আমেরিকার “ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন(NSF)” এর ২০১৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী শতকরা ৪৫ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান “জ্যোতিষশাস্ত্র(ASTROLOGY)” কে একপ্রকার বিজ্ঞান মনে করে ।আর সে দেশে ক্রিয়াশীল জ্যোতিষীদের সংখ্যা লাখের উপরে ।তথ্যটি যেকোনো বিজ্ঞানমনস্ক মানুষকে আঁতকে দেয়ার মত যথেষ্ট ।আর যখন আমেরিকার মত সর্বাধুনিক রাষ্ট্রের মানুষের এই দশা তখন বঙ্গদেশের কর্ম ফাঁকি দিয়ে স্বর্গ লাভের আশায় থাকা বাঙ্গালীর অবস্থা যে আরও করুন হবে তাতে সন্দেহ নেই।সেটা বুঝতে বোধহয় কোন রিপোর্টের প্রয়োজন পরবে না চারপাশে একটু খোলাচোখে তাকালেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। দেশের রোজকার দৈনিক পত্রিকাগুলোয় দিনের অনেক গুরুত্বপুর্ণ খবর বাদ গেলেও “আপনার দিনটি কেমন যাবে” বা “আপনার রাশিফল” বিভাগটি কখনো বাদ যায় না ।আবার কিছু কিছু টিভিচ্যানেলে সকালের বিশেষ আয়োজন থাকে এই রাশিফল নিয়ে। অথচ এমন অনেক পত্রিকা রয়েছে যাদের বিজ্ঞান নিয়ে সাপ্তাহিক আয়োজন টুকুও নেই। বরঞ্চ বিজ্ঞাপন কম আসে বলে কোন কোন পত্রিকা সেই সাপ্তাহিক আয়োজনটুকুও বাদ দিয়ে দেয় ।কিন্তু এই বিশেষ বিভাগ চালু রাখতে তাদের কোন সমস্যা নেই। কারণ একটাই এদেশে তো এই কুখাদ্যের ভোক্তার অভাব নেই। । হয়ত কেউ কেউ বলতে পারেন তাদের কাছে বিষয়টি নিছক বিনোদনের ।হ্যাঁ সেটা হতেই পারে ।কিন্তু বিষয়টি যদি শুধু বিনোদনের জায়গায় থাকত তাহলে কি জ্যোতিষীদের চেম্বার ,পাঁথরের দোকান বসুন্ধরার মত বড় বড় শপিং মলে কি দেখা যেত ? ।রাস্তার মোড়ে মোড়ে পত্রিকার দোকান গুলোতে কি দেখা যেত মাসিক,বাৎসরিক ভাগ্যলিপির পঞ্জিকা?আর টিভিচ্যানেল গুলোতেই বা কি দেখা যেত এদের রমরমা বিজ্ঞাপন?না মোটেই দেখা যেত না । বিজ্ঞানের এই চরম অগ্রগতির যুগে অপবিজ্ঞানগুলোর প্রসার একটি ভয়াবহ সামাজিক সংকট তৈরি করেছে ।আর এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বিজ্ঞানকে এদের নিজেদের কাজে ব্যবহার।এখন ইন্টারনেটে খোঁজ করেলেই পাওয়া যায় হাজার খানেক মুশকিলে আসান সেন্টারের ওয়েব অ্যাড্রেস ।পাওয়া যায় দৈনিক, মাসিক ,বাৎসরিক ভাগ্য জানার মোবাইল অ্যাপস,বিভিন্ন সফটওয়্যার। আর তাদের নিয়মিত আন্তজার্তিক কনফারেন্স তো আছেই। তবে সে যাইহোক বিজ্ঞানের মুখোশ পড়ে থাকলেই তো আর জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে না ।আর আজকে আমরা এই মিছে বিজ্ঞানের ভিতরটাই দেখার চেষ্টা করব ।এর আগমন ,এর প্রসার । আর দেখব কিভাবে এরা নিজেদের হিসেবে নিজেরাই গোলমাল পাকিয়ে মিছেবুলির পুড়িয়া বেচে চলেছে ।
জ্যোতিষ শাস্ত্রের ইতিহাসঃ মানব সভ্যতা কৃষি ভিত্তিক সমাজে প্রবেশের সময় থেকেই চন্দ্র –সূর্য ও নক্ষত্রের অবস্থান দেখে ঋতু পরিবর্তন বুঝে নেওয়ার এক ধরনের প্রচলন শুরু হয়।তাই বলতে গেলে মোটামুটি এর ইতিহাস প্রায় দশ হাজার বছরের।তবে একে শুধু জ্যোতিষ শাস্ত্রের সূত্রপাত বললে ভুল হবে ,এটি প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূত্রপাতও বটে ।বিজ্ঞানের কিছু প্রাচীন শাখার ন্যায় জ্যোতির্বিজ্ঞানও একটি সময় পর্যন্ত জ্যোতিষ শাস্ত্রের মত অপ বিজ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত ছিল।যেমন –কেমিস্ট্রি মানে রসায়ন ছিল অ্যালকেমি বিদ্যার সাথে সম্পৃক্ত।কারণ প্রাচীন কালে পর্যবেক্ষণের সীমাবদ্ধতা ও গাণিতিক হিসাব পদ্ধতি অনুন্নত থাকার ফলে সে সময় ব্যক্তি বিশ্বাসের সাথে পর্যবেক্ষণ তালগোল পাকিয়ে এ ধরনের অপ বিজ্ঞানের জন্ম নেয় ।যাহোক সে সময়কার মানুষরা রাতের আকাশে লক্ষ করেছিল যে বছরের বিভিন্ন সময়ে কিছু নিদিষ্ট নক্ষত্রমণ্ডলের আবির্ভাব ঘটে ।এসব পর্যবেক্ষণ তাদেরকে শীত ,গ্রীষ্ম ,বর্ষা সম্পর্কে বেশ আগেই অবগত করত ।যেমন মিশরের প্রাণ নীল নদের বন্যা বছরের একটি নিদিষ্ট সময়ে হত এবং বন্যায় আসা পলিতে উর্বর জমিতে ভাল চাষ হত । একটি নিদিষ্ট নক্ষত্র মণ্ডলে সূর্যের অবস্থানই তাদের বন্যার আগমনের কথা জানান দিত । এভাবে ক্রমেই তারা চন্দ্র –সূর্য-নক্ষত্রের নিয়মবদ্ধ চলাচল আবিষ্কার করেছিল এবং আকাশে চন্দ্র–সূর্য–নক্ষত্রের অবস্থান ধীরে ধীরে তাদের ধর্মীয় ,সামাজিক রীতিনীতিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করে।আকাশে চন্দ্র-সূর্য- নক্ষত্রের নিয়মবদ্ধ চলাচল আবিষ্কার হওয়ার ফলে তৈরি হয় বর্ষপঞ্জি । কোথাও তৈরি হয় সৌর বর্ষপঞ্জি আবার কোথাও চন্দ্র বর্ষপঞ্জি ।সুমেরীয়রা ও ব্যাবিলনীয়ানরাই প্রথম বছরকে ১২ টি মাসে ভাগ করে ।জ্ঞাত তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন মাসে বিভিন্ন নক্ষত্র মণ্ডলের উপস্থিতি দেখে ব্যাবিলনীয়ানরাই ৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সর্বপ্রথম রাশিচক্র প্রণয়ন করে ।পরে তা মহাবীর আলেকজান্ডারের হাত ধরে মিশর ,গ্রীসে,ভারতে আসে । এছাড়া ব্যাবিলনীয়ানরা ৭৮৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দেই তখনকার আবিষ্কৃত পাঁচটি গ্রহের সুশৃঙ্খল ও ধারাবাহিক তালিকা প্রণয়ন করেন ।এর প্রায় ৯০০ বছর পর এই তালিকা ব্যাবহার করে টলেমী গণিত সহযোগে ভূকেন্দ্রিক মানে পৃথিবী কেন্দ্রিক বিশ্ব মডেলের ধারনা দেন। কোপার্নিকাসের পূর্ব পর্যন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানে এই মডেলের ব্যাপক প্রভাব ছিল।আর এটিই এখন জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রামাণ্য মডেল। আর আমরা দেখতে পাই এই টলেমীতেই জ্যোতির্বিজ্ঞান আর জ্যোতিষশাস্ত্র মিলেমিশে একাকার ।একদিকে তার “আলমেজেস্ট” বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক অনন্য গ্রন্থ অপরদিকে তাঁর “টেট্রাবিবলস” জ্যোতিষশাস্ত্রের একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহিত হয় ,বলতে গেলে এটি জ্যোতিষীদের কাছে বাইবেলের মত।অর্থাৎ সে সময় একি ব্যক্তি এক সাথে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা করত।আর সে সময়ের রাজা বাদশাহদের জ্যোতির্বিজ্ঞানের বদলে জ্যোতিষশাস্ত্রে পৃষ্ঠপোষকতা এর অন্যতম একটি কারণ ।প্রাচীন ভারতের দিকে তাকালেও আমরা একি চিত্র দেখতে পাই।বরাহমিহিররের(৫০৫-৫৮৭ খ্রিষ্টাব্দ) “সিদ্ধান্ত” যেমন গ্রহ,নক্ষত্র,সূর্যগ্রহণ বিষয়ক গণিত সম্বলিত গ্রন্থ তেমনি “হোরা” হল ভাগ্য গণনা ,যাত্রার শুভ-অশুভ বলে দেওয়ার অপ বিজ্ঞান ।তবে জ্যোতিষশাস্ত্র হতে জ্যোতির্বিজ্ঞান পৃথক হতে শুরু করে ১৬শ শতকে কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক সৌর মডেলের আবির্ভাবের মাধ্যমে।এর ফলে টলেমীর ভূকেন্দ্রিক মডেল বাতিল হয়ে যায়।তবে মোটা দাগে বলতে গেলে কেপলারের(১৫৭১-১৬৩০) পর থেকেই এই দুটি বিষয় পৃথক ভাবে চর্চা হতে শুরু করে।কেপলারের সকল কাজ জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর হলেও তাঁর মাঝে জ্যোতিষশাস্ত্রের ভালো রকমের চর্চা লক্ষ করা যায় । পর্যবেক্ষণ ও গাণিতিক হিসেব পদ্ধতির উন্নতির সাথে সাথে কোপার্নিকাস,টাইকো,কেপলার,গ্যালিলিওদের হাত ধরে ধারাবাহিক ক্রমবিকাশের মাধম্যে জ্যোতির্বিজ্ঞান তাঁর আজকের অবস্থানে এসেছে।অপরপক্ষে ধীরে ধীরে রাজতন্ত্র বিলোপ এবং জ্যোতিষীদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় উপস্থিতি ,কদর হ্রাস পেতে থাকলে এই শাস্ত্রটির ব্যাপক ভাবে সামাজিকীকরণ ঘটে ।
রাশিচক্র কি? জ্যোতিষশাস্ত্রের সবচেয়ে বড় স্তম্ভ হল রাশিচক্র ।রাশিচক্রটা কিভাবে পাওয়া গেল তা বুঝতে হলে ক্ষণিকক্ষণ কিছু সাধারন বিষয় আমাদের জানা জরুরি । পৃথিবী পশ্চিম হতে পুবে ঘুরছে অর্থাৎ পৃথিবীর আহ্নিক গতি আছে বলেই যে সূর্য প্রতিদিন পূবে উদয় হয়ে পশ্চিমে অস্ত যায় তা বোধ হয় আমরা সকলেই জানি।এখন আমাদের এই বিশাল অর্ধগোলকাকৃতি যে আকাশটিতে সূর্য চন্দ্র ও অন্যান্য জ্যোতিষ্ক গুলো দেখা যায় সেটাকে যদি একটি গোলক চিন্তা করি তবে সেটাকে বলা হবে খ-গোলক ।এই খ-গোলক বরাবর সূর্য ,চন্দ্র ও জ্যোতিষ্কগুলি বছরে একটি নিদিষ্ট পথে পরিভ্রমণ করছে। খ-গোলোকে সূর্যের ভ্রমণপথকে বলা হয় ক্রান্তিবৃত্ত ।আর মাঝ বরাবর পৃথিবীর বৃত্তকে বিষুববৃত্ত বলা হয়। যদি পৃথিবী ২৩.৫ ডিগ্রি কোনে হেলে না থাকত তাহলে পৃথিবীর বিষুববৃত্তই হত এর ক্রান্তি বৃত্ত ।এখন আমরা এই ক্রান্তিবৃত্ত হতে উত্তর ও দক্ষিণে ৯ ডিগ্রি করে ১৮ ডিগ্রি চওড়া ব্রেসলেটের ন্যায় আকাশের এই অংশটি আলাদা ভাবে লক্ষ করি, তাহলে দেখা যাবে সারা বছরে পর্যায়ক্রমে আকাশের ৮৮ টি নক্ষত্র মণ্ডলের ১২ টি নক্ষত্রমণ্ডল বৃত্তাকার ব্রেসলেটের ন্যায় অংশটিতে অবস্থান করে । চওড়া বৃত্তাকার ব্রেসলেটের ন্যায় আকাশের এই অংশটিকে বলা হয় ক্রান্তিবলয় ।
চন্দ্র ও কিছু গ্রহের ভ্রমনপথও এই ক্রান্তি বলয়ের মধ্যে। রাতের আকাশে এই ক্রান্তিবলয়ে মাস ভেদে এই ১২ টি নক্ষত্রমণ্ডলের ধারাবাহিক অবস্থান আমরা দেখতে পাই।প্রাচীন জ্যোতির্বিদরা এই ক্রান্তিবলয়কে ৩০ ডিগ্রি করে ১২ টি নক্ষত্রমণ্ডলের জন্য ১২ টি ভাগে ভাগ করে।একেই তারা রাশিচক্র হিসেবে অভিহিত করেছিল । এই ক্রান্তিবলয় বরাবর সূর্যের দিনে প্রায় ১ ডিগ্রী করে সরণের ফলে সূর্য সে সময় প্রতিটি রাশিতে প্রায় ৩০ দিন করে অবস্থান। সেকারনে প্রাচীন কালে রাশিচক্র সময় ,মাস জানার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ন ছিল।আর এই রাশিচক্রই আজ জ্যোতিষ শাস্ত্রে ভিন্ন কাজে ব্যবহিত হয়ে আসছে।
অয়নচলন ও রাশিচক্রের বিভ্রান্তি: জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী কারো রাশি নির্নয় করা হয় তার জন্মমূহুর্তে সূর্য যে রাশিতে অবস্থান করে ।তাদের মতে এই রাশি অনুযায়ি নাকি মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয়। এখন তাদের কথা ধরেই দেখি তাদের ভুলটা কোথায়।
পত্রিকায় রাশিফল বিভাগে প্রথম যে রাশিটি আমরা দেখি তা হল মেষ রাশি ।আর ২১ মার্চ থেকে ২০ এপ্রিল সময়ে জন্মগ্রহণকারীরা এই রাশির জাতক।মজার ব্যাপার হল বর্তমান শতকে এই সময়ে সূর্য মেষ রাশিতে নয় বরং তা মীন রাশিতে অবস্থান করে ।এই গোলমাল অন্যান্য রাশির ক্ষেত্রেও একই রকম।এই গোলমালের মূল কারণ হচ্ছে পৃথিবীর “অয়নচলন”।আমরা জানি বিষুববৃত্ত ও ক্রান্তিবৃত্ত ২৩.৫ ডিগ্রী কোনে পৃথক রয়েছে এবং এই বৃত্ত দুটি পরস্পরকে দুটি বিন্দুতে ছেদ করে ।এই বিন্দু দুটিকে বলাহয় মহাবিষুব এবং জলবিষুব বিন্দু ।সহজ ভাবে বলতে খ-গোলকে এই দুটি বিন্দু হচ্ছে বছরে দুইদিন বিষুববৃত্তের উপর সূর্যের অবস্থান।এ দুই দিন হচ্ছে ২১ শে মার্চ(দিন রাত্রি সমান) এবং ২৩ শে সেপ্টেম্বর ।মহাবিষুব বিন্দুকে ক্রান্তিবৃত্তের শূন্য ডিগ্রী বিন্দু বা প্রারম্ভ বিন্দু ধরা হয়।এ কারণে ২০০০ বছর আগে ২১ শে মার্চ এই মহা বিষুববিন্দু হতে পরবর্তী ৩০ ডিগ্রী পর্যন্ত সূর্য মেষ রাশিতে অবস্থান করত বলেই মেষ রাশিকে রাশিচক্রের প্রথম রাশি ধরা হয়।গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল প্রতিবছর এই বিষুব বিন্দু দ্বয় তাদের অবস্থান পরিবর্তন করছে।প্রতি ৭২ বছরে এই বিন্দু দুটির ১ ডিগ্রী করে অগ্রগমন ঘটে এবং বর্তমান অবস্থায় ফিরে আসতে তাদের ঠিক ২৬০০০ বছর লাগবে । বিষুব বিন্দু দ্বয়ের এই চলনকেই অয়নচলন বলে।মনে প্রশ্ন জাগতে পারে কেন এমনটি ঘটে ?এর কারণ হচ্ছে পৃথিবীর ঘূর্নণ অক্ষের স্বল্প গতির ঘূর্নণ।পৃথিবী যেমন নিজ অক্ষে ঘুরে চলছে তেমনি এর ঘুর্নন অক্ষটিও নিজ অবস্থান থেকে নিয়ম মাফিক সরে যাচ্ছে । এই ঘূর্ননঅক্ষটি প্রতি ২৬০০০ বছরে চিত্রের ন্যায় একবার পূর্ণ ঘূর্ণন সম্পন্ন করে।পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষের এই সরণের ফলে ক্রান্তিবৃত্তেরও সরণ ঘটছে এবং এর ফলেই বিষুব বিন্দু দ্বয়ের সরণ বা “অয়নচলন” ঘটছে।ঘূর্ণন অক্ষের সরণের ফলে কিছু চমকপ্রদ ঘটনাও ঘটে ।যেমন আমরা উত্তর আকাশে বর্তমানে যে স্থানে ধ্রুবতারা দেখি ১৩০০০ বছর পর সেখানে বীণা মণ্ডলের অভিজিৎ নক্ষত্রটিকে দেখা যাবে এবং এরও ১৩০০০ বছর পর সেখানে পুনরায় ধ্রুবতারাকে দেখা যাবে । যাহোক হয়ত একটি প্রশ্ন আসতে পারে যে অয়নচলনের সাথে রাশিচক্রের রাশির অবস্থান পরিবর্তনের সম্পর্ক টা কি?সম্পর্ক টা বেশ সহজ । আজ থেকে ২০০০ বছর আগের কোন এক সময় রাশিচক্র তৈরি হয় তখন সূর্য ২১ মার্চ তারিখে সূর্য মেষ রাশিতে প্রবেশ করত যা আগেই বলা হয়েছে।যা টলেমীর “টেট্রাবিবলস” হতে জানা যায়।টলেমী তাঁর “টেট্রাবিবলস” এ বলেছেন “সূর্য তখন ২১ শে মার্চ তারিখে মেষ রাশিতে প্রবেশ করে এবং ২২ এপ্রিল পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করত”।কিন্তু আজ ২০০০ বছর পর মহাবিষুব বিন্দুর প্রায় ২৭ ডিগ্রী সরণের ফলে সূর্য এখন ২১ শে মার্চ মীন রাশিতে(নক্ষত্রমণ্ডল) প্রবেশ করে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করে এবং ১৪ই এপ্রিলে গিয়ে সূর্য মেষ রাশিতে প্রবেশ করে । রাশিচক্রের অন্যান্য রাশির ক্ষেত্রে একই অবস্থা এবং রাশি গুলোতে সূর্যের অবস্থানের সময় কালেরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। যেমন সূর্য কন্যা রাশিতে অবস্থান করে ৪৪ দিন আবার বৃশ্চিক রাশিতে অবস্থান করে মাত্র ৭ দিন । জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে জন্মমুহুর্তে সূর্যের অবস্থানই মানুষের রাশি নির্ধারন করে। এই শাস্ত্র মতে ১ আগস্ট জন্ম গ্রহণকারী হবে সিংহ রাশির তবে বর্তমানে এই দিন সূর্য অবস্থান করে কর্কট রাশিতে।তার মানে একই ব্যাক্তি এক সাথে পৃথক দু ধরনের ভাগ্যর অধিকারী !
আরও মজার ব্যাপার হল কারো জন্ম যদি ২৯ নভেম্বর থেকে ১৮ই ডিসেম্বরের মধ্যে হয় তাহলে তার জন্য বর্তমানে রাশিচক্রের কোন রাশিই বরাদ্দ নেই কারণ এই সময় সূর্য সর্পধারী নক্ষত্রমণ্ডলে(Ophiucus) অবস্থান করে।তাই কারো সাথে যদি পত্রিকার রাশিফল বা কোন জ্যোতিষীর ভবিষৎবাণী কাকতালীয় ভাবে মিলেও যায় তবে তৃপ্তির ঢেকুর তোলার কোন কারণ নেই ,কারণ আপনি নিজেকে যে রাশির জানেন আদতে আপনি মোটেও সেই রাশির নন।
সূর্য যেখানে গ্রহ এবং গ্রহ -নক্ষত্রের প্রভাব: জ্যোতিষশাস্ত্রে ভাগ্যগননার আর একটি বড় উপাদান হল গ্রহ ও তাদের অবস্থান।শাস্ত্রমতে গ্রহ নক্ষত্রদের সময় ভেদে অবস্থানের উপরেই নাকি অর্থপ্রাপ্তি ,ব্যবসার লাভক্ষতি,বিদেশ গমন ,রোগ, রোমান্স,বিয়ে,পরীক্ষায় ছাড়াও ইহ জাগতিক সকল কর্মর নির্ভর করে।তাহলে এখন খালিচোখে তাদের দাবিগুলোর আসড়তাটা দেখি।এখনপর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্রহের সংখ্যা হাজারেরও উপরে আর সেখানে জ্যোতিষশাস্ত্রের গণনায় আছে শুধুমাত্র প্রাচীন পৃথিবীর আবিষ্কৃত সেই ৫টি গ্রহ।আর ইউরেনাস ও নেপচুনকে তাদের এই গণনায় খুঁজে পাওয়া না গেলেও রাহু কেতু নামে দুটি কাল্পনিক গ্রহকে তাদের গণনায় পাওয়া যায় ।মজার বিষয় হচ্ছে মহাবিশ্বের এত গ্রহের মাঝে জ্যোতিষীরা গ্রহ স্বল্পতায় পরে সূর্যকে একটি গ্রহ হিসেবেই বিবেচনা করে!
বাস্তবিক অর্থে গ্রহ,নক্ষত্র গুলোর কোন শক্তি বা বলের এমন কোন প্রভাবই নেই যা মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে।আর পৃথিবীর উপর যদি কোন বলের প্রভাব থেকে থাকে তা হল মহাকর্ষীয় বল।তবে গ্রহ,নক্ষত্র গুলো পৃথিবী হতে এত দূরে যে তারা পৃথিবীর উপর মহাকর্ষীয় বা অভিকর্ষ জনিত যে বল বা শক্তি প্রয়োগ করে তার পরিমাণ অতি নগণ্য ।তাই কারো জন্ম মুহূর্তে গ্রহ-নক্ষত্রের আকর্ষণ বলের ক্রিয়া জন্মগ্রহণ কারীর ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করছে এমনটি ভাবার কোন যুক্তি নেই ।
উপরের চিত্র টি লক্ষ করি।প্রথম ছবিটি হল সিংহ নক্ষত্র মণ্ডলের।কয়েক মিলিয়ন বছর পরে সিংহ মণ্ডলের নক্ষত্রগুলো ২য় চিত্রের ন্যায় বিন্যস্ত হবে ।২য় চিত্রের নক্ষত্র গুলো নিয়ে কি কোন চিত্র কল্পনা করা যায়?দেখুনতো রাডার বা ভূ-কৃত্রিম উপগ্রহ কল্পনা করা যায় কিনা ।তাঁর মানে কি কয়েক মিলিয়ন বছর পর কিছু মানুষের আচরণ ,বৈশিষ্ট্য কি ভূ-কৃত্রিম উপগ্রহের ন্যায় হওয়া উচিত ?
তাই সর্বশেষ এটুকুই বলতে চাই যে প্রাচীনকালে মানুষ আকাশের বিভিন্ন অংশের এলোমেলো নক্ষত্রগুলোর মাঝে তাদের ঘটমান জীবনের পরিচিত বিষয়ের সাথে সাদৃশ্য খোঁজ করত বলেই কোন নক্ষত্র মণ্ডলকে মেষের ন্যায় আবার কোন নক্ষত্রমণ্ডলকে কন্যা ইত্যাদি রূপে কল্পনা করেছিল।তাই বর্তমান সময়ে নক্ষত্রমণ্ডল গুলোর নাম ও কল্পিত চিত্রগুলো তাদের মতই রয়ে গিয়েছে।আমরা চাইলে সেখানে অন্য কিছু খুঁজে পেতে পারি ।তাই কোন নক্ষত্র মণ্ডলকে সিংহ হিসেবে কল্পনা হয়েছে বলে তার প্রভাবে কারো বৈশিষ্ট্য তেজ দীপ্ত, সাহসী হবে তা ভাবার কোন কারণ নেই।
তথ্যসূত্রঃ
বিজ্ঞানের ইতিহাস-সমরেন্দ্রনাথ সেন
নক্ষত্র পরিচয় –বিকাশ চন্দ্র ভৌমিক সম্পাদিত
বিজ্ঞান,জ্যোতিষ ও সমাজ – উৎস মানুষ
ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের রিপোর্ট- http://www.nsf.gov/statistics/seind14/content/chapter-7/c07.pdf
পৃথিবীর জীবনে যদি গ্রহ নক্ষত্রের সম্পর্ক নাই থাকে তবেচন্দ্র সূর্যের আকর্ষণে কেন সমুদ্র বা নদীতে জোয়ার ভাটা হয়?
সহজ সহজ ছোটো ছোটো মিথ্যাকেও প্রশ্রয় দিলে তাও একদিন সত্য বলে মনে হয়কি! তেমনিভাবে এই জ্যোতিষশাস্ত্রও প্রশ্রয় পেতে পেতে অধিকাংশ মানুষের কাছে সত্য রূপে ধরা দিচ্ছে। যেমন অনেকেই হোমিওপ্যাথিকেও প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে চিকিৎসাবিদ্যায় অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেছে। তাই মনে করি এসব নিয়ে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে।
@শান,
কথা সইত্য।
ভবিষ্যদ্বাণী, খনার বচন, গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব- এসব একেবারে উড়িয়ে দেয়ার মত গবেষণা এখনও হয়নি বলে মনে করি। পূর্ণগ্রাস এবং দৃশ্যমান চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্য্যগ্রহণকালে মানবদেহের উপর গ্রহ-নক্ষত্রের কোন প্রভাব পড়ে কিনা, তা ঐ সময়ের একজন পূর্ণ গর্ভবতী মা-ই বলতে পারেন। খনার বচন তথা ভবিষ্যদ্বাণী এই বিজ্ঞানের যুগেও অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে কিনা, তা একজন প্রবীণ চাষা-ই বলতে পারেন।
ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার এক ‘শাস্ত্র-সিন্ধু’র করা ভবিষ্যদ্বাণী প্রসঙ্গে ১৩৭৯ সালের ১৫ মাঘ দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় এক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
১। ইয়াহিয়া- মুজিব বৈঠক সম্বন্ধে তিনি বলেছিলেন, “আপনারা বৈঠকের ফলাফল সম্বন্ধে দিন গুণছেন। আমি তো দেখছি এ আলোচনা ব্যর্থ হবে।”
২। কালরাত্রি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “তোমাদের দেখতে এলাম। আর হয়তো দেখা হবে না। আগামী ১১ চৈত্র (২৫ মার্চ) হতে পাক সেনারা বাঙালী হত্যা শুরু করবে।”
৩। বঙ্গবন্ধু যখন পাক কারাগারে বন্দী তখন বলেছিলেন, “১৯ পৌষ থেকে শেষ মুজিবের সুদিন শুরু হবে।”
@রিপন, উপরের উদাহরণসমূহের রেফারেন্স দিতে পারবেন, প্লিজ…?
@ঔপপত্তিক ঐকপত্য,
১। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উদাহরণের রেফারেন্স দেয়া দরকার ছিল, তা তো (পত্রিকার নাম এবং প্রবন্ধ প্রকাশের তারিখ) দিয়েছিই। এ বিষয়ে আরও রেফারেন্স যদি চান, সেক্ষেত্রে মাহবুব-উল আলম এর “বাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত” গ্রন্থে এর উল্লেখ রয়েছে।
২। খনার বচনে ভবিষ্যদ্বাণীর রেফারেন্স গ্রন্থ হচ্ছে, ড. আলি নওয়াজ এর ‘খনার বচন কৃষি ও কৃষ্টি’।
৩। মানবভ্রূণের উপর ‘পূর্ণগ্রাস এবং দৃশ্যমান চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্য্যগ্রহণ’ এর প্রভাব সরাসরি জীবন থেকে নেয়া, কোনও গ্রন্থ রেফারেন্স আপনাকে দিতে পারছি না।
এই ধরনের মুক্তো ও মুক্ত লেখা আরও আসুক। তবে, মন্তব্যের মাঠে লেখক অণুপস্থিত থাকলে জমে?
@গুবরে ফড়িং, ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।অনুপস্থিতির জন্য দুঃখিত । ব্যস্ততার কারণে আসা হয়ে উঠে নি
ধন্যবাদ লেখাটার জন্য। অনেকেই জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস না করেও নিছক আনন্দের জন্য রাশিফলের কলামটা দেখে, এটাও সব পত্রিকায় কলাম থাকার একটা কারণ। টিভিতে মাঝেমধ্যে দেখি সুরক্ষা বলয়ওয়ালা আংটির বিজ্ঞাপন দেয়া হয়! বিজ্ঞান এগিয়ে গেলেও এখনও কুসংস্করাচ্ছন্ন মানুষের সংখ্যাটা আশংকাজনক।
লেখার শিরোনামে বানান ভুল আছে।
@রামগড়ুড়ের ছানা, ধন্যবাদ লেখাটি পড়া ও মন্তব্যের জন্য ।শিরোনাম টা এডিট করতে পারছিনা ।
@ফয়সাল বিন তৌহিদ সিদ্দিকি,
শিরোনামটা ঠিক করে দিচ্ছি আমি।
অনেকেই বলেন, জ্যোতিষশাস্ত্র অবৈজ্ঞানিক, তবে ক্ষতিকর নয়। কিছু মানুষ এভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে পারলে করুক না!
কিন্তু তারা বুঝতে পারেন না যে জ্যোতিষী, পীর কিংবা ইমামদের কাজ সম্পূর্ণ আনপ্রোডাক্টিভ। এদেরকে এসব করতে দেয়ার অর্থ শ্রমশক্তির অপচয়। তাছাড়া জ্যোতিষীর কাছে মানুষই বা কেন যায়? আপনি ব্যবসায় লস খেয়ে জ্যোতিষীর কাছে গেলে সে আপনাকে হাজার টাকা দামের পাথরের আংটি পরতে দেবে। অথচ ঐ হাজার টাকা দিয়েই আপনি নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে পারতেন।
@লাবিব ওয়াহিদ, ঠিক বলেছেন
ধন্যবাদ, অনেক কিছু জানার ছিল। আমরা অনেকে অনেক কিছুই জানি না। আপনা এই পোস্টটি দ্বারা অনেকে কিছু তথ্য জানতে পারবে।আমি আপনাকে কোন প্রকার অফার করছি না। ছোট একটি তথ্য আপনার উপকারে আসতে পারে Residential
@আসুজীবন্দাল,
এখানে আপনার এই লিঙ্কটা প্রকাশের কারণ বুঝলাম না।