লিখেছেন – কিঙ্কর আহসান

সবুজ পটভূমিকায় লাল-নীল-হলুদ বাহারি ফুলের বেড-শিট, তার উপর স্থির হয়ে আছে বইয়ের ছায়া— বাইরে সন্ধ্যাটা ঝেঁকে বসেছে! বসুক! কিন্তু যে গল্পটা এইমাত্র পড়ে শেষ করলাম, সে গল্পের কথক– লম্বু সোলাইমানকে নিয়ে ধন্দে পড়ে যাই। ও যখন কুয়োর ভেতর বন্দি হয়ে পড়েছিল, কী না করেছে সেই সাপটা তার জন্য? গ্রেট ম্যাসিজের সেই একেবারে নির্জন পার্বত্য এলাকায় শিকার করতে গিয়েছিল সে আর তার চোখ কিনা আটকে ছিল ধ্যামড়া এক ধুসর শেয়ালের গায়ে— পড়ুক, দৌড়ানোর সময় তার মনে ছিল না সামনে গর্ত থাকতে পারে? যে সরু কুয়োয় পড়ে গেল, যা গভীর আর ভেতরে যা ঠান্ডা— যদি সাপটা বাইরে গিয়ে খরগোশ আর তিতির পাখি শিকার করে তাকে না খাওয়াত, দুই দিনেই তো মরে ভূত হয়ে যেত!

মাথার বেশ উপরে কুয়োর সরু মাথার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল এক চিলতে নীল আকাশ। আর সে আকাশ ওকে মনে করিয়ে দেয়, এই পিচ্ছিল ঠান্ডা কুয়োর তলায় অসহায় হয়ে মরে পড়ে থাকতে হবে তাকে। সেই আবছা অন্ধকারে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সবচেয়ে ছোটো মেয়েটার মুখ; দেখতেই পারত না ও মেয়েটাকে। ফেলে আসা গাঁ, সেই গাঁয়ের উজ্জ্বল দিনের আলো, আর তিন ছেলে-মেয়ে যে প্রতি রাত্রে তার চারপাশে গোল হয়ে চোখ বড় বড় করে কিচ্ছা শুনত— এইসব দৃশ্য তার গায়ে কাঁটা ফুটিয়ে দিচ্ছিল। বড্ডো অসহায় লাগছিল তার নিজেকে। তৃতীয় দিনে পাথরের দেয়াল ধরে পাগলের মত ওর লাফানো দেখে সাপটি আগে নিজে উপরে উঠে তারপর গাছের সাথে গলা পেঁচায় আর লেজ নাড়তে থাকে যাতে লম্বু সোলাইমান লেজটি শক্ত করে ধরে রাখে। অথচ প্রথম যেবার সাপটিকে কুয়োতে দেখে যে, জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, কী ভয়টাই না পেয়েছিল এই লম্বু সোলাইমান। আর কী সুন্দর, সাপ এগিয়ে এসে তার কোলে মাথা রাখল তারপর সারা শরীর পেঁচিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল— এক ঘুমেই রাত্রি পার!
ঐ মরণ গর্ত থেকে বের হয়ে যখন চারপাশে চোখ মেলে তাকাল, দিনের আলোয় কোনো কিছুই দেখে ভালো মতো বুঝে ওঠতে পারছিল না; সে পরের পুরো এক বছর গ্রামের যাকেই সামনে পেয়েছে, হাত ধরে বলেছে, ‘এই যে মিয়া ভাই, একটা গল্প শুনেন! ঐ যে আমি এক শেয়ালরে গুলি করতে গিয়া গর্তে পইরা গেছিলাম না? পরেই তো আমি আবাক! আরে— একি কান্ড! ওখানে ঘুটঘুটা অন্ধকারে দেখি— এক ফেরেশতা! সাপের মুর্তি ধইরা শুয়া রইছে আর ঐ শেয়ালডা নিশ্চয় কোনো বদ জীন আছিল— ভাগ্যিস কুয়ায় পইড়া গেছিলাম…’ ওরা জানে, এই গল্প তাকে শুনিয়েই ছাড়বে। তাই বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘ফেরেশতা দেখতে কী রহম?’

সে গল্প শেষ করে। গল্প যখন শেষের পথে, গর্তের বাইরে আসা থেকে শুরু করে বাড়ি ফেরার সময়কার সেই মুহূর্তটার কথা মনে পড়ে যায় তার। গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে আসে, আর শ্রোতার মাথার উপর দিয়ে দৃষ্টিকে ছুড়ে দেয় সামনের গীর্জার লাল গম্বুুজের উপর; শুন্য দৃষ্টি হারিয়ে যায় এক বছর আগের সেই মুহূর্তটায়— চোখের সামনে দেখতে পায় পরিচিত সূর্যের আলোয় সেই পরিচিত মাঠ। পৃথিবীর এই আলো বউ-বাচ্চা আর বাড়ির ছোট্ট উঠানের দিকে তাকে প্রবলভাবে ঠেলতে থাকে। আর বাড়ি ফেরার পথে যে ঝর্ণা নজরে আসে, তার জলে পা ডুবিয়ে ভাবতে থাকে, জীবনটা আসলেই সুন্দর! দূরে, তাদের গাঁয়ের মাথায় ধুঁয়োর কুন্ডলি উড়ছে। যেতে যেতে ঘরের সবুজ দেয়ালের রঙে চোখ আঁটকে যায় আর ঠিক তখনই বউয়ের ভেজা চুলের গন্ধ পেয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি সশব্দে বাড়তে থাকে সোলাইমানের। দয়ালু বন্ধু সাপকে বিদায় জানায় সে হাত নেড়ে, এদিকে বউ-বাচ্চাদের আনন্দের চিৎকার-চেচামেচি, কুকুরের ঘেউঘেউ— এইসব হট্টোগোলে গ্রামের সন্ধ্যা কিশোরী নর্তকীর মত নাচতে থাকে। যতদিন পর্যন্ত না সাপটাকে সে কয়েকজন ধান্দাবাজ দরবেশের কাছে ১৫ তুমানে বিক্রি করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সে গর্তটিকে চিনিয়ে দিয়ে আসে, ততদিন পর্যন্ত এই আবছা আলোর সন্ধ্যাটা তার কাছে এক টুকরো স্বপ্নের মতোই ছিল। আর ঠিক তখনই সোলাইমানের বিষন্ন আর বিধ্বস্ত চোখের ছবি আমার মনে ঝিলিক মেরে ওঠে, তার প্রতি আমার একিসাথে করুণা আর ঘেন্না জাগে। তার উঠোনে একটা সন্ধ্যা কাটানোর ইচ্ছা জাগে তার সাথে।

কিন্তু আমার ঘরের বাইরে যে সন্ধ্যাটা ঘনিয়ে আসছে, তা আমাকে ঘিরে নাচবে তো দূরের কথা, ঝিম মেরে বসে আছে। বইটা টেবিলে আলতো করে রেখে এক চক্কর বাইরে ঘুরে আসব কিনা স্থির করে ওঠতে পারছি না। বইয়ের কাভারটা বেশ সুন্দর! একটা সন্ধ্যা-ঘেরা মালভূমি— তার উপর বসে বসে এক গাছের নিচে যে ছেলে গল্প শোনাচ্ছে আরো তিন জনকে আর একটু দূরেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে যে গীর্জা তাদের সবাইকে বইটির প্রচ্ছদ শিল্পী গাঢ় নীল রঙের সান্ধ্য-পোশাক পরিয়ে দিয়েছে। পাশে ডুবন্ত বড় এক সূর্যের উপর লাল অক্ষরে লেখা— আরমানী ছোটগল্প-সংগ্রহ। বিরাট ডুবন্ত হালকা ছাই রঙের সূর্য, হালকা ধুসর আকাশ আর তার নিচে নীল সন্ধ্যা— আমিও যেন হেঁটে বেড়াচ্ছি সেই মালভূমির উপর দিয়ে! যেখানে সন্ধ্যা নীল সুয়েটার পরে নামে, সেখানকার সান্ধ্য-ঘাস কেমন হতে পারে এই নিয়ে ভাবনায় পড়ে যাই। আমার ছেলেবেলার এক সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে গেলো— কিন্তু সেই সন্ধ্যায় বড় আপা ছিল, পড়শি ছিল কয়েকজন আর ছিল অবন্তী। বহুদিন আগে ঘটে যাওয়া পৃথিবীতে সেই সন্ধ্যাটাকে কাঁচি দিয়ে কেটে আলাদা করে তারপর মালভূমির এই অপার্থিব নীল সন্ধ্যায় যদি ছেড়ে দেই, তবে প্রথমেই আমি অবন্তীর কানের কাছে মুখ এনে কয়েকটা কথা বলব। মাঠের উপর ওরা নাহয় চড়ুইভাতি খেলুক, আমি আর ও চুপি চুপি ছুটে যেতাম গীর্জার দিকে। এইবার আর কোনো ভয় আশংকা ছাড়াই সোজা ডুকে পড়তাম গীর্জায়। আমাদের গাঁয়ের মৌলবির মত অট্টহাসিতে ফেটে পড়বে না নিশ্চয়; গিয়ে এবার আর কানে কানে না— সোজা চোখের দিকে তাকিয়ে বলব, ‘ফাদার, আমরা বিয়ে করতে চাই।’ মৌলভি সংক্রান্ত ঘটনার সময় আমরা নাহয় পিচ্চি ছিলাম তাই মৌলভি হাসতে হাসতে ভেঙে পড়েছিলেন আর বলেছিলেন, ‘ইমনের মা, হুনো তোমার পিচ্চি পোলায় কী কয়!’ কিন্তু মালভূমির এই অপার্থিব নীল সন্ধ্যায় আমরা আর পিচ্চি নই। অবন্তী বেঁচে থাকলে এখন ওর বয়স হত সতের, আমার থেকে ও দুই বছরের ছোট ছিল।
গীর্জা থেকে বিয়ে করে ওদের দিকে যখন হাঁটা দিতাম, আমরা পরস্পরের দিকে তাকাতে লজ্জা পেতাম; ওর মুখে কমলা রং ছড়িয়ে পড়ত, নীল সন্ধ্যার আড়ালে দ্রুত কয়েকটা চুমো দিলে সে রং আরো গাঢ় হত। তখন সে রং থেকে কমলার সুবাস ছড়াত তারপর সে সুবাস ছড়িয়ে পড়ত তার সারা শরীরে। ওদের কাছে পৌঁছানোর আগেই ওর চিবুকে হাত ছুঁয়ে এক কৌটা গন্ধ চাইতাম। ও হেসে বলত, ‘আজ সারা রাত তোমার গায়ে গন্ধ বিলোব!’ আম্মার আঁচলের খুঁটের মত নির্ভয় চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে ও। সে এক অপার্থিব নীল সন্ধ্যা— পার্থিব কোনো ভাষায় কি আর তার বর্ণনা দেওয়া যায়?

বড্ডো ক্লান্ত লাগছিল, মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো। কোথায় সে অপার্থিব নীল সন্ধ্যায় অবন্তী, কোথায় সে চড়ুইভাতি, মাথার উপর হালকা ছাই রঙের ডুবন্ত সূর্য কিংবা হালকা ধুসর আকাশের বদলে মাথার উপর ফুলতোলা কাগজের সিলিং; বাইরে যে সন্ধ্যা ঝুলে আছে তাও বুড়ি বেশ্যার স্তনবৃন্তের মতো কালচে আর মৃত! আমার ভেতরে যে আমিত্ব ছিল আগে, তা মিইয়ে গেছে তাও তিন বছর হলো। ‘এক সহস্র ও এক রাত্রি’ বইটি অবন্তী যেদিন আমার হাতে রেখে কানে কানে বলে যে, সে নাকি আমার জন্যই পাঠাগার থেকে চুরি করেছে, সেদিন আমিও ঠিক ঠিক ঠাহর করতে পারছিলাম না, একদিন ও না থাকলেও এই বইয়ের প্রতিটা গাঁথার গা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে একেকটা অপার্থিব নীল সন্ধ্যা। বাগদাদ হয়ে ওঠবে আমার পাশের গাঁ! শাহজাদির বলা গল্পগুলো আমাদের প্রতি সন্ধ্যার মুখোমুখি মুহূর্তগুলো মনে করিয়ে দেবে!

অবন্তী যেদিন মারা যায়, সেদিন থেকে তার ছায়া বয়ে বেড়াচ্ছি তার দেওয়া আরব্য রজনীর প্রতিটা গাঁথায়-পাতায়। সেখানে তৃষার স্থান কীভাবে দেব, সে কি বুঝে না? বোন হিসেবে তাকে কত আপন বন্ধু ভাবতাম! অথচ… একটু আগে, সোলাইমানের গল্পে ডুব দেবার ঠিক আগপর্যন্ত, সমস্ত মানুষের প্রতি যে অবিশ্বাস এই রুমের প্রতিটা কোণে কোণে ঝুলে ছিল, হঠাৎ যেন দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে আবার ফিরে এলো আমার কাছে। পৃথিবীর কারোর সাথেই আর কোনো সম্পর্ক রাখার ইচ্ছে নাই, যেখানে আমার আপন বোন আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, সেখানে আর কাকে বিশ্বাস করব? তৃষার প্রতি তো আলাদা ভালবাসা ছিল, বিশ্বাসও করতাম— তবুও কেন বালিশের পাশ থেকে কারুকাজ করা আরব্য রজনীর সুখকর কারাগারের মত সেই ইমারতের কিতাবখানা সে চুরি করবে? ওকে কি বলি নাই যে, এই বই তো ছাপায় কয়েক দিস্তা কাগজে মোড়ানো একটা বান্ডিল না, ছিল আমার বন্ধু— যে বন্ধু, যখন আমার চোখের দিকে নরম করে তাকিয়ে কেউ একটা মিষ্টি কথা পর্যন্ত বলে নি তখন অসহনীয় মুহূর্তগুলোর কর্কশ চাহনি থেকে আমাকে আড়াল করে রেখেছিল! অথচ কী হাস্যকর— যে মেয়ে তিনবছর ধরে ঠোঁটের কোণে জিভে সরিয়ে, চোখ পিটপিট করে আমাদের গল্প শোনে যেত, তাকে বিশ্বাস করার কী দরকার ছিল! প্রায় সন্ধ্যার তার অভিযোগ গুলো যদি তখনই ভেবে দেখতাম তাহলে আমার আরব্য রজনীর শাহজাদি কি আজ মুদির দোকানের সদাই বেচার ঠোঙা হয়? মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘কী করছোস বই দিয়া?’ আর সে কিনা আমার শার্টের বোতামের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে উত্তর দেয়–‘আমি নেই নাই!’ গতকাল নগদে দেখি, ওপাড়ার সামাদ ভাই এই বইয়ের পাতার ঠোঙায় আয়েশ করে চানাচুর দিয়ে মুড়ি খাচ্ছে। তার কাছে এই ঠোঙা কোথায় পেলো তা জানতে চাইলে ও জানাল যে, মুদির দোকান থেকে কিনেছে আর তখনই মনে পড়ে গেল তৃষা প্রায়ই বলত, ‘সারাদিন কী পাইছো, খালি নিয়া পইড়া থাকো এক বই! আর, তোমার মুখে য্যান কুনো গপ্পই নাই, এক অবন্তীর ছাড়া। যত্তুক, এই ছিঁড়া বইটার যত্ন নেও, সুময় দেও— তত্তুক তো আমারেও দেও না!’ খেয়াল করতাম কথাগুলো বলার সময় ওর ঠোঁট আর গাল শক্ত হয়ে যাচ্ছে, ছুঁড়ে দেওয়া তীব্র দৃঢ় চাহনি আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন, ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দৈত্য ঘৃণ্য প্রভুর দিকে তাকিয়ে আছে নীরবে। যদি পারতাম এই বিদঘুটে চুপচাপ সন্ধ্যাটাকে ফুটো করে বেরিয়ে সেই গাঢ় নীল মুখর সন্ধ্যায় গিয়ে মেতে থাকতে, তাহলে গীর্জায় গিয়ে আগে দু দন্ড প্রার্থনা করতাম– ‘হে ইশ্বর, তুমি আমার বইটা ফিরয়ে দাও।’

রুমের চার দেয়াল যেন একজন আরেকজনের হাত ধরে আমাকে ঘিরে ঘুরছে তো ঘুরছেই। আমার চোখ বাঁধা; আমি কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি— ঘূর্ণমান চার দেয়াল আমার দিকে আঙুল তাক করে অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়ছে, এক দেয়ালের মাথা ঠোকাঠুকি খাচ্ছে আরেক দেয়ালের কপালে। এই ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-তামাশার আওয়াজ তাদের গায়ে যেন আছড়ে পড়ে প্রতিধ্বনি তুলছে আর আমার অসহায়ত্ব এইসব আওয়াজের পায়ে মাথা কুটে কয়েকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ভিক্ষা চাইছে।

জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে থাকা এর চেয়ে বরং স্বস্তির। অন্ধকারে দু একটা গাছের আবছা শরীর যতটুকু নজরে আসে, সেদিকে ছুটে গিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসতে পারলেই যেন শান্তি। জানালার শিকে মাথা ঠেকিয়ে ওভাবে কতক্ষণ বাইরে তাকিয়ে আছি, ঠিক ঠিক মনে করতে পারছি না। দূরে, গাছ-পালার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা ছেলে-মেয়ে বড় এক আগুনের কুণ্ডের চারপাশে গোল হয়ে বসে আছে। তাদের মাঝে মুদি দোকানীর ছেলেটার গড়ন হালকা বোঝা যাচ্ছে। হঠাৎ মনে পড়ে গেলো আজ এই সন্ধ্যায় আমার মুদির দোকানে যাওয়ার কথা। কেননা এই সময়টাতে দোকানে ভিড় একদম থাকে না বললেই চলে। এবং এটাই কাজ হাসিল করার মোক্ষম সময়।

হাতের পাতার উপর ভর দিয়ে সোজা হয়ে বসি। বিছানা থেকে নেমে জুতোয় পা গলাতে গিয়ে দেখতে পাই জুতোর একটা ফিতে ছিঁড়ে; নিচের দিকে ঝুঁকে ছেঁড়া ফিতের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে কিছু একটা মনে করতে চেষ্টা করলাম। আমার মনে হয় আজ সন্ধ্যায় বাজারে যাওয়ার কথা ছিল— ছেঁড়া জুতোটা সারিয়ে আনা, পালং শাক, একটা ব্লেড, বারান্দার ভাল্ব সেই পরশু দিন থেকে নষ্ট, নতুন একটা কিনে আনার কথা। ধুর! চুলোয় যাক বাজার!

বিছানা থেকে গল্পের বইটা তুলে টেবিলের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেই কিন্তু ঘুরতে ঘুরতে উড়ে গিয়ে পড়ে টেবিলের একেবারে কোণায়। এই সাধারণ নির্দোষ বইটাও মুদির দোকানে ঠোঙা হয়ে যেতে পারে, বিশ্বাস নাই! কোণা থেকে তুলে নিয়ে খাতার মাঝখানে সেঁধিয়ে রাখলাম।
বাইরের সেই অগ্নিকুণ্ডের উদ্দেশ্যে উঠানে পা রাখতেই ঠান্ডা বাতাস, আমি যে ঘর থেকে বাইরে বের হয়েছি, তা মনে করিয়ে দেয়। এইমাত্র খেয়াল হলো তৃষাকে সেই বিকেল থেকে কোথাও দেখছি না। আজকাল ও যথাসম্ভব আমার ছায়া এড়িয়ে চলে। সামনে পড়ে যদি যায়ও, মাথা নিচু করে থাকে; আমিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ি।

রান্না ঘর থেকে মা’র তীক্ষ্ণ চিৎকার কানে ভেসে আসে— “নবাবের পুত, আতুর ঘর থাইকা বাইর রইছো?” এসব আমার মুখস্থ। কিছুক্ষণ গজগজানির পর আপনা আপনি থেমে যাবে। আমার দৃষ্টি গিয়ে স্থির হলো মায়ের পান-খাওয়া বড় বড় দাঁতগুলোর উপর; কথার তোড়ে যেন ওগুলো বের হয়ে আসতে চাইছে। সোলাইমানের সাপটার চোখের মতো আমার চোখ থাকলে এখনি পুড়িয়ে যেন ছাই করে দিতাম তার মুখমণ্ডল! যখন রাস্তায় পা রাখলাম, মা’র ছোঁড়া বর্শার ফলার কয়েক টুকরো তখনো কানে এসে বিঁধছেঃ “বড় পোলা! এডা কামে যদি হাত দিত! এইডা কোনো মানুষ হইলো নাকি! এই যে গেলি আর য্যান বাইত না ফিরস! কয় যাবি, কইরা খা-গা!”

আমাদের বাড়ি ছেড়ে আরেক বাড়ির উঠোনে পা রাখি। সামান্য দূরে, খড়-কুটোর আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে চুল্লির মত, আর কয়েকজন সে আগুনের আঁচ থেকে বাঁচতে কুণ্ড থেকে সরে এদিকে মুখ করে বসে আছে, মুদির ছেলেটা এখন দাঁড়িয়ে, আগুনের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে— আর একমাত্র যে মেয়েটা সমানে ঠোঁট নেড়ে নেড়ে খানিক বাদে বাদেই হেসে কুটিকুটি হচ্ছে, সে তৃষার খুবই ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। লাল শিখায় তার হাত মুখ জ্বলছে। আমি সামান্য এগিয়ে মুদির দোকানে পৌঁছার রাস্তার দিকে এগুতে থাকি।
বেচারা সোলাইমানের জন্য খারাপ লাগে। তার এখন সঙ্গতা দরকার। এখন এই আমার গাঁয়ের গাঢ় সন্ধ্যার কুয়াশা-অন্ধকার-ধুয়োর যে মুহূর্তটায় বন্দি হয়ে আছি, যদি এখান থেকে বের হতে পারতাম! তবে, আমি যে সোলাইমানের সাথে একটা সন্ধ্যা কাটাব বলে নিজের মনে স্থির করেছিলাম, এটাই হতে পারে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আবছা অন্ধকারে গনগনা আগুনের চুল্লির চারধারে আমি আর মৃত এক রূপসী তার মুখোমুখি বসে থাকব। সেদিনও থাকবে এমনি অন্ধকার। সে গালের এক অংশ গামছা দিয়ে ঢেকে উদাস সুরে গল্প বলে যাবে।… আর কী আশ্চর্য, মুহূর্তেই সামনের থমথমে বাঁশঝাড়, পাশের নির্লিপ্ত মাঠ, এই নিঃসঙ্গ কুয়াশা, বুড়ো আকাশ আর তেজি ধোঁয়া হয়ে গেল পারস্য সীমান্তের নিকটবর্তী পাহাড়ি কোনো কনকনে শীতের গাঁ!

লম্বু সোলাইমান বলে যায়— “আমি পনের তুমানে সাপটা বেইচা দিছি।” মৃত রূপসী জানতে চায় যে, সে এই কাজ কেন করল। তার উত্তরে সোলাইমান ডান গালের উপর থেকে আস্তে আস্তে গামছা সরায়; আমরা দেখতে পাই, সেখানে গাল বলে কিছু নেই— একেবারে মাড়িতে ঝুলে থাকা সাদা দাঁতগুলো লজ্জায় যেন লালচে হয়ে গেছে। অপর যে গাল সেই মৃত সঙ্গির শোকে বিষন্ন আর উদাস, তা আবার কেঁপে ওঠে, বলেঃ “বেইচা দিছি, ভাবলাম— দরবেশরা যেহেতু বলল, সাপটা একা শীতে কষ্ট করব, তারা বরং ভাল ভাল খাবার দিবো, মখমলের কাপড়ে শোয়াব, তাছাড়া আমি ১০ তুমান দিয়া একটা বলদ কিনবার পামু! সে তো আর জানবো না যে, আমিই তার গর্ত দেখায়া দিছি। কিন্তু দরবেশরা মোহনীয় বাঁশির জাদুতে যখন বশ করে, বন্দী করে লোহার সিন্দুকে, গাঁয়ের মেলা মানুষে ঘিরা রাখছিল তাগোর আর সেই ভীড়ের মধ্যে যখন সাপটা আমারে দেখে, ভয়ংকরভাবে খেইপা যায়। য্যান লোহার সিন্ধুক ভাইঙা বাইর হয়া আসবো; যখন আমার চোখে চোখ রাখে, আমি পাথর হয়া যাই। আর তখনই ছাড়ে সেই হলদে থুথু। আমার ডানগালে আইসা পড়ে।”
মাথার উপর নিঃসঙ্গ কুয়াশা; নিচে চুল্লির চারপাশে আমরা— আমি, মৃত রূপসী আর সোলাইমান। কাঠের গনগনা আগুন; সেই চুল্লির লাল আলোয় মৃত রূপসীর চোখ চকচক করে ওঠে। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, আরব্য রজনীর শাহজাদির সাথে তার দেখা হয়েছিল কিনা। কিন্তু সেই সময় লম্বু সোলাইমানের কণ্ঠ আবার শুনতে পাই। হঠাৎ তার গলার স্বর, বলার ভঙ্গি বদলে যায়— কেঁপে ওঠে তার গলা!

“সেই বলদ বেইচা বউয়ের জন্য কামিজ, আর মেয়ের চিকিৎসা করাইছি। আমার নিজের ছায়া সাক্ষী।” অনেক দূরে প্রথমে একটা শেয়াল তারপর আরো কয়েকটা শেয়াল একসাথে ডেকে ওঠে— হুক্কা-হুয়া। সোলাইমান ‘আপনারা বহেন’ বলে গনগনা আগুনের চুল্লির পাশ থেকে উঠে পড়ে। আগুনের রং টকটকে লাল। ছুটে যায় ঘরে তারপর ফিরে আসে শিকারের সেই বন্দুক সাথে নিয়ে। এখনো ঠিকঠাক কাজ করে কিনা তা দেখে নেবার উদ্দেশ্যে আকাশে একটা গুলি ছোটায় সে। ধ্রুম করে একটা শব্দ নিস্তব্ধ উঠোনে প্রবল আওয়াজ তুলে আছড়ে পড়ে। কোথা থেকে একটা তিতির উড়ে এসে বসে সোলাইমানের কাঁধে।

মৃত রূপসী আর আমি খেয়াল করলাম, কে যেন সময় থামিয়ে দিয়েছে; সন্ধ্যা যেন আর ফুরাচ্ছেই না। সুতরাং আমাদের বয়সও বিশেষ এক মুহূর্তে এসে থেমে আছে। কতদিন ওর চোখে রামধনু খুঁজি না! চোখে একলা সবুজ একটা দ্বীপের ছবিও আঁকি না সেই তিন হেমন্ত থেকে— বহুদিন পর আরেকবার ওর চোখে-মুখে সবুজ দ্বীপ আঁকার ইচ্ছে জাগে; আমি তাকায় তার দিকে। মৃত রূপসীর পাতলা ঠোঁট কেঁপে ওঠে। ওর দিকে তাকিয়ে ভয়ে আমি চিৎকার দিয়ে ওঠলাম; গায়ে একটা সুতোও নেই ওর। সোলাইমান আবার চুল্লির পাশে এসে বসল, কাঁধে হাত রেখে আমাকে যেন আশ্বাস দিচ্ছে, এমন স্বরে বলে, ‘ইয়াং ম্যান, এখনি তো তোমরাগো সময়!’

জঙ্গল থেকে একটা খরগোশ ছুটে এসে সোলাইমানের কোলে লাফিয়ে পড়ে। সে তার পিঠে নরম করে হাত বোলাতে থাকে। ঘর থেকে তার সবচেয়ে ছোট্ট মেয়ে ছুটে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে, বায়না ধরে, ‘আব্বু, আমি কোলে ওঠবো।’ হঠাৎ কী মনে করে এক জটকায় উঠে দাঁড়ায় সোলাইমান; খরগোশটা কোল থেকে ছিটকে পড়ে গনগনা আগুনের চুলোয়।

‘আয় মা, কাছে আয়, কোলে নেই।’ মেয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়। সবচেয়ে এই ছোট্ট মেয়েটাকে এক পলকে উপরে তুলে নেয় লম্বু সোলাইমান; তারপর সজোরে এক আছাড় মারে। মেয়ে গিয়ে ছিটকে পড়ে উঠোনের এক কোণায়।
খরগোশের পোড়া গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা মারে। এই সময় মৃত রূপসী বিষন্ন গলায় বলে ওঠে, ‘লোকটা দেখো কী অদ্ভুত! অদ্ভুত সব কাজ করছে। আর কেমন দুর্বোদ্ধও ঠেকছে আমার কাছে। মনে হয় সে অমর হতে চায়।’ সোলাইমান আমার দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে, তারপর ঘোষণা দেয়— ‘আইজ রাইতে আমরা পুড়া খরগোশ দিয়া নাস্তা সারমু…’

ঘর থেকে একটা ছায়া দ্রুত পায়ে ছুটে আসে আমাদের দিকে। কাছে এসে সোলাইমানের দিকে আঙুল তাক করে জানতে চায় যে, তার মেয়েকে খুন করা কেন হলো। রাগে ক্ষোভে ছায়াটি যেন তিরতির করে কাঁপছে। সোলাইমান তার উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করে না। বউয়ের দিকে নিশানা তাক করে নিঃসঙ্কোচে ট্রিগার চাপে। চারপাশের পাহাড়ের গায়ে শব্দটা ধাক্কা খায়; কেঁপে ওঠে ওঠোন। সেই শব্দে তিতির ভয় পেয়ে উড়ে যায়। বন্দুকের নল থেকে বের হওয়া ধোঁয়া ফুঁ দিয়ে কমাতে চেষ্টা করে সে। এই কাজ অসমাপ্ত রেখে সোজা আমার দিকে চোখ রেখে বলে ওঠে— “কাউরে বিশ্বাস করবা না। এমনকি নিজের বোনরেও না।”

আর তখনই অবাক হয়ে লক্ষ করি, সে বন্দুকটা উঠোনের এক পাশে ছুঁড়ে মারে; তারপর কোদাল নিয়ে বড় পাহাড়ের দিকে ছুটে। একটা চাপা উদ্বেগ মৃত রূপসীর চোখ থেকে শিশির হয়ে ঝরে পড়ে। আমি যাতে তার ভেতরের লুকানো আবেগ বুঝতে না পারি, তাই যথাসাধ্য স্বাভাবিক গলায় সোলাইমানকে জিজ্ঞেস করে, ‘কোদাল নিয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছে, শুনি?’

সোলাইমান নিরাসক্ত গলায় উত্তর করে— ‘কবর খুড়তে।’

–‘কার কবর!’ –‘আমার নিজের।’

খুব ইচ্ছে ছিল মৃত রূপসীর কাছে চুল্লির পাশে বসে শাহজাতির গল্প শুনব। ও আমাকে ‘এক সহস্র এবং এক রাত্রির’ পরের রাত্রের গল্পগুলো শুনাতে চেয়েছিল। হঠাৎ সে ইচ্ছা উবে গেলো মুহূর্তে। আমি রেগে গিয়ে চিৎকার করে ওঠলাম, ‘তুমি এক মৃত জানোয়ার।’ চোখে গভীর বিষন্নতার ছায়া ঘনিয়ে এলো মৃত রূপসীর, ধীরে ধীরে বলে ওঠল, ‘মৃত, সেতো তুমিও! এমনকি, সবাই!’

কনকনে ঠান্ডার এই সন্ধ্যায় খরগোশের পোড়া গন্ধ যখন দূর পাহাড় পর্যন্ত ছেঁয়ে গেছে, সোলাইমানের বড় ছেলে ছুটে আসে আমাদের দিকে। মাথা নিচু করে ভীত গলায় বলে যে, তার অপর দুই বোন আত্মহত্যা করেছে। পড়ে আছে খাটের নিচে। তাদের মুখে ফুটে আছে অদ্ভুত এক ভয়ংকর হাসি। শুনে কিছুক্ষণ তার দিকে শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি, তারপর তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে পরামর্শ দেই, ‘যাও, যদি গন্ধ করা শুরু করে, উপরে মোটা চটের ছালা দিয়ে ঢেকে রাখো, তারপর খাটের উপর নিশ্চিন্তে গিয়ে ঘুমাও।’
মুদির দোকানের টঙে কখন থেকে অথবা কেনইবা বসে আসি, কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে গেছে। দোকানে একটা মোমবাতি ধিকিধিকি করে জ্বলছে; দোকানি একা বসে বসে ঝিমুচ্ছে। পায়ের কাছে গুটিসুটি একটা বেড়াল। সোলাইমানের সেই দুই মেয়ে, যারা কিনা খাটের নিচে মরে আছে, তাদের চোখে-মুখে যে মৃদু কৌতুক মেশানো বিজয়ীর হাসি ফুটে ছিল, তা যেন আমার মুখেও ফুটে ওঠল। আর, ঠিক সে সময় বাড়ির কাছাকাছি থেকে ছুটে আসা একটা করুণ আর্ত চিৎকারে আমি চমকে ওঠলাম— “ও ভা…আ…ইইই!” এতো তৃষার কন্ঠস্বর! কী হয়েছে তার? কোনো খারাপ কিছু নাতো? নাকি ভুল শুনলাম? স্পষ্ট শুনলাম যে!

যখন ওর কিছু বোঝার বয়সই হয়নি, সেই ছোটোবেলার এক সকালের টুকরো কথা, ছেঁড়া দৃশ্য চোখের সামনে নাচতে থাকে। আমি পলাতক। আমার মাথা নিচু… ও কাঁদছে… হাতে ধরা দুটো টাকা… মা’র শক্ত মুখ… ‘মা রে কইছি! বাইত নিবো তোমারে!’
আমি দোকান থেকে উঠে, শব্দ যেদিক থেকে আসছে, দ্রুত সেদিকে ছুটতে থাকি…