বাংলা ভাষায় সনেট বা ‘চতুর্দ্দশপদী কবিতা’-র জনক মাইকেল মধুসুদন দত্ত। তাঁর আগে এই বিষয় নিয়ে বাংলা ভাষায় কেউ চিন্তা করেছেন বা চেষ্টা করেছেন লিখতে, এমন কোনো তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। সৃষ্টির এই জগতে তিনিই প্রথম পুরুষ। চতুর্দ্দশপদী কবিতার নামকরণটাও তাঁরই করা। কনক বন্দোপাধ্যায় তাঁর ‘কাব্যসাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন’ গ্রন্থে বলেছেন, “মধুসূদনের চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী বঙ্গসাহিত্যে এক অভিনব সৃষ্টি। ভাষা ছন্দ ও গঠনরীতি যে দিক দিয়াই দেখা যাউক না কেন, চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী বঙ্গসাহিত্যে এক নূতন সৃষ্টি। ভাবের দিক দিয়াও এই শ্রেণীর কবিতাগুল বঙ্গসাহিত্যের ইতিহাসে নূতনত্বের সন্ধান দিয়াছিল।চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলীর মূলগত ভাব স্বদেশপ্রেম। প্রত্যেকটি কবিতার মধ্য দিয়া নিবিড় স্বদেশপ্রেম প্রকাশ পাইয়াছে। সুতরাং সকল দিক দিয়া বিবেচনা করিয়া দেখিতে গেলে দেখা যায় যে, এই ধরণের কবিতা বঙ্গসাহিত্যে ছিল না। মধুসূদনই এই শ্রেণীর কবিতা বঙ্গসাহিত্যে প্রথম প্রবর্ত্তন করেন। তিনিই সনেট রচনার একটা আদর্শ প্রবর্ত্তিত করিয়াছিলেন, সনেটের বিষয়বস্তু সম্বন্ধেও তিনি একটি সুস্পষ্ট সঙ্কেত রাখিয়া গিয়াছিলেন।”

বাংলা ভাষার প্রথম চতুর্দ্দশপদী কবিতাটির জন্ম হয় ১৮৬০ সালের শেষের দিকে, কোনো এক শুভ সকালে। খুবই অনাড়ম্বরভাবে এবং নিরালে-নিভৃতে এর জন্ম। কবিতাটার নাম ‘কবি-মাতৃভাষা’। এই কবিতাটিই পরে পরিশোধিত হয়ে বিখ্যাত ‘বঙ্গভাষা’ নামের কবিতায় পরিণত হয়।

সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের ঘটনা সেটি। মধুসুদন দত্ত তখন মেঘনাদবধ কাব্য রচনায় ব্যস্ত। প্রথম দুই সর্গ লিখে ফেলেছেন তিনি। তৃতীয় সর্গ লেখার কাজ চলছে। সেপ্টেম্বর মাসেই তিনি শেষ করে ফেলেছেন ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক লেখার কাজ। এর সাথে সাথে চলছে ইতালিয় ভাষার চর্চা। ইতালিয়ান কবি তাসোর কবিতা পড়ে মুগ্ধ তিনি। মাথায় ঘুরছে নতুন ভাবনা, নতুন সৃষ্টির দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা। এই সময়ে তিনি তাঁর বন্ধু রাজনারায়ন বসুকে প্রথম চতুর্দ্দশপদী কবিতার জন্মের সুখবর জানাচ্ছেন এক চিঠিতে।

“আমি আমাদের মাতৃভাষায় সনেটের প্রবর্ত্তন করিতে চাই, এবং কয়েকদিন আগে এক সকালে এইটি রচনা করিয়াছি।

কবি-মাতৃভাষা

নিজাগারে ছিল মোর অমূল্য-রতন

অগণ্য; তা সবে আমি অবহেলা করি,

অর্থলোভে দেশে দেশে করিনু ভ্রমণ,

বন্ধরে বন্দরে যথা বাণিজ্যের তরী।

কাটাইনু কত কাল সুখ পরিহরি,

এই ব্রতে, যথা তপোবনে তপোধন,

অশন, শয়ন ত্যজে, ইষ্টদেবে স্মরি,

তাঁহার সেবায় সদা সঁপি কায় মন।

বঙ্গকুল লক্ষ্ণী মোরে নিশার স্বপনে

কহিলা – “হে বৎস, দেখি তোমার তকতি,

সুপ্রসন্ন তব প্রতি দেবী সরস্বতী।

নিজ গৃহে ধন তব, তবে কি কারণে

ভিখারী তুমি হে আজি, কহ ধন-পতি?

কেন নিরানন্দ তুমি আনন্দ সদনে?

এ বিষয়ে তোমার কি মত, বন্ধু! আমি মনে করি, যদি প্রতিভাশা্লী ব্যক্তিরা ইহার অনুশীলন করেন, তাহা হইলে আমাদের সনেট একদিন ইতালীর সনেটের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারিবে।”

প্রথম সনেটের জন্মের পর দ্বিতীয় সনেটের জন্মের জন্য বাংলা ভাষাকে অপেক্ষায় থাকতে হয় বেশ কিছু দিন। প্রথম ওই সনেটের পরে বাকিগুলো সবই জন্ম নেয় বিদেশে। ১৮৬২ সালের জুন মাসে ক্যাণ্ডিয়া জাহাজে করে বিলেত যান মাইকেল। ভার্সাইয়ে থাকার সময়ে সনেট লেখা মন দেন তিনি। এমনই মন দেন যে, বিপ্লব আসে সনেটে। ধমাধম লিখে ফেলেন এক গাদা অসাধারণ মানের সনেট।

১৮৬৫ সালের ছাব্বিশে জানুয়ারি বাল্যবন্ধু গৌরদাস বসাককে এক চিঠি লেখেন তিনি। সেই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন।

“তোমার পত্রের শিরোনামায় পূনরায় বাগেরহাটের উল্লেখ দেখিতেছি। আমার জন্মভূমির নদীর তীরে যে বাগেরহাট, এ বাগেরহাট কি সেই? আমি সম্প্রতি ইতালীয় কবি পেত্রার্কার কাব্য পাঠ করিতেছিলাম – তাঁহার ধরনে কয়েকটি সনেট লিখিয়া ফেলিয়াছি। এই কবতক্ষকে সম্বোধন করিয়াই একটি সনেট লিখিত। ঐটি এবং সঙ্গে আর একটি সনেট পাঠাইলাম; শেষেরটির অনুবাদ কয়েকজন ইউরোপীয় বন্ধুকে শুনাইয়াছিলাম, তাঁহাদের ওটি অত্যন্ত পছন্দ হইয়াছে। ভরসা করিয়া বলিতে পারি, তোমারও ভাল লাগিবে। দোহাই তোমার, এগুলির নকল যতীন্দ্র ও রাজনারায়ণকে পাঠাইবে এবং তাঁহাদের মতামত আমাকে জানাইবে। আমাদের ভাষায় চতুর্দ্দশ-পদী কবিতা যে ভাল ভাবেই চলিবে, এ কথা বলিবার সাহস আমার আছে। শীঘ্রই এক খণ্ড পুস্তকে এগুলি প্রকাশ করিবার মতলব আছে। তিন নম্বরের একটি কবিতাও পাঠাইতেছি; মৃত্যুর পর আজ পর্য্যন্ত ভারতচন্দ্র রায়কে এমন মার্জ্জিত প্রশংসাবাদ কেহ করে নাই – এ আত্ম-প্রশংসা আমার প্রাপ্য। এগুলি বন্ধু, তোমার কাছে নূতন ঠেকিবে। আমার ইচ্ছা, রাজেন্দ্রও এগুলি দেখেন, তাঁহার বিচারবুদ্ধির উপর আমার আস্থা আছে। এই নূতন পদ্ধতির কাব্য সম্বন্ধে তোমাদের সকলের মতামত আমাকে জানাইবে। ভাই, আমার নিজের বিশ্বাস, আমাদের ভাষা অতি মনোহারী, প্রতিভাশালী ব্যক্তির হাতে ইহা মার্জ্জিত হইবার অপেক্ষা করিতেছে মাত্র।”

গৌরদাস বসাক মধুসুদনের সনেটগুলোকে তাঁর নির্দেশমতো পৌঁছে দেন যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরকে। এই ভদ্রলোক ছিলেন পাথুরিয়াঘাটার মহারাজ। মাইকেলের বিশেষ বন্ধু। বাংলা নাট্যশালার ইতিহাসে এঁর উল্লেখযোগ্য স্থান রয়েছে। বেলগাছিয়ায় রঙ্গালয় স্থাপনে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র-প্রতাপচন্দ্রকে সহযোগিতা করেছিলেন। পরে পাথুরিয়াঘাটায় নিজের বাড়িতে একটা রঙ্গনাট্যালয় স্থাপন করেন। এঁর অনুপ্রেরণাতেই মধুসুদন তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য রচনা করেন। তিলোত্তমাসম্ভবের মুদ্রণের ভারও তিনি নিয়েছিলেন। মধুসুদন এই কাব্যটি তাঁকেই উৎসর্গ করেন।

মধুসুদন যদিও তাঁর চিঠিতে তিনটি কবিতার কথা উল্লেখ করেছেন, আসলে সেখানে কবিতা ছিলো চারটি। অন্নপূর্ণার ঝাঁপি, জয়দেব, সায়ংকাল এবং কবতক্ষ নদ। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর কবিতাগুলো পড়েন। তারপর সেগুলোকে পাঠিয়ে দেন রাজেন্দ্রলাল মিত্রের কাছে প্রকাশের জন্য। রাজেন্দ্রলাল মিত্র মাসিক পত্রিকা রহস্য-সন্দর্ভের সম্পাদক ছিলেন। কবিতাগুলো সম্পর্কে তাঁর মতামতও যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর চিঠি লিখে গৌরদাস বসাককে জানান। সেই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেনঃ

“সনেট চারিটি আমি মনোযোগের সহিত পড়িয়াছি এবং আমার বিবেচনায় সেগুলি আমাদের কবির লেখনীর সম্পূর্ণ মর্য্যাদা রাখিয়াছে। চারিটির মধ্যে দুইটি আমার বেশী ভাল লাগিয়াছে – জয়দেব সম্বোধন করিয়া লিখিত সনেটটি এবং সায়ংকালের বর্ণনা-সম্বলিত সনেটটি।শেষেরটির ভাব যদিও সম্পূর্ণ মৌলিক নয়, তথাপি বাংলা ভাষায় একেবারে নূতন; এবং মধুসুদন এমন আশ্চর্য্য চমৎকার ভাবে মর্ম্মানুবাদ করিয়াছেন যে, কবিতাটি প্রায় মৌলিক কবিতার গৌরব লাভ করিয়াছে। আমাদের কবি যেখান হইতে যাহাই গ্রহণ করুক না, তাঁহার হাতে গৃহীত বস্তু উৎকর্ষ প্রাপ্ত হয় এবং ভাব ও অনুভূতি যত বিদেশী হউক, তাঁহার রচনা-কটাহে পড়িলে সকলই স্বাভাবিক মাধুর্য্য ও সৌন্দর্য্য লাভ করে। তৃতীয় সনেটটি যদিও কমনীয় ভাবে ভরা, তথাপি আমার মনে হয়, এটি অন্য দুইটির মত সহজ ও প্রাঞ্জল হইয়া উঠে নাই। আপনার নির্দ্দেশ-মত আমি সনেট চারিটি মাইকেলের পত্র সহ আমাদের বন্ধু রাজেন্দ্রকে দিয়াছি; ভরসা করি, তিনি খুশী হইয়াই তাঁহার পত্রিকায় সেগুলিকে স্থান দিবেন।”

রাজেন্দ্রলাল মিত্র ছিলেন বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত। পুরাতত্ত্বের আলোচনায় তাঁর খ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিলো। উড়িষ্যার পুরাতত্ত্বের উপরে লেখা তাঁর একটি ইংরেজি গ্রন্থ বাঙালি মনীষার কীর্তিস্তম্ভরূপে পরিগণিত ছিলো। সাংবাদিক এবং প্রাবন্ধিক হিসেবেও বাংলা গদ্যসাহিত্যে তাঁর স্থান অনেক উঁচুতে। তিনি দুটো সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছেন। ‘বিবিধার্থসংগ্রহ’ এবং ‘রহস্যসন্দর্ভ’। প্রথম যুগের বাংলা সাহিত্য-সমালোচকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম সেরা একজন।

বঙ্গভাষানুবাদক সমাজ ছিলো বিবিধার্থ সংগ্রহের প্রচারক, প্রকাশক। শুধু সংবাদ পরিবেশন নয়, বা সমাজ ও ধর্মসংস্কারের জন্য বাদ প্রতিবাদ নয়, সহজ সরল ভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞানের যাবতীয় বিষয় সাধারণ পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়াই ছিলো বিবিধার্থ সংগ্রহের মূল উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য যে পত্রিকাটি অনেকখানিই সাধন করতে পেরেছিলো তা রবীন্দ্রনাথের শৈশবস্মৃতি থেকেই টের পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ বিবিধার্থ সংগ্রহ সম্পর্কে লিখেছিলেন, “বার বার করে সেই বইখান পড়বার খুশি আজও আমার মনে পড়ে। সেই বড় চৌকো বইটাকে বুকে নিয়ে আমাদের শোবার ঘরে তক্তাপোষের উপর চিত হয়ে পড়ে নর্হাল তিমি মৎস্যের বিবরণ, কাজি বিচারের কৌতুকজনক গল্প, কৃষ্ণকুমারী উপন্যাস পড়তে পড়তে কত ছুটির দিনের মধ্যাহ্ন কেটেছে।”

রাজেন্দ্রলাল মিত্র নিজেই বহু বিচিত্র বিষয় নিয়ে লিখতে সক্ষম ছিলেন। এর সাথে তাঁর সঙ্গে তিনি পেয়েছিলেন সেই সময়ের বেশ ক’জন শক্তিমান লেখক। এঁদের মধ্যে ছিলেন রামচন্দ্র মিত্র, যাদবকৃষ্ণ সিংহ, রাধানাথ বিদ্যারত্ন, নবীনকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, হরিমোহন ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ক্ষেত্রমোহন মুখোপাধ্যায়, আনন্দনন্দন ঠাকুর, কালীপ্রসন্ন সিংহ, নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিবিধার্থ সংগ্রহ অন্য একটা কারণে বাংলা সাহিত্যে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। এখানে বাংলা সাহিত্যের সমালোচনামূলক প্রবন্ধের সূত্রপাত হয়। সেই সময়ে যে সমস্ত বই বের হতো, তার উল্লেখযোগ্যগুলোকে নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হতো বিবিধার্থ সংগ্রহে। মধুসূদনের তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যের প্রথম দুই সর্গ প্রকাশিত হয়েছিলো এখানে। রাজেন্দ্রলাল মিত্র এর সবিস্তার সমালোচনা লিখেছিলেন।

এই পত্রিকাটির ছয়টি পর্ব সম্পাদনার পরে দায়িত্ব ছেড়ে দেন রাজেন্দ্রলাল। কালীপ্রসন্ন সিংহ সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। সপ্তম পর্বের পরে কয়েকটা সংখ্যা অনিয়মিতভাবে বের হয়। তারপর পত্রিকাটির বিলুপ্তি ঘটে। এর কয়েক বছর পরে ১৮৬২ সালে রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সম্পাদনায় বের হয় ‘রহস্য সন্দর্ভ’ পত্রিকা। এটি মূলত ছিলো ‘বিবিধার্থ সংগ্রহের’-ই ভিন্ন নামে আত্মপ্রকাশ মাত্র।

মাইকেল মধুসূদনের সনেট যখন তাঁর হাতে পৌঁছুলো, রাজেন্দ্র মিত্র সত্যি সত্যিই প্রচণ্ড খুশি হলে। পাকা জহুরি তিনি। রত্ন চিনতে ভুল হয় না তাঁর। তিনি খুশি হয়ে বাংলা ভাষার এই নব জন্ম নেওয়া সম্পদকে তাঁর রহস্য-সন্দর্ভ পত্রিকায় স্থান দিয়েছিলেন। এই চারটি কবিতার মধ্যে কবতক্ষ নদ এবং সায়ংকাল ছাপা হয়ে যায় রহস্য-সন্দর্ভে। ছাপার হরফে বেরিয়ে আসে বাংলা ভাষার প্রথম সনেট। কবি-মাতৃভাষা প্রথম লিখিত সনেট, কিন্তু ছাপা হওয়া প্রথম সনেট হচ্ছে কবতক্ষ নদ আর সায়ংকাল। এই কবিতা যে অভিনব এবং অসাধারণ কবিতা ছিলো, সে বিষয়ে কোনো সংশয় ছিলো না তাঁর মনে। সে কারণেই চতুর্দ্দশপদী কবিতা শিরোনাম দিয়ে কবিতা দুটোর আগে একটা ছোট্ট সম্পাদকীয় নোট ছাপেন তিনি। সেখানে তিনি লেখেনঃ

“নিম্নস্থ চতুর্দ্দশপদী কবিতাদ্বয় শ্রীযুক্ত মাইকেল মধুসুদন দত্তকর্তৃক প্রণিত। উক্ত মহোদয়ের শর্মিষ্ঠা তিলোত্তমা মেঘনাদাদি কাব্য বঙ্গভাষার উৎকৃষ্ট বলিয়া প্রসিদ্ধ আছে। মেঘনাদ বাঙ্গালী মহাকাব্য বলিবার উপযুক্ত। অপর কবিবর কেবল উত্তম কাব্য লিখিয়াছেন এমত নহে। তাঁহাকর্তৃক বঙ্গভাষার অমিত্রাক্ষর কবিতার সৃষ্ট হইয়াছে বলিয়াও তিনি এতদ্দেশীয়দিগের মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত আছেন। তাঁহার এই অভিনব কবিতা তাঁহার কবিত্ব-মার্ত্তণ্ডের অনুপযুক্ত অংশু নহে।”

‘রহস্য সন্দর্ভে’ ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতাটি ছাপা হয়েছিলো ‘কবতক্ষ নদ’ শিরোনামে। ১৮৬৬ সালে স্ট্যানহোপ প্রেসের স্বাত্বাধিকারী ঈশ্বরচন্দ্র বসু মধুসূদনের সমস্ত সনেটগুলোকে একত্র করে চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী নামে একটা বই বের করেন। এখানে কবিতাটার শিরোনাম হয়ে যায় ‘কপোতাক্ষ নদ’। সেই থেকে এই কবিতার শিরোনাম লেখা হচ্ছে ‘কপোতাক্ষ নদ’। রহস্য সন্দর্ভে প্রকাশিত শিরোনামের কারণে প্রশ্ন এসে যায়, শুরুতে মধুসূদন আসলে কবিতাটার শিরোনাম কী দিয়েছিলেন? ‘কপোতাক্ষ নদ’ নাকি ‘কবতক্ষ নদ’? শুধু শিরোনাম নয়, কবিতাটার দুই একটা লাইনও একেবারেই ভিন্নতর, এখনকার সঙ্গে মেলে না। এখন এই কবিতাটা পড়ি আমরা এভাবে।

সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে

সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।

সতত যেমনি লোক নিশার স্বপনে

শোনে মায়া যন্ত্র ধ্বনি তব কলকলে

জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।

বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে

কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে

দুগ্ধস্রোতরূপি তুমি মাতৃভূমি স্তনে।

আর কি হে হবে দেখা যত দিন যাবে

প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে

বারি রূপ কর তুমি এ মিনতি গাবে

বঙ্গজ জনের কানে সখে-সখারিতে।

নাম তার এ প্রবাসে মজি প্রেমভাবে

লইছে যে নাম তব বঙ্গের সঙ্গীতে।

 

নিচেই আমি রহস্য সন্দর্ভে প্রকাশিত ‘কবতক্ষ নদ’ কবিতাটির চিত্র তুলে দিয়েছি। এর সঙ্গে মিলালেই পার্থক্যগুলো টের পাবেন। প্রথম প্রকাশে এই কবিতার মাঝখানে বেশ কিছু লাইন ছিলো, এখন যেগুলো নেই। এখনকার লাইনগুলো ভিন্ন রকমের। ওখানে ছয়, সা্‌ত, আট আর নয় নম্বর লাইনটা ছিলো এরকম।

কোথা তুমি? কোথা তুমি? কুভাগ্যের বলে

স্মরিলে সে কথা, হায়, আসে গো নয়নে

বারি-বিন্দু, নিরানন্দে ভাসি চক্ষু জলে।

কিন্তু বৃথা খেদ এবে, যত দিন যাবে,

 

এখকনকার চার লাইন এমন।

 

বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে

কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে

দুগ্ধস্রোতরূপি তুমি মাতৃভূমি স্তনে।

আর কি হে হবে দেখা যত দিন যাবে,

এছাড়াও কিছু শব্দের পরিবর্তন আছে। বারো নম্বর লাইন আগে ছিলো ‘বঙ্গজ জনের কাণে, হে নদ, পিরীতে’, এখন এটা হচ্ছে ‘বঙ্গজ জনের কানে সখে-সখারিতে।’। তেরো নম্বর লাইনের শেষ শব্দটা আগে ছিলো কবি-ভাবে, এখন হয়েছে প্রেমভাবে।

মধুসূদনের স্বহস্তে লেখা চিঠিগুলোর কোনো সংকলন নেই। সব জায়গাতেই ছাপার হরফে তাঁর চিঠি সংকলিত হয়েছে। মধুসূদন চিঠি লিখতেন মূলত ইংরেজিতে। তবে, এর মাঝে মাঝে বাংলা শব্দ, বাক্য বা কবিতার লাইন লিখে দিতেন। ১৮৬৫ সালের ছাব্বিশে জানুয়ারিতে তিনি গৌরদাস বসাককে যে চিঠি লিখেছিলেন, সেটি ছিলো ইংরেজিতে লেখা। কিন্তু, সেই চিঠিতে কপোতাক্ষ নদীর নাম উল্লেখ করা আছে বাংলায়, ইংরেজিতে নয়।। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ কর্তৃক প্রকাশিত মদুসূদন গ্রন্থাবলী-র চতুর্দ্দশবতী কবিতাবলীর ভূমিকায় এই চিঠিটা দেওয়া আছে। সেখানে নদীর নাম লেখা আছে কবতক্ষ। ক্ষেত্র গুপ্তের ‘কবি মধুসূদন ও তাঁর পত্রাবলীতে’ লেখা হয়েছে কপোতাক্ষ। অন্যদিকে ‘সনেটের আলোকে মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে জগদীশ ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন যে, কবির আদরের ভাষা হচ্ছে কবতক্ষ। এ থেকে অনুমান করা শক্ত না যে, মধুসূদন শুরুতে কবিতার শিরোনাম ‘কবতক্ষ নদ’-ই দিয়েছিলেন। কিন্তু, পরবর্তীতে এই আদরের ডাক পালটে গিয়ে কপোতাক্ষ তার আসল নাম পেয়ে যায়। কে দিয়েছিলো আসল নাম, তা আজ অজানাই। কবিতার শিরোনাম পালটে হয়ে যায় ‘কপোতাক্ষ নদ’। এটি কবির সম্মতিতে হয়েছিলো, নাকি তাঁর অসম্মতিতে, সেটা আজ এতো বছর পরে এসে বলাটা মুশকিলই বটে।

কপোতাক্ষ হোক আর কবতক্ষই হোক, নদীতো সেই একটাই। শিরোনামও যতই আলাদা হোক আর যাই হোক, কবিতা তো সেই একটাই। বহু ভালবাসার, বহু আবেগের, বহু ইতিহাস সৃষ্টি করার।

———————–

রহস্য-সন্দর্ভে প্রকাশিত কবতক্ষ নদ, ১৮৬৫ সাল।