বাম আন্দোলনের মূল ভিত্তি হলো শ্রেণিহীন সমাজ, সাম্য, মূল্যবোধ, সমাজ-প্রগতি,আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদি। কিন্তু এই উপমহাদেশে তুখোড় এবং প্রজ্ঞাবান বাম নেতৃত্ব থাকলেও রাষ্ট্রের মূল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদেরকে দৃশ্যপটে নিয়ে আসতে পারেনি। রাজনীতির মূলমন্ত্রই হলো জনগণকে নিয়ে, জনগণের চাহিদানুসারে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার বা পরিবর্তনের মূল বা সহায়ক শক্তিরূপে নিজেদের দৃশ্যমান করে আন্দোলন সংগ্রাম এবং সমাজ প্রগতির ধারাকে এগিয়ে নেয়া। এখানেই রাজনীতির সফলতা ব্যর্থতা নির্ভর করে। ভারত উপমহাদেশের বাম আন্দোলন তথা এই অঞ্চলের বাম আন্দোলন বরাবরই হয় জনগণের চাহিদার আগে হেঁটেছে কিংবা পিছনে হেঁটেছে, সাথে হেঁটেছে খুব অল্প সময় বা বিচ্ছিন্নভাবে। বহুধা বিভক্ত হয়েছে বাম ঐক্য, পিছিয়েছে সমাজ প্রগতির সংগ্রাম, রাজনীতি হয়ে উঠেছে হালুয়া রুটির ভাগ বাটোয়ারার অভয়ারণ্য।

বিশ্ব-রাজনীতির অনুসারী হতে গিয়ে ষাটের দশকের শেষ দিক থেকে পিকিং এবং মস্কোপন্থী হিসেবে বিভক্ত হয়ে সাম্য এবং ঐক্যের রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়েছে এই দেশের প্রগতিবাদী এই রাজনীতি। সাথে রণনীতি কিংবা লক্ষ্য এক থাকলেও রণকৌশল অংশে এসে বহুধা বিভক্ত হয় এঁদের প্রায়োগিক তত্ত্ব। যেমন ভাসানীর মতো বড় মাপের নেতা সত্তরের নির্বাচন বর্জনের মতো জন-বিচ্ছিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। স্লোগান দিয়েছেন ‘ভোটের আগে ভাত চাই’। মূলত: বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসনকে জোর দিতেই ইনি এই লাইনে আসেন। কিন্তু ছয় দফা এবং এগারো দফার জনপ্রিয়তার জোয়ারে বন্যার দুর্ভোগ সহ্য করে মানুষ যখন স্বায়ত্তশাসন নিয়ে উদগ্রীব তখন ভাসানির এই অবস্থান ছিলো জনগণের পিছনে হাঁটা। অন্যদিকে সিরাজ সিকদারদের রণকৌশল ছিলো জনগণকে পিছনে ফেলে অধিক সামনে এগিয়ে যাবার মতো ওভার স্টেপিং।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে যেমন দলীয় সংকীর্ণতা নোংরা ভাবে দৃশ্যমান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালেও তার কমতি ছিলোনা। শেখ মনির অনুসারী বৃহৎ ছাত্র যুব সংগঠন ছাড়াও আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীণ দক্ষিণ কিংবা উদার বা প্রগতিবাদী অংশ কিংবা সিরাজুল আলম খানের মতো র‍্যাডিক্যাল ধারণার অনুসারী অংশ কোনটাই মুক্তিযুদ্ধের অফিসিয়াল ভাগীদার করতে চাননি অন্য কোন রাজনৈতিক দলকে।

অন্যদিকে সিরাজ সিকদারের অনুসারী বলে পরিচিত আব্দুল হক এবং তোয়াহা তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে সিরাজ সিকদার থেকে আলাদা হয়ে যান বেশ আগেই। গঠন করেন পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (মাওবাদী-লেনিনবাদী)। লরেন্স লিফশুলৎস মোহাম্মদ তোয়াহা ও আব্দুল হকের নেতৃত্বাধীন পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (মাওবাদী-লেনিনবাদী)মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে অবস্থান সম্পর্কে বলেন- ‘ভদ্রলোকের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় এঁদের অবস্থান দ্বিধান্বিত আর নিন্দুকের ভাষায় বলতে গেলে দালালীর সমতুল্য’। হক তোয়াহা ১৯৬৮-৬৯ সালে পূর্ববাংলার স্বাধীনতার প্রশ্নে সিরাজ সিকদারের সাথে তাঁদের বিভক্তি শুরু হয়। হক এবং তোয়াহার তত্ত্ব হচ্ছে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার পথ বুর্জোয়া স্বার্থের প্রতিনিধি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানের বিভক্তিকরণকেই সাহায্য করবে। কিন্তু সিরাজ সিকদার এটি মানতে রাজী ছিলেন না।

কিন্তু ২৫ মার্চের কালোরাতের পর হক এবং তোয়াহার মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নকে মূল শত্রু হিসেবে ভিত্তি ধরে চীনের শত্রু ভারতের ষড়যন্ত্রকে রুখে দিতে পাকিস্তানের পক্ষে লড়াই করতে পাকসেনাদের সাথে লড়ে মুক্তিযোদ্ধা খতমের লাইন নেন আব্দুল হক।
অন্যদিকে তোয়াহা আব্দুল হকের এই লাইনের সাথে এক হতে পারেননি। তিনি এবং তাঁর সহযোগীরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চান কিন্তু ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনপুষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নয়। স্বাধীন ভাবে। ফলে উনি এবং ওনার সহযোগীরা পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধা উভয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামেন। দৃশ্যপটে আসে দুই কুকুরের লড়াই তত্ত্ব। ফলে হয়ে পড়েন জন-বিচ্ছিন্ন সংগঠনে।
অন্যদিকে জানুয়ারি ১৯৭১ এ সিরাজ সিকদার রণনীতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন- ‘আমাদের রণনীতি হল জাতীয় দ্বন্দ্বের সমাধান- পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদকে জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাত করে স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠা করা এবং সকল প্রকার জাতীয় নিপীড়নের অবসান করা; সামন্তবাদকে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাত করে কৃষকের হাতে জমি প্রদান করা’।

অনেকেই বলেন সিরাজ সিকদার বঙ্গবন্ধুকে কখনোই নেতৃত্বে দেখতে চাননি, উৎখাত করতে চেয়েছেন। কিন্তু ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দেয়না, অন্তত ৭০ এর নির্বাচনের পরে সিরাজ সিকদারের প্রস্তাবনা সেটা বলেনা। ২ মার্চ ১৯৭১ সিরাজ সিকদার শেখ মুজিবের উদ্দেশ্য একটি খোলা চিঠি লিখেন যার ২ নম্বর প্রস্তাবনা হচ্ছে ‘পূর্ব বাংলার কৃষক – শ্রমিক, প্রকাশ্য ও গোপনে কার্যরত পূর্ব বাংলার সকল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধি সম্বলিত স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী সরকার কায়েম করুন। প্রয়োজনে এই সরকারের কেন্দ্রীয় দপ্তর নিরপেক্ষ দেশে স্থাপন করুন’। তিন নম্বর প্রস্তাবনা ছিলো- ‘পূর্ব বাংলা-ব্যাপী এই সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের আহবান জানান’। এই প্রস্তাবনার মাধ্যমে মূলত সিরাজ সিকদার পূর্ববাংলার নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে মেনে নেন এবং নির্দেশনা দাবি করেন।

২৫ মার্চের কালরাত্রির পর পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির প্রভাবাধীন বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতা কর্মী ও পরিবারকে আশ্রয় দেয় এবং খাদ্য নিরাপত্তা প্রদান করে। কেননা প্রাথমিক প্রতিরোধের পর ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা দেশে প্রবেশের আগ পর্যন্ত সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন অংশ, কাদের সিদ্দীকির গ্রুফ কিংবা এরকম অংশগুলোই মূলতঃ বিচ্ছিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। আবার পিকিং পন্থী বলে পরিচিত এই পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির অনেকেই ভারতে ট্রেনিঙে যেতে আগ্রহী ছিলনা। যারাওবা যেতে চেয়েছে তারা ব্যর্থ হয়েছে। তাঁদের ট্রেনিঙে নেয়া হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের চর হিসেবে ধিকৃত হয়েছে। ফলে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে নিজেরাই গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে বাংলাদেশে থেকেই। এবং বরিশালের পেয়ারা বাগানসহ বিভিন্ন জায়গায় মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলে। অন্যদিকে ভারত থেকে ট্রেনিং প্রাপ্ত হয়ে আসার পর আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা, যারা ২৫ মার্চের পর পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির আশ্রয় গ্রহণ করেছিলো, তারাই সর্বহারা পার্টির সাথে ঐক্যবদ্ধ ভাবে যুদ্ধ করতে অস্বীকার করে এবং দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। ফলে অন্তর্ঘাতে উভয় পক্ষেরই অনেকে নিহত হন। পিকিং পন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্বে পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নিয়ন্ত্রণাধীন অনেক অঞ্চল হাতছাড়া হয়ে যায় সিরাজ সিকদারের দলের।
এইসব ঘটনা, চীনের ঐতিহাসিক ভুল এবং মাওসেতুং এর বাঙালীর মনোভাব বোঝায় অদূরদর্শিতা এবং মাও সেতুং এর প্রতি অন্ধ-মোহ সবকিছু মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ঠিক বিরোধিতা না করেও বাঙালীর মুক্তি বিষয়ে সিরাজ সিকদার তত্ত্বগত-ভাবে ওভার স্টেপিং করে ফেলেন এবং বলেন দেশ প্রেমিক-রূপে আওয়ামী লীগ বাঙালীর উপর ছয় পাহাড়ের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। আওয়ামী লীগকে বর্ণনা করেন ছয় পাহাড়ের দালাল হিসেবে। ছয় পাহাড় বলতে উনি ভারত ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ, সামন্তবাদের প্রতিনিধি, পূর্ববাংলার আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদকে বুঝিয়েছেন। এই ওভার স্টেপিং সিরাজ সিকদারকে জনতার মূল কাতার থেকে ছিটকে ফেলে অনেক দূরে।

কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের গোড়াপত্তনের সবকটি স্টেপে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলো এদেশের বাম চিন্তাচেতণার রাজনীতিকরা। নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত হ’বার পরও এঁরা চেষ্টা করেছে সমাজ প্রগতির সংগ্রামে অবদান রাখতে। রেখেছেও। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের সামনের কাতারে থেকেছে। ’৬২ শিক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। ’৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে। সাথে আবার আন্তর্জাতিকতাবাদের রাজনীতি করতে গিয়ে চরম দলাদলির কোন্দলও কম করে নাই। পিকিং পন্থী, মস্কো পন্থী ভাগে বিভক্ত হয়েছে। তবে তুলনামূলকভাবে মস্কোপন্থীরা অনেকাংশেই চেষ্টা করেছে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও জনতার সাথে হাঁটার। প্রায় গোটা পাকিস্তান আমল জুড়েই রাজনৈতিক ভাবে নিষিদ্ধ থেকেও, সবচে’ বেশি কারা নির্যাতন ভোগ করেও আদর্শের সংগ্রামে ছিলো অবিচল। এঁরা কখনো কাজ করেছে আওয়ামী লীগের ভিতরে ঢুকে, কখনো ন্যাপের মাধ্যমে, কখনোবা শুধুমাত্র শ্রমিক কৃষক ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে।
বঙ্গবন্ধুর ৬ দফাকে এগারো দফায় নিয়ে এসেছিলো ছাত্র সমাজ। ১১ দফায় মূলত সাম্রাজ্যবাদ ও একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থের বিরোধিতা করা হয়েছে। এই ১১ দফাকে সামনে এনেছিলো কমিউনিস্টরা। যেটি সমানভাবে জনপ্রিয়তা পায়। যাই হোক, ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের সময় মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের প্রধান কমরেড মনি সিং রাজশাহী জেলে কারাধীন ছিলেন। কিন্তু পাকসেনাদের ভয়াবহ গণহত্যার পর বাঙালীরা মিলে জেলখানা আক্রমণ করে এবং মনি সিং সহ রাজবন্ধীদের মুক্ত করে আনে তালা ভেঙে। এবং সেখান থেকেই মনি সিংকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ভারতে।

আগেই বলেছি একটি অপ্রিয় সত্য ইতিহাস হচ্ছে ’৭০ এর নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ এতোটাই মোহগ্রস্ত ছিলো যে অন্য কোন দলকে অফিসিয়ালি মুক্তিযুদ্ধের ভাগীদার করতে চায়নি এমনকি ছাত্র ইউনিয়নের যে সব নেতা কর্মী ভারতে প্রথম ধাপে ট্রেনিং নিতে গিয়েছিলো তাতে বাধা দিয়েছে মুজিব বাহিনী। বিষয়টি সমাধানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটা ভূমিকা ছিলো। চীন এবং আমেরিকার মতো বৃহৎ শক্তি সামাল দিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সবচে’ বেশি সমর্থন দেয়া ভারতের দরকার ছিলো আন্তর্জাতিক সমর্থনের। ফলে অন্য বৃহৎ শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুকূল অবস্থান জরুরী ছিলো। সেই বিবেচনায় সোভিয়েতের সাথে মৈত্রী চুক্তি করে ভারত আন্তর্জাতিক ভাবে নিজেদের সুরক্ষিত করার কৌশল নেয়। এটি করতে গিয়ে মস্কো-পন্থীদের মূল ফ্রন্টে নিয়ে আসা দরকার ছিলো। সেই লক্ষ্যে গঠিত হয় মুজিব নগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। যেখানে অন্তর্ভুক্ত হন কমরেড মনি সিংহ, কমরেড মোজাফফর আহমেদ। গঠিত হয় ন্যাপ সিপিবি ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনী। যারা সরাসরি বীরত্ব পূর্ণ অবদান রেখেছেন সম্মুখ যুদ্ধে। কিন্তু খেয়াল করবেন মূল বাহিনীর সাথে কিন্তু এঁরা ট্রেনিং নিতে পারেনি। কিন্তু যেসব পিকিং পন্থী কমিউনিস্ট চীনের অবস্থানকে অবজ্ঞা করে ভারতে ট্রেনিং এ গিয়েছিলেন (যেমন মেনন, কাজী জাফর) তাঁরা প্রস্তাব দিয়েছিলেন যেহেতু সর্বদলীয় সমন্বয় কমিটি আওয়ামী লীগ করতে চাইছেনা তাই কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে একটি বাম পন্থী ফ্রন্ট গঠন করার জন্য। কিন্তু মনি সিং এটি গ্রহণ করেননি। মস্কো-পন্থীদের মূল্যায়ন ছিলো এটি বিভেদাত্মক ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐক্যকে দুর্বল করবে। বামপন্থীদের প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ভারতের মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর হয়। তাছাড়া পৃথিবীর অন্যদেশে মুক্তিযুদ্ধকে কূটনৈতিক ভাবে তুলে ধরতে যে টিমটি ইউরোপ সহ বিভিন্ন দেশ সফর করে সেটিতে ছিলেন সামাদ আজাদ, ন্যাপের দেওয়ান মাহবুব আলী এবং কমিউনিস্ট পার্টির ডা সারোয়ার আলী। যারা আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

মনে রাখা প্রয়োজন বৃহৎ শক্তি চীন তিন তিন বার জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব এনেছে এবং তিনবারই সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর কারণে সেটি সফল হয়নি, নাহলে ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো। ভুলে গেলে চলবেনা আমেরিকার মতো বৃহৎ শক্তি পাকিস্তানের পক্ষে লড়েছে সামরিক কূটনৈতিক উভয় ভাবে। আমেরিকানদের পাঠানো সপ্তম নৌবহর যখন বঙ্গোপসাগর অভিমুখে তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন সাবমেরিন পাঠিয়ে সেটিকে ঠেকিয়েছে। এই যে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত এবং সেটিকে ঠেকিয়ে দেয়ার কূটনৈতিক সফলতা সেটা সফল হয়েছে তাজউদ্দীন, সামাদ আজাদ, মনি সিং এর যৌথ প্রচেষ্টায়। ফলে সামগ্রিক ভাবে বিবেচনা করতে গেলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বামদের অবদান দৈনন্দিন আলোচনা বা গতানুগতিক ইতিহাসে থাকুক আর না থাকুক প্রকৃত ইতিহাসের পাতা ফুঁড়ে সাক্ষ্য দেবেই।