প্রারম্ভিকাঃ
প্রথমেই একটা বিষয়ে আলোকপাত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি, আর সেটা হচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধে বড় পরিসরে ধর্ষণ হয়েছে’ এই উক্তিটি কি সর্বমহলে সমান গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে কি না, না পেয়ে থাকলে কেন পায়নি। এর বিপরীতে কি কি বক্তব্য এসেছে, কেন এসেছে এবং সেইসব বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতাই বা কতটুকু।

যুদ্ধ মাত্রই ধর্ষণ, সম্ভবত পৃথিবীতে বড় পরিসরে ঘটে যাওয়া এমন একটি যুদ্ধও পাওয়া যাবে না যেখানে কোন ধর্ষণ হয়নি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও প্রচুর ধর্ষণ হয়েছে বলেই আমরা দাবী করা হয়ে, বাংলাদেশ সরকারের হিসেবে সংখ্যাটা প্রায় দুই লাখ বিবেচনা করা হলেও প্রকৃত সংখ্যাটা এরচেয়ে অনেক বেশী হতে পারে কিংবা কমও হতে পারে। প্রকৃত সংখ্যা আসলে কত হতে পারে এ নিয়ে এই নিবন্ধের পরবর্তী পর্বগুলোতে বড় পরিসরে আলোচনা করা হবে। পক্ষে বিপক্ষের সমস্ত ডাটা থেকে আমরা বের করে আনার চেষ্টা করবো মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণের প্রকৃত পরিসংখ্যান। কাজটা আমাদের জন্য খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না কারণ এই ঘটনার ভিকটিম আমরা নিজেরাই, আমাদের মা-বোনেরাই। তবুও আমরা চেষ্টা করবো সর্বোচ্চ নির্মোহ থাকার, চেষ্টা করবো আসল সত্যটাকে তুলে আনার। ব্যাপারটা অনেকটা চল্লিশ বছর পর বধ্যভুমি থেকে লাশ গোনার প্রচেষ্টাও বলা যেতে পারে, কিন্তু আমরা নিরুপায়। সময়ের প্রয়োজনে আজ এটা করা অনিবার্য।

এ বিষয়ে আমাদের কাজ সহজ করে দিয়েছেন একজন মানুষ, তার নাম শর্মিলা বসু। বসু একজন ভারতীয় বংশোদ্ভুত আমেরিকান, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের একজন সিনিয়র গবেষণা সহযোগী । ১৯৭১ সালের যুদ্ধের ওপর বড় পরিসরে লেখা তাঁর বই “ডেড রেকনিং: ১৯৭১ এর বাংলাদেশ যুদ্ধের স্মৃতি” দেশে বিদেশে ব্যাপক আলোচনার রসদ যুগিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্মরণকালের সবচেয়ে বিতর্কিত বই হিসেবে এটি আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এছাড়া Economic and Political Weekly এর September 22, 2007 সংখ্যায় “Losing the Victims: Problems of Using Women as Weapons in Recounting the Bangladesh War” প্রবন্ধেও ৭১ সালে সংগঠিত যুদ্ধে নারীদের ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি উঠে এসেছে। এ ছাড়াও শর্মিলা বোসের লেখেন “Anatomy of Violence: Analysis of Civil War in East Pakistan in 1971″ (EPW, Oct 8, 2005)। নিবন্ধটির প্রথম সংস্করণ ডঃ বোস ২০০৫ সালের ২৮-২৯ জুন যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতরের ইতিহাস বিভাগ আয়োজিত দুই দিন ব্যাপী এক সম্মেলনে উপস্থাপন করেন। সম্মেলনের শিরোনাম ছিল “ সংকটে দক্ষিণ এশিয়াঃ যুক্তরাষ্ট্রের নীতি, ১৯৬১-১৯৭২” ।

প্রথমেই বলে নিচ্ছি এই প্রবন্ধে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বোসের সমস্ত লেখনীর ওপর আলোকপাত করা হবে না, শুধুমাত্র ৭১ সালে সংগঠিত যুদ্ধে নারী নির্যাতন সম্পর্কে তাঁর গবেষণার দিকেই আমরা দৃষ্টিপাত করবো।

যুদ্ধ নিয়ে জয়ী অংশের একটা গল্প থাকে, পরাজিতদেরও একটা গল্প থাকে। আর স্বাভাবিক ভাবেই দুটো গল্পে পরস্পরকে দোষারোপ করা হয়। দুটো গল্পেই থাকতে পারে অনেক ভুল তথ্য , অনেক মিথ্যাচার। কিন্তু অনেক অনেক বছর পর যখন ইতিহাস লেখা হয় তখন সব গল্পের জট খুলে সত্যটা ঠিকই বের হয়ে আসে। এটাই স্বাভাবিক।

এখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন হতে পারে কেন এই প্রবন্ধে শর্মিলা বসুকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, অন্য কেউ নয় কেন। অনেকেই তো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন।

উত্তরটা অতি সহজ, ওয়াশিংটনের একটি কনফারেন্সে শর্মিলা বোসের নিবন্ধ উত্থাপিত হবার পরপরই পাকিস্তানী বিভিন্নপত্র-পত্রিকাগুলোয় আবার মুক্তিযুদ্ধের ইস্যু গুলো নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়। ত্বরিত এ বিষয়ে লেখা ছাপা হয় দ্য ডেইলি টাইমস (হাসান, জুন ৩০, ২০০৫; সম্পাদকীয় জুলাই ২, ২০০৫) এবং ডন (ইকবাল, জুলাই ৭, ২০০৫) এর মত প্রভাবশালী পত্রিকায়। দু’টো পত্রিকাই বোসের বরাত দিয়ে উল্লেখ করে- বাংলাদেশের যুদ্ধে কোন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে নি।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে পাকিস্তানী জেনারেলদের অনেকেই লিখেছেন। যারা পড়েছেন তারা জানেন এসব বইয়ের প্রায় সবটাই মিথ্যাচারে ভরপুর, এদিকে বাংলাদেশেও অনেক গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে নির্মোহভাবে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য উপাত্ত যাচাই করতে আমাদের সবচেয়ে বেশী সাহায্য করেছে আন্তর্জাতিক মিডিয়া। পাকিস্তানী বাহিনীর রক্তচক্ষুর ভেতর দিয়েও মুক্তিযুদ্ধ আর গনহত্যার সমস্ত খবরা খবর বিশ্বময় পৌঁছে যায় এসব পত্রিকার মধ্যে দিয়ে। পৃথিবীর বড় অংশের জানতে পারে পাকিস্তানিদের নির্মমতার কথা। সারা পৃথিবীর জনমত চলে আসে বাঙালীদের পক্ষে। আর এইসব খবরাখবর সরবরাহ করেন যেসব সাংবাদিক এবং বিদেশী পর্যবেক্ষক তারা ঘটনাগুলো নিরপেক্ষ এবং নির্মোহভাবেই লিখেছেন। এইসব টেলিভিশন আর সংবাদপত্রের প্রচারণার কারণেই মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী পাকিস্তানিদের নির্মমতা পৃথিবীর মানুষদের কাছে পরিস্কার। বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষরা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে ঘৃণা করে। কিন্তু অন্য দিকে পাকিস্তান তাদের পক্ষে কোন গ্রহণযোগ্য ইতিহাসকেই তারা দাঁড় করাতে পারেনি। যদিও পাকিস্তানের বিভিন্ন স্কুল কলেজের বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক গুলোতে তারা নিয়মিত মিথ্যাচারিতা, বাংলাদেশীদের প্রতি বিনা কারণে বিদ্বেষে পরিপূর্ণ করে রেখেছে। কিন্তু বাংলাদেশের পাঠ্যবইতে নিয়মমাফিক পাকবাহিনীর নির্মমতার কথাই বলা আছে, কখনোই বিনা কারণে পাকিস্তানের সাধারন নাগরিকদের প্রতি কোন হিংসার বানী নেই।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তানী জেনারেলদের বই গুলো খাপছাড়া। এসব বইতে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার সাথে সাথে স্ব-গোত্রীয়দের বিরোধিতা করেছে। সেনাবাহিনী পরাজয়ের জন্য দায়ী করেছে রাজনীতিবিদদের। পলিটিশিয়ানরা দায়ী করেছে সেনাবাহিনীকে। যুদ্ধকালীন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল আরেকজন জেনারেলকে দায়ী করে লিখেছে প্রচুর। ফলশ্রুতিতে পুরো পাকিস্তানী সেনাবাহিনী মিলে এমন একটা গ্রন্থ গ্রন্থনা করতে পারেনি যেখানে সমস্ত খুন-ধর্ষণ-গনহত্যা-লুটপাটের দায়মুক্তি পাবে তারা। একক ভাবে বাঙালীদের দায়ী করে একটা বই তারা আসলেই লিখতে পারেনি। তাদের এই শূন্যতাকে পূরণ করেছেন শর্মিলা বসু তার”ডেড রেকনিং: ১৯৭১ এর বাংলাদেশ যুদ্ধের স্মৃতি” বই এবং তাঁর বিভিন্ন গবেষণা নিবন্ধের মাধ্যমে।

গুরুতর অভিযোগঃ

শর্মিলা বসুর “Losing the Victims: Problems of Using Women as Weapons in Recounting the Bangladesh War” প্রবন্ধে করা কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক।

১)শর্মিলা লিখেছেন “মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর বলছে ‘পঁচিশে মার্চ থেকে ষোলই ডিসেম্বরের মধ্যে তিরিশ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে, দুই লক্ষ নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং এক কোটিকে হতে হয়েছে শরণার্থী। এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঘটে যাওয়া সবচেয়ে জঘন্যতম গনহত্যা’
মাত্র ৩৪,০০০ সদস্যের একটি সেনা বাহিনীর পক্ষে আট থেকে নয় মাসের মধ্যে এই মাত্রায় ধর্ষণ করতে হলে প্রত্যেককে ধর্ষণে লিপ্ত হতে হবে এবং প্রত্যেককে অবিশ্বাস্য সংখ্যক ধর্ষণ করতে হবে।”
[Losing the Victims: Problems of Using Women as Weapons in Recounting the Bangladesh War. P-3865]

২) শর্মিলা জেনারেল নিয়াজীর যুদ্ধাবস্থায় (১৫ এপ্রিল ১৯৭১) দেয়া এক নির্দেশনার বরাত দিয়ে বলেছেন ‘যুদ্ধে কিছু ধর্ষণ হতেই পারে, তবে আমি আশা করবো আমার সৈনিকেরা সবধরনে লুট, ডাকাতি এবং অসদ আচরণ থেকে বিরত থাকবে। যদি এ ধরণের অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্ত মূলক ব্যাবস্থা নেয়া হবে।’
[Losing the Victims: Problems of Using Women as Weapons in Recounting the Bangladesh War. P-3866]

৩)শর্মিলা লিখেছেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানী হত্যাকান্ডের চাক্ষুস সাক্ষীদের সাথে সরাসরি কথা বলে আমি জানতে পেরেছি পাক বাহিনী সবসময় পুরুষদের টার্গেট করতো। মহিলাদের সবসময়ই আলাদা করে ছেড়ে দেয়া হত। কয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়ত ঘটতে পারে তবে এত বড় স্কেলে ধর্ষণ অসম্ভব। হত্যাকান্ডের সময় কখনই নারীদের হত্যা করা হয় নাই, কয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে থাকলে সেসব ছিলো ক্রস ফায়ার
[Losing the Victims: Problems of Using Women as Weapons in Recounting the Bangladesh War. P-3866]

৪)শর্মিলা লিখেছেন; আমার কাছে যে তথ্য প্রমাণ আছে সেটা থেকে বলতে পারি ৭১এ কিছু ধর্ষণ হয়েছে কিন্তু সংখ্যাটা কখনোই হাজার হাজার কিংবা লক্ষ লক্ষ নয়।

ধর্ষিতাদের মধ্যে ছিলো হিন্দু এবং মুসলিম, বাঙালী, বিহারী এবং পশ্চিম পাকিস্তানী। আর ধর্ষণ করেছিলো বাঙালীরা, বিহারীরা, পশ্চিম পাকিস্তানিরা এবং আর্মি অফিসারেরা। অনেক অবাঙালীদের ধর্ষণের পর হত্যা করে বাঙালিরা।
[Losing the Victims: Problems of Using Women as Weapons in Recounting the Bangladesh War. P-3870]

৫)শর্মিলা লিখেছেন, তখনকার কিছু জুনিয়ার অফিসারের সাথে কথা বলে আমি জেনেছি যে কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এবং তাদের শাস্তিও দেয়া হয়েছে আর্মিদের বিধান অনুযায়ী। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের জেলও হয়েছে। কিছু বিচ্ছিন্ন ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও এত বড় স্কেলে ধর্ষণ কখনই ঘটেনি।
[Losing the Victims: Problems of Using Women as Weapons in Recounting the Bangladesh War. P-3866]

৬)ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী সম্পর্কে লিখেছেন-
পাকিস্তানিদের কর্তৃক কথিত ধর্ষণের পরেও তিনি তার পরিবারে কাছে পালিয়ে চলে যান নি, বরং অফিস করেছেন। ফেরদৌসী সেই সময় বন্দী ছিলেন না। বাসায় থাকতেন, অফিসে যেতেন, এমনকি ইচ্ছে হলে যশোর ক্যান্টনমেন্টে ঘুরে আসতেন। সেনারা তাকে সিনেমায় নিয়ে যেত, জেনারেল ম্যানেজারের বাসায় ডিনারে আমন্ত্রণ করতো, ফোন করতো…
[Losing the Victims: Problems of Using Women as Weapons in Recounting the Bangladesh War. P-3867]

এই পুরো প্রবন্ধ জুড়ে শর্মিলা বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন কয়েকটি পয়েন্ট।

* পাক সেনাদের হাতে ধর্ষণ একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা
* ধর্ষণ হয়েছে কিন্তু সংখ্যা খুবই কম।
* পাকিস্তানীদের পাশাপাশি অনেক বাঙালীও ধর্ষণ করেছিলো।
* অনেক বাঙালী নারী সেনাবাহিনীকে মনরঞ্জন করতে সম্মত ছিলো।

এরপর তিনি তার মনমত কিছু কেস স্টাডি দেখান। ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীর ঘটনাও তার মধ্যে অন্যতম। সবগুলো সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে সামনের পর্বগুলোতে। কিন্তু সবার আগে একটা জিনিস পরিস্কার করা দরকার আর সেটা হচ্ছে

পাকিস্তানীদের হাতে ধর্ষণগুলো কি নিতান্তই বিচ্ছিন্ন ঘটনা, না কি তাদের কোন সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিলো।

ঈমানী দায়িত্বঃ

স্বাধীনতার পর ধর্ষিতা বাঙালী মহিলাদের চিকিৎসায় নিয়োজিত অষ্ট্রেলিয় ডাক্তার জেফ্রি ডেভিস গনধর্ষনের ভয়াবহ মাত্রা দেখে হতবাক হয়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আটক পাক অফিসারকে জেরা করেছিলেন যে তারা কিভাবে এমন ঘৃণ্য কাজ-কারবার করেছিলো। অষ্ট্রেলিয় চিকিৎসক বিচলিত হলেও পাক অফিসারদের সাচ্চা ধার্মিক হৃদয়ে কোন রকম রেখাপাত ঘটেনি। তাদের সরল জবাব ছিলো,

“আমাদের কাছে টিক্কা খানের নির্দেশনা ছিলো যে একজন ভালো মুসলমান কখনই তার বাবার সাথে যুদ্ধ করবে না। তাই আমাদের যত বেশী সম্ভব বাঙালী মেয়েদের গর্ভবতী করে যেতে হবে।”
“We had orders from Tikka Khan to the effect that a good Muslim will fight anybody except his father. So what we had to do was to impregnate as many Bengali women as we could.”

ধর্ষণে লিপ্ত এক পাকিস্তানী মেজর তার বন্ধুকে চিঠি লিখেছে;

“আমাদের এসব উশৃঙ্খল মেয়েদের পরিবর্তন করতে হবে যাতে এদের পরবর্তী প্রজন্মে পরিবর্তন আসে, তারা যেন হয়ে ওঠে ভালো মুসলিম এবং ভালো পাকিস্তানী”
“We must tame the Bengali tigress and change the next generation Change to better Muslims and Pakistanis”

উপরের ঘটনা দুটো প্রচণ্ড তাৎপর্যপূর্ণ। এটা শুধুমাত্র নিম্নপদস্থ সৈনিকদের মানসিকতার প্রতিনিধিত্ব করছে। আর উচ্চপদস্থ অফিসারদের অবস্থা তো আর ভয়াবহ।

একাত্তরের সেপ্টেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানের সকল ডিভিশান কমান্ডারের কনফারেন্সে এক অফিসার তুলেছিলেন পাকিস্তানী সেনা কর্তৃক বাঙ্গালী নারীদের ধর্ষনের প্রসঙ্গ । নিয়াজী তখন সেই অফিসারকে বলেন, “আমরা যুদ্ধের মধ্যে আছি। যুদ্ধক্ষেত্রে এই ধরনের ঘটনাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিও।” তারপর তিনি হেসে বলেন, “ভালই তো এসব বাঙ্গালী রক্তে পাঞ্জাবী রক্ত মিশিয়ে তাদের জাত উন্নত করে দাও।”

আর এই ধর্ষণের পক্ষে তিনি যুক্তি দিয়ে বলতেন,

“আপনারা কি ভাবে আশা করেন একজন সৈন্য থাকবে,যুদ্ধ করবে, মারা যাবে পূর্ব পাকিস্তানে এবং যৌন ক্ষুধা মেঠাতে যাবে ঝিলমে?”

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার আবদুল রহমান সিদ্দিকী তার East Pakistan The EndGame বইতে আরও লেখেন,

“নিয়াজী জওয়ানদের অসৈনিকসুলভ, অনৈতিক এবং কামাশক্তিমূলক কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করতেন। ‘গত রাতে তোমার অর্জন কি শেরা (বাঘ)?’ চোখে শয়তানের দীপ্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন তিনি। অর্জন বলতে তিনি ধর্ষণকে বোঝাতেন।

পাকিস্তানী জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা “অ্যা স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি” বইতে লিখেছেন, নিয়াজী ধর্ষণে তার সেনাদের এতই চাপ দিতেন যে তা সামলে উঠতে না পেরে এক বাঙালি সেনা অফিসার নিজে আত্মহত্যা করতে বসেন।

এখানেই শেষ নয়।

ধর্ষণের অবিচ্ছিন্নতা প্রমাণের জন্য রয়েছে কিছু প্রামাণ্য ছবি,

“বেগ সাহেবের জন্য ভালো মাল পাঠাবেন। রোজ অন্তত একটা।” মাল বলতে এখানে বাঙালী মেয়েদের কথা বলা হয়েছে।

শর্মিলা বসু বারবার বলেছেন, পরিকল্পিত ধর্ষণ হয়নি, যা হয়েছে তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বীভৎস নির্যাতনর ব্যাপারটি সতর্কভাবে এড়িয়ে গেছেন শর্মিলা। এটিকে কি শর্মিলার opportunistic rape মনে হয়?

পাকিস্তানি হেরেম থেকে চার হাজার বাঙালি মেয়েকে পাওয়া নিশ্চয়ই বিচ্ছিন্ন ঘটনা শর্মিলা বসুর কাছে।

সিলেটের শালুটিকরে পাকিস্তানী ক্যাম্পের দেয়ালে ঐ নরপশুদের আঁকা কয়েকটি ছবির দিকে দৃষ্টিপাত করছি।

এর থেকে বড় প্রমাণ বোধহয় আর হয় না

আমাদের প্রতি নিঃসংশতার প্রামাণ্য দলিল

এবারে দৃষ্টিপাত করি আরও কিছু ঘটনার দিকে,
ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গ্রন্থ “যুদ্ধ ও নারী”তে উঠে আসে অনেক তথ্য যা পাঠকদের নিঃসন্দেহে আগ্রহ জোগাবে

“যুদ্ধ শেষে ক্যাম্প থেকে কয়েকটি কাঁচের জার উদ্ধার করা হয়,যার মধ্যে ফরমালিনে সংরক্ষিত ছিল মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন অংশ। অংশগুলো কাটা হয়ে ছিল খুব নিখুঁতভাবে।”
– ডাঃ বিকাশ চক্রবর্তী, খুলনা

“আমাদের সংস্থায় আসা ধর্ষিত নারীদের প্রায় সবারই ছিল ক্ষত-বিক্ষত যৌনাঙ্গ। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ছিড়ে ফেলা রক্তাক্ত যোনিপথ, দাঁত দিয়ে ছিড়ে ফেলা স্তন, বেয়োনেট দিয়ে কেটে ফেলা স্তন-উরু এবং পশ্চাৎদেশে ছুরির আঘাত নিয়ে নারীরা পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসতো।”
-মালেকা খান, যুদ্ধের পর পুনর্বাসন সংস্থায় ধর্ষিতাদের নিবন্ধীকরণে যুক্ত সমাজকর্মী।

“কোনো কোনো মেয়েকে পাকসেনারা এক রাতে ৮০ বারও ধর্ষণ করেছে।”
-সুসান ব্রাউনি মিলার (এগেইনেস্ট আওয়ার উইল: ম্যান, উইম্যান এন্ড রেপঃ ৮৩)

এই সব খণ্ড খণ্ড জবানবন্দী এই কথাই প্রমাণ করে যে মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণ সাধারন কোন যুদ্ধের ধর্ষণ নয়। এটা পাক বাহিনী শুধুই প্লেজারের জন্য করে নাই, তারা এটা করেছে দায়িত্ব বোধ থেকে। শুধু প্লেজারের জন্য বেয়নেট দিয়ে যোনি পথ খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করতে হয় নয়া, দাঁত দিয়ে স্তন ছিঁড়ে ফেলতে হয় না, দু দিক থেকে পা টেনে চিঁরে ফেলতে হয় না, একজনকে আশিবার ধর্ষণ করতে হয় না।

খুলনার একটি ক্যাম্প থেকে যখন কাচের জারে ফরমালিনে সংরক্ষিত ছিল মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন অংশ পাওয়া যায় খুব নিখুঁতভাবে কাঁটা। যখন সিলেটের দেয়ালে ধর্ষকেরা সদম্ভে এঁকে রেখে যায় নিজেদের কৃতকর্ম, তখন বুঝে নিতে হয় এই ধর্ষণ দু’একজন সামরিক কর্মকর্তার বিচ্ছিন্ন মনোরঞ্জন নয়। তখন বুঝতে হয় তারা এসব করেছিলো একটা এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে, আর সেই এজেন্ডার কথা সৈয়দ সামসুল হক তার কালজয়ী নিষিদ্ধ লোবান উপন্যাসে লিখেছেন সবচেয়ে সুন্দর করে।

“আমি তোমায় সন্তান দিতে পারব। উত্তম বীজ উত্তম ফসল। তোমার সন্তান খাঁটি মুসলমান হবে, খোদার ওপর ঈমাণ রাখবে, আন্তরিক পাকিস্তানী হবে, চাওনা সেই সন্তান? আমরা সেই সন্তান তোমাদের দেব, তোমাকে দেব, তোমার বোনকে দেব, তোমার মাকে দেব, যারা হিন্দু নয়, বিশ্বাসঘাতক নয়, অবাধ্য নয়, আন্দোলন করে না, শ্লোগান দেয় না, কমিউনিস্ট হয় না। জাতির এই খেদমত আমরা করতে এসেছি। তোমাদের রক্ত শুদ্ধ করে দিয়ে যাব, তোমাদের গর্ভে খাঁটি পাকিস্তানী রেখে যাব, ইসলামের নিশানা উড়িয়ে যাব। তোমরা কৃতজ্ঞ থাকবে, তোমরা আমাদের পথের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তোমরা আমাদের সুললিত গান শোনাবে… ”

– নিষিদ্ধ লোবান, সৈয়দ শামসুল হক

পরবর্তি পর্বে আমরা কথা বলবো ডাক্তার জেফ্রি ডেভিসকে নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের পরপরই যাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়েছিলো বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অনুরোধে ১৯৭২ সালে। ধর্ষিত বীরাঙ্গনাদের চিকিৎসা এবং গর্ভপাতের জন্য। তার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন তিনি বলেছেন বাংলাদেশ চার লক্ষাধিক মহিলা এবং শিশুকে ধর্ষণের কথা, সরকারী হিসাবের ত্রুটি নিয়ে কথা বলেছেন। এছাড়া কথা বলবো সুসান ব্রাউনি মিলারের এগেইনেস্ট আওয়ার উইল: ম্যান, উইম্যান এন্ড রেপ বইটা নিয়ে।

এই লেখাটা শুরু করা ছিলো আমার অনেকদিনের স্বপ্ন। পোষ্ট গুলোতে নির্মোহ থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।

লেট দ্যা ডেটা স্পিক…

দ্বিতীয় পর্বঃ

তৃতীয় পর্বঃ