আগামী কয়েক শতাব্দীতেই হয়তো বিজ্ঞানীরা মানুষের দেহের মতো সংবেদনশীল রোবট তৈরি করতে সমর্থ হবে; অবশ্য পরক্ষণেই আশাহত হয়ে দেখবে সাড়ে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে কানায় কানায় পূর্ণ বাঙালিরা অনেক আগেই পরিপূর্ণ রোবট হয়ে বসে আছে! নদীমাতৃক, পলিবিধেৌত এ ব-দ্বীপের “কাদা মাটির মতো নরোম মন” সমৃদ্ধ মানুষের থেকে হর রোজ একটু একটু করে আবেগ যেনো উদ্বায়ী পদার্থের মতো মহাশূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে! তা না হলে আমাদের আশপাশে এতো কিছু ঘটে যাবার পরেও আমরা দিব্যি খেয়ে-পড়ে বেঁচে আছি কী করে!

যখন এ ব্লগটি লিখতে বসেছি তখন ফেসবুকের লাস্ট ইস্যুর “অর্ধায়ু” পেরিয়ে গেছে! আরেকটি শোরগোল তোলা ইস্যু এখনো আসেনি বলে অবশ্য এখনো এখানে ওখানে এ নিয়ে কদাচ আলোচনা হচ্ছে। গত কয়েকদিন এ ইস্যুতে ফেসবুক ভালোই সরগরম হলো। দিন পার হতে থাকলো, সেই সাথে মানুষের এ ইস্যুতে “চিল্লাপাল্লা”ও কমতে থাকলো।

বলছিলাম একাত্তরের অন্যতম যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর দেলওয়ার হোসেন সাইদির আপিলের রায় ঘোষণার ব্যাপারে। এ ব্যাপারে কথা বলতে গেলে অনেকেই সামনে নিয়ে আসেন “আদালত অবমাননা” নামক একটা টার্মের যার মোদ্দাকথা হলো আদালতের রায়ের ব্যাপারে অসন্তোষ জানানো যাবে না (রায়ের ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে)। অথচ গত বছরের সেপ্টেম্বরে আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩(সংশোধনী) এর আটটি ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করা হলে মহামান্য হাইকোর্ট শুনানি শেষে পুরো আইনটিকে বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করেছেন।

এক্ষেত্রে একটা বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে, অবমাননা ও সমালোচনা কিন্তু এক নয়। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের যে কোনো ব্যাপারে গঠনমূলক সমালোচনা করার অধিকার আমার নিশ্চয় আছে…
(অবশ্য আদালত অবমাননার পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে প্রচণ্ড রকমের গোলমেলে বলে মনে হয়। :-X )

যাহোক, যে যাই বলুক আমার মতে এ রায়ে সাইদি তথা জামাতের এক প্রকার বিজয়ই হয়েছে। এ রায়ের প্রভাব যে কতটা সুদূরপ্রসারী হতে পারে সেটা বোধ করি আমরা চিন্তাও করতে পারছিনা! সাঈদীর রায় প্রসঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যতই বলুন, “সাঈদী মানুষের মধ্যে নিজেকে ধর্মপ্রচারক ও ধর্মগুরু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এ রায়ের ফলে তাঁর যুদ্ধাপরাধ প্রমাণ হয়েছে। মুখে ভালো কথা বললেও ব্যক্তিগতভাবে সাঈদী যে কত বড় জঘন্য, তা দেশবাসী জানতে পেরেছে।” আসলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষশক্তির এক প্রকার পরাজয়ই হয়েছে এ রায়ের মধ্য দিয়ে। সাইদির বর্তমান বয়স ৭৪ বছর। যদি ১০ বছর পরেও সে কোনোভাবে জের থেকে ছাড়া পায় তাহলে এদেশের মুমিন সমাজে তার স্থান আল্লামা শফীরও উপরে হবে। আল্লামা শফীর নামের পেছনে “ওয়াজ শুনিয়ে হিন্দু থেকে মুসলিম বানানো”র কোনো তকমা লাগানো আছে বলে আমার জানা নেই কিন্তু মুসলমানদের চরম আকৃষ্টকারী এ তকমাটি সাইদির নামের সাথে বেশ ভালোভাবে সেঁটে আছে। শঙ্কার কথা হলো বাদবাকী সব রাজাকার মিলেও দেশে যতটা না বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারবে এক সাইদি তার চেয়ে বেশি করতে পারবে কেবল তার ধর্মীয় গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে। এক্ষেত্রে ৫ ই মে তে শাপলা চত্ত্বর বিভীষিকার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। সেদিনের আগপর্যন্ত আল্লামা শফী কিংবা ক্বওমীদের ব্যাপারে অতটা গা কিন্তু কেউই করেনি; বিপদ যখন সমাসীন তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিলো। শঙ্কার উপর শঙ্কা- সাইদির অনুসারীরা আবার ক্বওমীদের চাইতে এক ডিগ্রি বেশি উগ্র…

সাইদির রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সবচচাইতে বেশি যে শব্দটি উচ্চারিত হয়েছে তা সম্ভবত “আঁতাত।” অবশ্য ফেসবুকে দলকানারা “ফাঁসি বহাল রাখলে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতো” , “আদালত রায় দিয়েছে, এখানে সরকারের কোনো হাত নেই” টাইপের হাস্যকর যুক্তি দিয়ে ছিদ্র ভরার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে কেউ যদি তাদের যুক্তি অনুসরণ করেই বলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেয়ার মাধ্যমে “জানমালকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন” তবে সেটা কেমন শোনাবে?!! :-s
অপরদিকে যেখানে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া বলতে গেলে দেশ অচল (গুগলে “প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ” লিখে সার্চ দেয়ার প্রেক্ষিতে সার্চ রেজাল্ট) দেখলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে) সেখানে এতো বড় একটা রায় স্বাধীনভাবে হয়েছে এটা মেনে নেয়া বেকুবি। তাছাড়া সরকারের হাত যদি নাই থাকে তাহলে প্রশ্ন আসবে গত বছরের ১২ ই ডিসেম্বর কাদের মোল্লার ফাসিঁর রায়ে দলকানাগণ ট্রাইব্যুনাল বা বিচার বিভাগের নামে যতটা না প্রশস্তি গেয়েছে তার শতগুণ প্রশস্তি “লেৌহমানবী” শেখ হাসিনার নামে গেয়েছিলো কেনো??

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের কথা বাদ দিলাম (যদিও যেসব অপরাধে তাকে খালাস ও আমৃত্যু দণ্ড দেয়া হয়েছে এ রায়ের পর বাংলায় আর কোনো ফাসিঁর আদেশ হওয়ার কথা নয়!)! সাইদীকে সনাক্ত করে সাক্ষী দেয়ার অপরাধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী গোলাম মোস্তফাকে ঘরের সিঁধ কেটে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গোলাম মোস্তফার স্ত্রী স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে তাঁকেও কুপিয়ে আহত করে সেই চেনা শত্রুরা।

গোলাম মোস্তফা ছিলেন বিশবালী হত্যা মামলায় আট নাম্বার সাক্ষী। আদালতে উপস্থিত থেকে আসামী সাইদীকে সনাক্ত করেন তিনি এবং একই সাথে এই হত্যা মামলা সাইদী জড়িত থাকার পক্ষেও সাক্ষ্য দেন তিনি। সেই বিশাবালী হত্যা মামলায়ই সাইদীর মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলো নিম্ন-আদালত, আর সেই শাস্তিকে অযৌক্তিক বিবেচনা করে শাস্তি কমিয়ে আমৃত্যু কারাদন্ড দিয়েছে আপীল বিভাগ। কী প্রহসন!!

এসবকিছুও বাদ দিয়ে একটু ঘুরে আসি নিহত গোলাম মোস্তফার পরিবারের কাছ থেকে। এই রায়ের পর তাঁর পরিবারের কি কিছুর বলার আছে?! মোস্তফা ছিলেন সেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি, তাঁকে হত্যার পর তিন মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে তাঁর স্ত্রীর। কেউ তাঁদের পাশে নেই। গোলাম মোস্তফার মৃত্যুর পর তাঁর ছোট ছেলে হাফিজুল বাজারে একটা ছোট চায়ের দোকান দেয়। এখনো নিয়মিত হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে তাকে। রায়ের আগের দিন পুলিশের হেফাজতে রাখা হয়েছিলো হাফিজুলকে।

গোলাম মোস্তফা মারা যাবার পর পাড়েরহাট বন্দরে ছোট চায়ের দোকানের আয়েই কোনো রকমে সংসার চলছে। কিন্তু রায়ের পরবর্তী সহিংসতার আশংকায় কয়েকদিন সেই চায়ের দোকান বন্ধ থাকায় তাঁদের খাবারের বন্দবোস্ত হয়নি। এসবকে কী বলবেন??

আমি শেখ হাসিনা তথা আওয়ামীলীগের যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনার প্রক্রিয়াকে আন্তরিকভাবে সাধুবাদ জানাই এবং এ কারণে আজন্ম কৃতজ্ঞ থাকবো দলটার প্রতি কিন্তু এটা ভোলাও মনে হয় সম্ভব হবে না যে, কোটি মানুুষের আবেগ নিয়ে, চেতনা নিয়ে রাজনীতি করেছে যে দলটা সেটার নামও আওোয়ামীলীগই।

“রোম যখন পুড়ছিলো, রোম সম্রাট নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলো”, এর বাংলাদেশি সংস্করণটা দেখি – “দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ রহিত করে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ অনলাইন ও চায়ের কাপে ঝড় তুলতেছিল তখন বাংলাদেশের হিরো শেখ হাসিনা সেই দিন জাতীয় সংসদে বিচারপতিদের মুখে “গোমোই” পড়ানোর জন্য আইন পাশ করিতেছিল।”

শহরে বেড়ে উঠা প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা জানে না গোমোই কি বস্তু। খায় না মাথায় দেয়! গ্রাম বাংলায় গরু-মহিষকে হাল চাষ করার জন্য অন্যের খেতের আইল দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় ডানে-বাঁয়ে অন্যের ধান খেত থেকে দুই-চারটা কামড় দেয়। ফলে এক কৃষকের সাথে অন্য কৃষকের ঝগড়া লেগে যায় হর-হামেশা। তাই নিজের খেতে না যাওয়া পর্যন্ত বেয়াড়া গরু-মহিষের মুখ বন্ধ রাখার জন্য কৃষক গরু-মহিষের মুখে এক ধরনের মুখোস পড়িয়ে রাখেন যাতে করে তারা অন্যের শস্য খেয়ে কৃষককে বিব্রতকর অবস্থায় না ফেলেন।

গোমোইকে তুলনা করা যেতে পারে পশ্চিমা বিশ্বে বাচ্চা শিশুদের মুখ বন্ধ রাখার একটা খেলনা (Baby pacifiers) এর সাথে; যা বাচ্চাদের মুখে পুরে দেওয়া হয় যাতে করে বাচ্চার বাবা-মায়ের দেওয়া খাদ্য ব্যতীত অন্য কিছু মুখে দিতে না পারে। একই সাথে উচ্চস্বরে কান্না করে অন্যদের সামনে বাবা-মাদের বিব্রতকর অবস্হায় না ফেলে।

নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের মামলার সবকিছু জানার পরে র‌্যাব অফিসারদের নিজ নিজ বাহিনী থেকে অবসর কালীন পূর্ণ সুবিধা দিয়ে যখন পুরা ব্যাপারটা ধামা-চাপা দিয়ে ফেলা গেছিলো ঠিক তখন হাই কোর্টের দুই বেয়াড়া বিচারক কাটা ঘায়ে লবণের ছিটা দিয়ে রুল জারি করল র‌্যাবের কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করার জন্য সেই সাথে রাষ্ট্র পক্ষকে নির্দেশ দিল প্রত্যেক সপ্তাহে তদন্তের অগ্রগতি জানানোর জন্য। সুতরাং কৃষক যেমন বেয়াড়া গরু-মহিষের মুখ বন্ধ রাখার জন্য গোমোই পড়ায় তেমনি বেয়াড়া বিচারকদের মুখ বন্ধ রাখতে তাদের মুখেও গোমোই পড়ানোও হয়ে গেলো। একে বোধহয় বলা যায় এক ঢিলে দুই পাখি!

মাঝেমধ্যে গণজাগরণকে ফ্যালাসি বলে মনে হয়! রাজাকার যারা কীনা এদেশটাই চায়নি তাদের বিচারের জন্য কেনো সবাইকে রাস্তায় নেমে কয়েক মাস আন্দোলন করতে হবে? আন্দোলন করে রাজাকারের প্রাপ্য সাজা “আদায়” করে নিতে হবে? দ্বিতীয়বার আদায় করতে গেলে গরম জলের ঝাপটা আর পুলিশের পিটুনি খেতে হবে? দেশ কি এখনো পূর্ব পাকিস্থান? নাকি ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায়?

আমাদের সবচাইতে বড় সমস্যা হলো, আমাদের জনগোষ্ঠী এখনো খুব চড়া মানের কুসংস্কারবাদী। এরা মোটেই শিক্ষিত না। এদের হয়তো কারো ডিগ্রী আছে, তবে লাইট ও ডার্কের মধ্যে পার্থক্য করতে এরা শিখে নি। এদের মধ্যে নিম্ন শ্রেনির আবেগ যথেষ্ট আছে, যা কাজে লাগিয়ে যেকোনো চেতনাবাদি বা মৌলবাদী দল এদের দিয়ে যেকোনো কিছু করিরে নিতে পারবে। যে দেশের মানুষ ফিজিস্কে ডক্টরেট ডিগ্রী নিয়ে, চাঁদের ফাটল নিয়ে বা ফেরাউনের লাশ কেন পঁচে না এসব নিয়ে প্রবন্ধ লিখবে, সে দেশের কিছু মানুষকে স্বাধীনতার ৫০০ বছর পরেও রাজাকারের বিচারের জন্য আন্দোলন করতে হবে।

বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ সজল কুমার দাস ও হিমাংশু কর