প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে অনুভব করেন না এমন কোনো কবি কি আছেন? সব কবিই তো কম-বেশি প্রকৃতির কবি। তবে কবি জীবনানন্দের কবিতায় যেন প্রকৃতিকে বেশি বেশি করে পাই। তাঁর কবিতায় রয়েছে প্রকৃতির ঘ্রাণ, প্রকৃতির সাথে তাঁর একান্ত প্রেম, নিভৃত অভিসার। ছোট্ট একটি পাতা কিংবা ফুলও কবিকে শিহরিত করতো, ক্ষুদ্র কীটের বুকের ব্যথাও যেন বাজতো তাঁর বুকে তীব্রভাবে। স্বভাবে তিনি ছিলেন লাজুক, চুপচাপ, মুখচোরা ও নির্জন। লোকজনের সাথে তেমন একটা কথা বলতেন না। তাঁর সার্বক্ষণিক সম্পর্ক ছিল প্রকৃতির সাথে। নক্ষত্র, জোনাকি, নদীর জল, বাতাসের ঘ্রাণ, গাছের পাতা, আকাশের নীল, ভোরের শিশির এদের সৌন্দর্যসুধা পান করতেন কবি চোখে ও মনে। এদের সুখ-দুঃখ অনুভব করতেন একান্তভাবে।

জীবনানন্দের “ক্যাম্পে” কবিতাটি নিয়ে নাকি অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছিল। এই কবিতায় কবি লিখেছেন,
“ এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি;
সারারাত দক্ষিণা বাতাসে
আকাশের চাঁদের আলোয়
এই ঘাই হরিণীর ডাক শুনি-
কাহারে সে ডাকে——-
একে একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে।
সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খোঁজে
দাঁতের-নখের কথা ভুলে গিয়ে তাদের বোনের কাছে ওই
সুন্দরী গাছের নিচে জ্যোৎস্নায়!
মানুষ যেমন করে ঘ্রাণ পেয়ে আসে
তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে।“

এই কবিতাটি উদ্ধৃত করে সজনীকান্ত দাস “শনিবারের চিঠি”তে লিখেছিলেন, ‘ ভাইয়েরা না হয় তাহাদের বোনের কাছে আসিল, মানিলাম, আটকাইবার উপায় নাই- কবির তন্ময়তায় না হয় গাছও সুন্দরী হইলো, বুঝিলাম কবির ঘোর লাগিয়াছে। কিন্তু মেয়েমানুষ কি করিয়া নোনা হইলো? নোনা ইলিশ খাইয়াছি বটে, কিন্তু কবির দেশে মেয়েমানুষেরও কি জারক প্রস্তুত হয়? কবি যে এতদিনে হজম হইয়া যান নাই ইহাই আশ্চর্য!” এর উত্তরে কবি লিখেছিলেন, ‘ কিন্তু বাংলাদেশে সজনেগাছ ছাড়াও যে গাছ আরো ঢের আছে- সুন্দরী গাছ বাংলার বিশাল সুন্দরবন ছেয়ে রয়েছে তা সজনের কাছে অবিদিত থাকতে পারে।‘
সজনে বলতে কবি এখানে সজনীকান্তকেই বুঝিয়েছিলেন। তাঁর মারাত্মক রসবোধের পরিচয় পাওয়া যায় এখানে। “নোনা মেয়েমানুষ” বলতে কবি আসলেই কী বোঝাতে চেয়েছিলেন কী জানি!
ওই সময়ে ব্রাহ্মবাদী ও অধিকাংশ মানুষই নিরীহ প্রেমের কবিতাকেও অশ্লীল মনে করতো। রবীন্দ্রনাথের ‘ কেন যামিনী না যেতে জাগালে না’ গানটিকে পর্যন্ত দ্বিজেন্দ্রলাল প্রমুখরা অশ্লীল বলেছিলেন।
‘ক্যাম্পে’ কবিতাটি যখন লিখেন তখন কবি সিটি কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক। এই কবিতাটি লেখার অপরাধেই নাকি সিটি কলেজ থেকে কবি চাকরিচ্যুত হন! চাকরি চলে যাবার মত এমন গুরুতর অপরাধমূলক কী লেখা আছে এই কবিতাতে তা বোধগম্য নয়।

জীবনানন্দ জীবনে বারবার নিদারুণ অর্থসংকটে পড়েছেন। চাকরিচ্যুতির পর আর্থিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। আর্থিক সংকটের বিভিন্ন সময়ে কবি ছাতার বাঁটের ব্যবসা, জীবন বিমার দালালি, রাস্তায় রাস্তায় খবরের কাগজের হকারি ইত্যাদি কাজের কথাও ভেবেছেন। হয়ে ওঠেনি শেষ পর্যন্ত। বাংলার প্রতি কবির অস্বাভাবিক রকমের টান ছিল। বাংলা ছেড়ে কোথাও যাননি তিনি জীবিকার প্রয়োজনেও। সংস্থানহীন অবস্থায় আত্মীয়স্বজনরা তাঁর জন্য পাঞ্জাবে বা শিলঙে চাকরি ঠিক করে সেখানে যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করেছেন। অত্যন্ত প্রয়োজন সত্ত্বেও যাননি তিনি।
তিনি লিখেছেন, ‘ তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও
আমি এই বাংলার পরে রয়ে যাব।‘

‘ বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’

‘কোথাও দেখিনি আহা, এমন বিজন ঘাস’

এমন কি মৃত্যুর পরেও তিনি শঙ্খচিল শালিখ বা কাকের বেশে বাংলায় ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন তাঁর কবিতায়।
“ আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে’

জীবনানন্দের প্রেম সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। স্ত্রী লাবণ্যের সাথে প্রথম থেকেই বনিবনা হয়নি। তাঁর দিনলিপি পড়ে একজন মাত্র নারীর প্রতি তাঁর অনুরাগের প্রমাণ পাওয়া যায়। যাঁকে তিনি “Y” অক্ষরে প্রকাশ করেছেন। নাম প্রকাশ করেননি কখনো। বোঝা যায়, এই নাম না জানা রহস্যময়ী রমণীর জন্য কবির হৃদয়ে তীব্র হাহাকারবোধ ছিল। এই অনামিকার জন্যই কি কবি লিখেছেন,-
‘ হৃদয়ে প্রেমের দিন কখন যে শেষ হয়- চিতা শুধু পড়ে থাকে তার—‘

‘ আজ রাতে আমার আহ্বান ভেসে যাবে পথের বাতাসে
তবুও হৃদয়ে প্রেম আসে’

‘ তোমারে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে’

‘ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে – আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর।‘

‘আমার মনে অনেক জন্ম ধরে ছিলো ব্যথা’

‘জানি আমি তোমার দুচোখ আজ আমাকে খোঁজে না’

‘পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু’জনার মনে’

কে সে রমণী, যাঁর জন্য কবির হৃদয়ে এত আকুলতা, এত অজস্র প্রেম? কার সাথে কবি ভাগাভাগি করে নিয়ে নিয়েছেন পৃথিবীর তামাম প্রেম? যাঁকে কবি ভালোবেসেছিলেন তাঁকে পাননি। যাঁকে পেয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে ভালোবাসা বা মনের মিল কোনোটাই হয়নি। প্রেম ও প্রেমিকাকে না পাওয়ার বড় অতৃপ্তি রয়ে গিয়েছিল কবির হৃদয়ে।

কিছু কিছু শব্দ জীবনানন্দের কবিতায় বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। যেমন নক্ষত্র, পেঁচা, হিজল, ঘাস, ঘ্রাণ, আঘ্রান, ধানসিড়ি ইত্যাদি। অনেকটা একই ধরনের বা একই বিষয়েরও কবিতা লিখেছেন তিনি। কিন্তু বারবার পড়ে কখনো এসকল কবিতা পুরনো বা একঘেয়ে মনে হয় না। তাঁর কিছু কবিতা পড়ে মন বিষণ্ন বিমূঢ় হয়ে যায়। এই বিষণ্নতায় আছন্ন ও অভিভূত হয়ে থাকতে ভালো লাগে।

‘ হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’- আজন্ম পথিক কবি। অক্লান্ত হেঁটেছেন কবি বাংলার পথে-প্রান্তরে। ধানসিড়ি নদী কবির অত্যন্ত ভালোবাসার নদী। এই নদীর সাথে কবির নাড়ির নিবিড় বন্ধন। এই নদীর পাড়ে কবি হেঁটেছেন অজস্র। হাঁটতে ভালোবাসতেন কবি। হেঁটে বেড়াতেন নদীর পাড়ে, ফসলের মাঠের ধারে, ঘাসের ওপরে, গাছের ছায়ায়। মুগ্ধ হয়ে অনুভব ও উপলব্ধি করতেম প্রকৃতিকে। চাকরিচ্যুতির পর ভীষণ সংকটের সময়ও উদ্ভ্রান্তের মতো হেঁটেছেন কবি। একদিন দেশপ্রিয় পার্কের কাছে রাসবিহারী এভিনিউতে অন্যমনস্কভাবে রাস্তা পার হতে গিয়ে ট্রামের ধাক্কায় আহত হন কবি। ট্যাক্সিতে করে তাঁকে নয়ে যাওয়া হয় শম্ভুনাথ হাসপাতালে। ২২শে অক্টোবর রাত ১১টায় মারা গেলেন কবি। কবি লিখেছিলেন,
‘ আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে।‘

কার্তিক মাসেই কবি মারা যান বাংলার বুকে। যে কবি হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে পথে পথ হেঁটেছেন, সেই চিরপথিক কবি পথ হাঁটতে হাঁটতেই অন্তিম দেশে চলে গেলেন। এই দুর্ঘটনার মৃত্যু আর্থিক অনটন ও মানসিক অশান্তির কারণে জীবন হতে কবির স্বেচ্ছায় পরিত্রাণ লাভ ছিল নাকি অন্যমনস্কতার কারণে দুর্ঘটনা ছিল? তা জানার কোনো উপায় তো আর নেই। সেটা এক রহস্যই রয়ে গেল।

সহায়ক গ্রন্থ
প্রজ্বলন্ত সূর্য এবং সাতটি তারার তিমির – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কালের পুতুল – বুদ্ধদেব বসু
এতদিন কোথায় ছিলেন – আনিসুল হক
জীবনানন্দের কবিতাসমগ্র