বিবর্তনের বাঁকে বাঁকে
আকাশ মালিক
‘যে ব্যক্তি তার মেধা, বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জন ও বাগ্মিতাকে কুসংস্কার ও মিথ্যার পদতলে বলি দিয়ে বৌদ্ধিক বেশ্যাবৃত্তি করে, তার উত্তরসুরী না হয়ে আমি বরং সেইসব নিরীহ প্রাণীদের উত্তরসুরী হতে চাইবো যারা গাছে গাছে বাস করে, যারা কিচিরমিচির করে ডাল থেকে ডালে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ায়।’- হাক্সলি (Thomas Henry Huxley)
(শিরোনাম দেখে কেউ ভাববেন না যে, আকাশ মালিক বুঝি এবার জীববিজ্ঞান নিয়ে বসলো। জীববিজ্ঞান আমার পড়ার সাব্জেক্ট কোনদিন ছিলনা, আসলে কোন বিজ্ঞানই ভাল করে কোনকালে পড়া হয় নি। এ কোন গবেষণালব্ধ, কোন অনুসন্ধানী লেখা নয়, একে বরং আমার যত এলোমেলো ভাবনাই বলা যেতো। তবে কেন এই শিরোনাম? এই লেখাটাই সেই কৈফিয়ত)
বড়দিন ও নববর্ষ উৎসবে যেটুকু আনন্দ-উল্লাস বউ মিস করেন তার সবটুকু পুশিয়ে নেন ঈদ উৎসবে। ক্রিসমাসে ঘরের আলোকসজ্বা থেকে সকল আয়োজনের দায়ীত্বে থাকে ছেলে মেয়েরা, মিউজিক টেলিভিশন থাকে তাদের দখলে আর বউ থাকেন নীরব দর্শক। ঈদে হয় ঠিক তার উলটো। সবকিছু হয় বউয়ের প্লান-পছন্দ মোতাবেক। বাঙ্গালীর ঘরে বাংলাদেশের রাজনীতির আবহ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এখানে বউ প্রধানমন্ত্রী (একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী) স্বামী ঠুটো জগন্নাথ প্রেসিডেন্ট (সিগনেচারের মালিক) আর সন্তানেরা পাবলিক (রাষ্ট্রের উৎস)। গত ঈদটা একটু ব্যতিক্রমী ছিল। এতদিন মেয়েরা ঈদের দিনে সেলোয়ার কামিজ পরতো, গত ঈদে বউ আইন পাশ করলেন, এবার সবাই পরবে শাড়ি। তার বাঙ্গালী সনদ (মদিনার সনদ নয়) অনুযায়ী মেয়েরা শাড়ি পরার যোগ্য হয়ে গেছে। উপর তলায় বেডরুমে শাড়ি পরার রিহার্সেল হলো। শাড়ি পরা নাকি জগতের সব চেয়ে কঠিন শৈল্পিক বৌদ্ধিক কর্ম। শাড়ি পরে মেয়ে তিনটি সিড়ি বেয়ে নিচে আসার পথে এক পর্যায়ে আমাকে লক্ষ্য করে তাদের নানী বললেন, ‘দেখো যেন আসমান থেকে এক একটা চাঁদ নেমে আসছে’। আমি বললাম, হ্যাঁ মানুষ আসমান থেকে এসেছে, বিজ্ঞানীরা সেটাই আজ ভাবছেন। ‘আরে বাবা, বিজ্ঞানীরা ভাবছেন আজ, আর আমাদের রাসুল জানতেন দেড় হাজার বছর আগেই’। পঁচাত্তর বছর বয়েসী আমার শাশুড়ির সরলোক্তি। আমি আর কথা বাড়ালাম না। তিনি যখন তার চাঁদের হাট নিয়ে ব্যস্ত আমি তখন ভাবছি, এই যে সঙ্গবদ্ধ পরিবার, এই পারিবারিক নিয়ম-রীতি, শৃংখলা- বিশৃংখলা, হাসি-কান্না, বিরহ-বিচ্ছেদ, সুখ-দুঃখ, মায়া-ভালবাসা, প্রেম-যাতনা, হিংসা-বিদ্বেষ, ধর্ম-বিশ্বাস এ সব আমাদের পূর্বপুরুষের মাঝেও কি ছিল? কেমন ছিল তাদের জীবনধারা, তাদের জীবনপদ্ধতি? জীবজগতে অন্যান্য প্রাণীদের মাঝেও কি এ সব দেখা যায়? এই সম্পদ দখলদারিত্ব, অধিকার-বঞ্চণা, শাসন-শোষণ, ব্যবসা-বানিজ্য, লেনদেন-চুক্তি, ধিক্ষার- পুরুষ্কার, দান-প্রতিদান, লজ্বা-শরম এ সকল শব্দগুলোর উৎপত্তি কোন সময় থেকে? এমন আজগুবি চিন্তা, আনাড়ি প্রশ্ন আমার মাথায় খেলতো ছোটকাল থেকেই। উত্তর জানতাম না, জানার সুযোগ ছিলনা। এখন যতটুকু জেনেছি, দেখেছি, পড়েছি তাতে আমি নিশ্চিত মানুষ আর পশুদের মধ্যে জীবনাচরণগত পার্থক্য খুবই সামান্য। যারা রিচার্ড ডকিন্সের The Selfish Gene কিংবা জর্জ উইলিয়ামসের Adaptation and Natural Selection বই দুটো পড়েছেন, তারা আশা করি একমত হবেন যে, মানুষের প্রায় সকল দোষাবলি, গুণাবলি, বৈশিষ্টাবলি পশুদের মাঝেও বিদ্যমান আছে।
পশুদের মাঝেও সঙ্গবদ্ধ পরিবার, পারিবারিক নিয়ম-শৃংখলা, মায়া-ভালবাসা, প্রেম-অনুভুতি, মালিকানা-দখলদারিত্ব, হিংসা-ঝগড়া, ত্যাগ-ভক্তি, প্রতারণা-ধোকাবাজি, পরকিয়া, বহুগামিতা, সমকামিতা, রূপচর্চা, সেন্স অফ বিউটি, সেবা-যত্ন, নার্সিং, হেল্পিং, ফস্টারিং, চাতুরি-ছলনা, অন্নহীনকে অন্ন দান, পঙ্গুদের ঘরে বসায়ে খাওয়ানো, অন্ধকে পথ দেখানো সবই আছে। এ সবই যখন আছে তাহলে ইমোশন বা আবেগ, আর মোরালিটি বা নৈতিকতা বাকি রইলো কোথায়? না, বাকি নেই। ওয়াও! পশুর মাঝে ইমোশন, মোরালিটি? বলির পশু বুঝে ভুতেশ্বরের নামে তার গলা কাটা অন্যায়? কোরবানীর গরু টের পায় মানুষ কেমন অসুর? এসব শুনলে অনেকের চোখ ওপরে ওঠারই কথা। ‘আবেগ’ আর ‘নৈতিকতা’ এ দুটো গুন জন্মগতভাবেই মানুষের দখলে তা আমরা জেনে এসেছি বহুকাল যাবত। কিন্তু আজিকার জীববিজ্ঞানীরা তা আর মানছেন না। তারা বলছেন, পশুর মধ্যেও নৈতিকতা আর আবেগ আছে। ডারউইন সাহেব তো এক কদম আগ বাড়িয়ে বলেই দিয়েছেন যে, নৈতিকতা আসলে পশুর কাছ থেকেই মানুষ শিখে নিয়েছে। কি সর্বনাশা কথা! ঈশ্বর তার বাড়ির উঠোনে আদমকে চিৎ করায়ে শুইয়ে বছরের পর বছর সকাল বিকাল নৈতিকতা শিখালো, সাথে একগাদা বই বগলে দিয়ে দুনিয়ায় পাঠালো, আর এখন কি না বলা হয় মানুষ নৈতিকতা শিখেছে পশুর কাছ থেকে। তবে ডারউইন ঠিক ‘পশুর কাছ থেকে মানুষ নৈতিকতা শিখেছে’ বলেন নি, বলেছেন ‘বিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের পূর্ব পুরুষ (animal ancestors) থেকে পেয়েছি’। আর যদি বলাই হয় যে, মানুষ পশুর কাছ থেকে শিখেছে তাহলে ভুল কি বলা হবে? কারণ পশু যে, আদমের আগে পৃথিবীতে এসেছে তা তো সকল ধর্মগ্রন্থই স্বীকার করে। বুঝা গেল ‘নৈতিকতা’ ‘একটা চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া, জনম ভইরা চলিতেছে’ এ রকম কিছু নয়, ওটা ধীরে ধীরে বেড়েছে বিবর্তন প্রক্রীয়ায়, আগে থেকে মানুষের মগজে ডিজাইন করা ছিলনা। Marc Bekoff এর ‘Wild Justice and Moral Intelligence in Animals’ আর Charles Darwin এর ‘The Descent of Man’ বই দুটোতে এ বিষয়ের ওপর সুন্দর সুন্দর প্রচুর উদাহরণ ও প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে। উৎসাহী পাঠক এ ব্যাপারে সেখান থেকে জেনে নিতে পারেন। তাহলে পার্থক্য কি একেবারেই নেই? মান-সম্মান, জ্ঞান-বুদ্ধিতে মানুষ আর জানোয়ার সমান সমান? পশুর মত বাচ্চা প্রসব, রিপ্রোডাকশন, মৃত্যুর আগে নিজের বংশ রেখে যাওয়া, নিজের জিন বিস্তার করা ছাড়া মানুষেরও জীবনের আর কোন লক্ষ্য কোন উদ্দেশ্য নেই? সেই কথা বলার জন্যেই আজকের এই লেখা।
প্রকৃতি যে, বিরাট শিশুর আনমনে সৃষ্টি ও ধ্বংসের খেলায় মত্ত আছে, আমরা মানুষ সহ সকল জীবেরা তার সেই খেলার পুতুল ছাড়া আর কিছু নয়। সেই খেলা চলে আসছে সময়ের বা সৃষ্টির সুচনালগ্ন থেকে। নুতনের সৃষ্টি, পুরাতনের ধ্বংস এই তার খেলা এই তার লীলা, এই তার নিয়ম। সে পুরাতনকে ধ্বংস করে নুতনদের জায়গা করে দিবে, তার কাছে পুরাতনের ভালবাসা, কান্না, আবেগের কোন মূল্য নেই। সাগর পাড়ের চিৎকারে সাগরের ঢেউয়ের কিচ্ছু আসে যায় না। প্রকৃতির এই পাগলপনা খেলায় ভুল হয়, মিসটেইক হয়, সকলকে সমান ভাবে একই নিয়মে সৃষ্টি করেনা, বড়ই বিশৃংখল তার ডিজাইন তার ম্যাকানিজম। তার খেলা সে খেলছে নিজের ইচ্ছে মত, সে কারো পরোয়া করেনা। কেউ দূর্বল, কেউ সবল, কেউ সুন্দর কেউ কুৎসিত, কেউ ছোট, কেউ বড়, প্রকৃতির পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ায়ে যে চলতে পারবে সে ই ঠিকবে অন্যরা বিলুপ্ত হয়ে যাবে, এ নিয়ে সে মোটেই চিন্তিত নয়। সৃষ্ট জীবেরা প্রকৃতির এই হেয়ালীপনা, তার পাগলপনা নিয়ম-কানুন মেনে চলেছে জীবের জন্মলগ্ন থেকে। এটাই পশুদের ধর্ম, মানুষের ধর্মও ছিল তাই। জীবজগতের সদস্যপদে মানুষের নাম উঠেছিল প্রাণের উৎপত্তির অনেক পরে। মানুষও অন্যান্য জীবের মত প্রকৃতির সেই নিয়ম মেনে চলেছিল হাজার লক্ষ বছর যাবত। ‘জন্ম, রিপ্রোডাকশন, মৃত্যু’ এ ছাড়া জীবনের আর কোন লক্ষ্য আর কোন উদ্দেশ্য নেই। গুহাযুগ, প্রস্তরযুগ, শিকারযুগ এভাবে ধাপে ধাপে মানুষ যখন কৃষিভিত্তিকযুগে এসে পৌছিল তখন থেকে মানব জগত অন্যান্য প্রাণীর জীবনধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তাহলে নিশ্চয়ই এর পেছনে কোন কাহিনি আছে। কাহিনি শুরু হয়েছিল প্রকৃতির সৃষ্ট মানব প্রজাতির নারী-পুরুষের দৈহিক কাঠামোর তারতম্যের কারণে। সে কথা পরে হবে, তার আগে মানব জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা যাক।
বলা হয় সন্তান নাকি মা বাবার ভালবাসার ফসল। ভালবাসা জিনিসটা কী? মানুষ ভালবাসার সংজ্ঞা সন্ধান করে আসছে বহু যুগ পূর্ব থেকে। এর ঠিক উত্তর বোধ হয় রবীন্দ্রনাথও জানতেন না, তিনি লিখেছেন-
সখী, ভাবনা কাহারে বলে। সখী, যাতনা কাহারে বলে ।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’—
সখী, ভালোবাসা কারে কয় ! সে কি কেবলই যাতনাময় । ।
আমরা মনে করি, ভালবাসা কী জিনিস তা অনেকেই জানি। না, আমরা জানিনা। আর জানিনা বলেই আমাদের মাঝে অন্য আরেকটি বিষয়ের জন্ম দিয়েছি। Jealousy ঈর্ষা। নিজের সম্পর্কে জানা, অপরকে বুঝা ও বিশেষ করে মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে ঈর্ষার প্রভাব অনস্বীকার্য। যে মুহুর্তে আপনি কাউকে ভালবেসেছেন, সেই মুহুর্ত থেকেই ঐ মানুষটির অকালমৃত্যু হয়ে গেছে। এক প্রকার অধিকার Monopoly বা দখলদারিত্ব Possessiveness কিংবা অন্যভাবে বললে জীবের স্বাধীনতা হরণ করে নেয়ার অপর নাম ভালবাসা। মানুষ ভালবাসা বলতে সেটাই বুঝায়, সেটাই মিন করে। শুনতে আজব লাগেনা? লাগারই কথা। আমরা যুগ যুগ ধরে ভালবাসা শব্দটির ভুল অর্থ করে আসছি, ভুল বুঝেছি তাই এখন ‘ভালবাসা’ থেকে ’ঈর্ষা’ শব্দকে আলাদা করতে পারিনা, সেই পথ আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। তাত্বিক অর্থে শব্দ দূটো মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। আপনি যখন আপনার পছন্দের একজন সুন্দরী নারীকে বললেন- ‘আমি তোমায় মনে প্রাণে ভালবাসি’ এর অর্থটা কী দাঁড়ালো? আপনি চান এই নারী শুধুই আপনার হয়ে থাকুক, একে যেন আর কেউ ভালবাসেনা। অন্যভাবে বলা যায়, যেহেতু আপনি এই নারীর ভালবাসা কামনা করেন তাই সে যেন অন্য কাউকে ভালবাসেনা। ভালবাসার নামে আপনি তার ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চান, তার স্বাধীনতা বা অধিকার কেড়ে নিতে চান। আপনি চান না এই মেয়েটিকে অন্য কেউ ভালবাসুক, আপনি চান না এই মেয়েটি অন্য কাউকে ভালবাসুক। এরই নাম ঈর্ষা। এই ঈর্ষার বশবর্তি হয়ে আপনি আপনার ভালবাসার মেয়েটিকে খুনও করতে পারেন। তাহলে ভালবাসার অর্থটা কী দাঁড়ালো? এই ভালবাসা পশু জগতে নেই, আমাদের পূর্বপুরুষদের মাঝেও ছিলনা। পশুর ধর্ম হলো; ক্ষিদে পেয়েছে, খাদ্যের সন্ধানে বের হও। খাদ্য আহরণ করে পেট পুরে খাও তারপর বিশ্রাম করো, লম্বা একটা সুখ নিদ্রা, কিছুটা কুলাকুলি, কিছুটা আনন্দ, যতক্ষণ পর্যন্ত না আবার ক্ষিধে পেয়েছে। রোজ আনি রোজ খাই, সঞ্চয়ের দরকার নেই, বেংক ব্যালেন্স বাড়ানোর দরকার নেই, নেই কোন লেন-দেন, কোন লাভ-মুনাফার চুক্তি বন্ধন। দূর্ভিক্ষের দিনে, সংকট সময়ে মাল গুদামজাত করে, ষ্টোক করে অন্যের ভোগান্তি সৃষ্টিরও চিন্তা নেই। প্রাণের উৎপত্তিকাল থেকে পশুরা এই ধর্ম মেনে চলে আসছে, আমাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মও ছিল তাই। এখন আমরা আমাদের ভালবাসা প্রকাশ করি-
কইলজার ভিতর বাইন্ধা রাখুম তোয়ারে
ছিনার লগে বাইন্ধা রাখুম তোয়ারে, ও ননাইরে।।
কেউ বাঁধে কলিজায় কেউ বাঁধে ছিনায়, কেউ বাঁধে মাথার কেশ দিয়ে, কেউ শাড়ির আঁচল দিয়ে কেউ চুলের বেণী দিয়ে। এই বাঁধা-বাঁধি পশু জগতে নেই, আমাদের পূর্বপূরুষদের মাঝেও ছিলনা। আরেকটা উদাহরণ হতে পারে এমন; আপনার প্রীয় ব্যক্তিটি, নির্দিষ্টভাবে আপনার প্রেমিকা বা স্ত্রীকে পরপুরুষের সাথে মেলেমেশা বা চলাফেরা করতে দেখলে, স্বাভাবিক ভাবেই আপনি ঈর্ষান্বিত হবেন, দুঃখ পাবেন। কিন্তু এতে যদি আপনার ঈর্ষা না হয়, যদি এতে আপনি ক্ষুব্ধ না হন তাহলেও সমস্যা আছে। আপনি মনে করবেন, আপনি তাকে ভালবাসেন না, আপনার উচিৎ ছিল ঈর্ষান্বিত হওয়া, গোস্বা করা, রক্তচক্ষু দেখানো। এ ভাবেই ‘ভালবাসা’ আর ‘ঈর্ষা’ একে অন্যের সাথে অতঃপ্রতভাবে জড়িয়ে গেছে। ঈর্ষামিশ্রিত ভালবাসা প্রকৃত ভালবাসা হতে পারেনা।
যুগ যুগ ধরে এই ঈর্ষামিশ্রিত ভালবাসার শেষ পরিণতি হল মানব সমাজে ‘বিবাহ পদ্ধতি’। ভেঙ্গে পড়ার, চুরি হওয়ার বা হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাময় জিনিসের ইনসুরেন্স, সিকিউরিটি বা গ্যারান্টির প্রয়োজন পড়ে। ঠুনকো ভালবাসা এতই নড়বড়ে যে, তাকে আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। এই আছে তো এই নেই, সুতরাং একে শেকল পরাতে হবে, শক্ত করে বেঁধে রাখতে হবে। কেশের চেয়েও শক্ত বাঁধন, লোহার চেয়েও শক্ত বেড়ি, অর্থাৎ এখান থেকে ভালবাসাকে শেকল পরানো যুগের সুচনা। তারপর আগামী দিনের কথা, ভবিষ্যত জীবনের সুখ শান্তির কথাও তো চিন্তা করতে হয়। আপনি এখন যুবক, কাল বৃদ্ধ হবেন, সেই বৃদ্ধ বয়সের প্রয়োজনকালে আপনার স্ত্রী যেন পাশে থাকেন এমন একটা গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তা আপনি চান। ভালবাসার মানুষটি যেন শুধুই আপনাকে সারা জীবন ভালবাসে এই গ্যারান্টি পেতে হলে কিছু লেনদেন, কিছু চুক্তি কিছু সমঝোতা তো করতেই হয়। বলার অপেক্ষা রাখেনা- চুক্তি, লেনদেন আর সমঝোতা যেখানে সমস্যাও সেখানে। সিকিউরড ভবিষ্যত বা আগামী দিনের নিশ্চয়তার জন্যে একটা সিষ্টেমের দরকার পড়লো। সেই সিষ্টেমের নাম দেয়া হল ‘বিয়ে’। বলা বাহুল্য এর পেছনে নারীর কোন হাত ছিলনা, আইডিয়াটা পুরুষের। বিয়ের মাধ্যমে নারী হল পুরুষের দখলকৃত বা ক্রয়কৃত প্রাইভেট সম্পত্তি। পশুদের বিয়ে নেই, প্রাইভেট সম্পত্তিও নেই। তারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, পশুরা সবাই এক একটা ঝানু কমিউনিষ্ট। মানুষ কমিউনিষ্টদের চেয়ে তা অবশ্যই উন্নত। পশুদের মাঝে শ্রেণী বৈষম্য নেই, বর্ণবাদ নেই, শ্রমিকের উপর বুর্জুয়াদের শোষণ নেই। তারা সদা মুক্ত, সদা স্বাধীন। বিয়ে সাদী নেই, সুতরাং লেনদেন, সমঝোতা চুক্তির প্রশ্নই উঠেনা। প্রকৃতির নির্দেশনানুযায়ী যথা সময়ে উত্তরসূরী জন্ম দিয়ে বিদায় নিতে হবে। সুতরাং নির্দিষ্ট সময়ে নুতনের বেঁচে থাকার উপযুক্ত নুতন জায়গায় নুতন বাসা তৈরী করবে। পুরাতন বাসা পদ্মার জলে ভেসে গেল, নাকি হিমালয়ের ঝড়ে উড়ে গেল এ নিয়ে তাদের কোনই টেনশন নেই। সারা দুনিয়া তাদের বাড়ি। হাজার হাজার বছর যাবত আদিমানব আমাদের যাযাবর পূর্বপুরুষদের জীবনও এমন ছিল। বিয়ে সাদী ছাড়াই তারা দলবদ্ধ হয়ে বাস করতেন। আজ এখানে তো কাল সেখানে, রোজ আনি রোজ খাই।
মোরা এক ঘাটেতে রান্ধি বারি আরেক ঘাটে খাই / মোদের ঘর বাড়ি নাই,
সকল দুনিয়া বাড়ি মোদের / সকল মানুষ ভাই
মোদের সুখের সীমা নাই।।
পূর্বে উল্লেখ করেছিলাম, কৃষিভিত্তিক সমাজ গড়ার মাধ্যমে মানব প্রজাতির জীবনধারা পশুজগত থেকে আলাদা হয়ে যায়। এক সময় মানুষ গুহায় বাস করতো। সময়ের পরিক্রমায় তারা সমতল ভূমিতে আবাস গড়ে তোলে। কালের সুদীর্ঘ যাত্রাপথে মানবজাতি বেশ কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে এসে যখন কৃষিভিত্তিক সমাজ গড়ে তুললো, তখন থেকে আধুনিক মানব সভ্যতার শুরু আর আদিমযুগের অবসান হয়।
শিকার ভিত্তিক জীবন ব্যবস্থায়, নিত্যদিন পশু সন্ধানে ব্যস্ত পুরুষের নুতন কোন খাদ্য আবিষ্কার বা অন্য কোন জ্ঞান অর্জনের সময় বা উপায় ছিলনা। কৃষিভিত্তিক ব্যবস্থা মানুষের জীবন ও তার দুনিয়াটাই বদলে দেয়। এর শুরুটা করেছিলেন নারী। পরবর্তিতে এই নারীকেই হাতের মুঠোয় বন্দী করে পুরুষ, বিয়ে নামক প্রথা উদ্ভাবনের মাধ্যমে। সে কথায় পরে আসছি, আগে দেখা যাক এর শুরু হল কীভাবে? প্রকৃতি নারীর শারিরিক গঠন, দৈহিক কাঠামো, যে ভাবে গড়ে দিয়েছে তা বন্যপশু শিকারের জন্যে উপযোগী নয়। অথচ পশু শিকারই ছিল মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। নারীকে বসে থাকতে হয় ঘরে শিকারের অপেক্ষায়, ছোটদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়ীত্বে। অনেক সময় সে থাকে গর্ভবতি ও শারীরিকভাবে দূর্বল। সে বাসস্থান পরিচ্ছন্ন রাখা ও খাদ্য প্রস্তুতি শেষে যতটুকু সময় পায় তা ব্যয় করতো তার চারপাশ অনুসন্ধান পর্যবেক্ষণ করে। সে প্রকৃতিকে গভীরভাবে চিনতে ও জানতে চেষ্টা করে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করে নারী মুগ্ধ হয়। সে নিজেকে সেই রূপে সাজিয়ে তোলে। খোপায় ফুল, গলায় হার, পায়ে রঙ মেখে সুন্দর পৃথিবীকে নারী আরো সুন্দরতম করে তোলে। প্রকৃতির ডাক নারী শুনতে পায়। মায়ের ডাকে ব্যাকুল নারী গেয়ে উঠে-
তোমার প্রেমে তোমার গন্ধে পরান ভরে রাখি
এইতো আমার জীবন মরণ এমনি যেন থাকি।।
নারী প্রকৃতির কাছ থেকে শিখেছে সৃষ্টি, আবিষ্কার, মমতা, ভালবাসা, নারী হয়ে উঠে প্রকৃতির সুন্দরের প্রতীক। সুন্দরই তার ধর্ম, সুন্দরই তার কামনা, সে সুন্দরের পুজারি, তার অন্য কাউকে পুজোর দরকার নেই। তাই নারী কোনদিন কোন ধর্মগ্রন্থ লিখেনি, সে কোন পয়গাম্বর, অবতার, অস্পরা, দার্শনিক হতে চায় নি।
এক সময় নারী আবিষ্কার করে, প্রকৃতি তার সৃষ্ট জীবের জন্যে পশু শিকার ছাড়াও তার চারপাশে প্রচুর খাদ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে। সে লক্ষ্য করে মাটি থেকে উদ্ভিদ জন্ম নেয়, তাতে ফুল ফুটে, ফল ধরে, ফল থেকে বীজ হয় সেই বীজ আবার মাটিতে পড়ে আবার অঙ্কুরিত হয়। অন্যান্য জীবেরা এই ফল-মুল খেয়ে বাঁচে। সে নিজে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে থাকে তার নিজের জন্যে কোনটা আহার উপযোগী আর কোনটা অনুপযোগী। এক সময় নারী কৃষিকাজে মনযোগী হয়ে উঠে আর মানব প্রজাতির খাদ্যাভাব পুরনের এক অভিনব পন্থা আবিষ্কার করে ফেলে। এখান থেকে মানব জীবনের আরেক নতুন অধ্যায়ের শুরু।
মানুষ সঙ্গবদ্ধ জীবন শুরু করেছিল পশুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে। পশুরা যেমন খাদ্যের সন্ধানে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়াতো, মানুষকেও পশুর সন্ধানে তাদের পিছু ছুটতে হতো অবিরত, এক জায়গায় স্থির থাকা সম্ভব হতোনা। জীবজগতে অন্যান্য প্রাণীরা তার শিকার ধরতে কৃত্রিম অস্ত্র ব্যবহার করেনা। একবেলা খাদ্যের যোগান হলে হাতের কাছে পেয়েও অতিরিক্ত শিকার ধরেনা। পেটের তাগিদ ও প্রাণের নিরাপত্তার কারণ ছাড়া মারামারি করেনা, কারো ঘাড় মটকায় না। বাঘের কোলে হরিন শাবক পালিত হতেও আমরা দেখেছি। মানুষই একমাত্র জীব, যে তার শিকারের জন্যে অস্ত্র ব্যবহার করে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য সঞ্চয় করে। আধুনিক যুগে এসে মানুষ শুধু পশু শিকারে নয়, সে স্বজাতির মানুষকে হত্যা করতেও অস্ত্র ব্যবহার শুরু করে। এই আইডিয়াটায় নারীর কোন হাত নেই, এটাও পুরুষের উর্বর মস্তিষ্কের জঘন্য কাজ।
যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে কখনো ধর্মের নামে, কখনো সভ্যতার নামে, কখনো গনতন্ত্রের নামে মানুষ মানুষকে খুন করলো, এমন অসভ্য কাজ পশুরা কোনদিন করে? কত সহজে, কত কম সময়ে, কত বেশী খুন করা যায়, এই চিন্তা পশুদের নেই আছে মানুষের। জগতে কয়টা হলোকাষ্ট, কয়টা হিরোসিমা-নাগাসাকি, কারবালা, কুরুক্ষেত্র পশুরা ঘটিয়েছে? এখানেই মানুষ ও পশুদের মাঝে বিরাট একটা পার্থক্য। তাই মানব প্রজাতিকে আশরাফুল মখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব বলে আখ্যায়ীত না করে তার উল্টোটা বলাই যৌক্তিক হত। নিজেকে সৃষ্টির সেরা দাবী করার আগে মানুষ কি জীবজগতের দিকে একবার চোখ মেলে তাকিয়ে দেখবেনা, ‘Salmon fish’ একটি মাছের বাচ্চার ব্রেইনের মত ব্রেইনও যে তাদের মাথায় নেই?
যে নারী, এই দুনিয়া আবাদ করলো, পুরুষকে নয়টা মাস যে নারী নিজের শরীরের রক্ত মাংস খাওয়ায়ে তার ভেতরেই বড় করলো, পুরুষকে জন্ম দিতে, দুনিয়ায় নিয়ে আসতে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়লো, তার জরায়ু রক্তাক্ত ছিন্ন ভিন্ন হল, সেই নারীকে পুরুষ আসতীর অপবাদ দেয়, পাথর মারে, আগুনে পোড়ায়, এ কেমন শ্রেষ্ট মানুষ? যুগ যুগ ধরে পুরুষ নারীর সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, লুলুপ দৃষ্টিতে নারীর জরায়ুর দিকে তাকিয়েছে, নারী কোনদিন পুরুষকে অসতের অপবাদ দিয়ে পাথর মারেনি, আগুনে পোড়ায় নি। এখানেও মানুষ আর পশুর মধ্যে আরেকটা পার্থক্য পাওয়া গেল।
ধীরে ধীরে মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে আর শিকারের পশুর সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে। এক সময় পুরুষের জন্যে পর্যাপ্ত খাদ্যের যোগান দেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। পুরুষকে নারীর কাছে ফিরে আসতে হয়। পুরুষ একমত হতে বাধ্য হয় যে, কৃষিভিত্তিক ব্যবস্থায় কোনদিন খাদ্যাভাব দেখা দিবেনা। ধীরে ধীরে পশু শিকার কমতে থাকে আর শষ্য-ফল উৎপাদনের লক্ষ্যে জমি চাষাবাদ বাড়তে থাকে। কিন্তু এর সাথে পাল্লা দিয়ে আরেকটি নতুন সমস্যার উদ্ভব হয়। জমির পরিমাণ যত বেশী হবে, ফসলের পরিমাণও তত বেশী হবে এটাই স্বাভাবিক। দলে বা গোত্রে সকল মানুষ শারীরিকভাবে সমান শক্তির বা সামর্থ্যের হয়ে জন্মায় না। এবার সবলেরা অধিক জমি দখল করে শষ্য-ফল উৎপাদনে দূর্বলদের চেয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। এখান থেকে দখলদারীত্ব, ব্যক্তি মালিকানা, নিম্নবিত্ত-উচ্চবিত্ত, শ্রেণী বৈষম্যের শুরু। এরই ফলশ্রুতিতে জন্ম নিল বিনিময় সিষ্টেম। মানুষের বহুদিনের সাথী জীবজগতের অন্যান্য পশুরা কমিউনিষ্ট রয়ে গেল আর মানুষের জীবনে হল পুঁজিবাদের শুরু। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একজাতীয় শষ্য ঘরে রাখার কোন মানে হয় না। মানুষ ভাবলো, এর বিনিময় মূল্যে সমপরিমা্ণ বা এর অতিরিক্ত পরিমাণ ভিন্ন স্বাদের খাদ্য-শষ্য বা ভিন্ন জিনিস পেলে ক্ষতি কী? এক ধারার সহজ জীবন থেকে বহুরূপী ধারার, বহু সম্ভাবনার স্বাপনিক ও কঠিন জীবনে মানুষ পদার্পণ করলো। পরবর্তিতে এই ব্যক্তি মালিকানা আরেকটি সমস্যার সৃষ্টি করলো। যখন সম্পত্তির মালিক মারা যায়, তখন তার সঞ্চিত সম্পদের মালিক কে হবে? কেউ চাইবেনা তার কষ্টার্জিত সম্পদ অপচয় হউক, ধ্বংস বা বিনষ্ট হউক কিংবা অপরের দখলে চলে যাক। সুতরাং এর পাহারাদার, এর উত্তরাধিকারী, এর রক্ষণা বেক্ষণের দায়ীত্বে কাউকে নিয়োজিত করা দরকার। বলা নিষ্প্রয়োজন, সে অবশ্যই হবে নিজের রক্ত সম্পর্কের কেউ। এখানে এসে মানুষ তার আদিম জীবনধারা থেকে সম্পূর্ণ বদলে যায়। এক সময় আদিমযুগে পুরুষ শিকার থেকে ফিরে এসে ঘরে নবজাতক শিশু দেখে অবাক হত। সে বুঝতে পারতো না এই শিশু কোত্থেকে এলো, এটা কার সন্তান। আধুনিক যুগে এসে পুরুষ তার সন্তানের উপর মালিকানা দাবী করে বসলো এবং মৃত্যুর পর নিজের সন্তানের কাছেই তার সম্পত্তি রেখে যেতে চাইল। সন্তানের উপর মালিকানা দাবী করার আগে, বীর্য পরিচয় নিশ্চিত করা দরকার। আর তা করতে হলে অবশ্যই সন্তানের মায়ের সাথে সমঝোতায় বা চুক্তিতে আসতে হবে। এই চুক্তির সভ্য নামকরণ হল ‘বিয়ে’। চুক্তিবদ্ধ বিয়ের মাধ্যমেই পুরুষ নিশ্চিত হতে চায় যে, সন্তান তার নিজের। বিয়েবহির্ভুত সন্তানের নাম দেয়া হল ‘জারজ’। ‘ভালবাসা’ থেকে ‘বিয়ে’ শব্দের জন্ম হয় নি, হয়েছে ‘ব্যক্তি মালিকানা’ বা ‘অর্থনীতি’ থেকে। পুরুষ এবার শুধু সম্পদেরই মালিক হলোনা, তার চির সাথী নারীকেও সম্পদ হিসেবে ভাবতে লাগলো। তার এই ভাবনাকে বাস্তব রুপ দিতে সে ধর্মের আশ্রয় নিল। নারীকে দেখালো আজগুবি সব ভয়-ভীতি। তৈরি করলো নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে কিছু নিয়ম বিধান। ধর্মগ্রন্থে লিখিতভাবে ঘোষণা দেয়া হল, নারী শ্রেষ্ট উপভোগ্য সম্পদ। আইন করে দেয়া হল, পুরুষের কামবাসনা জাগা মাত্র নারীকে সর্বাবস্থায় তৈরী থাকতে হবে। নারীর পেছনে জুড়ে দেয়া হল আজগুবি সব বিশেষণ। কেউ অসতী বলে পাথর মেরে হত্যা করে, আর কেউ সতীত্বের পরীক্ষা নেয় আগুনে পুড়ে। ভালবাসার পরীক্ষা শুধু নারীকেই দিতে হয় আগুনে ঝাপ দিয়ে। কেউ কোনদিন পুরুষের ভালবাসার পরীক্ষা নিতে বিধান সৃষ্টি করলোনা।
নারীর স্বকীয়তা, স্বাধীনতা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, পছন্দ-অপছন্দ বলে আর কিছু রইলোনা। অথচ এই মানব সভ্যতা, এই জগতের যা কিছু কল্যাণকর, যা কিছু সুন্দর সবটুকুতেই নারীর অবদান আছে। এই পৃথিবীকে এমন সুন্দর করে গড়ে তোলার পেছনে নারীর স্বপ্ন, নারীর কল্পনা, নারীর ত্যাগ অস্বীকার করার উপায় নেই।
মা যখন তার সন্তানদের দিয়ে প্রায় অর্ধেক পৃথিবী আবাদ করে নিয়েছেন তখন পর্যন্ত বাবার জন্মই হয়নি। অবশ্য মা সব সময়ই ছিলেন। সন্তান জানতোনা দলের কোন পুরুষ তার বাবা, সুতরাং সকল পুরুষই তার চাচা। এই হিসেবে বাবার চেয়ে চাচা অনেক পুরাতন শব্দ। সভ্যযুগে এসে মানবপ্রজাতি যখন বিয়ে প্রথার জন্ম দিলেন, একই সাথে আরেকটি অসভ্য শব্দের জন্ম হল। ‘জারজ’। পশুদের কোন জারজ সন্তান নেই, তাদের সকল সন্তানই বৈধ সন্তান। আমাদের পূর্বপুরুষদের মাঝেও জারজ সন্তান ছিলনা, আমরা সকলেই আমাদের পূর্বপুরুষদের বৈধ সন্তান। যদিও তাদের মাঝে বিয়ের প্রচলন ছিলনা। বিয়েকে যদি বৈধতার মাপকাটি বলে মেনে নিই তাহলে আমরা সকলেই জারজ সন্তান, এই পৃথিবীতে বৈধ সন্তান একজনও খুঁজে পাওয়া যাবেনা। কারণ যারা এই ফতোয়া আবিষ্কার করেছিলেন, যারা এই শব্দের জন্মদাতা, তারা নিজেরাই কারো না কারো অবৈধ সন্তান ছিলেন।
ভালবাসাকে শেকল পরানো প্রকৃতিবিরোদ্ধ কাজ। জোর করে ভালবাসা অর্জন করা যায় না। ‘বিয়ে’ ‘ধর্ম’ ‘জারজ’ এ সব আধুনিক যুগের পুরুষের আবিষ্কার, নারী ও প্রকৃতির এতে সমর্থন নেই, আমাদের পূর্বপুরুষদেরও ছিলনা। বলা হয়, লজ্বা নাকি নারীর বসন। পুরুষের নয় কেন? আমাদের পূর্বপুরুষদের ঠিক কোন সময় থেকে লজ্বাবোধের উৎপত্তি, আমি সে প্রশ্নের উত্তরটি আজও খুঁজে পেলাম না। যেহেতু জীব জগতের অন্য কোথাও এর প্রমাণ মেলেনা, অনুমান করি আমাদের পূর্বপুরুষদের মাঝেও ‘জারজ’ এবং লজ্বা বলতে কোন শব্দ ছিলনা। আজও আফ্রিকার বনাঞ্চলের ট্রাইব বা উপজাতিরা উলঙ্গ অবস্থায়ই আছে। মানব প্রজাতি তার লক্ষ কোটি বছরের বিবর্তনের বাঁকে বাঁকে প্রমাণ রেখে এসেছে, সেও যে জীব জগতের অন্যান্য প্রাণীর মতই প্রকৃতি-পরিবারের এক সাধা্রণ সদস্য বই আর কিছু নয়।
পুরোপুরি ভিন্ন স্বাদ! অসাধারণ লাগলো। বিবর্তনকে মানব জন্মের আদি সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত গল্পচ্ছলে নিয়ে আসাটা দারুণ লেগেছে।
:good: অনেকদিন পর আপনার লেখার স্বাদ পেলাম,আশা করি স্বল্প বিরতিতেই আপনার পরবর্তী লেখা পাবো।
আকাশ মালিক ভাই,
ভালো না লেগে কোন উপায আছে এই লেখাটি পড়ার পরে? রাহুল সংস্কৃত্যায়নের একটা স্বাদ পেলাম আবার! দারুণ লেগেছে। আরো্ও লিখুন। বিশেষ করে জর্জ সি উইলিয়ামসের আ্যডাপটেশন এন্ড ন্যাচারাল সিলেকশনের উদাহরণ গুলো জানতে ইচ্ছে হচ্ছে! বইটা হাতের কাছে নেই। সেই পারিবারিক রাজনৈতিক পরিমন্ডল থেকে প্রগৈতিহাসিক জীব বিবর্তন হয়ে আধুনিক পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মানবতাবাদের যে পরিচয় উঠে এলো…..! তাতে নিজেদের আশরাফুল মকলুকাত বলতে জিভ আড়ষ্ঠ হয়ে পড়ছে!
খাসা বলেছেন! আর দেখুন না, আমরা কিন্তু বিবর্তন সহায়ক! মেয়েদের নিয়ন্ত্রনে সবকিছু!
অথচ কবি-সাহিত্যিকরা তা কত আগেই না লিখে গেছেন! মবি ডিক, হোয়াই ফ্যাং, মহেষ ইত্যাদি।
সেরেছে!! ডিজাইন!
সে যাই হউক, লেখাটা বিমলানন্দ দিয়েছে জ্ঞান যোগানোর পাশাপাশি।
আর সময় করে নীচের বইগুলো পড়ে ফেলবঃ
রিচার্ড ডকিন্সের The Selfish Gene
জর্জ উইলিয়ামসের Adaptation and Natural Selection
Marc Bekoff এর ‘Wild Justice and Moral Intelligence in Animals’
Charles Darwin এর ‘The Descent of Man’
আহা, এমন যদি হত! আর এমনি তো ছিল! কেনই যে আমরা সুখের ঘরে দুঃখের আগুন লাগালুম বা লাগিয়ে যাচ্ছি!
@গুবরে ফড়িং,
আমি বলি ঈশ্বরকে আকাশে খোঁজার আগে হে মানবজাতি, একবার জলে স্থলে জীবজগতের দিকে তাকাও। দেখবে ঈশ্বরের নাম-গন্ধ কোথাও নাই।
লেখাটি পড়ে মন্তব্য করার জন্যে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সবাই দেখি পেশা পরিবর্তন করছেন। ইরতিশাদ ভাই ভাষাবিজ্ঞানী হয়ে উঠেছেন। আপনিও দেখছি ইসলাম ছেড়ে বিবর্তন, প্রেম ভালবাসা নিয়ে পড়েছেন।
যাহোক নতুন পেশায় স্বাগতম। ভাল লাগলো লেখাটা 🙂
@অভিজিৎ,
ধন্যবাদ দাদা, আপনার ভাল লেগেছে জেনে আরো লেখার উৎসাহ পেলাম।