১.

ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম সেরা লেখক হচ্ছেন রুডইয়ার্ড কিপলিং। ১৮৬৫ সালে তাঁর জন্ম হয় ভারতের মুম্বাইতে। তাঁর জন্মের সময় তাঁর বাবা-মা ছিলেন ভারতে সদ্য আগত। আরো অসংখ্য বৃটিশ নাগরিকদের মতো তাঁরাও ভারতে এসেছিলেন ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়। কিপলিং এর বাবা-মা ভারতে ভালই করেছিলেন, স্বচ্ছল জীবন ছিলো তাঁদের।

কিপলিং এর জন্য ভারত ছিলো এক বিস্ময়ভূমি। ছোট বোন এলিসকে সঙ্গী করে টই টই করে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। ভাঁজ খুলে খুলে দেখতেন ভারতের অন্দরমহল। হিন্দুস্থানী ভাষাটাও শিখে ফেলেছিলেন তিনি। ভারত এবং এর সংস্কৃতির প্রেমে পড়ে যান তিনি অতি অল্প বয়সে, অতি অল্প সময়ে।

কিপলিং এর এই সুখের দিন অবশ্য বেশিদিন টেকে নি। মাত্র ছয় বছর বয়সে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায় তাঁর স্বপ্নের দিনগুলি। তাঁর মায়ের বড় শখ ছিলো যে, কিপলিং আনুষ্ঠানিক বৃটিশ শিক্ষা পাক। এই চিন্তা করে তিনি তাঁর শিশু পুত্রকে পাঠিয়ে দেন ইংল্যান্ডের সাউথসিতে। এক পালক বাবা-মায়ের কাছে আশ্রয় হয় কিপলিং এর। তখন তাঁর বয়স মাত্র ছয় বছর।

এই সময়টা কিপলিং এর জন্য বড্ড খারাপ সময়। তাঁর পালক মাতা ছিলো নিষ্ঠুর প্রকৃতির এক মহিলা। অল্পদিনের মধ্যেই কিপলিং তাঁর নিদারুণ অপছন্দের তালিকায় চলে যায়। এই মহিলা কিপলিং-কে নিয়মিত মারধর ও নানা ধরনের অত্যাচার-নির্যাতন করতো। স্কুলেও নিজেক খাপ খাওয়াতে সমস্যা হচ্ছিলো কিপলিং এর। তাঁর একমাত্র আশ্রয় ছিলো বইয়ের জগত। কিন্তু সেটাও তাঁর পালক মায়ের অত্যাচারে সম্ভব ছিলো না।

এগারো বছর বয়সের মধ্যে এই ভয়ংকর অত্যাচারে নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়ে যায় তাঁর। তাঁর এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় এই অবস্থা দেখে ভারতে থাকা তাঁর বাব-মায়ের কাছে খবর পাঠায়। কিপলিং এর বাবা-মা দ্রুতগতিতে ইংল্যান্ডে চলে আসেন। তাঁর মা এলিস ছেলেকে নিয়ে দীর্ঘ ছুটিতে চলে যান। ছুটি শেষে তাঁকে ভর্তি করানো হয় ডেভনের এক স্কুলে। এখানে কিপলিং নিজেকে মেলে ধরেন। লেখালেখিতে তাঁর যে প্রতিভা আছে, সেটা এখানে এসেই টের পান তিনি। স্কুল ম্যাগাজিনের এডিটর হয়ে যান তিনি।

১৮৮২ সালে আবারো ধাক্কা খান তিনি। হাইস্কুল সবে শেষ করেছেন তিনি। অক্সফোর্ডে স্কলারশীপ নিয়ে ভর্তি হতে পারেন নি। তাঁর বাবা-মা জানিয়ে দিলেন যে, এতো পয়সা খরচ করে ইংল্যান্ডে তাঁকে পড়ানোর সামর্থ তাঁদের নেই। ভারতে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হলো কিপলিং-কে। ফিরে এলেন তিনি ভারতে। তখন তাঁর বাবা লাহোরে। লাহোরেই যান তিনি। এখানে বাবার সহযোগিতায় এক পত্রিকা অফিসে কাজ পান তিনি। এই চাকরি তাঁকে সুযোগ করে দেয় রাতের আঁধারে শহরের অলিগলি ঘুরে দেখার। আবিষ্কার আর উন্মোচন হতে থাকে জীবনের অনেক রহস্য, পুষ্ট হতে থাকে অভিজ্ঞতা।

এই সব অভিজ্ঞতাই তাঁর একগাদা ছোটগল্পের ব্যাকবোন হিসাবে কাজ করে। প্রায় চল্লিশটার মতো ছোট গল্প তিনি লেখেন। এগুলোই একত্রিত হয়ে বই আকারে বের হয়। নাম হচ্ছে প্লেইন টেলস ফ্রম দ্য হিলস। এটি ইংল্যান্ডে দারুণ জনপ্রিয়তা পায়।

১৮৮৯ সালে তিনি আবার ইংল্যান্ডে যান। লেখক হিসাবে নামডাক করার ইচ্ছাই ছিলো এবারের গমনের উদ্দেশ্য। ছোটগল্পের কারণে কিছুটা নামডাক হয়েছে ইংল্যান্ডে, এটাই ছিলো তাঁর ভরসার উৎসস্থল।

কিপলিং তাঁর সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক ছিলেন। ১৯০৭ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পান তিনি। তখন তাঁর বয়স মাত্র একচল্লিশ বছর। ইংরেজি ভাষা-ভাষী লেখক সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই প্রথম নোবেল বিজয়ী।

২.

সরলা দেবীর জন্ম আঠারো শো বাহাত্তর সালে। কিপলিং এর চেয়ে সাত বছরের ছোট তিনি। জন্মেছিলেন জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতনি তিনি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগ্নি।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী তখনকার যুগেও সংস্কৃত, বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় বিদুষী ছিলেন। তিনি ভারতী পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছেন দু দুবার। উপন্যাস, কবিতা, গল্প, সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রবন্ধ রচনা করে তিনি খ্যাতি লাভ করেন।

জানকীনাথ ছিলেন নদীয়ার জয়রামপুরের বিখ্যাত ঘোষাল বংশের সন্তান। অসাধারণ বলবীর্যের জন্য ঘোষাল বংশ বিখ্যাত ছিলো। জানকীনাথ বংশের ধারা অনুযায়ী অত্যন্ত সুদর্শন ও বীর্যবান পুরুষ ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে দেখে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর মেয়ে স্বর্ণকুমারীর সাথে আগ্রহের সাথে বিয়ে দেন। জানকীনাথ ব্যক্তিত্ববান পুরুষ ছিলেন। বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের জামাই হলেও, ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেন নি তিনি, আর ঘরজামাই হন নি। যদিও তাঁর বিয়ে হয়েছিলো ব্রাহ্ম রীতিতে। এবং এই অপরাধের কারণে তিনি ত্যাজ্যপুত্র হয়েছিলেন।

জানকীনাথের সবচেয়ে প্রিয় কার্যক্ষেত্র ছিল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস। কংগ্রেসের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি এর সাথে জড়িত ছিলেন। কংগ্রেসের সাধারণ সেক্রেটারির দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন। ব্যারিস্টারি পড়ার সময় যখন বিলেত যান, তখন তিনি স্ত্রী ও পুত্রকন্যাদের ঠাকুর বাড়িতে রেখে যান।

জানকীনাথের মতো স্বর্ণকুমারী দেবীও কংগ্রেসের রাজনৈতিক চর্চায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ১৮৮৯ সালে কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনে প্রথম নারী প্রতিনিধিরূপে এবং ১৮৯০ সালে কংগ্রেসের কলিকাতা অধিবেশনে প্রতিনিধিরূপে স্বর্ণকুমারী দেবী এবং কাদম্বিনী গাঙ্গুলি যোগদন করেন।

এই বাবা-মায়ের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান হচ্ছেন সরলা দেবী।

যে সময়ে মেয়েরা লেখাপড়া শিখতো না, বাড়িতে পর্দার আড়ালে থেকে শুধু ঘরুকন্না করা আর বাচ্চা বিয়োতে ব্যস্ত, সেই সময়ে ১৮৮৬ সালে মাত্র তেরো বছর বয়সে তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করেন। ১৮৯০ সালে যখন তাঁর বয়স মাত্র সতেরো, তখন তিনি ইংরেজিতে অনার্সসহ বি এ পাশ করেন। বাংলা ১৩০৬ সাল থেকে ১৩১৪ সাল পর্যন্ত তিনি ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদনায় লিপ্ত ছিলেন।

৩.

কিপলিং তাঁর এক ছোটগল্পের বইয়ের কোনো এক গল্পে বাঙালিদের কাপুরুষ বা গিদ্ধর বলেছিলেন। এই বইটা পড়ার পরে সরলা দেবী কিপলিং এর উপরে ভীষণ চটে যান। তিনি কিপলিংকে উদ্দেশ্য করে কঠোর একটা চিঠি লেখেন। সেই চিঠিটা এরকমঃ

তুমি বাঙালিকে ‘গিদ্ধর’ বলে সমগ্র বাঙালি জাতিকে অপমানিত করেছ। এই অপমান মোচনের জন্য আমার ভাইদের যে কোন একজনের সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে তোমাকে আহ্বান করছি। তৈরি হওয়ার জন্য তোমাকে পাঁচ বছর সময় দিচ্ছি। বন্দুক হোক, তলোয়ার হোক যে কোন অস্ত্রে তুমি নিজেকে উপযুক্তভাবে তৈরি করে নিতে পার – আমার ভাইরা তার জন্য তোমার সাথে লড়াই করতে তৈরি থাকবে। তখনই তুমি বুঝতে পারবে বাঙালি গিদ্ধর না সচেতন। 

চিঠি তো লিখলেন, কিন্তু পাঠাতে গিয়ে দেখেন যে কিপলিং এর ঠিকানাটাই তাঁর জানা নেই। চিঠি না পাঠাতে পারার যন্ত্রণায় তিনি ভুগতে থাকেন। কিপলিংকে উচিত জবাব না দিতে পেরে মানসিক শান্তি কিছুতেই পাচ্ছিলেন না তিনি। এই সময়ে তিনি কটকে এসেছিলেন। এখানে এসে তাঁর দেখা হয় দেশভক্ত মধুসূদন দাসের সাথে। নিজের মনের দুঃখের কথা মধুসূদন দাসকে খুলে বলেন সরলা দেবী। সবকিছু শুনে মধুসূদন দাস বলেন যে,

ওকে যখন পাঁচ বছর সময় দিয়েছেন, নিজেও পাঁচ বছর অপেক্ষা করুন। এই সময়ের মধ্যে বাঙালি যুবকদের অস্ত্র বিদ্যায় তৈরি করে নিন।

বাংলার যুবকদের সর্বতোভাবে সবরকম অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী করে তুলতে পারলে তবেই তো আপনার পক্ষে বদলা নেওয়া সম্ভব হবে। আপনি দেখাতে পারবেন বাঙালিরা গিদ্ধর নয়। যুদ্ধের ময়দানে বাঙালিরা বুঝিয়ে দিতে পারবে তারা বিদেশিদের থেকে কোন অংশে ছোট নয়। বাঙালি যুবক-যুবতীকে তৈরি করে নেওয়ার পর কিপলিংকে চ্যালেঞ্জ পাঠাবেন। উত্তেজনার বশে কিছু করা ঠিক হবে না।

মধুসূদন দাসের যুক্তি মনে ধরেছিলো সরলা দেবীর। কোলকাতায় ফিরে কাশিয়াবাগানের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে সরলাদেবী উঠে এসেছিলেন ২৬ নং সার্কুলার রোডে। সেখানে মুর্তাজা নামে একজন মুসলমান ওস্তাদকে নিযুক্ত করে বাঙালি যুবকদের ছোরা খেলা, তলোয়ার চালানো, লাঠি খেলা, এগুলো শিক্ষা দেওয়া শুরু করেন। এগুলোর জন্য নিজের পয়সায় অস্ত্রশস্ত্র কিনতে হয়েছিলো তাঁকে। অস্ত্র শিক্ষার জন্য একটা ক্লাবই প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন সরলা দেবী।

ছেলেপেলেরা অস্ত্রশিক্ষা নিতো আর সরলাদেবী গভীর স্নেহে পাশে বসে থেকে তা দেখতেন।এই অস্ত্র শিক্ষার ক্লাবটির কথা ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। দূর-দূরান্তের ছেলেরা সেখানে অস্ত্র শিক্ষা নেবার জন্য ও শরীর গঠনের জন্য আসতে শুরু করে।

সরলা দেবীর এই দেশপ্রেম, এই তেজস্বীতার সূত্রপাত অনেক অল্প বয়েস থেকেই। এন্ট্রান্স পরীক্ষার সময় ইতিহাসের প্রশ্নের মধ্যে মেকলে লিখিত ‘লর্ড ক্লাইভ’ পাঠ্যপুস্তকের উপর ভিত্তি করে ক্লাইভ এর বঙ্গ বিজয় সম্পর্কে একটা প্রশ্ন ছিলো। মেকলে যেভাবে বঙ্গ বিজয়কে তাঁর বইতে লিখেছিলেন, সেটির সম্পুর্ণ বিপরীত মত যুক্তি, তেজ ও আন্তরিকতার সাথে দিয়েছিলেন তিনি। ইতিহাসের পরীক্ষক এন ঘোষ এই বিদ্রোহী ছাত্রীকে সবচেয়ে বেশি নম্বর দিয়েছিলেন। সরলা দেবী তাঁর জীবনের ঝরাপাতা নামের আত্মজীবনীতে লিখেছেন,

বাঙালী জাতি সম্বন্ধে আমার আত্মাভিমান তখনই মাথা খাড়া করেছিল। এরই পূর্ণ বিকাশ দেখা দিলে বছর দশ বারো পরে কিপলিং-এর একখানা ছোটগল্পের বইয়ে একটা গল্পে বাঙালী জাতিকে ভীষণভাবে অবমানিত পেয়ে তার প্রতিবিধানকল্পে আমি যে দেশ ও জাতি ব্যাপী প্রচেষ্টা আরম্ভ করলুম তাতে। 

মারাঠিদের ‘শিবাজী উৎসব’ এর অনুকরণে তিনি ১৯০৩ সালে কলিকাতায় শুরু করলেন ‘প্রতাপাদিত্য উৎসব’। মণিলাল গাঙ্গুলী একদিন তাঁর সাহিত্য-সমিতির সাংবৎসরিক উৎসবে সরলা দেবীকে সভানেত্রী হতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সরলা দেবী রাজী হলেন। তবে, একটি শর্ত যোগ করে দিলেন। সেটি হচ্ছে যে, সেই তারিখটি পহেলা বৈশাখে ফেলতে হবে এবং সেখানে ‘প্রতাপাদিত্য উৎসব’ অনুষ্ঠিত করতে হবে। সভায় থাকবে না কোনো বক্তৃতা। কেবল একটিমাত্র প্রবন্ধ পাঠ করা হবে। আর সেটি হচ্ছে প্রতাপাদিত্যের জীবনী। এই প্রতাপাদিত্য উৎসবের জন্য খুঁজে বের করতে হবে বাঙালি কুস্তিগীর, তলোয়ারধারী, বক্সিং এবং লাঠি বীরদের। সেই উৎসবে হবে তাদেরই খেলার প্রদর্শনী।

এই প্রতাপাদিত্য উৎসব অনুষ্ঠিত হবার পরে তা ব্যাপক আলোড়ন তুললো বাংলাদেশে। বিপিন পাল তাঁর ইয়াং ইন্ডিয়াতে লিখেছিলেন – “As necessity is the mother of invention, Sarala Devi is the mother of Pratapaditya to meet the necessity of a hero for Bengal!”

এই পর্যায়ে এসে সরলা দেবী প্রকাশ করা শুরু করলেন বঙ্গের বীর সিরিজের ছোট ছোট পুস্তিকা। এর পর আয়োজন করেন প্রতাপাদিত্যের ছেলে উদয়াদিত্যের স্মরণে উদয়াদিত্য উৎসব। স্টেজের উপর একটা তরবারি রেখে সবাই বীর উদয়াদিত্যকে স্মরণ করে তাতে দেবে পুষ্পাঞ্জলি। এই উৎসবও যুবমনে প্রবল জোয়ার হয়ে ধাক্কা দিয়েছিলো।

অনেক ইংরেজই অহমিকাবলে ভারতীয়দের সাথে পথে ঘাটে খুবই বাজে ব্যবহার করতো। বেশিরভাগ লোকই এরা শাসনকর্তা ভেবে এই সব অপমান গায়ে সয়ে নিতো। তবে, এর মধ্যেও ব্যতিক্রম থাকতো। কেউ কেউ অপমানের প্রতিবাদ হিসাবে আইন আদালতের দ্বারস্থ হতো। আবার কেউ কেউ ছিলো আরো তেজি। আইন আদালত পর্যন্ত যাবার ধৈর্য তাদের ছিলো না। সাদা চামড়া তো কী হয়েছে? অপমানের বদলা তারা তাৎক্ষণিকভাবে নিয়ে নিতো। এই তেজস্বি লোকদের তেজি আচরণগুলোকে প্রকাশ করার বিষয়ে আগ্রহ ছিলো সরলা দেবীর। ভারতীতে তিনি লিখেছেন, ‘বিলিতী ঘুষি বনাম দেশী কিল’ নামের বিজ্ঞাপন। সেখানে তিনি লিখেছিলেন – “ভারতীর পৃষ্ঠায় আমন্ত্রণ করলুম, রেলে, স্টীমারে, পথে ঘাটে যেখানে সেখানে গোরা সৈনিক বা সিভিলিয়ানদের হাতে স্ত্রী, ভগ্নী, কন্যা বা নিজের অপমানে মুহ্যমান হয়ে আদালতে নালিশের আশ্রয় না নিয়ে – অপমানিত ক্ষুব্ধ মানী ব্যক্তি স্বহস্তে তখনি তখনি অপমানের প্রতিকার নিয়েছে – সেই সকল ইতিবৃত্তের ধারাবাহিক বর্ণনা পাঠাতে।” তাঁর এই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে অনেকেই লিখতে শুরু করলেন এই সব কাহিনি। পাঠকদের মনের মধ্যকার লুকোনো আগুন, যেটা এতোদিন জ্বলছিলো ধুঁকে ধুঁকে, অতি সংগোপনে, তা বেরিয়ে এলো প্রবল তেজে, আগ্নেয়গিরি লাভার মতো খরস্রোতে।

দলে দলে ছাত্র এবং বয়ষ্করা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আরম্ভ করলেন। তিনি তাদের থেকে বাছাই করে একটি অন্তরঙ্গ দল গঠন করলেন। ভারতবর্ষের একখানা মানচিত্র তাদের সামনে রেখে সেটিকে প্রণাম করিয়ে শপথ করাতেন এই বলে যে তনু মন ধন দিয়ে এই ভারতের সেবা করবে তারা। শেষে তাদের হাতে একটি রাখি বেঁধে দিতেন তাদের আত্মনিবেদনের সাক্ষী বা ব্যাজ হিসাবে। এটি ছিলো মাতৃভূমির জন্য বিপদ বরণের স্বীকৃতি।

স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহার ও প্রচার করার জন্য ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ নামে একটা দোকান খুলেছিলেন তিনি। সারা বাংলাদেশের সমস্ত জেলা থেকে সংগ্রহ করে এখানে স্বদেশি বস্ত্র ও জিনিস আনা হতো। আর এইসব দেশি পণ্য ছিলো শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য। এখানেই শেষ নয়। সরলা দেবী এবং যোগেশ চৌধুরী প্রভৃতি কয়েকজন মিলে একটা লিমিটেড কোম্পানি করে বৌবাজারে ‘স্বদেশি স্টোর্স নামে আরেকটি স্বদেশী জিনিসের দোকান খোলেন। এই দোকানের পরিচালনার ভার ছিলো যোগেশবাবুর উপরে। তাঁদের এই প্রচেষ্টা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বহু পূর্বে করা হয়েছে।শুধু স্বদেশী জিনিসের প্রচার, প্রসার আর বিক্রি করেই ক্ষান্ত ছিলেন না তিনি, কোথাও যেতে হলে নিজেও তিনি আপাদমস্তক স্বদেশি বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে যেতেন।

১৯০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে কংগ্রেসের অধিবেশন চলছিলো। সেখানে কংগ্রেস সভাপতি গোখলে সরলা দেবিকে ‘বন্দে মাতরম’ গানটি গাইতে অনুরোধ করেন। সরলা দেবী ‘সপ্ত কোটি’-কে চট করে ‘ত্রিংশ কোটি’ করে দিয়ে এই গান গেয়ে ফেলেন। মুগ্ধ এবং স্তম্ভিত হয়ে যায় অনুষ্ঠানে আগত লোকজন। বন্দে মাতরম গানের প্রথম সুর সরলা দেবীরই দেওয়া। এই সুর তিনি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে। গানের প্রথম দুই লাইনের সুর করেছেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং নিজে।

সরলা দেবী শেষ বয়সে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের সংগে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন । সে কারণে অনেকেরই ধারনা যে তিনি বোধ হয় সশস্ত্র আন্দোলনের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন। এই ধারণাটি খুব সম্ভবত ভুল। সশস্ত্র আন্দোলনের প্রতি বিরূপ মনোভাব থাকলে তিনি তাঁর প্রথম জীবনে অস্ত্র শিক্ষা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। সেই সময় প্রত্যক্ষভাবে একজন নারীর পক্ষে সশস্ত্র আন্দোলনে যোগ দেওয়াটা কিছুটা অসম্ভবই ছিলো। সে কারনেই হয়তো সব দিক বিবেচনা করে অহিংস আন্দোলনকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। তবে, আন্দোলনের যে পথই বেছে নিন না কেনো, দেশের প্রতি মমতায় তাঁর বিন্দুমাত্র কোনো খাঁদ ছিলো না। শোণিতে স্বদেশপ্রেম বয়ে নিয়ে বেড়ানো এক শুভ্র এবং সুন্দর নারী ছিলেন তিনি। বিদেশি শাসকমুক্ত স্বদেশের জন্য আজীবন লড়াই করে গেছেন তাঁর মতো করে।