সেই প্রথম দিনের জেল প্রবেশের কথা মনে পড়ছে। গাড়ি থেকে যখন নামানো হলো, তখন আমরা সংখ্যায় পরিণত হয়েছিলাম। গরু-বাছুরের মতো আমাদের বারবার গোনা হচ্ছিল, এরপরে একটা অন্ধকার করিডোরে নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা চারজন একজনার পিছনে আরেকজন ঢুকছি, আমাদের সামনে পিছনে চারজন কারাপ্রহরী। সবার আগে রাসেল ভাই (রাসেল পারভেজ), তারপরে শুভ (সুব্রত অধিকারী শুভ), তারপরে আমি, সবশেষে বিপ্লব ভাই (মশিউর রহমান বিপ্লব)। আমাদের ১৪ সেলে নিয়ে গেল। ১৪ সেলের দরজা দিয়ে ঢোকার সাথে সাথেই চারদিক থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল, তাদের টিনের বাসন দিয়ে শব্দ করে কান ঝালাপালা আবস্থা। তারা সবাই একসাথে শ্লোগান দিতে লাগলো; বলতে লাগলো, “নাস্তিকমুক্ত জেলখানা চাই”, “নাস্তিকদের আজই ফাঁসি চাই”, “জেলখানায় নাস্তিক, মানি না মানবো না”।— এভাবেই ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীন তাঁর প্রবন্ধ সংকলন ‘আমার কারাবাস, শাহবাগ এবং অন্যান্য’ বইটিতে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের শাস্তি দাবিতে গড়ে ওঠা জনগণের গণ-বিস্ফোরণের ফলাফল শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের গণজাগরণ মঞ্চ। শুরু থেকেই এ জন-আন্দোলন ঘিরে নানা ষড়যন্ত্র করে আসছিল যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। দেশে বিদেশে বিভিন্ন মাধ্যমে নানা প্রপাগান্ডা, মিথ্যাচার, বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছিল এ দল দুটি। আর এদের সাথে যুদ্ধাপরাধের দায় কাঁধে নিয়ে বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপিও একই সুরে কথা বলতে থাকে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শাহবাগের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় বিএনপি। তারই ধারাবাহিকতায় বিএনপি-জামায়াত বারবার দাবি করতে থাকে শাহবাগের আন্দোলন নাস্তিক-ব্লগারদের আন্দোলন। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াও জনসমাবেশে শাহবাগের আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে বিষাদগার করে তাঁর নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন। গণজাগরণ মঞ্চকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে গড়ে তোলে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। দেশ ও দেশের বাইরে এ বলে প্রচার করা হয়— “শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের সকলেই নাস্তিক-ব্লগার। বিভিন্ন লেখায় তারা আল্লাহ-রাসুলকে হেয় প্রতিপন্ন করে (?) লেখা প্রচার করছে।” বিএনপি-জামায়াতের এ কথাকে প্রতিষ্ঠিত করতে তারা বিভিন্ন ছলচাতুরিরও আশ্রয় নেয়। শাহবাগের আন্দোলনকারী ব্লগার রাজীবকে হত্যার পর তার নামে একটি (থাবা বাবা) ব্লগপেজ খুলে সেখানে নানা কুরুচিপূর্ণ কথা সেঁটে দেওয়া হয়। প্রমাণ হিসেবে এসব লেখাকে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে। যদিও শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির বাইরে ধর্মীয় কোনো বক্তব্যের প্রমাণ মেলেনি, তারপরেও একসময় কেউ কেউ বিশ্বাস করতে শুরু করে শাহবাগের আন্দোলন ‘নাস্তিকদের আন্দোলন’। যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর লক্ষ্যে কাজ করা দলগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার তথাকথিত নাস্তিকের নামে কয়েকজন মুক্তচিন্তা চর্চাকারী, প্রগতিশীল গণজাগরণকর্মী তরুণদের গ্রেপ্তার করে। তাদেরই একজন আসিফ মহিউদ্দীন।
আসিফ লিখেন—
“একটা সিনেমাতে এমনটা দেখেছিলাম। খুব বিখ্যাত একজন খুনী জেলে ঢোকার পরে সিনেমাটায় এমন হয়েছিল। জেলখানায় খুনি, ধর্ষক, মাদকব্যবসায়ী সকলেই আছেন, এমন কোনো অপরাধ নেই যা এক একজন করেনি। কেউ নিজের মাকে হত্যা করেছে তো কেউ ছোট একটা বাচ্চা মেয়েকে ধর্ষণ করেছে, আবার কেউ ২০-২৫টা খুন করেছে, কেউ বা দেশ ফেনসিডিলের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছে। সবাই আছে, থাকবে, ছিল। কিন্তু পুরো জেলখানায় চারজন ধর্মে অবিশ্বাসী নাস্তিকের জায়গা নেই! যেন পৃথিবীর সবচাইতে বড় অপরাধ হচ্ছে ঈশ্বরে অবিশ্বাস করা, মনে হচ্ছিল চিন্তা করতে পারার মতো, নিজের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সিদ্ধান্ত নিজে পছন্দ করার মতো খারাপ কাজ এই শতাব্দীতে আর একটিও নেই।
সত্যিকথা বলতে কী, এই কথাটি বলে তারা ধার্মিকদের জয়গান গাইলো নাকি প্রকারান্তরে নাস্তিকদেরই জয়ধ্বনি দিলো, সেটা বোঝা গেল না। কারণ জেলখানা তারা ধার্মিক দিয়ে পূর্ণ করে ফেললে ধর্মের সম্মান হয় নাকি অসম্মান, সেটা একটা সুন্দর বিতর্কের বিষয় হতে পারে, তবে সেই বিতর্কে তখন যাবার মতো অবস্থা ছিল না। আমি সম্ভবত তাদের বেশ পছন্দের ছিলাম, তারা বলতে লাগলো, “ঐ যে তিন নম্বরটা আসিফ মহিউদ্দীন” এবং সেই সাথে আমার পরিবার-পরিজন পূর্বপুরুষের সবাইকে উদ্দেশ্য করে খুব সভ্য-ভদ্র-মার্জিত ভাষার বুলি শোনাতে লাগলো। স্বঘোষিত ধর্মরক্ষকগণের এহেন বুলি শুনে কারো মনে তাদের পবিত্র ধর্ম সম্পর্কে কী ধারণা হওয়া উচিত, তা পাঠক মাত্রই বুঝে নেবেন। এর চাইতে বেশি কিছু বলা শোভন হবে না, এই মুহূর্তে আরেকটি মামলা খেয়ে যাবার কোনো ইচ্ছা নেই। তবে খাঁটি ধর্মপ্রাণ সমাজ আসলেই এরকমই হবে, এরকমই হবার কথা।”
শাহবাগের আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন আসিফ। এ বইয়ে সেই বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার কথাই তুলে ধরেছেন লেখক। আসিফ বলছেন— “আমরা জানি না, আমাদের ছেড়ে দেবে নাকি আটকে রাখবে। আমরা ভাবছি আজকের রাতটাই তো, সকালেই ছেড়ে দেবে। আমাদের বিরুদ্ধে তো পুলিশ কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। তখনও জানতাম না, দুঃস্বপ্নের সবে শুরু।”
আমার কারাবাস, শাহবাগ এবং অন্যান্য; লেখক : আসিফ মহিউদ্দীন; প্রকাশনা : গুরুচণ্ডালি, কলকাতা; প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১৪; প্রচ্ছদ : সুমেরু মুখোপাধ্যায়; মূল্য : ১২০ টাকা।
লেখাটির অসম্পূর্ণ লাগলো।
মান্যবর অ্যাডমিন,
ওপার বাংলার ব্লগাজিন গুরুচণ্ডালি ডটকম-এ আসিফ মহিউদ্দীনের ধারাবাহিক রচনা “আমার কারাবাস” প্রকাশিত হয়েছে। পরে এসব লেখাই চটি সিরিজ আকারে গত ফেব্রুয়ারিতে কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে মুক্তমনায় কয়েক দফায় আলোচনাও হয়েছে।
আর ওই ধারাবিহকটি আসিফ নিজে কখনোই গুরুচণ্ডালির বাইরে মুক্তমনা বা অপর কোনো ব্লগে প্রকাশ করেননি।
তো, হঠাৎ করে সেই সব পুরনো লেখা আরেক সহব্লগারের পুন:প্রচারের প্রয়োজন কি পড়লো, তা বোধগম্য নয়। তাছাড়া আন্তর্জালে আগে প্রকাশিত লেখা মুক্তমনায় পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রেও নীতিমালায় বোধকরি বেশ কিছুটা বিধি-নিষেধ আছে।
এ পর্যায়ে চলতি লেখাটি সরিয়ে ফেলার বিনীত অনুরোধ করছি।
পুনশ্চ: গুরুচণ্ডালিতে আসিফ মহিউদ্দীনের ধাবাবাহিক রচনা “আমার কারাবাস” এইখানে।
@বিপ্লব রহমান,
গুরুচণ্ডালিতে আসিফের লেখাটা পড়লাম। কিন্তু অঞ্জনের লেখার সাথে তার মিল পেলাম না।
যতদূর মনে হচ্ছে, অজন হয়তো এতদিনে আসিফকে নিয়ে প্রকাশিত বইটি (‘আমার কারাবাস, শাহবাগ এবং অন্যান্য’) পড়েছেন এবং এটি হয়তো তার রিভিউ।
সেটা সত্য হলে এটা থাকতে পারে কিন্তু। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। তবে অঞ্জন নিশ্চয় তার নিজের ব্যাখ্যা দেবেন।
@অভিজিৎ দা,
আপনার প্রতিক্রিয়া পেয়ে ভালো লাগলো, যদিও অ্যাডমিন বা লেখক অঞ্জন আচার্য এ বিষয়ে এখনো কিছু বলেননি। যাই হোক, আসিফের ওই ধারাবাহিকের পাঠ প্রতিক্রিয়া থাকা খুব জরুরি। আর লেখক যদি সে প্রয়াসই নিয়ে থাকেন, তাহলে লেখাটি মুক্তমনায় যেমন আছে, তেমনই থাক না। অহেতুক সব কিছু যান্ত্রিকভাবে দেখার পক্ষপাতি আমিও নই।
মনে পড়ছে, আসিফের ওই চটি বইটিতে অভি দা, আপনি একটি অসামন্য ভূমিকা লিখেছেন। পরে সেটি ফেবুতেও পড়েছি। এই সুযোগে এই ভূমিকাটি এখানে হুবহু সংযুক্ত করছি। জয় হোক মুক্তচিন্তার।
@বিপ্লব ভাই,
শুভেচ্ছা নেবেন। আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। আমি আসিফ মহিউদ্দীনের লেখাটি এর আগে ধারাবাহিকভাবে গুরুচণ্ডালিতে পড়েছি। সেই সাথে অভিজিৎ দা’র লেখা চমৎকার রিভিউটিও আমার পড়া। আমার লেখাটি আসলে বইটির এক ধরনের পরিচিতিমূলক-রিভিউ মাত্র। পুরো লেখার গঠনমূলক সমালোচনা কিন্তু এটা নয়। তাই অন্য কোনো রিভিউয়ের সাথে সেটি সাদৃশ্য হওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। তারপরেও যদি মান্যবর অ্যাডমিন মনে করেন, আমার এ লেখাটি মুছে ফেলতে, সেক্ষেত্রে আমার আপত্তি নেই। আমি তা সহজভাবেই গ্রহণ করবো।
মূলত এ বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় শাহবাগের গণজাগরণের ওপর প্রকাশিত ১৩টি বই (যতদূর জানি, বইমেলাতে মোট ১৩টি বই-ই প্রকাশিত হয়েছে) আমি নিজ উদ্যোগে সংগ্রহ করে সেগুলোর রিভিউ করেছি। আসিফের বইটি-ই একমাত্র বই, যেটি দেশের বাইরে থেকে (কলকাতা) প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের পাঠকেরা যা সহজেই চাইলেই পাবেন না। কারণ আপনি তো জানেন, কলকাতার সব বই বাংলাদেশে বসে চাইলেই পাওয়া যায় না। পেতে চাইলেও হ্যাপার শেষ নেই। এক ‘দাঙ্গার ইতিহাস’ বইটি হাতে পেতে আমাকে স্বয়ং কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের মিত্র অ্যান্ড ঘোষের নিজস্ব বিপণিতে পর্যন্ত যেতে হয়েছে। যে যাই হোক।
আত্মপক্ষ সমর্থনে বলছি, চেতনার দিক থেকে আমি শাহবাগ-আন্দোলনের একজন হিসেবে এই বইগুলোর পরিচিতি তুলে ধরা আমার নৈতিক দায়িত্ব বলেই মনে করেছি। আমি চেয়েছি, বইগুলো গণ-মানুষের কাছে পৌঁছাক। মানুষ অন্তত জানুক, বইগুলোতে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে। উৎসুক পাঠকের কৌতূহলকে উস্কে দিতেই এ আমার ক্ষুদ্র প্রয়াস।
আপনি জেনে খুশি হবেন, ইতোমধ্যে শাহবাগের ওপর লেখা বইয়ের রিভিউ কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি এখনো প্রকাশিতব্য আছে। পড়লে কৃতজ্ঞ থাকবো। ভালো থাকবেন সবসময়…
প্রকাশিত রিভিউ :
http://www.risingbd.com/detailsnews.php?nssl=75649
http://www.banglamail24.com/news/2014/11/06/id/87126/
@অঞ্জন আচার্য, :good:
@বিপ্লব রহমান, ধন্যবাদ।
দৈনিক ভোরের কাগজে প্রকাশিত লেখা :
http://www.bkagoj1.com/print-edition/2014/11/14/4528.php