লিখেছেন – মিলন আহমেদ

রাষ্ট্র নাকি কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। আধুনিক রাষ্ট্র সম্পর্কে মনিষীরা অন্তঃত তাই বলেন। রাষ্ট্রকে জনগণের সামগ্রিক কল্যাণে নিয়োজিত সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান হিসেবেই সবাই জানে। তবে রাষ্ট্রের জনহিতকর কর্মকাণ্ডসমূহকে আমি স্বীকার করে নিয়েই ‘ইরান’ নামক রাষ্ট্রটির প্রসঙ্গে আসতে চাচ্ছি। শুধু ইরান নয়, মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সকল রাষ্ট্রসহ এশিয়ার বেশকিছু রাষ্ট্র এবং আফ্রিকার অধিকাংশ রাষ্ট্রের চরিত্রই প্রায় একইরকম, বাংলাদেশও দূরে নয়। বিশ্বের কয়েক’শ কোটি মানুষ এসব অপরাষ্ট্রের কবল থেকে কবে নাগাদ পরিত্রাণ পাবে, কবে নাগাদ এসব রাষ্ট্র গণমুখী হবে তা এখন হিসেবের বিষয়।

রেহানে জাবারির মতো কতশত কতহাজার নারী-পুরুষের জীবন হারিয়ে যাচ্ছে আইন নামক ওসব ‘অন্ধকার যুগ’-এর অন্ধকারের ফসলে, সে হিসেব করাও সহজ নয়। ‘আল্লাহু আকবর’ বলে মানুষের শিরোচ্ছেদ করা অথবা সৎ এবং ভাল মানুষদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা ওসব দেশের নিত্যদিনের কাজ। গত ২২ অক্টোবর ভোরে খুনের দায়ে রেহানের ফাঁসি হল। অথচ জানা গেছে জীবনে তিনি একটি মশাকে পর্যন্ত মারেননি, আরশোলাদের শুঁড় ধরে জানালা দিয়ে ফেলে দিতেন। ফাঁসির পূর্বে তিনি তাঁর মায়ের কাছে লেখা চিঠিতে যেসব কথা লিখেছেন তাতে ইরান নামক কু-রাষ্ট্রটির ভিত্তি নড়ে যাওয়ার কথা।

অত্যন্ত আত্মমর্যাদাবান মেয়ে রেহানে নিজের ফাঁসির কথা শুনেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি, অটল থেকেছেন নীতির প্রতি। মাকে লিখেছেন, “তুমি দুঃখে ভেঙ্গে পড়েছ জেনে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছি।” আরো লিখেছেন, “আমি চোখের পানি ফেলিনি। ভিক্ষাও চাইনি। আমি কাঁদিনি, কারণ আইনের প্রতি আমার অটুট আস্থা ছিল।” জীবনের শেষ ইচ্ছেটা জানানোর উদ্দেশ্যে লেখা উক্ত চিঠিতে তিনি তাঁর মাকে আরো লিখেছেন, “এবার আমার অন্তিম ইচ্ছেটা বলি শোনো। কেঁদো না মা, এখন শোকের সময় নয়। আমার ফাঁসি দেওয়ার পর আমার চোখ, কিডনি, হৃদযন্ত্র, হাড়, আর যা কিছু দরকার যেন আর কারো জীবন রক্ষা করতে কাজে লাগানো হয়। তবে যিনিই এসব পাবেন, কখনোই যেন আমার নাম না জানেন। আমি চাই না এর জন্য আমার সমাধিতে কেউ ফুলের তোড়া রেখে আসুক। এমনকি তুমিও না। আমি চাই না আমার কবরের সামনে বসে কালো পোষাক পড়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ো তুমি। বরং আমার দুঃখের দিনগুলো সব হাওয়ায় ভাসিয়ে দিও।”

মেয়েটি ধর্ষিত হওয়ার ঠিক পূর্বমুহুর্তে সুযোগ পেয়ে ধর্ষকের পিঠে ছুরিকাঘাত করেছিলেন। ঘটনার অনেক পরে লোকটি মারা যায়। ওই আঘাতেই সে মারা গেছে কিনা তা নিয়ে মতভেদ থাকলেও আমরা ধরে নিলাম রেহানেই তাকে খুন করেছে। তবে একটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট যে, মেয়েটি কোনোমতেই ঠাণ্ডামাথার খুনি নয়। কিন্তু ‘প্রাণের বদলে প্রাণ’-এই অমানবিক নীতির উপর দাঁড়ানো ‘কিসাস’ নামক শরীয়া আইনে নিস্পাপ মেয়েটিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিল ইরানের মধ্যযুগীয় সরকার। গোটা বিশ্বের অজস্র মানবাধিকার সংগঠন এবং বিশ্বের বাঘা বাঘা বহু নেতা ওই ফাঁসির আদেশের বিরোধীতা করেছেন, ইরানের সরকারের কাছে অনুরোধ করেছেন; রেহানের মা ‘শোলেহ’ মেয়ের পরিবর্তে তাঁকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানোর করুণ আকুতিও করেছিলেন। কোনোকিছুই রোধ করতে পারেনি ওই বর্বরতাকে। পারবে না, কারণ দেশটি নাকি ইসলামী প্রজাতন্ত্রী। ইসলামী প্রজাতন্ত্র, হিন্দী প্রজাতন্ত্র, খ্রিষ্টীয় প্রজাতন্ত্র এসব করতে গেলে মানুষের প্রজাতন্ত্র হয় না। প্রজাতন্ত্র শব্দটি গণতন্ত্রের সমার্থক কিন্তু গণতন্ত্র কোনো ধর্মীয় হয় না। ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’- এসব শব্দই পাগলের প্রলাপ। কারণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সকল ধর্মের মানুষ সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করে এবং রাষ্ট্র সব ধর্মের মানুষকে সমানভাবে নিরাপত্তা দেয়, সেবা দেয়।

ধর্ষককে হত্যা করাও সমর্থনযোগ্য নয়। তবে নিজেকে রক্ষা করতে মেয়েটি নিরূপায় হয়ে আঘাত করেছিলেন আর একবিংশ শতাব্দিতে এসেও স্বয়ং রাষ্ট্র নিজে আইন দিয়ে মেয়েটিকে হত্যা করলো। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, ধর্ষণ কি এবং ধর্ষক কতটুকু অপরাধী সেবিষয়টা ওসব নারীবিরোধী রাষ্ট্র এবং সরকারসমূহ অবগত কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ধর্ষণের বিভীষিকা এতই সূদুরপ্রসারী যে, অনেক ধর্ষিতাই মানষিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। ধর্ষিত হওয়া নারীর জন্য মৃত্যুর থেকেও ভয়ঙ্কর এবং ধর্ষণ-পরবর্তী জীবন কোনোমতেই স্বাভাবিকতা পায় না। ধর্ষিত নারী কখনো পূর্বের মানসিক অবস্থা ফিরে পায় না, যতদিন বাঁচে পৃথিবীটা তার কাছে বিষাদময় হয়ে থাকে, কোনো পুরুষকেই আর বিশ্বাস করতে পারে না। ধর্ষণের বিভীষিকায় অনেক সময় ভিকটিম মারা যায়, অথবা তার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যায়, কথাবলার শক্তি হারিয়ে অনেক সময় বোবা হয়ে যায়। আন্দ্রিয়া ডরকিন বলেছেন, “ধর্ষণ কোন দুর্ঘটনা নয়, কোন ভুল নয়। পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে যৌনতার সংজ্ঞা হল ধর্ষণ। যতদিন পর্যন্ত এই সংজ্ঞা বহাল থাকবে, ততদিন পর্যন্ত যৌন আক্রমণকারী হিসেবে পুরুষ এবং তার শিকার হিসেবে চিহ্নিত হবে নারী। এই সংস্কৃতিকে যারা স্বাভাবিক মনে করে, তারা ঠান্ডা মাথায় প্রতিদিন ধর্ষণ চালিয়ে যায়।” বিখ্যাত নারীবাদী ম্যাগাজিন সিজ এর সম্পাদক রবিন মরগ্যানের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘যে যৌন সম্পর্কটির উদ্যোক্তা নারী নয়, নারীর সত্যিকার যৌনইচ্ছে থেকে যেটি ঘটে না, সেই যৌন সম্পর্কটি ঘটা মানেই ধর্ষণ ঘটা।’ তসলিমা নাসরিন তাঁর ইংরেজী ব্লগে লিখেছেন, “রেপ ইজ নট অ্যাবাউট সেক্স, রেপ ইজ অ্যাবাউট মেগালঅমানিয়া, ম্যাচিজমো এণ্ড মিছোগাইনী।” অর্থাৎ ধর্ষণ কোনো যৌনতার ব্যাপার নয়, ধর্ষণ হচ্ছে নিজেকে(পুরুষের) বড় ভাবার ব্যাপার, পুরুষের অযথা অহঙ্কার এবং নারীবিদ্বেষীর প্রকাশ। মরগ্যান আরো বলেছেন, “রেপ ইজ দ্য পারফেক্টেড অ্যাক্ট অব মেইল সেক্সুয়ালিটি ইন এ পেট্রিআর্কাল কালচার। ইট ইজ দ্য আলটিমেট মেটাফর ফর ডমিনেশন, ভায়োলেন্স, সাবজুগেশন অ্যন্ড পজেশন।”

ধর্ষণের মুখোমুখি থেকে বেঁচে আসতে পেরেছিলেন, তাই তা উপলদ্ধি করতেও পেরেছিলেন। ধর্ষিত হলে কি হতো তা তাঁর মাকে লিখেছেন, “দুনিয়া আমায় ১৯ বছর বাঁচতে দিয়েছে। সেই অভিশপ্ত রাতে আমারই তো মরে যাওয়া উচিত ছিল, তাই না? আমার মৃতদেহ ছুড়ে ফেলার কথা ছিল শহরের অজ্ঞাত কোণে। কয়েকদিন পর মর্গে যা শনাক্ত করার কথা ছিল তোমার। সঙ্গে এটাও জানতে পারতে যে হত্যার আগে আমাকে ধর্ষণও করা হয়েছিল। হত্যাকারীরা অবশ্যই ধরা পড়ে না, কারণ আমাদের না আছে অর্থ, না ক্ষমতা। তারপর বাকি জীবনটা সীমাহীন শোক ও অসহ্য লজ্জায় কাটিয়ে কয়েক বছর পর তোমারও মৃত্যু হতো। এটাই যে হওয়ার কথা ছিল।” ঠিকই। এভাবেই প্রতিদিন বহু মেয়ে ধর্ষিত হচ্ছে এবং লাশ পাওয়া যাচ্ছে শহরের কোনো এক কোণে। রেহানের এই চিঠি যেদিন(২৯/১০/২০১৪) ছাপানো হয়েছে সেদিনের পত্রিকাতেও ‘ছাত্রী-শিশুসহ ছয়জন ধর্ষণের শিকার’- শিরোনামে খবর লক্ষ্য করা গেল। শাহজাদপুর, গৌরনদী, চকরিয়া, মাগুরা, মুন্সিগঞ্জ ও জকিগঞ্জে ওগুলো ঘটেছে। পরেরদিনের পত্রিকাতেও, তারপরের দিনেও একই রকম। রেহানের ভাগ্যেও অনুরূপ ঘটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আত্মরক্ষা করতে গিয়েই পরিস্থিতি পাল্টে গিয়েছিল। ওই চিঠিতে তাই তিনি লিখেছেন, “কিন্তু সেরাতের আকস্মিক আঘাত সবকিছু ওলটপালট করে দিল। শহরের কোনো গলি নয়, আমার শরীরটা প্রথমে ছুড়ে ফেলা হলো এ ভিন জেলের নিঃসঙ্গ কুঠুরীতে, আর সেখান থেকে কবরের মতো এই শহরের কারাগারের সেলে। কিন্তু এ নিয়ে অনুযোগ করো না মা। আর তুমি তো জানো যে মৃত্যুতেই সব শেষ হয়ে যায় না।”

ধর্ম এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চিরকালই নারীর অধিকারের শত্র“। নারী-স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের সঙ্গে ধর্মান্ধতা এবং ধর্মীয় আইনের বিরোধ আজকের নয়; ধর্মসৃষ্টির গোড়া থেকেই। নারীর মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, বেগম রোকেয়া, তসলিমা, মালালা সবাই ধর্মান্ধতার শিকার হয়েছেন। লক্ষ্য করলে পরিস্কারভাবে দেখা যায় বিশ্বের যেসমস্ত দেশের শাসনব্যবস্থায় ধর্মের ব্যবহার বেশি সেই সমস্ত দেশের নারীরাই অধিক লাঞ্চিত। কৃষ্ণা বসু তাঁর ‘ধর্ম ও নারী’ গ্রন্থে লিখেছেন, “আমাদের এই পৃথিবীতে যত ধর্ম আছে, যত ধর্মগ্রন্থ রয়েছে তার সবই পুরুষের রচনা- এই কথাটি সবচেয়ে বেশি করে মনে রাখবার মতো বিষয় বলেই মনে করি। কি পুরাণ, কি রামায়ণ মহাভারত, কি বাইবেল, কি কোরান, কি বৌদ্ধ ধর্মের গ্রন্থরাজি- সমস্ত ধর্মগ্রন্থই পুরুষের সৃষ্টি। যে সমাজে আমরা বাস করি, জন্মগ্রহণ করি, নিঃশ্বাস নিই; শিক্ষিত ও পালিত হয়ে উঠি, জীবন যাপন করি, আত্মীয়-পরিজন সন্তানদের সঙ্গে পারিবারিক জীবন অতিবাহন করি- তার সমস্তটাই তৈরি করেছে পুরুষেরা, স্বভাবতই তাই, পুরুষের স্বার্থে, পুরুষের নিজের প্রয়োজনে সমস্তরকম বিধিব্যবস্থা, সকল মূল্যবোধ এবং আচরণ-বিধি পুরুষেরাই নির্মাণ করে দিয়েছে। সেখানে সমস্ত ধর্মে মেয়েদের হেয় করা হয়েছে, হীন চোখে দেখা হয়েছে, দমিত করে রেখে দেওয়া হয়েছে; কোথাও আত্ম-সম্মানে মাথা উঁচু করে বাঁচতে দেওয়া হয়নি।” কাজেই ইরানের মতো দেশে রেহানে জাবারিদের ফাঁসি এখন অস্বাভাবিক নয়। তবে ইউরোপ থেকে ধর্ম-শাসনকে বিদায় দেয়া হয়েছে; ইরানসহ অন্যদেশসমূহ থেকেও বিদায় এখন সময়ের ব্যাপার। একথা নিশ্চিত যে, রেহানে জাবারির জীবন সেসময়কে দ্রুত কাছে টেনে আনবে।

আকাশ-সমান উঁচু দর্শন অন্তরে ধারণকারী রেহানে জাবারি চিঠিতে তাঁর মাকে আরো লিখেছেন, “মা, তুমিই তো শিখিয়েছ অভিজ্ঞতা লাভ ও শিক্ষা পাওয়ার জন্যই আমাদের জন্ম। তুমি বলেছিলে, প্রত্যেক জন্মে আমাদের কাঁধে এক বিশেষ দায়িত্ব দেয়া থাকে। মাঝেমধ্যে লড়াই করতে হয়, সে শিক্ষা তো তোমার থেকেই পেয়েছি। সেই গল্পটা মনে পড়ছে, চাবুকের ঝাপটা সহ্য করতে করতে একবার প্রতিবাদ জানানোর ফলে আরো নির্মমতার শিকার হয়েছিল এক ব্যক্তি। শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু হয়। কিন্তু প্রতিবাদ তো সে করেছিল ! আমি শিখেছি, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে অধ্যবসায় প্রয়োজন। তার জন্য যদি মৃত্যু আসে, তাকেই মেনে নিতে হয়।” এইরকম মহান একজন মেয়ে জন্ম দিতে পারায় অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে রেহানের মা ‘শোলেহ’-কে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

মহাত্মা গান্ধী গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটা বলেছেন তা হল, “চোখের বদলে চোখ- এমন নীতি পুরো জগতকে অন্ধ করে দেয়।” ঠিকই, ‘হত্যার বদলে হত্যা’ কোনো সভ্যতা হতে পারে না। প্রতিশোধমূলক আইন কোনো সভ্যতা নয়, বরং পৈশাচিক বর্বরতা। সংশোধনমূলক আইনই হচ্ছে প্রকৃত সভ্যতার পরিচায়ক। এ অবস্থায় রেহানের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলতে চাই, হ্যাঁ ‘মৃত্যুতেই সব শেষ হয়ে যায় না’। রেহানের মৃত্যু অবশ্যই সার্থক হবে, রেহানের জীবনের ধাক্কায় ইরানীয় বর্বরতার ভিত্তি দুর্বল হয়েছে সত্যি; তবে আমরা চাই এই ধাক্কাতেই ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাক সে বর্বরতা। রেহানে জাবারি, সেলুট তোমাকে।

লেখক: মিলন আহমেদ, ঈশ্বরদী, বাংলাদেশ