শফি পাগলা এক ঘায়ে আমাকে মুরীদ করে ফেলতে পারত। কিন্তু আমি মিথ্যা এবং মিথে বিশ্বাস করি না। তাই তার কথা আমার কানে ঢুকেছে। মর্মে ঢুকেনি।

অতীতে যাওয়ার কোন পদ্ধতি এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু মন আমাদেরকে অতীতে ফিরিয়ে নিতে পারে। দু-তিন বছরের ঘটনাগুলো মনের চোখে দেখতে ভাল লাগে। একা থাকলে অতীতের ঘটনাবলী সংগ দেয়। মন প্রফুল্ল থাকে। সময় কেটে যায় নিমিষে। পুরনো ছবি বের করি। ছবির ভিতর দিয়ে অতীতে চলে যাই। অতীত আমার কাছে ফিরে আসে ঘাসের গন্ধ, কাল-বৈশাখী ঝড়, খরা-বন্যা আর বৃষ্টি-বাদল নিয়ে। কার্তিক-অঘ্রানে আমন ধানের শীষে ভোরের শিশির দেখি। শিশিরের ভারে শীষ নুইয়ে পড়া ধান গাছ গ্রামের সরু পথ ঢেকে দেয়। দুহাতে ঠেলে দিলে রাস্তা বেরোয়, কোথাও আটকে পড়া বর্ষার জল থাকে। ডানকানা মাছের আশায় ধবল বক এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
school
ছবিটাতে দূরে টিনের একটা সুন্দর ঘর দেখা যাচ্ছে। কন্ডু ডাক্তারের চাকর-বাকর থাকত এই ঘরটিতে। তিনি মারা গেছেন ১৯৬০ এর দশকের শুরুতে। কন্ডু ডাক্তার নামে সবাই চিনত তাঁকে। আরো একটা নাম ছিল তাঁর – কমরুদ্দিন আহমেদ। কিন্তু এই নাম বললে পাশের বাড়ীর লোকেরাও নানা প্রশ্ন করত – বাড়ী কোথায়? কার ছেলে? কার নাতি?

প্রায় বিশ একর জমির উপর তাঁর বসত বাড়ী। নিকটে দুমড়ে পড়া চৌচালাটি একসময় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। জায়গা এবং ঘরটি তিনিই দিয়েছিলেন। তিনি এখানে পড়াতেন। পড়নে লুঙ্গি, হাতাওয়ালা গেঞ্জি চাপিয়ে খড়ম পায়ে ঠক ঠক করতে করতে আসতেন। চোয়ালের নীচে গুটি কয়েক সাদা দাড়ি। চিক চিক করত। তাতেই তিনি সারাবেলা হাত বুলাতেন। এবং দুপা টিনের চেয়ারে তুলে ঘুমিয়ে পড়তেন। স্বপ্নের মধ্যে বকাবকি করতেন। আমরা মুখ টিপে হাসতাম। স্কুলের সামনেই পিঁয়াজের পালান। ঘুম ভাংগলে নিড়ানী নিয়ে ওখানে ঘাস বাছতে যেতেন। কন্ডু ডাক্তারের দেওয়া এই স্কুল থেকেই আমি স্বরে-অ, স্বরে-আ শিখেছি, ইংরেজী ভাষা শিখেছি। যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ শিখেছি, ইতিহাস, ভূগোল এবং বিজ্ঞান শিখেছি। এই বিদ্যাপীঠের জ্ঞানের উপর ভিত্তি করেই আমার পিএইডি ডিগ্রীলাভ ঘটেছে। এই স্কুলটিই আমাকে আমেরিকা আসার পথ দেখিয়েছে। কাজেই এটি এক নজর দেখার আকর্ষন থাকবেই। ছবিটির মাঝখানে দাঁড়ি এবং মাথায় পাগড়ীওয়ালা এক বৃদ্ধকে দেখা যাচ্ছে। বৃদ্ধটি হঠাৎ করে বলে ফেলল – “আপনে নিপ্যাদা না?” ১৯৫০ দশকের শেষার্দ্ধে এক বোনের কোলে যাকে ন্যাংটা দেখতাম এখন ইনি বৃদ্ধ হয়েছেন। মাঝখানের বছরগুলো নেই। সে এক অভাবনীয় অনুভূতি। আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ন্যাংটাটি আমাকে ধরল। তারপর দেখি ন্যাংটোটির চোখদুটো ভিজে গেছে। সে এক অপার আনন্দ-অনুভূতি। এই আনন্দ আর একবার পেতে হলে আবার পঞ্চাশটি বছর অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু কারও হাতেই সে সময় নাই।

এমনি করেই একদিন শফি পাগলার ছবিটা বেরিয়ে আসে। হাত দেখতে গিয়ে ব্যাটা একটা মারাত্মক কথা বলে ফেলেছিল। কিন্তু পাগল ভেবে কোন গুরুত্ব দিইনি। গুরুত্বের কথাটা এখন মনে পড়ছে।

আগে ভিন্ন পথে মামার বাড়ী যেতাম। এখন এই স্কুল ঘরটির পাশ দিয়েই যেতে হয়। মামার বাড়ীটি এখন প্রাচীন ঐতিয্য ধারক ছাড়া আর কিছু নেই। তবু আবেগের টানে যাই। বুঁজে যাওয়া ইঁদারাটি আছে। তুলসী গাছের টব আছে। লোহার সিন্দুক আছে। আর আছে মজে যাওয়া কতগুলো পুকুর। এসব দেখতে ইচ্ছে করে। সেটা ২০০৭ সালের গ্রীষ্মকাল। রিক্সা, বেবী ট্যাক্সি চলে। কিন্তু আমার পায়ে হেটে চলাফেরা করতেই ভাল লাগে। ধীরে চলি। অনেক কথা মনে পড়ে। পথটি কাঁচা ছিল। মায়ের কোল চড়ে মামার বাড়ী যেতাম। মা সারা পথ কোলে টানতে পারত না। নামিয়ে দিয়ে বলত – হাট আমার সাথে। আমি উলটো দিকে দৌড়ে যেতাম। মার জড়িমানাই হত। পেছনে দৌড়ে গিয়ে ধরে ফেলত। মাকে সেখান থেকে আবার কোলে নিতে হত।

১৯৫০-৬০ সাল সময়ে আমার গ্রাম থেকে একটি প্রশস্ত কাঁচা রাস্তা ধরে বংশী নদীতে স্নান করতে যেতাম। বর্ষাকালে কাঁচা রাস্তাটি জলে ডুবে যেত। জলের নীচে গর্ত লকিয়ে থাকত। স্কুলে যাওয়ার পথে গর্তে পড়লে জাম-কাপড় বই সব ভিজে যাওয়া ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। এখন এটি পাকা হয়েছে। এটি মিশেছে একটি বড় রাস্তায়, উত্তর-দক্ষিনে। উত্তর দিকে এক মাইল হাটলেই একটা ছোট্ট খাল। বর্ষাকালে গামছা পড়ে পার হতাম। খালের পরেই কন্ডু ডাক্তারের বাড়ীতে আমার প্রাইমারী স্কুলটি। স্কুলটির উত্তর-পুব পাশেই হাত কাটা ট্যানার বাড়ী।

হাটতে হাটতে স্কুল পেরিয়ে আরও এক মাইল উত্তরে চলে এসেছি। একটি বৃদ্ধ লোক আসছে উলটো দিক থেকে। ১৯৫৯ সালে যুবা বয়সে এই লোকটিকে তার বইয়ের দোকানে একবার দেখেছিলাম। তখন আমি সবে তৃতীয় শ্রেণীতে উঠেছি। তখনই প্রথম দেখা। ট্যানার মেয়েকে বিয়ের করতে এলে শেষবার দেখেছি। পঞ্চাশ বছর আগের যুবক এখন প্রৌঢ়। মুখ দাঁড়িতে ঢাকা। কিন্তু আমি লোকটাকে ঠিকই চিনে ফেলেছি। আমার ভিতরে উত্তেজনায় এক শিহরণ জেগে উঠে। ইনি নিশ্চয় গিয়াস উদ্দিন হবেন। এই গ্রামেই যে তার বাড়ী তা আমি জানতাম।

সামনে দাঁড়িয়ে আমি তার পথ আটকে দিলাম – আপনার নাম গিয়াস উদ্দিন না?

গিয়াস উদ্দিনের এক অক্ষরে উত্তর দিয়েই খালাস – হ্যা।
Gias
আবেগ-অনুভূতি-ভ্রুক্ষেপ এবং উদ্বেগহীন গিয়াস উদ্দিন

গিয়াস উদ্দিনের চোখে-মুখে কোন ভাব-লেশ নাই। স্বাভাবিকভাবেই আমাকে প্রশ্ন করতে পারতেন – আমি লোকটা কে, কীভাবে এবং কেন তাকে চিনি, ইত্যাদি। কিন্তু তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। বয়স হলে এরকম হয়। সারজীবনে অনেক কিছু তো জেনেছেন, অনেক মানুষকে চিনেছেন। অনেক হয়েছে। তাই তার কোন উদ্বেগ নেই, অনুভূতি নেই। পৃথিবীতে কত কিছু ঘটতে দেখেছেন। দেখতে দেখতেই তো বুড়ো হয়েছেন। আর কত?

আমি চাই একটা কিছু জিজ্ঞেস করুক। নাম জানতে ইচ্ছে না করুক, অন্তত আমি কোন গাঁয়ের সেটা তো জিজ্ঞেস করতে পারতেন! পথ আগলে দাঁড়ানোর জন্য খানিকটা বিরক্তও হতে পারতেন। লোকটার এই নিরুদ্বেগ ভাবটা আমার ভাল লাগল না। আমি নতুন কথা যোগ করলাম – আপনি ট্যানার মেয়েকে বিয়ে করেছেন না?
ট্যানা আগে ছিল নিতাই কায়াদের লাঠিয়াল। মুকদম ফকীর ভাগিয়ে নিজের লাঠিয়াল বানিয়েছিলেন। এতে নিতাইএর রাগ হল। লাঠি দিয়ে ওর মাথায় একটা ঘা দিয়ে শেষ করে দিতে হবে। জমি নিয়ে ফিবছর লাঠালাঠি হয়। একদিন ডান হাতের কনুই প্রচন্ড জোড়ে রামদা দিয়ে একটা কোপ বসিয়ে দিলেন। প্রথমে পচন ধরল। তারপর কনুই থেকে হাতটা ফেলেই দিতে হল।

মুকদম ফকীরের ছেলে ইয়ানুসের সাথে ক্লাশ টু পর্যন্ত পড়তে হয়েছে। ক্লাশ টু-তেই ইয়ানুছের মুখ কাল দাঁড়িতে ভড়ে থাকত। তার কাছেই বাপের লাঠালাঠির গল্প শুনতাম। বাবার কত যে তন্ত্র-মন্ত্রের গল্প শুনেছি, তার ইয়ত্তা ছিল না। নিতাই কায়াদ একদিন মারা গেলেন। লাঠালাঠি শেষ হল। মুকদম ফকীরও বৃদ্ধ হলেন। একদিন ছিল খুব গরম। বাড়ীর পেছনে রাস্তার ধারে গাছের নীচে মৃদু বাতাসে মুকদম ফকীর বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই বললেন – বস। আমি বললাম – শুনেছি আপনি অনেক মন্ত্র-তন্ত্র জানেন। আপনি একটি লাঠি ঘুরালে নাকি একশটা লাঠি ঘুরত আপনার চারপাশে?

মুকদম ফকীর হাসলেন। বললেন – সবাই তাই বিশ্বাস করত। কিন্তু নিতাই বিশ্বাস করত না। তারপর নিজের টাক মাথাটা নীচু করে দেখালেন। লাঠির আঘাতে কেটে যাওয়া অনেক গুলো দাগ। বললেন – সব গুলো নিতাইর কাজ। নিতাই ট্যানার হাতটাই একদিন কেটে দিল!

গিয়াস উদ্দিনকে আমি ছাড়ছি না। তখন আমি ক্লাশ টু থেকে থ্রি-তে কেবল উঠেছি। নিজের পুরণো কথা শুনলে কে না উৎফুল্ল হয়! ভাবলাম তিনিও হবেন। পঞ্চাশ বছর আগের গিয়াস উদ্দিনের যৌবনকালের কিছু কথা মনে করিয়ে দিলাম। ভাবলাম এবারে তার গায়ে সুড়সুড়ি লাগবে। কিন্তু না। কিছুই হল না। আমি হতাশ। গিয়াস উদ্দিন জীবন এবং এই বিশ্বজগত নিয়ে আর ভাবেন না। একেবারেই উদাসীন। ভাবলাম আর একটা চেষ্টা করি।

বললাম – আপনার স্ত্রীর নাম আমেনা বেগম না?

গিয়াস উদ্দিনের শরীরে কোন রক্ত সঞ্চালন হল না। নির্বিকার। একই উত্তর দিলেন – হ্যা।

বাজারে তার একটা বইয়ের দোকান ছিল ১৯৫০ এর দশকে। ভাবলাম সেটা নিয়ে কথা বলি। তার অতীত মনে পড়বে। বললাম আপনার দোকানের উপরে সাইন বোর্ডে লেখা ছিল – “এখানে স্কুলের যাবতীয় বই-পুস্তক পাওয়া যায়।” গিয়াস উদ্দিনের মনে পড়ল। মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কিন্তু কিছু বললেন না। বললাম – তখন সদ্য থ্রী-তে উঠেছি। আপনার “যাবতীয়” শব্দের অর্থটা জানতাম না।

গিয়াস উদ্দিনের এই শব্দটা মনে আছে কি নাই কিছুই বুঝা গেল না। অর্থটা হয়ত তিনি নিজেও জানতেন না। এখনও হয়ত জানেন না। পুরণো দিনের স্মৃতি নিয়ে এত কষ্ট করছি, অথচ লোকটার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। এর কি বোধশক্তি বলতে কিছু নাই! কোনদিন ছিল তাও ত বুঝতে পারছি না।

বাজারে কন্ডু ডাক্তারের একটা অষুধের দোকানও ছিল। মিকচার বিক্রি করেই ডাক্তার পদবীটা পেয়েছিলেন। কিছু মানুষ আছে যারা টাকা রুজি করার জন্য কোন পথ বাকী রাখেন না। আমাদের বিত্তবান কন্ডু ডাক্তার মাষ্টারী এবং অষুধ বেচা ছাড়াও বইয়ের ব্যবসা করতেন। শোবার ঘরটাই ছিল তাঁর ডাক্তারী এবং বইয়ের দোকান। মূলতঃ পাঠ্য বইটির সাথে সহায়িকা বইটি জোড় করিয়ে ধরিয়ে দিতেন। ওটাতেই ছিল তাঁর আসল ব্যবসা। সেবারে তিনি ক্লাশ থ্রীর ইতিহাস বইটি আনতে পারেননি।

একদিন, দুদিন, সপ্তাহ করে মাস কেটে গেল। ইতিহাস বই নাই। গিয়াস উদ্দিনের দোকানে এই বইটি থাকার কথা নয়। তাই খোঁজ নেওয়ার দরকারটাও মনে করলাম না। আট থেকে দশ মাইল দূরে সাটুরিয়া বাজারে বিরাট একটি বইয়ের দোকানের কথা শুনেছিলাম। নাম – “পূর্ণচন্দ্র লাইব্রেরী।” সন্তোষ শীল আর আমি একদিন হেটে পূর্ণচন্দ্র লাইব্রেরীতে গেলাম। কিন্তু ওখানেও ইতিহাস বইটি পেলাম না। হতাশ হয়ে ফিরে এলাম। বাজার হয়েই বাড়ী ফিরতে হয়। সন্তোষ বলল – গিয়াস উদ্দিনের দোকানটিতে জিজ্ঞাসা করি। কোন ক্ষতি তো নাই।

গিয়াস উদ্দিন বললেন – নাহ্‌, এই বইটা নাই। তখন আমি বললাম – পূর্ণচন্দ্র লাইব্রেরীতেও পেলাম না।

আমার কথা শুনে ত গিয়াস উদ্দিন অবাক! চক্ষু চড়কগাছ! বড় বড় চোখ করে বললেন – বল কী! তোমরা পিচ্চি-পিচ্চি দু্টি বাচ্চা ছেলে, সাটুরিয়া এত দূরে গেলে কীভাবে? বড় হলে তোমরা তো বিদেশে চলে যাবে!

এর সাথে গিয়াস উদ্দিনকে তাঁর ভবিষ্যৎ বাণীর কথাটি মনে করিয়ে দিয়ে বললাম – আপনার কথা ঠিক হয়েছে। কয়েকটি দেশে গিয়েছি। এখন আমি আমেরিকায় থাকি।

গিয়াস উদ্দিন এক অদ্ভূত মানুষ। কথা শুনল কিনা কে জানে। হ্যা বা না কোন উত্তর দিলেন না। বললেন – আমাকে কুশুরা বাজারে যেতে হবে। তারপর আমার পাশ কাটিয়ে দক্ষিন দিকে হাটতে শুরু করলেন। আমি হতবাক, বিহ্বল, বাকরূদ্ধ।

আমার মনোযোগ ছিল গিয়াস উদ্দিনের উপর। এতক্ষন ছায়ার মত একটা কিছু যে আমার পিছনে ছিল খেয়াল করিনি। গিয়াস উদ্দিন চলে যেতেই ছায়াটি যাত্রাগানের পাগলের ভঙ্গিতে এক লাফে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। তখন জুন মাস। গরম কাল। কিন্তু তার গায়ে চাঁদর। উস্কো-খুস্কো চুল। যত্নহীন দাঁড়ি। হাসলে জলপাই ফলের মত বিরাট আকৃতির আকাবাকা দাঁতগুলো প্রথমেই চোখে পড়ে। দেখেই মনে হল যাত্রাগানে পাগলা চরিত্রটি এভাবেই সাজানো হয়। হাসির কোন সৌন্দর্য নেই। বিকট হাসি। কয়েকটি দাঁত ভেঙ্গেও গেছে। এই মূর্তি দেখলে ভয়ে যেকোন শিশু দৌড়ে পালাবে তাতে কোন সন্দেহ নাই।

এই শফি পাগলাও আমেরিকার খবর জানে। “আমেরিকা” শব্দটি শুনেই লাফ দিয়ে আমার পথ আগলে দাঁড়িয়েই বলল – “আপনে আমেরিকায় থাকেন? হি হি হি।”

আমি বললাম – হ্যা।

শফি পাগলা “ওরে আল্লাহরে” শব্দ করে অদ্ভূত এক ধরণের নৃত্যের ভঙ্গিতে বৃত্তাকারে ঘুরে সামনে দাঁড়াল। আবার একই প্রশ্ন করল – “আপনে আমেরিকা থাকেন? হি হি হি।”
বিরক্ত হয়ে বললাম – বললাম তো! এই আজব চীজটি একই ভাবে আবার “ওরে আল্লাহরে” শব্দ করে অদ্ভূত নাচন দিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরে আমাকে আটকিয়েই রাখল।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি। ভাবলাম আজব চীজটির একটা ছবি তুলি। এরকম দূর্লভ জিনিষ পাওয়া সহজ কথা নয়। শফি পাগলা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আমাকে ছবি তোলার সুযোগ দিল।

Shafi
দাঁতগুলোর পেছনে আছে শফি পাগলার প্রাণখোলা কদর্য হাসি।

ছবি তোলা শেষে পাগলটার একই প্রশ্ন – “আপনে আমেরিকা থাকেন? হি হি হি।” তারপর লাফ দিয়ে একই কায়দায় বৃত্তাকারে নাচন।
পাগলের পাগলামির শেষ কখন হয় কে জানে। পাশ কাটিয়ে উত্তর দিকে হাটতে শুরু করলাম। ওমা! পাগলটি নাছোরবান্দা। আমার সাথে সমানে চলতে শুরু করল। তারপর হঠাৎ নতুন উৎপাত শুরু করল – “আপনের হাতটা দেখি?”

বললাম – “দ্যাখেন।”

বিচক্ষণের মত দেখেই বলল – “আপনে তো এক্কেবারে মরার ঘর থ্যাইক্যা ফিরা আইচেন।”

আমি একথায় উত্তর না দিয়ে বললাম – আমার ত্বারা আছে। আপনার সাথে আর একদিন কথা হবে। শফি বুঝল। আর বিরক্ত করল না। আমি রক্ষা পেলাম।

শফি পাগলাকে মনে রাখার কোন কারণ ছিল না। কিন্তু আজ হঠাৎ করে ছবিটা দেখে ওর “আপনে আমেরিকা থাকেন? হি হি হি।” আর বিশেষ ভঙ্গিমার নাচনের সাথে আমার দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। শফি পাগলা বলেছিল, আমি নাকি মরতে মরতে বেঁচি গেছি। ওর পাগলামি দেখতে গিয়ে কথাটা একেবারেই গুরুত্ব দিইনি। আসলেই আমি দু-দুটোবার মরেই গিয়েছিলাম। প্রতিবারেই মৃত্যুর ওপার থেকে ফিরে এসেছি। আশ্চর্য! ঘটনা গুলো তার জানার কথা নয়। আমি কাউকে বলিনি। আমার বাড়ীর লোকেরা পর্যন্ত জানেনা। শফি পাগলা কি এই ঘটনার দুটির কথাই বলেছিল?

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৩ই জুলাই কয়েকবার মৃত্যুর ফাঁক দিয়ে বেঁচে থেকেছি। কুমিল্লার পথে দাউদকান্দি ফেরি পার হয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছি। আমার সামনে তিনজন। পাকিস্তানী এক মিলিটারী তীক্ষ্ণ নজড় দিয়ে দেখল সবাইকে। আমাকেও। আমার প্রথম ভয় যদি লুঙ্গি খুলতে বলে তো আমার আর রক্ষা নাই। কিন্তু আমি বেঁচে গেলাম। লোকটি আমাকে বাদ দিয়ে আমার পেছনের জনকে নিয়ে গেল নদীর পারে। গুমটি ঘরের পেছনে। তারপর গুলির একটা প্রচন্ড আওয়াজ হল। নদীর পারের পাখীগুলো ভয়ে উড়ে চলে গেল। আমরা কেউ কোন কথা বললাম না। বাসে উঠলাম।

বাস থামল ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে। ঢোকার পথ থেকেই এদিক ওদিক অনেক মিলিটারী জীপ এবং অস্ত্র হাতে পাক সেনারা সদা প্রস্তত। আমি বাসে উঠার গেটের সামনের সাড়িতে বসা ছিলাম। স্টেনগান ধারী এক পাকিস্তানী মিলিটারী ঊঠেই আমাকে ধরল। চেহারাটা কর্কষ এবং বিরক্তিপূর্ণ। আমার মৃত্যু মূহুর্তের ব্যাপার মাত্র। বাস যাত্রীদের মুখ শুকিয়ে গেল মুহুর্তে। আমার কথা আমি জানিনা। সম্ভবতঃ আমার কোন বোধ শক্তি ছিল না তখন।

প্রশ্ন হল – নাম কেয়া হায়। বললাম – আব্দুর রহিম। আর একবার জিজ্ঞেস করলে হয়ত বলে ফেলতাম আব্দুর রহমান। অথবা লুঙ্গি ধরে টান দিলেই আমার পরিচয় বেরিয়ে আসত। এগুলোর বুদ্ধিশুদ্ধি তেমন ছিল না। তাই বেঁচে গেছি।

– আপকা পাছ ড্যান্ডি কার্ড হ্যায়? (আইডেন্টি কার্ডকে ওরা ড্যান্ডি কার্ড বলত।) আমি বললাম – নাই। পরে বানাব।

– কপ বানায়ে গা? মউত কা বাদ বানায়ে গা?

শেষের প্রশ্নটি বুঝতে পারিনি। তাই একটা ভুল উত্তর দিয়ে ফেললাম। এই ভুল উত্তরটাই আমার শাপে বর হল। বেঁচে গেলাম। তাই আমি এখনও বেঁচে আছি।

আমি ‘হ্যা’ সূচক উত্তর দিয়েছিলাম – যার অর্থ ছিল – হ্যা, আমি মৃত্যুর পরেই বানাব। বাসে তখন ছিল পিন-পতন নীরবতা। আমাকে এখনই নীচে নামিয়ে গুলি করবে। ঠিক তখনই আমার উত্তর শুনে সারা বাসে একটা চাপা ভীতিসূচক শব্দের স্রোত বইয়ে গেল। মিলিটারীটা হতচকিয়ে গেল। কন্ডাক্টরের দিকে তাকাল। কন্ডাক্টরটা বুঝিয়ে বলল – ছেলেটি না বুঝে উলটা উত্তর দিয়েছে। মিলিটারীটা আমার উপর বিরক্ত হয়ে বলল – বঠিয়ে। বুঝলাম আমি এতক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম। বসতে বললে বুঝলাম আমি এ যাত্রাও বেঁচে গেলাম।

কুমিল্লা শহর থেকে প্রথমে রিক্সা এবং পরে হেটে একটা বাজারে পৌছে গেছি। মাত্র দেড় মাইল দুরেই সোনামুড়া বর্ডার। সূর্য ডুবার মাত্র আধ ঘন্টা বাকি। বাজারটি ছোট। মাত্র কয়েকটি বাচারী ঘর। কিন্তু সব বন্ধ। বাজারে কোন লোকজন নেই। হঠাৎ কোত্থেকে এক বুড়ো এগিয়ে এসে বলল – আপনেরা শীগ্‌গীর এই গ্রামে ঢুইক্যা পড়েন। কিছু মুক্তিযোদ্ধা বর্ডারের ওপার থ্যাইক্যা শেল মারচে। তাই একটা মিলিটারী জীপ এইমাত্র বর্ডারের দিকে গেল। দেখলাম – কাঁচা রাস্তায় তখনও ধুলি উড়ছে। মাত্র দুই মিনিট আগে এখানে পৌছলে কোন রক্ষা ছিল না। মুক্তিবাহিনী সন্দেহে দেখামাত্র গুলি করে মেরে ফেলত।

গ্রামের ভিতরে একটি বাড়ীতে উঠে রাতের জন্য থাকতে চাইলাম। বাড়ীওয়ালা বলল – আপনেরা নিকটে কোন ধান ক্ষেতে লুক্যাইয়্যা থাকেন। আমাদের উপর নির্দেশ আছে – অপরিচিত কোন যুবক দেখলে যেন অবিলম্বে মিলিটারী ক্যাম্পে খবর দেই। না দিলে আমাগো বাড়ী-ঘর জ্বালাইয়্যা দিব। বউ-পুলাপান সহ আমাগাও মাইর‍্যা ফালাইব। প্রত্যেক দিন করে। এখন আপনেরা অন্য কোন বাড়ীতেও আশ্রয় চাইবেন না। আমি আপনাদেরকে ধরাইয়্যা দিলাম না। কিন্তু প্রাণের ভয়ে যে কেউ ধরাইয়্যা দিবার পারে। ধানের ক্ষেতে লুক্যাইয়্যা থাকবেন সেটাও যেন কেউ না দেখে। সারারাত শেলিং চলব। গুলি লাগলেও শব্দ করবেন না। শেষরাতে শেলিং কমব। সেই সময় পুব দিকে হাটতে থাকবেন। দেড় মাইল হাটলেই ভারতে পৌছে যাবেন। আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করি আপনারা সহি সালামতে ভারতে চইল্যা যাইবার পারেন।

দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ১৯৬৭ সালের জুন মাসে। আমার মনে হয় – মৃত্যু হয়েছিল। মৃত্যুর ওপার থেকে কী ভাবে ফিরে এসেছিলাম জানিনা। কিন্তু দৃশ্যগুলো ক্রিস্টাল ক্লিয়ার মনে আছে এবং থাকবে। এস-এস-সি পরীক্ষার ফল তখনও বের হয়নি। বংশী নদীর জল কূল ছাপিয়ে উঠছে। প্রচন্ড স্রোত। কোথাও কোথাও ঘুরপাক খাচ্ছে – আনুভূমিক অথবা উপরে-নীচে। ঘোলা জল। সেখানেই দল বেঁধে স্নান করতে গেছি। তাৎক্ষনিক ভাবে সিদ্ধান্ত হল ভাটির দিকে দুইমাইল সাঁতরে ধলকুন্ড ঘাট পর্যন্ত যেতে হবে। আমি ভাল সাতার জানিনা। একে একে সবাই চলে গেল। আমার অনেক ছোটরাও চলে গেল। আমি একা বাদ। শেষে কী ভেবে আমিও পিছু পিছু ছুটলাম।

দু মিনিট পরেই আমার শক্তি প্রায় শেষ। নদীর কোন পার নিকটবর্তী তা বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমি চলছি স্রোতের সাথে।

পানকাত্তার কোম নামে একটা ভয়াবহ জায়গা আছে। পচিশ-তিরিশ ফুট গভীর জল। সেখানে জল চক্রাকারে ঘুরে। কখনও উপরে নীচে। তিরিশ ফুট তলদেশের জল মাটি ঘাস-পাতা সহ উপরে উঠে আসে আবার নীচে চলে যায়। আমি সেই ভয়ংকর জায়গাটায় চলে এসেছি তখন। বাতাসে ঢেউ ভেঙ্গে পড়ছে। সামনে আমি কাউকে দেখছি না। আমার শরীরের সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে গেছে। হাত পা নিস্তেজ হয়ে গেছে। নদীর এপার ওপার কোন পারই তখন আর আমার চোখে পড়ছে না। আমার চেতনা লোপ পাচ্ছে দ্রুত। আমি যে নিশ্চিত মারা যাচ্ছি সেটা বুঝতে পারছি। জীবন আমার মৃত্যুর হাতে সমর্পিত। মৃত্যু আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমার চেতনা নাই। কোন ভাবনা নাই। আমি একটা জড় পদার্থ মাত্র। আমার বৃত্তাকার দৃষ্টি সীমানা খুবই ছোট গেছে। উপরে জল ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি তারই মাঝে। তিরিশ ফুট নীচে নদীর তলদেশ থেকে জল, মাটি, ঘাস-পাতা উপরে আসছে। আবার নীচে যাচ্ছে। আমি এদের সহযাত্রী।

ছোটবেলায় কোন ছড়ানো পাত্রের জল হাত দিয়ে প্রচন্ড জোড়ে ঘুরিয়ে দিতাম। এতে সেন্ট্রিফিউগ্যাল ফোর্সের কারণে জল পেরিফেরিতে চলে যেত। মাঝখানে জলহীন গর্তের মত হত। জল চতুর্দিকে ঘুরত আর হাইড্রোস্ট্যাটিক ফোর্সের কারণে গর্তটা কোণিক আকৃতির হত। দেখে খুব মজা পেতাম। আমার চেতনা যখন লোপ পেল তখন আমি এই কৌণিক আকারের গর্তে ঢুকে গেছি। আমার উপরে নদীর ঘোলা জল। তাই নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। কিন্তু গর্তটা অন্ধকার নয়। নিয়ন বাতিতে যেমন স্পষ্ট দেখা সেরকম পরিষ্কার। আমি সেন্ট্রিফিউগ্যাল ফোর্সের কারণে সৃষ্ট গর্তের চারিদিকে জলের আবর্তন দেখতে পাচ্ছি। আমার গায়ে কোন জল লাগছে না। আমি আছি কৌণিক গর্তের একেবারে মাঝখান দিয়ে আস্তে আস্তে নীচে গেলাম। কোণটা নীচে উত্তরে দক্ষিনে বিস্তৃত একটি সুড়ঙ্গে মিশে গেছে। সুড়ংগটি দশ ফুট ব্যাসের মত। সুড়ঙ্গে ঢুকতেই কৌণিক আকৃতির গর্তটা আর নজরে পড়ল না।

সুড়ংগেও কোন জল ছিল না। সুড়ঙ্গের ভিতর আমার দৃষ্টি সীমানা দশ ফুট ব্যাসের একটি গোলক। একবারে কেন্দ্রে আমি আটকা। আমার কোন ওজন নেই। আমার হাতপা গুটানো। থুথনি হাটুর সাথে লাগানো। হাত দুটো পায়ের পাতার উপর। সবটা ভূমির সাথে প্রায় ৭৫ ডিগ্রী কৌণিক অবস্থানে। গোলকটা অত্যন্ত মন্থর গতিতে আমাকে নিয়ে সামনে এগুচ্ছে। আমার কোন স্মৃতি শক্তি নাই। কয়েক মিনিট আগে আমি কী ছিলাম, কোথায় ছিলাম –সেসব ভাবনা আমার নাই। আমি কী জিনিস সে চিন্তা-ভাবনাও আমার নাই। অনাদিকাল থেকে আমি যেন এই সুড়ঙ্গেরই বাসিন্দা। এখানটায় আলো বেশ কম। কিন্তু আমি পরম যত্নে সব কিছু দেখছি আর বাতাসে ভেসে যাচ্ছি উত্তর থেকে দক্ষিনে। পাঁচ ফুট নীচে নদীর তলদেশ। দক্ষিন দিকে ঢালু। এক চিলতে জল এগিয়ে যাচ্ছে। স্থানে স্থানে খাঁজ কাটা। উপরের খাঁজ থেকে জল ছপ করে নীচের খাঁজে পড়ছে। জলের ধারার সাথে আছে বাদালী ঘাসের বড় বড় বিচি। একটা দুটো বিচি অন্য বিচির সাথে বাঁধা আছে। কখনও তা আটকে যাচ্ছে। খুলে গিয়ে আবার জলধারার সাথী হচ্ছে। জলের সাথে ছোট ছোট নুড়ি পাথর বয়ে চলেছে। কে জানে কবে কোন পাহাড়-পর্বত থেকে খসে গিয়ে জলের সাথে বয়ে চলছে। এদের কোন ছুটি নেই। কোন আবেগ-অনুভূতি নেই। চলছে তো চলছেই। গোলকের ভিতরে এরাই আমার সাথী। আমিও এদের সাথী। আমাদের চলার শেষ নেই। সেদিকে কারও কোন ভ্রূক্ষেপও নাই।

শফি পাগলা বলেছিল, আমি মৃত্যুর ওপার থেকে বেঁচে এসেছি। ওর কথায় ভাববার মশলা আছে। একবার নয়, দুবার ঘটেছে। কিন্তু কীভাবে বলল পাগলটা? আশ্চর্য! ভাবলে অবশ্যই আশ্চর্যের ব্যাপার। কোন ঘটনাতেই আমার বাঁচার কথা ছিল না। কিন্তু আমি বেঁচে গেছি। আমি দুর্বল চিত্তের মানুষ হলে শফি পাগলা আমার কাছে পীর বা দেবতা একটা কিছু হয়ে যেত। শফি পাগলা হত বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। আমিও বিখ্যাত হতাম। ওর কথার সাথে দু-দুটো ঘটনা মিলে গিয়েছে তো কী হয়েছে? তাতে শফি পাগলার কথার মূল্য দেওয়ার তেমন কী আছে! পাগলে কত কিছুই বলে। বিষয়টা মুক্তমন এবং যুক্তি দিয়ে বিচার করার মত বিচার-বুদ্ধি এবং সচেতনা থাকলে শফি পাগলার কথার সাথে দু-দুটো ঘটনা মিলে যাওয়াকে কাকতালীয় ব্যাপার হিসেবেই ব্যাখ্যা করা যায়। শফি পাগলা সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে কোন বিশেষ খাতির-বার্তা পায় নাই। এবং সৃষ্টি কর্তা আমাকে বাঁচিয়েছে এমনটা ভাবারও কোন কারণ নাই। সৃষ্টিকর্তা বলে কিছু থাকলে তো?