আমাদের আধুনিক উচ্চ শিক্ষিত মুসলিম বন্ধুদের মাঝে উতসবের আমেজ তৈরি হয়েছে কুরআন এবং ইসলাম বিষয়ে কিছু নতুন বয়ান প্রচার করবার জন্যে। যদিও এই বয়ানের মূল লক্ষ ইসলামের অনুসারী বা মুসলমান পাঠকেরা হতে পারেন, কিন্তু লক্ষ্য কখনও কখনও উপলক্ষের কাছে হেরে যায়। আমাদের বন্ধু পারভেজ আলমের এই ধরনের লেখার উপলক্ষ হচ্ছেন অভিজিত রায়। অর্থাৎ অভিজিত রায়কে সাধারণ মুসলমানদের “শত্রু” বানানোর একটি মিশনে ক্লান্তিহীনভাবে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন পারভেজ। এটা কোনও বড়ো সমস্যা নয়। কারন, ইতিহাসে ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে বটে, কিন্তু ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের অংশ মাত্র। অভিজিত রায় বাংলাদেশের মুক্তমনা আন্দোলনের প্রধান মানুষদের অন্যতম, কিন্তু সভ্যতার কাছে তিনি একজন অংশ গ্রহণকারী, তার পরেও আরো হাজার হাজার বাঙ্গালী ছেলে মেয়ে কাজ করবেন। তাই, পারভেজ যতই চেষ্টা করুন না কেনও, অভিজিত রায়কে মুসলিম কমিউনিটির বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর, এটা খুবই পরিশ্রমের কাজ হয়ে যাবে, কারন, পারভেজ না চাইলেও, ইতিহাসের গতিমুখ সামনের দিকে। এবং সেই গতিমুখ কোনও কথিত “র‍্যাশনাল ইসলাম” দিয়ে সংজ্ঞায়িত হবেনা, গত এক হাজার বছর ধরে তা হয়নি। কথাগুলো এভাবে বলতে হচ্ছে এই জন্যে যে, আমাদের বন্ধু পারভেজ আলমের সাম্প্রতিক সময়ের লেখা গুলো প্রায়শই শেষ হচ্ছে অভিজিত রায়ের নাম জপ করে। পারভেজ কি স্বপ্নে কিম্বা দুঃস্বপ্নেও অভিজিত কে দেখছেন? দেখুন পারভেজ এর সর্বশেষ পাঁচটি ব্লগ এর তালিকা। রিল্যাক্স পারভেজ !

Image and video hosting by TinyPic

আসুন ব্যক্তি অভিজিত এবং পারভেজ কে শিকায় তুলে রেখে, মূল লেখায় প্রবেশ করি। পারভেজ আলম ইশটিশন ব্লগে একটি লেখা লিখেছেন “কুরানের ঐতিহাসিক কন্টেক্সট নির্ভর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে” এই শিরোনামে। লেখাটিতে বেশ ইসলামী জারগন আছে, অসংখ্য নাম ধাম আছে, মেলানো একটু কষ্টকর, কিন্তু লেখাটি প্রয়োজনীয়, এই জন্যে প্রয়োজনীয় যে, যুগে যুগে শ্রুতিমধুর আবেগী শব্দের মোড়কে ধর্ম কিভাবে মানুষকে বিষ গেলানোর চেষ্টা করে গেছে ক্লান্তিহীন ভাবে, এই ধরনের লেখা তার উৎকৃষ্ট প্রমান। আমার ইন্টারপ্রেটেশন এর উপর নির্ভর না করে, পাঠক নিজেই লেখাটি পড়তে পারেন এখানে , পারভেজ এর মূল বক্তব্য টি হচ্ছে – কুরআনের বক্তব্য কে আক্ষরিক অর্থে নেয়া যাবেনা, অন্তত ইসলামের ইতিহাসে স্কলার দের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মনে করতেন যে কুরআন কে বুঝতে হবে সেই সময়কার প্রেক্ষিত বা “কন্টেক্সট” এর আলোকে। অর্থাৎ কুরআনের কোনও কোনও আয়াত শুধু মাত্র সেই সময়ের জন্যে প্রযোজ্য, বা সার্বজনীন ভাবে সকল কালের জন্যে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। পারভেজ বলেছেন, কুরআনের এই “কন্টেস্কচুয়াল” ব্যাক্ষ্যা টি প্রতিষ্ঠিত করা না গেলেও, সেই সময় ফুরিয়ে যায়নি। আশাবাদী পারভেজ লিখেছেন এভাবে

“ইতিহাস পালটানো না গেলেও ভবিষ্যত নির্মান করার সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায় নাই। বর্তমানের সংকট মোকাবেলায় এই বিতর্কের দিকে মুসলমানরা দৃষ্টি দেবেন সেই প্রত্যাশা করি। আমাদের জন্যে আশার বিষয় যে, এই বিতর্ক সম্বন্ধে জেনে অথবা না জেনেও কুরানের কন্টেক্সচুয়াল ব্যাখ্যা মুসলমানরা ঠিকই করে যাচ্ছেন।“

যাক পারভেজ “আমাদের” শব্দ টি দিয়ে অন্তত নিজেকে একটি দলভুক্ত করলেন, এটা ভালো লক্ষন। কিন্তু এই “আমাদের” কারা? কাদের? মুসলমানদের? পারভেজ লিখছেন –

“আধুনিক ইসলামী পন্ডিতদের মধ্যে ফজলুর রহমানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার পিতা ছিলেন দেওবন্দে পড়ালেখা করা আলেম। ফজলুর রহমান পড়াশোনা করেছেন পাশ্চাত্যের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দুই জায়গাতেই ইসলাম সম্বন্ধে তিনি একজন বিশেষজ্ঞ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি। কুরানের যে আয়াতটিতে পুরুষকে নারীর উপর অধিকার দেয়া হয়েছে, তার পরের আয়াতটিকে গুরুত্ব দিয়ে ফজলুর রহমান দাবি করেছিলেন যে পুরুষের এই শ্রেষ্ঠত্ব অর্থনীতির দিক থেকে ফাংশনাল শ্রেষ্ঠত্ব, নারীর উপর পুরুষের কোন জন্মগত শ্রেষ্ঠত্ব নয়। অর্থাৎ, ঐতিহাসিক এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতা পরিবর্তিত হলে এই অধিকারের হায়ারিচি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার দাবি রাখতে পারে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, হেফাজতের নারী নীতি বিরোধী আন্দোলনের সময় আমিও একিভাবে কুরানের এই আয়াতের ব্যাখ্যা করেছিলাম ইসলামের ভেতর থেকে হেফাজত বিরোধীতার ডিসকোর্স দাঁড় করানোর চেষ্টা থেকে। “

অর্থাৎ সুরা নিসায় পুরুষ কে নারীর উপরে মর্যাদা দেয়া হয়েছে সেটি সেই সময়কার অর্থনৈতিক কাঠামোতে পুরুষের প্রাধান্য বা নেতৃত্বের কারনে। যদি অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন হয় তাহলে এই হায়ারারকিরও পরিবর্তন হতে পারে। এই “পরিবরতিত হয়ে যাওয়ার দাবী রাখতে পারে”, কথা টির মানে কি? যদি পরিবর্তিত হয়ে যাবার প্রেক্ষিতে নারীর অবস্থান টিকে পরিবর্তন করার দাবী করা যেতে পারে, তাহলে কি কুরআনের এই সকল অংশের পুনর্লিখনের দাবী টি করা যেতে পারে? পারভেজ কুরআনের কোনও কোনও অংশও পুনর্লিখনের সম্ভাবনার কথা বলছেন? যদি বলে থাকেন, তাহলে সন্দেহাতীত ভাবে আমি এবং বোধ করি অনেক নাস্তিক – মুক্তমনা – এক্টিভিস্ট তার সাথে একমত হবেন। অর্থাৎ কুরআনের একটি বিশদ পুনরলিখন এর দাবী টি অযৌক্তিক নয়, কারন “কন্টেক্সট” বা প্রেক্ষিত বদলে গেছে আমুল। প্রসঙ্গ টিকে যদি আরেকটু বর্ধিত করা হয় তাহলে কেমন হয়? ধরুন পারভেজ সুরা নিসার যে আয়াত টির কথা বলেছেন তাহল এই রকমের ……

Image and video hosting by TinyPic

পারভেজ, বিশিষ্ট পন্ডিত ফজলুর রহমানের বয়ানে, এই আয়াতটির কেবল একাংশের “কন্টেস্কচুয়াল” ব্যাখ্যা করলেন, কিন্তু বাকি অংশের ব্যাক্ষ্যা টুকু চেপে গেলেন। এই আয়াত টিতে তিনটি অংশ আছে-

১- নারীর উপরে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব বা কর্তৃত্ব, যা আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত এবং যার সাথে আয় ও ধন সম্পদের সম্পর্ক আছে।
২-যে সমস্ত নারী ভালো এবং পুণ্যবতী, তারা পুরুষের আনুগত্য করে এবং আল্লাহর ইচ্ছা সংরক্ষন করেন
৩-কিছু নারীর মধ্যে অবাধ্যতা দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে, আল্লাহ তায়ালা বলছেন, প্রথমে তাদেরকে সদুপদেশ দেয়ার জন্যে, তারপরে বিছানা থেকে আলাদা করে দেবার জন্যে এবং তারপরে প্রহার করার জন্যে।

আমি ব্যক্তিগত ভাবে আন্দাজ করতে পারিনা সুরা নিসার এই আয়াত টির বাকি অংশের ব্যাক্ষ্যা মুফতি ফজলুর রহমান কি দিয়েছিলেন, পারভেজ নিশ্চয়ই জানেন। যদিও তিনি তার লেখায় সেটুকু আর উল্লেখ করেন নাই। আপনারা পাঠক হিসাবে একটু বলবেন এই অংশ টুকুর আক্ষরিক আর “কন্টেক্সচুয়াল” ব্যাক্ষ্যার মধ্যে কি পার্থক্য থাকতে পারে? তার মানে কি এই যে, অর্থনৈতিক ক্ষমতা যেমন পুরুষ কে নারীর উপরে অবস্থান দেয়, পুরুষ কে ক্ষমতা দেয় নারীকে বিছানা থেকে আলাদা করে দেবার, পুরুষ কে ক্ষমতা দেয় নারীকে প্রহার (কিম্বা পারভেজ দের ভাষায় “মৃদু প্রহার” বা “মৃদু লাঠি চার্জ” ধরনের কিছু একটা) করবার, যদি নারী কখনও সেই অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করে, তাহলে নারী সুরা নিসায় বর্ণিত পুরুষের স্থানে অধিষ্ঠিত হতে পারে? যদি তাইই হয়, সে ক্ষেত্রে পারভেজ কি সুরা নিসার সংশ্লিষ্ট অংশও টুকু পুনর্লিখনের দাবী জানাবেন?

সুরা নিসায় এগার নাম্বার আয়াত বলছে –

“আল্লাহ তায়ালা তোমাদের সন্তান দের সম্মন্ধে তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, এক পুত্রের জন্যে দুই কন্যার অংশের তুল্য”।

– অর্থাৎ আক্ষরিক ভাবে যদি বলা যায় তাহলে বলতে হবে, দুই কন্যা মিলে যা পাবে একজন পুত্র তা পাবে, মানে হোল ছেলের অধিকার মেয়ের চাইতে দ্বিগুণ। কিন্তু পারভেজ এর মতো লেখকেরা তাহলে আমাকে “সালাফি” উপাধি দিয়ে গর্বিত করবেন, কারন আমি কুরআনের আক্ষরিক অর্থ করছি। পাঠক আপনারাই বলুন এই আয়াতটির “কন্টেক্সচুয়াল” ব্যাক্ষ্যা আর কি হতে পারে? আচ্ছা ধরেই নেয়া গেলো যে, সেই সময়ের প্রেক্ষিতে হয়ত এটাই সঠিক এবং যৌক্তিক ছিল, কিন্তু এখনও কি মেয়েরা ছেলে সন্তানদের অর্ধেক উত্তরাধিকার হবে? এই পরিবর্তিত “কন্টেক্সট” এ? পরিবর্তিত “কন্টেক্সট” এও সুরা নিসার এই বিধান কার্যকর থাকে তাহলে কোনও কথা নেই, কিন্তু যদি তা না হয়, তাহলে কুরআনের সুরা নিসার এই অংশের পুনর্লিখনের দাবীর সাথে কি পারভেজ একমত হবেন?

সুরা নিসার পরতে পরতে রয়েছে নারীর জন্যে অমর্যাদাকর কথা ও বানী। আর এই বানী গুলোকেই মুসলমানেরা হাজার বছর ধরে প্রচার করেছে নারীর প্রতি “মর্যাদা” হিসাবে। পারভেজ দের মতে, কুরআনের সকল বানী যেহেতু কোনও না কোনও “কন্টেস্কট” এর সাপেক্ষে নাজেল হয়েছিলো, তাই হয়ত বলা যেতে পারে, নারীর প্রতি এই সকল অমর্যাদাকর টেক্সট হয়ত কোনও এক “কন্টেক্সট” এ জায়েজ ছিল ……… ! আজ হয়ত সেই “কন্টেক্সট” আর নেই, তাই কুরআনের এই সকল আয়াত এর পুনর্লিখনের দাবী টি অযৌক্তিক হবেনা। পারভেজ তার লেখায় “আমাদের” বলে নিজেকে যেভাবে ইনক্লুড করলেন, তাতে তিনি কি এই দাবিটি নিয়ে এগিয়ে যাবেন?

আমি নিশ্চিত, আপনি যদি পরিবর্তিত “কন্টেক্সট” এর কারনে কুরআনের পুনর্লিখন দাবী করেন, তাহলে তিনি অভিজিত সহ আরও হাজারো বাঙ্গালী মুক্তমনা-নাস্তিকদের কে তার পাশে পাবেন। আসুন পারভেজ, আমরা একসাথে শ্লোগান তুলি – পবিত্র গ্রন্থ কুরআন এর একটি বিস্তারিত পুনর্লিখন আশু প্রয়োজন। এটা মুসলমানদের টিকে থাকার স্বার্থেই প্রয়োজন।