বিদেশী শাসন এবং শোষণ থেকে মুক্তির তীব্র আকাঙ্খাই জন্ম দিয়েছে জাতীয়তাবাদের। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্য তৈরি হয়েছে মুক্তিকামী মানুষের গণ আন্দোলনের। আর এই সব গণ আন্দোলনকে পুষ্টি দিতে জন্মেছে গণ-সঙ্গীত। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আগে স্বদেশী গানগুলি ছিলো সে যুগের গণ-সঙ্গীত। এই গানগুলো দেশবাসীকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সাহস যুগিয়েছে, প্রেরণা দিয়েছে। এই গানগুলিই যুগিয়েছে সাদা ব্রিটিশের চোখে চোখ রেখে কালো মানুষের নিজের অধিকার আদায়ের স্পর্ধাটুকু দেখানোর। এই গানগুলিই ব্রিটিশ সৈন্যের বুলেট আর ফাঁসির মুখোমুখি হতে সাহস যুগিয়েছে অগুণতি মানুষকে।
এই গানগুলির গুরুত্ব কমে নি আজও। নানা সময়ে শোষণ থেকে মুক্তির জন্য শ্রমজীবী মানুষের মনে সাহস ও উদ্দীপনা জাগিয়েছে গণ আন্দোলন করার জন্য। গণ-আন্দোলনের অপরিহার্য এক শক্তি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে গণ-সঙ্গীত।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে যে গান সদা সোচ্চার, মানুষের দুঃখ দুর্দশাকে দূর করার জন্য, তাঁকে সুস্থ সুন্দর জীবনে নিয়ে আসার জন্য পথ দেখায় যে গান, তাই গণসঙ্গীত। অধিকার সচেতন, শ্রেণীচেতনায় উদবুদ্ধ মানুষকেই বলা যায় ‘গণ’। আর তাঁদের জন্য যে গান তাই গণ-সঙ্গীত। আমাদের দেশে ‘গণসঙ্গীত’ কথাটার ব্যবহার শুরু হয়েছে চল্লিশের দশকের প্রথম দিক থেকে।
বিশ শতকের বাংলা গানে গণসঙ্গীতের স্থান অনেক উঁচুতে। পরাধীনতার জ্বালায়, অপমানে, ক্লেশে ভারতবাসী স্বরাজের স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠেছিলো। বিদেশী ইংরেজ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বরাজ প্রতিষ্ঠাউ তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিলো। আর এই লক্ষ্যে গণসঙ্গীত পালন করেছেন এক অনন্য ভূমিকা।
১৯১৭ সালের অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর এদেশে প্রলেতারীয় মতাদর্শের সূচনা হয়। গানে এর রূপ পায় নজরুলের লেখায়। রণাঙ্গন থেকে নজরুল কোলকাতায় এলে তখনকার কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। ইতিপূর্বে রাশিয়ার বিপ্লব তাঁকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছিলো। কোলকাতায় এসেই কমিউনিস্টদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন নজরুল। ১৯২১ সালে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার যে পরিকল্পনা নেওয়া হয় সেখানে অংশ নেন তিনি।
শুরু হলো শ্রমিকের রক্তপতাকার জয়গান। ১৯২৬ সালে কৃষনগরে ‘নিখিল বঙ্গীয় প্রজা সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিকদল’ তৈরি হলো। নজরুল সম্ভবত এসময়েই আন্তর্জাতিক সঙ্গীতটির ভাবানুবাদ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনাকালে ফ্যাসীবাদ বিরোধী আন্দোলনের পটভূমিকাতেই গণসঙ্গীতের জোয়ার এল।
গণসঙ্গীতের বিস্তার খুব সহজেই ঘটতে পারে। সাধারণ মানুষ নিজে থেকেই গলায় তুলে নিতে চায় এর কথা ও সুর। যন্ত্রণাময় জীবন থেকে বেঁচে ওঠবার স্বপ্ন সে পায় এসব গানে। এ গান খুব সহজভাবে বাঁধা সড়কের বাইরে পা ফেলতে পারে। সুরের নতুন প্রয়োগ দেখা যায়, আবার বিভিন্ন ধরণের সুরের ও গায়নভঙ্গির মিশ্রণও ঘটে এখানে।
বাংলা গণসঙ্গীতে অনেকেরই অবদান রয়েছে। বিখ্যাত থেকে স্বল্পখ্যাত, এমন বহু শিল্পীই গণসঙ্গীতে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন। গণসঙ্গিত যেহেতু গণ মানুষের গান। কে যে কোথায় কখন এই গান গাইছে, তার হদিস রাখা মুশকিল। তারপরেও যাঁরা গণসঙ্গীত গেয়েছে, রচনা করেছেন, সুর সংযোগ করেছেন, তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে হেমাঙ্গ বিশ্বাস হচ্ছেন সবার সেরা, সবচেয়ে স্মরণীয় নাম। বাংলা গণসঙ্গীতের প্রথম সারির স্রষ্টা তিনি।
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জন্ম ১৯১২ সালে। জন্মেছিলেন হবিগঞ্জের মিরাশী গ্রামে। জমিদার পিতার সন্তান ছিলেন তিনি। কিন্তু, জমিদারের উচ্চ শ্রেণীকে নিজেকে আটকে রাখেন নি তিনি। রাজনৈতিক মতাদর্শে এবং অঙ্গীকারে তিনি অতিক্রম করেছিলেন শ্রেণীর সীমানাকে । আজীবন বামপন্থার প্রতি নিষ্ঠা দেখিয়েছেন তিনি। শোষিত, নির্যাতিত, খেটে খাওয়া সংরামী মানুষের প্রতি তাঁর পক্ষপাত অটুট থেকেছে মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত। শিরদাঁড়াটাকে সোজা রেখেছেন তিনি আগাগোড়াই। তাঁর সাথের অনেক লাল কমরেডই জীবনের যাত্রাপথে আপোষ করে বর্ণ পালটেছেন, তিনি করেন নি। অনেকেই বাম থেকে সরে গেছেন চরম ডানে। তিনি অবিচল থেকেছেন আপন অবস্থানে। এর জন্য সকল মোহকে, সকল লোভ-লালসাকে দূরে সরিয়ে রাখতে হয়েছে তাঁকে।
যে পরিবারে তিনি জন্মেছিলেন, সেখানে গান-বাজনার কোনো চর্চা ছিল না। তাঁর মায়ের পরিবার অবশ্য ছিলো ভিন্নতর। নানা ছিলেন সে সময়ের নামকরা তবলা বাদক। মা সরোজিনী বিশ্বাসও গান কিছুটা জানতেন। মায়ের আগ্রহেই তাঁর কবিতা লেখার সুত্রপাত ঘটে। শৈশবে স্কুলে যাবার পথে গান গেয়ে গেয়ে স্কুলে যেতেন। কিন্তু, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গান শেখার সৌভাগ্য তাঁর হয় নি। জ্যোতিপ্রকাশ আগারওয়ালের কাছ থেকে গানের কিছুটা তালিম নিয়েছিলেন এক সময়। সেটাই ছিল তাঁর একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। এর বাইরে বলা যেতে পারে যে, গানের ক্ষেত্রে তিনি মূলত স্বশিক্ষিতই ছিলেন। হেমাঙ্গ বিশ্বাস নিজেই এ সম্পর্কে বলেন যে, “গানের প্রতি আমার এই আকর্ষণ কিন্তু বাবার মোটেও মনঃপূত ছিল না। তাই ইস্কুল যাওয়ার পথে মাঠ ঘাট ছিল আমার গাইবার ক্ষেত্র। খেতের কৃষকরা আমার গান শুনতে খুব ভালবাসতো। এমনি করে মাঠের সঙ্গে হাওয়ার সঙ্গে আমার গানের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেলো।“
শৈশব থেকেই লোকসঙ্গীত গাইতেন এবং তা নিয়েই ভাবতেন আর চর্চা করতেন বলেই লোকসঙ্গীতে অসামান্য দখল ছিল তাঁর। লোকসঙ্গীতের সরল আবহ দিয়ে সহজ-সরল সাধারণ মানুষের কাছে সহজে পৌঁছে যাওয়া যায়, এটা শুরুতেই টের পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সে কারণে লোকসঙ্গীতের আঙ্গিকেই মূলত গণসঙ্গীত গেয়েছেন তিনি।
কলেজে থাকা অবস্থায় হেমাঙ্গ বিশ্বাস জড়িয়ে পড়েন স্বদেশী আন্দোলনে। আন্দোলন করতে গিয়ে আটক হন। বিচারে ছয় মাসের জেল হয় তাঁর। কলেজ থেকে বহিস্কৃতও হতে হয় তাঁকে এজন্য। তাঁর কারাভোগের এখানেই শেষ না। স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ততার কারণে ১৯৩২ সালে আবারও গ্রেফতার হন তিনি। প্রায় তিন বছর কারাভোগ করতে হয় সে সময়। জেলে থাকা অবস্থাতেই আক্রান্ত হন সেই সময়কার মরণব্যাধি যক্ষ্মাতে।
জেলে থাকা অবস্থাতেই ইংরেজরা বেশ কয়েকবার প্রস্তাব নিয়ে এসেছে তাঁর কাছে। আর কখনো স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত হবেন না, এটা লিখিত দিলে মুক্তি পাবেন তিনি। এরকম অবমাননাকর প্রস্তাবগুলোকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন তিনি। যক্ষ্ণায় তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত জেনে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে মুক্তি দেয়। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে জেলে রাখা বড্ড বেশি ঝামেলার কাজ।
জেল থেকে বের হয়ে এসে পরপারে যাবার বদলে সুস্থ হয়ে উঠেন তিনি। তবে, এর জন্য তাঁকে যাদবপুর যক্ষ্মা হাসপাতালে থাকতে হয় দীর্ঘ তিনবছর । জেলে থাকা সময়ে কংগ্রেসের অহিংস নীতির প্রতি আস্থা-বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। এবারে ঝুঁকে পড়লেন মার্কসবাদী রাজনীতির প্রতি। ১৯৩৯ সালে কংগ্রেস সভাপতি সুভাষ বসু হবিগঞ্জে এলে তাঁকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। সংবর্ধনাপত্র পাঠ করেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস।
চা বাগানের শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলন এবং ডিকবয় তেল কোম্পানির শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদে সংঘটিত আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ১৯৪২ সালের ১৮ জুলাই কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে সিলেট শহরের গোবিন্দচরণ পার্কে সাংস্কৃতিক স্কোয়াড ‘সুরমা ভ্যালি কালচারাল স্কোয়াড’ গঠন করেন। সিলেট তখন বাংলার অংশ ছিল না, ছিল আসামের অংশ। গানের স্কোয়াড নিয়ে চষে বেড়িয়েছেন তিনি সারা আসাম জুড়ে।
তিনি যে বামপন্থী মতাদর্শী এবং এর স্বপক্ষে নানা আন্দোলন করে যাচ্ছেন, এটা একেবারেই পছন্দ হয় নি তাঁর জমিদার পিতার। ছেলে বখে গিয়েছে এই চিন্তা থেকে তিনি তাঁকে বাড়ি থেকে বিতাড়ন করেন। বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাস চলে যান শিলং এ। এই যে বাড়ি ছাড়া হলেন তিনি, আমৃত্যু আর ফিরে যান নি তাঁর পরিবারের কাছে। আপন ঘরকে পর করে বাহিরকে আপন করে নিয়েছিলেন তিনি। মানবমুক্তির লক্ষ্যে নিজেকে সম্পূর্ণ বিলিয়ে দিয়েছেন। সিলেটের কমিউনিস্ট পার্টি তাঁর ঘাড়ে সম্পূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে গ্রামাঞ্চলে সংগঠন গড়ার কাজে তাঁকে পাঠায়। এই সময়ে তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গান ‘কাস্তেটারে দিও জোরে শানরে’ প্রচলিত একটা গানকেই পালটে দিয়ে নতুনরূপে হাজির করেছিলেন তিনি। একদিন তিনি হঠাৎ করেই একটা সারি গান শোনেন। সে গানটা ছিলো এরকম।
সাবধানে গুরুজীর নাম লইওরে সাধুভাই
সাবধানে গুরুজীর নাম লইও।
এটাকেই পালটে দিয়ে, এর গঠনসূত্র অনুসরণ করে তিনি লিখলেন,
কাস্তেটারে দিও জোরে শান কিষাণ ভাই রে
কাস্তেটারে দিও জোরে শান।
ফসল কাটার সময় এলে কাটবে সোনার ধানরে
দস্যু যদি লুটতে আসে কাটবে তাহার জান রে।
১৯৪৬ সালে আসামে গণনাট্য সংঘ গঠিত হয়। তিনি এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পর-পর তিনবার ঐ পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ভারত ভাগের গণনাট্য সংঘের এবং কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরাও বিভাজিত হয়ে যায়। এই সময় তিনি লেখেন তাঁর বিখ্যাত ব্যাঙ্গাত্মক গান – মাউন্ট ব্যাটন মঙ্গলকাব্য এই গান দেশজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিল তখন।
১৯৪৮ সালে তেলেঙ্গানা ও তেভাগা কৃষক বিদ্রোহ দমনে স্বাধীন ভারতে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়। হাজার হাজার কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন-পীড়ন এবং গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫১ সালে হেমাঙ্গ বিশ্বাস গ্রেফতার হন। কিন্তু, এবারও অসুস্থতার কারণে ছাড়া পেয়ে যান তিনি। ১৯৫৭ সালে চিকিৎসার জন্য তাঁকে চিনে পাঠায় কমুনিস্ট পার্টি। চিনে তিন বছর ছিলেন তিনি। এই তিন বছরে চিনা ভাষাটা শিখে ফেলেন তিনি।
চিন থেকে ফিরে আসার পর ১৯৫৯ সালে রাণু দত্তকে বিয়ে করেন। এরপর আরো কয়েকবার তিনি চিনে গিয়েছেন। কমরেড মুজাফ্ফর আহ্মদের সুপারিশে কলকাতার সোভিয়েত কনস্যুলেটে ১৯৬১ সালে চাকরি হয় তাঁর। কিন্তু, বেশিদিন এই চাকরিটাকে টিকিয়ে রাখতে পারেন নি তিনি। চীন-সোভিয়েত মতাদর্শগত বিভাজনে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনও তখন চরমভাবে বিভক্ত। যার বিরূপ প্রভাব এই উপমহাদেশেও পড়েছিল। চিনের প্রতি তাঁর অতি আকর্ষণ এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে সোভিয়েত পার্টির সমালোচনার কারণে ১৯৭৪ সালে সোভিয়েত কনস্যুলেটের চাকরি ত্যাগ করতে হয় তাঁকে।
১৯৬৯ সালে নকশাল বাড়ি আন্দোলনের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন দেন তিনি। এই আন্দোলনও সফল হয় নি। ব্যাপক দামামা বেজেছিলো যদিও এই আন্দোলনে দামামা বেজেছিলো প্রচুর। কিন্তু শেষমেষ থেকে গিয়েছিলো ব্যররথ একটি আন্দোলন হিসাবেই। অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নকশাল আন্দোলনকে ধ্বংস করে দেয়।
১৯৭১ সালে হেমাঙ্গ বিশ্বাস গঠন করেন ‘মাস সিঙ্গার’ নামে গানের এক দল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই দল নিয়েই তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ-বিদেশ। এই অনন্য সাধারণ মানুষটি, এই অসাধারণ গণসঙ্গীত শিল্পীটি মারা যান সাতাশি সালে।
সঙ্গীত পরিবেশনের ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তা সবসময়ই কেন্দ্রীভূত থেকেছে সংগ্রামী জনতার প্রতি। এদেরকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে তাঁর সাঙ্গীতিক জগত। তাঁর সৃষ্টিশীলতা তাই কখনও অন্যদিকে বাঁক নেয় নি। চল্লিশের দশকে ‘কাস্তেটারে দিয়ো জোরে শান’ এ যাঁর সঙ্গীত জীবন শুরু, তেভাগা সংগ্রামের পথ বেয়ে তেলেঙ্গানার পথে ‘মাউন্টব্যাটন মঙ্গলকাব্যে’ তার সঙ্গীত জীবনের সফল পরিণতি।
পঞ্চাশের দশকে তাঁর গানে যেমন দেশবিভাগের যন্ত্রণা অনুভব করা যায়, ঠিক তেমনই সংগ্রামের কঠিন শপথে উদ্দীপিত হয়ে উঠা যায়। পঞ্চাশ দশকের শেষভাগে তিনি দীর্ঘদিন চিন দেশে কাটিয়ে এসেছেন। গীতিকার হিসেবে তাঁর ওপর এর প্রভাব ছিল অপরিসীম।
ষাটের দশকে কল্লোল, তীর, লাল লণ্ঠন এরকম কিছু বিপ্লবী নাটকে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে আমরা তাঁকে নতুনভাবে পাই। লাল লণ্ঠন নাটকের সঙ্গীতে বিভিন্ন চিনা সুর ব্যবহার করেন তিনি। এটা তাঁর শিল্পী জীবনের এক উজ্জ্বল বিবর্তন। গান নিয়ে নানা পরীক্ষা-নীরিক্ষায় মেতে উঠেন তিনি এই সময়টাতেই। এই সময় তাঁর পরীক্ষা নিরীক্ষার একটি অসাধারণ ফসল হলো ‘শঙ্খচিলের গান’।
সত্তর দশকে আমরা তাঁকে পাই আন্তর্জাতিক শ্রমিকশ্রেণী ও প্রগতিশীল মানুষের বিশ্ববিখ্যাত সংগ্রামী গানের সুর অক্ষুণ্ণ রেখে বাংলার সার্থক অনুবাদকরূপে। মূল চিনা ভাষা থেকে বাংলা ও অসমীয়া ভাষায় সঙ্গীত রূপান্তরের তিনিই সম্ভবত পথিকৃত।
হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর গানগুলোর কোনটি নিজে রচনা ও সুরারোপ করেছিলেন, কোনটি সংগ্রহ করেছিলেন লোকসঙ্গীতের ভাণ্ডার থেকে, কোনটি কিছুটা পাল্টে নিয়ে চলতি লড়াই-এর সাথে যুক্ত করেছিলেন। গণসঙ্গীত একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে রচিত হয় নিশ্চয়ই, কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে একটি গণসঙ্গীত যদি মানুষ ও তার লড়াইয়ের প্রাণ ধারণ করতে পারে তাহলে তা দীর্ঘদিন অন্যান্য লড়াইকেও উজ্জীবিত করতে সক্ষম হয়। কারণ শোষণ পীড়ন, বৈষম্য আর নিষ্পেষণ, অপমান বঞ্চনার বিরুদ্ধে কান্না ক্রোধ ও প্রতিবাদ, কিংবা মানুষের স্বপ্ন, সাহস এবং আরও অসংখ্য মানুষের সাথে মৈত্রী সংহতির গান মানুষকে স্পর্শ করবেই।
আমেরিকার ভিয়েতনাম আক্রমণের প্রতিবাদে ১৯৬৪ সালে তিনি সৃষ্টি করেন এক অনন্যসাধারণ গান, শঙ্খচিলের গান। এটি বাংলা ভাষার অন্যতম সেরা একটি গান। যদিও প্রচারের অভাবে প্রায় হারিয়ে গিয়েছে এই গান। এই গানের গীতিকা অনন্য, প্রচলিত অন্য যে কোনো বাংলা গানের তুলনায় সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী। এর সুরের বিচিত্র উঠা-নামা শ্রোতার শ্রুতিরাজ্যে এক অদ্ভুত মায়াজগত তৈরি করে। গান নয়, যেনো কোনো কল্পলোক তৈরি হচ্ছে চোখের সামনে। অপ্রত্যাশিত পালাবদলে মাঝে মাঝেই চমকে উঠতে হয় বিপুল বিস্ময়ে। ক্ষণে ক্ষণে গায়ে কাঁটাও দিয়ে যায় রক্তনালীতে রোমাঞ্চের ছোঁয়ায়। যুদ্ধবিরোধী এমন মানবিক গান, যুদ্ধের বিরুদ্ধে এমন শক্তিশালী অস্ত্র খুব কমই আছে।
এই গানটি যে শুধুমাত্র আমার মতো সাধারণ একজন মানুষকে আকৃষত করেছে, তা নয়। অনেক বড় বড় মানুষকেও বিস্মিত করেছিলো, সম্মোহিত করেছিলো, চুম্বকের মতো টেনেছিলো। ভিন্নধর্মী কিছু করার তাড়না সৃষ্টি করেছিলো।
টরন্টোতে কামাল আহমেদ নামে একজন বর্ষীয়ান ভদ্রলোক আছেন। ইনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। গোবিন্দ হালদারকে দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অসাধারণ মানের একগাদা দেশাত্মবোধক গান লিখিয়ে নেবার পিছনে তাঁর ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল। ইনি পঞ্চাশের দশকে ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র বাড়ী থেকে পালিয়ের সহকারী পরিচালক হিসাবে কাজ করেছেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী এই গান নিয়ে ঋত্বিক ঘটক অত্যন্ত আপ্লুত ছিলেন। এটাকে ভিত্তি করে একটা চলচ্চিত্র নির্মাণের ইচ্ছা ছিলো তাঁর। সেই ইচ্ছা পূরণের অংশ হিসেবে এর চিত্রনাট্যও তৈরি করে ফেলেছিলেন। কামাল আহমেদ স্বচক্ষে সেই চিত্রনাট্য দেখেছেনও। শুধু ঋত্বিক ঘটক একাই নন। বাংলা চলচ্চিত্রের আরেক দিকপাল মৃণাল সেনও এটিকে নিয়ে চলচ্চিত্র করার কথা ভেবেছিলেন। দুর্ভাগ্য যে এর কোনোটিই পরিণতি লাভ করে নি। শঙ্খচিলের গান সাঁঝবেলাতে মিলিয়ে গিয়েছে অন্তহীন সাগরে।
শঙ্খচিলের গানটি অনেক বড় একটি গান। এর শুরু আর শেষের কিছু অংশ এখানে তুলে দিলাম।
সুদূর সমুদ্দুর
প্রশান্তের বুকে, হিরোশিমা দ্বীপে
আমি শঙ্খচিল৷
আমার দুডানা ঢেউয়ের দোলা
আমার দুচোখে
নীল, শুধু নীল৷
আমার শান্তিগানে বিদ্রোহ বাণ হানে
আফ্রো-এশিয়া-আমেরিকায় আমার ডানায় তোলে আঁধিয়া আকাশতলে
ঝনক ঝনন মরুঝঞ্ঝা, সাহারার৷
নদনদী বন্দরে অরণ্য প্রান্তরে পাহাড়ে গহ্বরে
রক্তে আদায় করি রক্তের ঋণ
আমি ভিয়েতমিন, আমি ভিয়েতমিন, আমি ভিয়েতমিন৷
httpv://www.youtube.com/watch?v=PRmB3NswWZA
জালালী কইতরের গান: মাউন্ট ব্যাটন সাহেব ও…..
https://www.youtube.com/watch?v=PLkHwI-mw7w
এই লেখাটিতে প্রকাশিত তথ্যগুলোর রেফারেন্স বই, ম্যাগাজিন, ওয়েবসাইটগুলোর একটা তালিকা করে লেখাতে সংযোজন করার অনুরোধ করলাম।
@মহাছাগল,
এই লেখার জন্য মূলত যে বইগুলো থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে সেগুলো হচ্ছে।
গণসংগীত সংগ্রহ – সুব্রত রুদ্র
গানের বাহিরানা – হেমাঙ্গ বিশ্বাস
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান – প্রকাশক মার্স সিঙ্গারস
লোক সঙ্গীত সমীক্ষা বাংলা ও আসাম – হেমাঙ্গ বিশ্বাস
লেখাটা পড়তে পড়তে কাস্তে নিয়ে আমার প্রিয় একটা গণসঙ্গীত মনে পড়ে গেল, দিনেশ দাসের।
কাস্তে
বেয়নেট হোক যত ধারালো—
কাস্তেটা ধার দিও, বন্ধু!
শেল আর বম হোক ভারালো
কাস্তেটা শান দিও বন্ধু |
নতুন চাঁদের বাঁকা ফালিটি
তুমি বুঝি খুব ভালবাসতে?
চাঁদের শতক আজ নহে তো
এ-যুগের চাঁদ হ’লো কাস্তে!
ইস্পাতে কামানেতে দুনিয়া
কাল যারা করেছিল পূর্ণ,
কামানে-কামানে ঠোকাঠুকিতে
আজ তারা চূর্ণবিচূর্ণ!
চূর্ণ এ লৌহের পৃথিবী
তোমাদের রক্ত-সমুদ্রে
গ’লে পরিনত হয় মাটিতে,
মাটির—মাটির যুগ ঊর্ধ্বে!
দিগন্তে মৃত্তিকা ঘনায়ে
আসে ওই! চেয়ে দ্যাখো বন্ধু!
কাস্তেটা রেখেছো কি শানায়ে
এ-মাটির কাস্তেটা, বন্ধু!
-দিনেশ দাস
@তানভীরুল ইসলাম,
সুব্রত রূদ্রের সম্পাদিত গণসংগীত-সংগ্রহ বইয়ে দীনেশ দাসে আরো কয়েকটা গানের সাথে এই গানটাও আছে। কাস্তে নিয়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাসেরও পুরো গানটা এরকম।
কাস্তেটারে দিও জোরে শান
তোমরা কাস্তেটারে দিও জোরে শান
কিষাণ ভাইরে,
কাস্তেটারে দিও জোরে শান।।
ফসল কাটার সময় হলে কাটবে সোনার ধান
দস্যু যদি লুটতে আসে কাটবে তাহার জান-রে।।
শান দিও, জোরসে দিও, দিও বারে বার
হুশিয়ার ভাই, কভু তাহার, যায় না যেন ধার -রে।।
ও কিষাণ তোর ঘরে আগুন, বাইরে যে তুফান
বিদেশী সরকার ঘরে, দুয়ারে জাপান-রে।।
একতায় ভাই চীনের মানুষ হইল বলীয়ান
ছয়টি বছর জাপানীরে করলো যে হয়রান-রে।।
এক হয়ে আজ দাঁড়াও দেখি মজুর কিষাণ
এক নিমেষে আসবে স্বরাজ, ঘুচবে অপমানরে।।
@তানভীরুল ইসলাম,
কাস্তে কবি যদি বাঁচত তবে আত্মহত্যা করত, আমি ১০০ শতাংশ সিওর।
খুব ভাল লেখা। অনেক কিছু জানা হল।
ফরিদ ভাই,
ধীরে ধীরে আপনি আমার কাছে এনসাইক্লোপিডিয়ায় রূপান্তরিত হতে চলেছেন কিন্তু…..! দারুন লেগেছে! আমি কিছুটা জানতাম কিন্তু এতো বিস্তারিত কিছুই জানতাম না। শুধু গানই শুনেছি….! উপড়ে কাজী রহমান যা বলেছেন আমিও তাই চাই। আমাদের সন্তানেরা হোক মুক্তমনের অধিকারী, হয়ে উঠুক এ বিশ্বের নাগরিক। ওদের মাঝেই বেঁচে থাকুক হেমাঙ্গ বিশ্বাস দের মতো মানুষেরা, মানবতা।
@কেশব কুমার অধিকারী,
এখন থেকে পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর এমনকি আশি নব্বই বছর আগেও আমরা অনেক বেশি প্রগতিশীল ছিলাম এখনকার তুলনায়। সেই বিষয়টাকেই আমি সবসময় তুলে আনতে চাই। সেটা দেখে যদি বর্তমানের এই রক্ষনশীল যাত্রায় যাওয়া মানুষের কিছুটা হলেও বোধোদয় হয়।
@ফরিদ আহমেদ,
আপনার এ মূল্যায়ন যথার্থ। কিন্তু এ সব পাঠকে আমাদের তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দেবার উপায় দরকার। আমাদের তারুণ্যের দিন গুলোতে যে উচ্ছ্বাস আর প্রগতির পথে পা বাড়াবার আকাঙ্খা ছিলো এখন ঠিক তার উল্টো একটা স্রোত বইছে! এ পশ্চাদমুখীনতার কারণ নির্ধারন দরকার, দরকার একটা জাগরণ। ৮০/৯০ এর দশকে এর জন্যে আমাদের মাঝে চর্চা ছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এম এম আকাশ (আমরা আকাশ ভাই বলে ডাকতাম!) এঁর কাছে আমরা রাজনীতি, সমাজনীতি আর বিশ্ব অর্থনীতির পাঠও নিয়েছিলাম, তাঁরা দিতেন। আমরা নিজেদের গড়বো বলে। গনসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীর এর অনেক গল্প শুনেছি তাঁর নিজের কাছেই বি সি আই সি ভবনে তাঁর অফিসে বসে! সে দিন গুলো আজ আর নেই! আমাদের হৃদয়ের ভেতর থেকে যে ডাক সেদিন আমরা শুনতে পেতাম, আজ সেখানে শুধুই হত্বাশ্বাসের ছোঁয়া!
দেখো ভাই হেমাঙ্গ বিশ্বাসদের বাঁচিয়ে রাখবার দ্বায়িত্ব কিন্তু মুক্ত মনের প্রগতিশীল মানুষদেরই। ওরা বলবে হেমাঙ্গদের কথা, লিখবে; ছড়াবে। কিন্তু বাঙালির বিপুল একটা অংশ এখন ধর্মানুভুতিতে প্রবল ভাবে আক্রান্ত। অন্তত তাদের আচরণ এখন সে রকমই। আমার ধারণা হেমাঙ্গ বিশ্বাসরা গনমানুষের চেতনায় ততটা আর নেই; আছে শুধু অগ্রসর মানুষের ভাব্নায়। এখন আর গভীর রাজনৈতিক আদর্শ চর্চা হয় না; হয় অন্য কিছুর। আমি খুব আশা করছি আজকের নতুন মা বাবারা তাদের সন্তানদের মুক্তমনে বড় হবার সুযোগ দেবে। ধর্মানুভুতি চাপিয়ে দেবে না। তথ্য প্রযুক্তি আর নতুন কালের কারণে সুযোগ হয়তো এমনি এমনিই হয়ে যাবে ওদের। আশা করি নতুনরা বড় হবার সময়টা জুড়ে আজকের অগ্রসর অভিভাবকরা উদার ভাবে পুরোপুরি সচেতন থাকবে।
হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে নিয়ে লিখবার সময় দেবার জন্য ধন্যবাদ.
বাংলা গনসঙ্গিত গুলো বিভিন্ন আন্দোলন এ প্রান গুগিয়াছে আজও জুগিয়ে যাচ্ছে । আপনার ব্লগ থেকে অনেক কিছু জানলাম…………… ধন্যবাদ
[img]http://http://1.bp.blogspot.com/-oM3TVuaz_0E/Umj028afYjI/AAAAAAAAEA4/UqVolEXjbKU/s1600/%E0%A6%B9%E0%A7%87%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97 %E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8.jpg[/img]
১৯৮১ সালের মার্চে তাকে ঢাকায় গণ সংবর্ধনা দেওয়া হয়।তার ঐতিহাসিক গণসঙ্গীত ‘ঢাকার ডাক’।
[img]http://https://m.facebook.com/Hemanga.Biswas/photos/a.196747580345237.49578.196747190345276/528284363858222/?type=1&source=45&refid=17[/img]
ভদ্রলোকের কথা আগে শুনিনি কখনো। বেশ বিচিত্র ক্যারিয়ার বলতে হয়।
গণসংগীতের আবির্ভাব যে মোটে ৪০ দশকে তাও জানা ছিল না।
ওপারের নকশাল ওয়ালারা সামগ্রিকভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ছিল বলে শোনা যায়। সে ক্ষেত্রে নকশাল সমর্থক হেমাংগের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করা ব্যাতিক্রম বলতে হয়।
চুড়ান্তভাবে যাইই হোক, এক সময় বামপন্থীরা সব ধরনের প্রগতিশীল আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছেন। অনেক সত্য ত্যাগী নেতা কর্মী অবদান নিয়েও তারা তেমন প্রচার পায়নি, আজকের দিনে উলটা সম্পূর্ন নেগেটিভ প্রচারনা পায়।
@আদিল মাহমুদ,
এই অপরাধের জন্য আপনার ফাইন হওয়া উচিত। বাংলা গণসঙ্গীতের ইনি সম্রাট। আমাদের ফকির আলমগীর আজকের ফকির আলমগীর হয়েছেন এঁর বদৌলতেই। একাত্তর সালে ফকির আলমগীর দোতরা বাজিয়ে গান গাওয়া এক বাউল ছিলেন। যুদ্ধ এড়াতে পালিয়ে গিয়েছিলেন কোলকাতায়। এখানেই হেমাঙ্গ বিশ্বাসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন তিনি।
পূর্ববঙ্গের লোক যারাই সেই সময়ে কোলকাতায় ছিলেন বিচ্ছিন্ন দুই একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে সবারই সহানুভূতি ছিলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি। মাটির মায়ার উপরে মায়া হয় না।
বামদের নিয়ে হাসি মশকরা করা, ঠাট্টা করা এখন খুব ভালো একটা ফ্যাশন। এই ফ্যাশনে আমি যোগ দেই না সাধারণত। আমাদের দেশে প্রগতিশীলতার যতখানি বিস্তার ঘটেছে তার পিছনে বামপন্থীদের অবদানই সবচেয়ে বেশি। আমি নিজে বামপন্থী সংগঠন করি নি, কিন্তু বাম আদর্শের প্রতি আমার পক্ষপাত বহু পুরোনো। সেই পক্ষপাতকে এখনো ত্যাগ করি নি আমি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, সাধারণ মানুষের সার্বিক মুক্তি আসলে তা শুধুমাত্র বাম আদর্শের মধ্য দিয়েই আসবে, আর কোনোভাবে নয়।
@ফরিদ আহমেদ,
আমি ছাপোষা মানূষ, সিনামা ফিনামার গান মাঝে মধ্যে শুনি, গানের লেখক কে দূরের কথা এমনকি কার গলা তাও বলতে পারি না। আমার শাস্তি দাবী করে কি হবে।
আমি নিজে ডান বাম এমন কোন গতবাধা আদর্শের মাঝেই একমাত্র মুক্তি সম্ভব এভাবে চিন্তা করি না। গভীরে গেলে সব কিছুরই দোষ গুন চোখে পড়ে। প্রকৃত আদর্শ হতে হয় ডায়নামিক, স্থান কাল ভেদে সব কিছুরই যতটা সম্ভব ভাল দিক গ্রহন করে।
গণমানূষের জন্য কাজ করা আদর্শবাদী রাজনীতিক বলতে এখনো আমার চোখে বামপন্থীদের কথাই প্রথম মনে আসে। বামপন্থীরা স্বাভাবিক কারনেই কোনদিন ক্ষমতায় যেতে পারেনি, তাই সম্ভবত তাদের যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি। তাদের অবদান থেকে গেছে সব সময়ই আড়ালে, এমনকি মুক্তিযুদ্ধেও বামপন্থীদের অবদান মূল্যায়িত হয়নি, তারাও কোনদিন অন্যান্যদের মত জোর গলায় দাবী করেনি।
তাদের নিয়ে বর্তমানের প্রজন্ম চীনাবাদাম বাঁআতি এমন নানান পরিভাষা ব্যাবহার করে। বামদের নিয়ে মশকরা করার প্রবনতা এরশাদ আমলেও দেখছি। মস্কোতে বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা ধর তখনই শুনেছি। এ দেশের বহুধা ধারায় বিভক্ত বামপন্থীরা নিজেরাও অনেকটা দায়ী, আল হাজ্ব ইনু মেননের কথা না হয় বাদই দেই। তাও বলতে হয় বামদের প্রতি সমালোচনার তীর এক তরফাই বেশীই গেছে। আদর্শের কথা বললে আদর্শ বলতে আসলে কারোই কিছু নেই, বামদের প্রতি কটাক্ষের মাত্রা বেশী হবার কারন সম্ভবত তারা অন্তত কোন একটা আদর্শ মানে দাবী করে বলে।
@ফরিদ আহমেদ,
জিনিসটা কি সেটা বোধহয় আপনি বুঝাতে পারবেননা, কাজেই বাদ দিচ্ছি, খালি ওই
বলতে কি বুঝায় একটু যদি বুঝিয়ে বলেন। আপনার রোম্যান্টিক চিন্তাধারায় আমি নিশ্চিত যে এই ধার্মিক চিন্তাধারার অনুশীলনে আপনার কোনও প্রতক্ষ্য অভিজ্ঞতা নেই।
@অজয় রাউত,
মুক্তমনায় এখন আমি কোনো বিতর্কে জড়াই না। দীর্ঘ বছরগুলো তর্ক-বিতর্ক করে দেখেছি যে, খামোখাই নিজের সময় এবং শ্রম নষ্ট হয় এতে। কাজেই আপনার সাথেও কোনো বিতর্কে যাচ্ছি না আমি এখন। বাম আদর্শকে যে আপনি ধার্মিক চিন্তাধারা বলেছেন, এটাতে খুব মজা পেয়েছি আমি। আর হ্যাঁ, আরেকটা বিষয় ঠিক বলেছেন আপনি। আমি কোনো বাম সংগঠন করি নি কখনো।
@ফরিদ আহমেদ,
ঠিকই বলেছেন, বিতর্ক তর্ক আনে আর তর্ক আনে অসূয়া। আমি মতান্তরের যা প্রায়সই মনান্তরে পর্যবসিত হয় তাতে উৎসাহী নয়। তবে আপনি যদি কিছু বক্তব্য উপস্থাপিত করেন তবে তার ব্যখ্যা দেওয়ার দায় বোধহয় আপনার উপরেই বর্তায়।
@ফরিদ আহমেদ,
আপনার মতামত ব্যক্ত করার জন্য কিছু পয়েন্ট, মানব সভ্যতার অগ্রগতির বিপক্ষে কাজ করছে তিনটে শক্তি, ফাসিজম, কম্যুনিজম আর ইস্লামিজম, ব্যাপক অর্থে। স্বাভাবিক যুক্তিতে এটা বোধহয় বলা যেতে পারে আমরা প্রথম দুইটাকে পরাস্ত করেছি আর শেষেরটার বিরুদ্ধে লড়াই চলছে।