঞানী ফিল জুকারম্যান (Phil Zuckerman) ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্টের ৫০ টি স্টেট সহ বিশ্বের সকল দেশ সমূহের একটি সার্বিক বিশ্লেষণ করেন যেখানে তিনি বিভিন্ন দেশের ধর্ম প্রবণতার সাথে সেই দেশের সামাজিক স্বাস্থ্য (societal health): সম্পদ (wealth), সাম্যতা (equality), নারীর অধিকার (women’s rights), শিক্ষা গ্রহণ (educational attainment), বাঁচার প্রত্যাশা (life expectancy), শিশু মৃত্যুর হার (infant mortality), কিশোরী গর্ভধারণের হার (teenage pregnancy), যৌন রোগের প্রকোপ (STI rates), অপরাধের মাত্রা (crime rates), আত্মহত্যার মাত্রা (suicide rates), ও খুনের মাত্রা (murder rates)-র একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেন ! এই গবেষণায় ফলাফলে দেখা যায় যে, যে সমাজ যত বেশি ইহজাগতিক (secular) সেখানে সামাজিক স্বাস্থ্য তত ভাল ! তবে তিনি বলেন যে এর অর্থ এই নয় যে কোন সমাজ ইহজাগতিক হয়ে গেলেই সেই সমাজে স্বতস্ফুর্ত ভাবে সামাজিক স্বাস্থের উন্নতি ঘটবে, বরং কোন দেশে কোন কাল্পনিক ঈশ্বরের প্রতি নির্ভরশীল না হয়ে মানুষের সুপ্ত শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে সুষ্ঠু সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সামাজিক স্বাস্থের উন্নতি ঘটাতে পারলে সেখানে স্বতস্ফুর্ত ভাবে মানুষ ক্রমে ক্রমে ইহজাগতিকতাকে গ্রহণ করবে ! তাঁর এই গবেষণা থেকে এটা বলা যায় যে, কোন দেশের সামাজিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য ধর্মে আস্থা বা ঈশ্বরে বিশ্বাস কোন আবশ্যিক বিষয় নয় ! তিনি মনে করেন মানুষের ইহজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি কোন দেশের সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক ভুমিকা পালন করতে পারে ! প্রথমত: যদি একজন মানুষ মনে করে যে এই পৃথিবীর জীবনই তার একমাত্র জীবন, মৃত্যুর পর আর কোন জীবন নেই তবে সে সর্বোচ্চ ভাবে চেষ্টা করবে তার এই জীবনকে আরো কত সুন্দর করা যায়, দ্বিতীয়ত: মানুষ যখন তার প্রাত্যহিক জীবনে ইহজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি (secular orientation) গ্রহণ করবে তখন সে বিজ্ঞানের প্রতি, শিক্ষার প্রতি জোর দিবে এবং যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবে – উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে সমাজকে অপরাধ মুক্ত করতে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার পরিবর্তে তার মূল কারণ উদঘাটন করে সেই কারণকে নির্মূল করার মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবে ! কাজেই এই পৃথিবী একদিন ধর্ম-হীন বা ঈশ্বর-বিহীন হয়ে গেলে অমঙ্গল আর অশান্তিতে এই পৃথিবী ভরে উঠবে এমন ধারণা এক অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়!

শেষ কথা
যদিও এই বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতির যুগে এসেও পৃথিবীর অনেক দেশই এখনও ধর্মান্ধতায় ডুবে আছে, ধর্মান্ধ মানুষেরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের সহায়তায় মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে রুদ্ধ করছে, মুক্তমনা বা মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হচ্ছে – এমনকি ধন্মান্ধ গোষ্ঠির হাতে প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিচ্ছে, তবু আশার কথা এই যে ইতিমধ্যেই পৃথিবীর বহু দেশ এই ধর্মান্ধতা থেকে মুক্তিলাভও করতে পেরেছে ! তবে যদিও এখনও অনেক উন্নত দেশেও অনেক মানুষই ধর্মের বেড়াজাল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারে নি, তবে তাদের মধ্যও অনেকেই মুক্তমন নিয়ে ধর্মের সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা উৎসবের দিকটাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে ! একদিকে যেমন তারা তাদের শোকে-দুঃখে এক অজানা মহাশক্তির কাছে আবেদন-নিবেদন করে অন্যদিকে আবার সহজাত ভাবেই বিজ্ঞানের দেয়া কলা-কৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের নিজের তথা চারপাশের জগৎকে উন্নত করতে সচেষ্ট হয় ! সমাজবিজ্ঞানী Norenzayan-এর মতে অনেক মানুষেরই ধর্মীয় বিশ্বাসের পিছনে গভীর মনস্তাত্বিক কারণ বিদ্যমান ! জীবনের কোন গভীর সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়ে মানুষ যখন প্রচন্ড হতাশ হয়, গভীর শোকে (যেমন আপনজন বা প্রিয়জনের মৃত্যুতে) মানুষ যখন আচ্ছন্ন হয়, তখন মানুষ ধর্ম বা কল্পিত ঈশ্বরের আশ্রয় নিয়ে সান্তনা খোঁজে ! এই সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন জীবনের অনেক গভীর সমস্যায়, শোকে-দুঃখে মানুষ কোন বিকল্প সান্তনার আশ্রয় না পাওয়া পর্যন্ত মানব সমাজে ধর্ম ও ঈশ্বর কোন না কোন ভাবে হয়ত ঠিকে থাকবে! তবে ধর্মের সামাজিক দিকটা পালন করেও, শোকে-দুঃখে এক মহা-দয়াশীল কল্পিত ঈশ্বরের কাছে নিজেকে নিবেদন করেও “সবার উপরে মানুষ সত্য” এই দর্শনকে জীবনে গ্রহণ করে মুক্তবুদ্ধি নিয়ে কর্মে নিয়োজিত হতে পারলে সবার জন্যই পৃথিবীতে এই মানব জীবন আরো সুন্দর আরো শান্তিময় হতে পারে!