মিথ্যাকে বারংবার বলার মাধ্যমে সত্যরূপে চালিয়ে দেয়ার গোয়েবলসীয় বুদ্ধি আমাদের ইতিহাসেও প্রয়োগ করা হয়েছে অনেকবার। আমার স্পষ্ট মনে আছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ২০০১-২০০৬ সালে (২০০১ সালে আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি) যখন ক্ষমতায় তখন আমরা দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গিয়েছিলাম সঠিক উত্তর কোনটি- বঙ্গবন্ধু নাকি জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক?! আগের বছর পড়েছি বঙ্গবন্ধু কিন্তু পরের বছর সেটা হয়ে গেলো মেজর জিয়া। কিছুতেই মিলাতে পারছিলাম না। তারিখেও পরিবর্তন। একবার ২৬ শে মার্চ, আরেকবার ২৭ শে মার্চ। শিক্ষক তথা গুরুজনদের নিকট প্রশ্ন করেও সদুত্তর পাইনি। আমার তখন মাথায় আসতো না এতো গর্বের একটা ব্যাপার এমন অনিশ্চয়তা দিয়ে কীভাবে ঢাকলো! এ ব্যাপারে জানার আগ্রহ ছিলো কিন্তু মফস্বলে এ সংক্রান্ত খুব বেশি বই সহজলভ্য ছিলো না আর আমার চারপাশে যারা ছিলেন তাদের বেশিরভাগই যে কোনো কারণেই হোক বঙ্গবন্ধুর প্রতি কিছুটা রুষ্ট ছিলেন! গত কয়েক বছরে আমি অনলাইনে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যতটা জেনেছি সেটা আমার মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত জ্ঞানের কম করে হলেও ৯৫%! মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাকে শিহরিত হতে শিখিয়েছে আন্তর্জাল; আমি অসম্ভব কৃতজ্ঞ জিনিসটার প্রতি।

যাহোক, অনেকেই হয়তো বিশ্লেষণ করেছেন স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরেও আমাদের মধ্যে ঐক্য নাই কেনো? কেনো আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমস্ত প্রতিকূলতাকে দূরে ঠেলে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছিনা? আমাদের মতো অমন করে মাতৃভাষার জন্য, মাতৃভূমির জন্য হাসিমুখে বুকের তাজা রক্ত ঢেলেছে আর কোন জাতি? এতো সাধনার পর যে অর্জন তা এতো তাড়াতাড়ি ধূসর হওয়ার কারণ খোঁজা হয়েছে অনেকবার কিন্তু প্রতিকারের চেষ্টা কি করা হয়েছে? পঁচাত্তরে জাতির পিতার নৃশংস খুনের মধ্য দিয়ে বাংলার আকাশে পুনরায় যে শকুনের আনাগোনা শুরু হয়েছিলো সেসব আজ বংশবৃদ্ধি করে বেশ বড় একটি দলে পরিণত হয়েছে। আর তাদের সাথে যোগ দিয়েছে সমাজের সুবিধাবাদী, অকৃতজ্ঞ ও মনে মনে অখণ্ড পাকিস্তান চাওয়া জারজের দল।

আমাদের সীমাবদ্ধতা হলো আমরা সবকিছুর মূলে যা আছে সেটার প্রতিবিধান ব্যতিরেকে সমস্যার শাখা-প্রশাখা নিয়ে পড়ে আছি। এভাবে শাক দিয়ে মাছ আর বোধ করি বেশিদিন ঢাকা যাবে না। কারণ সময়ের পরিক্রমায় ইতিহাসের সত্য রূপটি সবার সামনে উন্মুক্ত হয়ে আসছে।

বস্তুত আমাদের বর্তমান অবস্থা দেখে অধ্যাপক মুনতাসির মামুন স্যারের করা ক্ষেদোক্তিটি আসলেই যথার্থ! আসলেই

বঙ্গবন্ধু একটি অনিচ্ছুক জাতিকে স্বাধীনতা উপহার দিয়েছিলেন

তা না হলে আমাদের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী স্বাধীনতার প্রশ্নে এমন উদাসীন হবেন কেনো?? তাও আবার স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পূর্ণ না হতেই…

আসুন একটু গোড়ায় হাত দেয়া যাক! দ্বিজাতি তত্ত্বের মাধ্যমে যে ভারত পাকিস্তান বিভাজন হলো ১৯৪৭ সালে সেটার ফায়দা পুরোপুরি তুলেছিলো পশ্চিম পাকিস্তান। অন্যদিকে ক্ষুদ্র বদ্বীপটির চারদিক থেকে সনাতন ধর্মালম্বীপরিবেষ্টিত হওয়ার কারণেই হোক কিংবা আবহমান কাল ধরে হিন্দু-মুসলমান সহাবস্থান করার ফলেই হোক পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানেরা তুলনামূলক অনেক বেশি অসাম্প্রদায়িক ও বন্ধুভাবাপন্ন ছিলো। একটা উদাহরণে এটা অনেকটা পরিষ্কার হতে পারে। বিয়েতে যে গায়ে হলুদ, বেৌ-ভাতের প্রচলন সেটা কিন্তু মুসলমানেরা সনাতনীয় সংস্কৃতি থেকে ধার করেছে। এমন আরো ছোটোখাটো ব্যাপার পূর্ব পাকিস্তানী মুসলিমদের দৈনন্দিন কাজে-কর্মে ঢুকে গিয়েছিলো। তাছাড়া এ ভূ-খণ্ডে মূলত সূফী-দরবেশদের দ্বারা ইসলামের চাষ হয়েছে। ফলে ইসলামের “রক্তপিপাসু” দিকটার ব্যাপারে এ অঞ্চলের মানুষজন খুব বেশি ওয়াকেবহাল ছিলো না্। তাদের বেশিরভাগই ছিলো যথেষ্ট বন্ধুভাবাপন্ন এবং এ কারণেই যুদ্ধকালীন পাকিস্তানি মিলিটারিদের মুখে শোনা যেতো পূর্ব পাকিস্তানিরা “সাচ্চা মুসলিম” নয়; তারা মুরতাদ। কারণ বিধর্মীরা মুসলমানের বন্ধু হতে পারে না এটা স্বয়ং আল্লাহর বাণী। এ প্রেক্ষিতেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ মদদে হানাদার বাহিনী এদেশের নারীদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এ ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা সহব্লগার আরিফ রহমান বেশ চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। আগ্রহীরা দেখে নিতে পারেন।
অর্থাৎ যত যাই বলা হোক না কেনো পশ্চিম পাকিস্তনিরা ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা মুক্তিযুদ্ধকে ইসলাম রক্ষার যুদ্ধ হিসেবেই নিয়েছিলো।

বাংলাদেশের আজকের অবস্থার জন্য পাকিস্তানি হানাদারেরা যতটা না দায়ী তার চাইতে অনেক বেশি দায়ী তাদের এদেশীয় দোসরেরা। বেঈমানরা পরাজয় অবশ্যম্ভাবী জেনেই আত্নসমর্পণের মাত্র দু’দিন আগে রীতিমতো লিস্ট করে বাঙালি জাতির মেরুদণ্ড একে একে ভেঙে দিতে সমর্থ হয়। এর ফলে জাতির বুদ্ধিজীবী মহলে যে শূন্যস্থানের সৃষ্টি হয়েছিলো তা এই ৪৩ বছরেও পূরণ করা সম্ভব হয়নি বরং সেসব শূন্যস্থান কিছু খালি কলসি দ্বারা পূরণ হয়ে জাতির অবনমনের গতি কেবর ত্বরান্বিতই করেছে।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে জাতির জনক ভাঙাচুড়া দেশকে একহাতে গড়তে গিয়ে কতিপয় মীরজাফরের দ্বারা অকালে প্রাণ হারালেন এবং সেই থেকেই বাংলার আকাশে সেই পুরনো শকুনের আনাগোনা আবারো শুরু হলো। এরই মধ্যে “মুক্তিযোদ্ধা” মেজর জিয়ার বদেৌলতে শকুনেরা এদেশে বাসা বানাবার অনুমতি পেলো; পরবর্তীতে বেগম জিয়ার হাত ধরে তারা যে দেশটির অস্তিত্ব মনেপ্রাণে অস্বীকার করে এসেছে সে দেশটির মন্ত্রী পর্যন্ত হয়ে গেলো!! আমার বুঝে আসেনা এমন সব কথা বলার পরেও এদেশের আলো-বাতাসে বেঁচে থাকতে হলে কতটা নির্লজ্জ হতে হয়!

* ‘পাকিস্তান যদি না থাকে তাহলে জামাত কর্মীদের দুনিয়ায় বেঁচে থেকে লাভ নেই।’ – গোলাম আজম
– দৈনিক সংগ্রাম, ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
* ‘কালেমার ঝান্ডা উঁচু রাখার জন্য রাজাকারদের কাজ করে যেতে হবে।’- গোলাম আজম
-দৈনিক সংগ্রাম, ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
* ‘দুষ্কৃতিকারীদের ধ্বংস করার কাজে পূর্ব পাকিস্তানের জনগন সশস্ত্র বাহিনীকে পূর্ণ সহযোগিতা করছে।’ – গোলাম আজম
-দৈনিক সংগ্রাম, ১৭ আগস্ট ১৯৭১
*’পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি মুসলমান নিজ নিজ এলাকার দুষ্কৃতিকারীদের তন্নতন্ন করে তালাশ করে নির্মূল করবে।’ – গোলাম আজম
-দৈনিক সংগ্রাম, ১২ আগস্ট ১৯৭১
* ‘দুষ্কৃতিকারীদের মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে দেশের আদর্শ এবং সংহতিতে বিশ্বাসী লোকদের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য আবেদন করেছি।’ – গোলাম আজম
-দৈনিক সংগ্রাম, ২৯ আগস্ট ১৯৭১
* ‘তথাকথিত বাংলাদেশের আন্দোলনের ভূয়া শ্লোগানে কান না দিয়ে পাকিস্তানকে নতুনভাবে গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। – গোলাম আজম
-দৈনিক পাকিস্তান, ১৭ অক্টোবর ১৯৭১
* ‘কোনো ভালো মুসলমানই তথাকথিত বাংলাদেশের আন্দোলনের সমর্থক হতে পারে না। রাজাকাররা খুব ভালো কাজ করছে।’ – গোলাম আজম
-দৈনিক সংগ্রাম, ২ অক্টোবর ১৯৭১
* ‘বর্তমান মুহূর্তে আক্রমনাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করাই হবে দেশের জন্য আত্মরক্ষার সর্বোত্তম ব্যবস্থা।’ – গোলাম আজম
-দৈনিক সংগ্রাম, ২৪ নভেম্বর ১৯৭১
* ‘পূর্ব পাকিস্তানের জামাতে ইসলামের কর্মীরা বেশিরভাগ রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধ করছে এবং প্রান দিচ্ছে। এখানে জামাতের অবদানই বেশি। সুতরাং পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হলে জামায়াত থেকেই হতে হবে।’ – গোলাম আজম
(বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, চতুর্থ খন্ড, মুক্তিযুদ্ধ পর্ব।)
কৃতজ্ঞতাঃ আলিম আল রাজি

যাহোক, এরই মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের সবাই ধর্মকে বর্ম হিসেবে নিয়ে তাদের প্রোপাগান্ডা ব্যাপকহারে প্রচার করতে থাকে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে এসে পেট্রোডলারের বদেৌলতে হওয়া চাকচিক্যময় মসজিদগুলো অনাহারী-অর্ধাহারী, বুখা-নাঙ্গা মানুষজনের মধ্যে ইহকালের সমস্ত না পাওযার সাদ পরকালে পূরণের স্বপ্ন দেখায়। এদিকে আফগানফেরত মুজাহিদিনরাও জোরেশোরে “সত্যিকারের ইসলাম” প্রচারে নিজেদের উৎসর্গ করে। সব মিলিয়ে ফলাফলটা হয় ভয়াবহ। একাত্তরে বাঙালিদের একটি বড় অংশ স্বাধীনতা চায়নি। এদের মধ্যে যাদের সাহস তুলনামূলক বেশি ছিলো তারা রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনী গড়ে “অখণ্ড পাকিস্তান” রক্ষায় ব্রতী হয়েছিলো। আর একটা অংশ কায়মনোবাক্যে চেয়েছে পাকিস্তানের ভাঙণ রোধ হোক। আর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় অংশ যে স্বপ্ন নিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলো তাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়ে গেছিলো এরই মধ্যে। ফলে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রোপাগাণ্ডার বিরুদ্ধে তেমন একটা প্রতিরোধ গড়ে উঠেনি এবং এই সুযোগে বিপক্ষশক্তি দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পেৌঁছে গিয়ে গোটা জাতিকেই দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।

আমরা যাদের যুদ্ধাপরাধী বলছি তারা কিন্তু তাদের কৃতকর্মের বিন্দুমাত্র অনুশোচনা বোধ করছে না। যদি তাই করতো তাহলে ফাঁসির রায় হবার পরেও ভি চিহ্ন দেখানোর মতো ঔদ্ধত্ব দেখাতে পারতো না। এথেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে তারা সুস্থ মস্তিষ্কে বাংলাদেশ বিরোধিতা করে যাচ্ছে বাংলাদেশের খেয়ে পড়েই। তাছাড়া পাকিস্তানে গোলাম আযমের গায়েবানা জানাযা পড়ানোর মাধ্যমে পাকিস্তানও গোলাম আযমের অবস্থান পরিষ্কার করেছে।

এখন আবার তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে আদর্শহীন, সুবিধাবাদী লোকে পূর্ণ বি এন পি। যুদ্ধাপরাধীদের রায়ে বরাবরের মতোই নীরবতা আর গোরাম আযম পুত্রের হুংকার এটাই বলে দিচ্ছে যে মডারেট বিএনপি এরই মধ্যে জামায়াতে বিলীন হয়ে গেছে। এখন আমার প্রশ্ন হলো যে দলটি বাংরাদেশকেই অস্বীকার করে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে সে দলের রাজনৈতিক কর্মসূচী কতটা গ্রহণযোগ্য??

দেরিতে হলেও যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি প্রদানের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে তার সফল পরিসমাপ্তি এবং আইন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে জাদুঘরে পাঠানোই পারে বাঙালিদের কাঁধের বোঝা হালকা করে মনোবল চাঙা করতে…
পুরনো শকুনরা আবারো হয়তো সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামতে পারে; তাই আমাদেরও প্রস্তুত থাকতে হবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মোকাবিলা করার…