শহর যেন কেইন শা’র কাছে বিছার কামড়, ভিমরুলের হুল। সবাই থাকে থাক, সে থাকবে না শহরে। তার আবার থাকা, থাকা মানে পড়ে থাকা। বউ ছেড়ে যাবার পর সেই কবে ঘর ছেড়েছে মনে নেই তার। তারপরে আর ঘরে ঢোকেনি, আর ওমুখো হয়নি। ডাউন টাউনের রাজপথে থাকতে সরকারী লোক এসে শীতের কামড়ের হাত থেকে বাচাতে শেল্টারে নিয়ে যেত তাকে। সেখানে কিছুদিন থেকে রাতের অন্ধকারে পালাত কেইন- তাকে পালাতে হতো। ওখানকার লোকগুলো অসহ্য- শীতের কামড়ের থেকেও অসহ্য। তারচেয়ে এইখানে এই সুফলা গ্রামের বুক চিরে ধাবমান হাইওয়ের বড় ব্রীজটার নীচে তার এই প্লাস্টিক মোড়ানো ছোট ঘরটা তার অন্যরকম স্বর্গ- বড্ড নিরাপদ, কোলাহল নেই মানুষের। সবথেকে বড় কথা এখানে সরকারী লোক তাকে আর ধরে নিতে আসে না, আসবে না। এখান থেকে হাটা দূরত্বে একটা পরিত্যক্ত ভবন চোখে পড়ে। ওটাতে থাকতে সাহস পায় না কেইন, শেষে কোথায় কোন ঝামেলা হবে তাই ভেবে। দিনের বেলায় মাঝেমধ্যে ওটার ভিতরে গিয়ে হাটে সে। ভাললাগা পুরান গন্ধ বুক ভরে নিতে কখনও ভোলে না কেইন।
ব্রীজের নীচের এই ঘরটা কেইনের নিজের হাতে গড়া। ঘরের খুব কাছ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট একটা খাল। এই ঘরটা তার স্বর্গ- সত্যিকারের স্বর্গ। বড় রাস্তা ধরে খাল পার হয়ে ওপার গেলে একটা জাংক-ইয়ার্ড, মানে ময়লা ফেলার চাতাল পাওয়া যাবে। সেখানে মাঝে মাঝে দূরের ঐ ধুমায়মান বেকারীটা থেকে পরিত্যাক্ত রুটি-বিস্কুট ফেলে দিয়ে যায়। খাবারের অভাব হয় না তাই কেইনের। ক্ষিদে লাগলেই ওগুলো ঘাটে সে। এতদিন কোন মনুষ্য প্রাণী তার চোখে পড়েনি আশেপাশে কোথাও। আজ একটা বাচ্চা ছেলে, বছর দশ হবে বয়স, ময়লা ঘাটছে আনমনে সেখানে। মনেহয় পেটে টান পড়েছে। অবাক কাণ্ড! কথা বলতে গেলে পালিয়ে গেল। আহারে, বেচারা- মনের ভিতরে কেমন জানি করলো কেইনের। কিন্ত মুখে তার ‘এ আবার কোন আপদ এলো’ গোছের ভাব জারি থাকলো কঠিন ভাবে। ময়লা ঘাটা শুরু করলো কেইন শা আবার। আজকের ভাল রুটিটাই তাকে পেতে হবে। রোজ রোজ আসা যায় না ব্রীজ পার হয়ে এতটা দূরে, বুড়ো হাড়ে পরিশ্রম সয় না। সময় নিয়ে মন দিয়ে আবর্জনা ঘাটতে থাকে কেইন। হঠাত করে একটা দস্তানা পেয়ে যায়, একেবারে নতুন- খাটি পশমের তৈরী। আনন্দ-উত্তেজনায় চিতকার করে উঠে সে। হন্যে হয়ে খুজতে থাকে আরেক পাটি দস্তানা। পেয়ে যায় আরেকটা। আজকে সে মহাভাগ্যবান। কার মুখ দেখে যে সে আজকে নিদ্রাভঙ্গ দিয়েছিল মনে করতে পারে না- হয়তো ময়লা ঘাটা রেকুনের মুখ দেখে। শীত আসছে ধেয়ে আর মাসখানেক পরে। শীতের কামড় থেকে হাতটাকে বাচানো যাবে। নিজের একটুখানি সৌভাগ্য-সুখের ভাবনায় স্বপ্নালু হয় তার চোখ।
দুইহাতে দুটো রুটির কার্টুন আর দস্তানা জোড়া নিয়ে গুইসাপের মতন হেলে দুলে হেটে হেটে নিজের ছাপড়ায় ফিরে আসে কেইন। ঘরে ঢোকার পথে জিনিসগুলো থপ করে রেখে প্লাস্টিকের ঘরের মেঝেতে একটুখানি জিড়োতে বসে। জিড়োতে বসে কখন যে তন্দ্রামতো এসে গেছে চোখে টের পায়নি সে। সহসা কার্টুনের খসখস আওয়াজে ঘুম টুটে গেল। চমকে চোখ মেলে দেখলো, কে যেন দস্তানাটা চিলের মতো ছো মেরে নিয়ে দৌড় দিলো। বাইরে এসে দেখলো কেইন, সেই ছেলেটা একটা দস্তানা হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছে প্রানপণে। ছুটছে সে পরিত্যাক্ত ভবনটার দিকে। দেরী না করে কেইনও আরেকটা দস্তানা হাতে নিয়ে অনুসরণ করলো দুষ্ট হতভাগা ছেলেটার। ঢুকে পড়লো ছেলেটা ভবনটার পেটের ভিতরে, পিছে পিছে কেইনও। এঘর ওঘর করে, করিডোর ঘুরে অবশেষে বেওয়ারিশ চোরটা গিয়ে ঢুকলো একটা অপ্রশস্ত হল ঘরের ভিতরে। হল ঘরের একটা দরজা, সেখান দিয়ে হেলে দুলে ঢুকলো এসে বৃদ্ধ কেইন। ছেলেটার পালাবার কোন পথ নেই, সামনে সব পথ আটকে দিয়েছে খাড়া বিনিদ্র দেয়ালগুলো। মুখোমুখি এখন বাদী আর বিবাদী। ছেলেটার মুখ ভাষাহীন, চোখে যত কথা। মুখমণ্ডলে ক্ষমাভিক্ষার আরজি। বৃদ্ধ কেইনের মুখেও কথা নেই। কয়েক মুহুর্ত মাত্র, সহসা বৃদ্ধ আরেক পাটি দস্তানা এগিয়ে ধরলো ছেলেটার দিকে। ছেলেটা সেটা লুফে নিয়ে দিলো এক প্রাণপণ দৌড়, যেন ফিরে পাওয়া জানটা আগে বাঁচিয়ে নেই, পরে আরসব ভাবা যাবে। পলায়নপর চোরের হারিয়ে যাওয়া পথের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে বাদী। বৃদ্ধ কেইনের চোখ দুটো একটুখানি হাসলো বুঝি, তাও ক্ষনিকের জন্যে। তারপর আবার সেই কাঠিন্য ফিরে এলো মুখে, অনেকটা ‘এ আবার কোন আপদ এলো’ গোছের কিছু। সে এমনই, চিরকালই এমন- তার বাহিরটা সবসময় এমনই পাথর হয়ে থাকে। অতঃপর পাথরের মুখোশ মুখে এটে কেইন শা গুইসাপের মতন হেলেদুলে এসে ঢুকে পড়ে তার নিজের ঘরে, তার প্লাস্টিকের স্বর্গে- যেখান থেকে সবাইকে সে দেখতে পায়, কিন্তু কেউ তাকে আর দেখতে পারে না, সরকারী লোকও না।
[আমেরিকার একটা বহুল প্রচলিত লোক-কাহীনির ছায়া অবলম্বনে রচিত]
কেইন শা কে??? 🙂