বাংলাদেশের পাঠক পাঠিকারা , মূলত নাস্তিকরা -এই প্রশ্ন আমাকে প্রায় করেন। বাংলাদেশে নাস্তিকতার ভবিষ্যত কি?

বাংলাদেশ বা এই বাংলা ঐতিহাসিক ভাবেই উদার সমাজের উত্তরাসূরী। সহজিয়া এই মাটির সূর। রবীন্দ্রনাথ, লালন সাঁই, নজরুল এই গৌরবাজ্জ্বল উত্তরাধিকারের শ্রেষ্ঠ সন্তান।

কিন্ত গত দুই বছরে বাংলাদেশের নাস্তিকরা যেভাবে তাদের দেশে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন-রাষ্ট্রযন্ত্রের কায়েমী স্বার্থ আসিফ মহিউদ্দিনের মতন ব্লগারদের জেলে ঢুকিয়েছে-খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাদের মনে অনেক ভয়। সংশয়। যুক্তি বুদ্ধিতে অবিচল থেকে পথ চলা যেন বর্ষার অমবশ্যার রাতে কাদায় পা রাখা। কখনো না জানা খাদ, কখনো উঁচিয়ে আছে সাপ। কল্লাকাটা মৌলবাদি সাপের ছোবল নিয়ে যায় রাজীব হায়দারের মতন তরুন যুক্তিবাদিদের জীবন। অহল্যার অভিশপ্ত জীবন-সাপমোচনে অপেক্ষায় দিন গুজরান। অনেকেই হতাশ। আশা হারাচ্ছেন।

আমি বাংলাদেশীও নই-সমাজবিজ্ঞানীও নই। তাই বাংলাদেশে নাস্তিকতার ভবিষ্যত নিয়ে লেখা অনেকটা অনধিকার চর্চা। কিন্ত আমার চোখ কান খোলা. ইতিহাস ঘাঁটা। প্রযুক্তিবিদ হওয়ার কারনে ভবিষ্যত দেখার সুযোগটা আরেকটু বেশী। সেই অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই লিখছি। যেটা মনে হচ্ছে ঠিক-সেটাই লিখছি।

(১) সমাজ উদার হবে না কট্টর পন্থী-এর ভিত্তি উৎপাদন কাঠামো। এবং ইতিহাস। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বিবর্তন না বুঝলে, ভবিষ্যতবাণী সম্ভব না।

বাংলাদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে-যার আবার অধিকাংশ জল- ষোল কোটি লোকের সংস্থান অসম্ভব। বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত সেই দিকেই যাবে যেদিকে জমি প্রতি উৎপাদন বেশী।

বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পের উদ্ভব এবং কৃষি থেকে আস্তে আস্তে মেশিন নির্ভর কুটির শিল্পের বিকাশ– কৃষি শ্রমিক থেকে শিল্প শ্রমিকের বিবর্তনের গল্প। যা অন্যান্য দেশেও হয়েছে অতীতে। একটা দেশ যখন কৃষি থেকে আস্তে আস্তে শিল্পের দিকে এগোতে থাকে- প্রকৃতির নিয়মেই সেই সমাজে আস্তে আস্তে ধর্মের গিঁট ঢিলা হতে থাকে।

ক) শিল্প শ্রমিক মূলত নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির জন্ম দেয়-যারা অনেকটাই স্বাধীন স্বতন্ত্র জীবন ( অন্তত গ্রামের থেকে) কাটাতে সক্ষম

খ) মহিলা শ্রমিকের উদ্ভব-আরেকটি গুরুত্বপূর্ন সামাজিক বিপ্লব-যা মৌলবাদকে অনেকটাই রুখতে সাহায্য করবে। শরিয়ার বিরুদ্ধে সব থেকে সরব সমর্থন আসবে মহিলা শ্রমিকদের কাছ থেকেই। ইসলামের থেকে পেট, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ন এদের কাছে।

গ) শিল্প শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়ানোর প্রয়োজনেই-সমাজে “স্কিল” এর গুরুত্ব বাড়বে। “স্কিল” অর্জন করা সমাজের ফোকাস হলে-সেই সমাজ ইহকালের “স্কিল” এবং তার থেকে কি করে উপায় বাড়ানো যায়-সেই চিন্তাতে চলবে। নতুন বাংলাদেশ জাভা, পি এচ পি শিখতে যতটা আগ্রহী হবে-ধর্মের ব্যাপারে অতটা আগ্রহ থাকতে পারে না। ব্যাতিক্রম থাকতেই পারে।

তবে আজ বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পের যে রমরমা, সেটা-আর খুব বেশী হলে চলবে আগামী কুড়ি বছর। অটোমেশনের ফলে আমেরিকাতে পোষাক তৈরী করা আস্তে আস্তে বাংলাদেশ থেকে আমদানীর চেয়ে লাভজনক হবে। বর্তমানে থ্রি ডি অটোমেশনের দৌলতে একজন লোকের থ্রিডি মডেল জানা থাকলে, তার মাপের একদম ফিট পোষাক, মেশিন থেকে অটোমেটিক বার করা কোন সমস্যাই হবে না। ফলে বাংলাদেশের দরকার হবে নতুন জীবিকার। নতুন শিল্পের।

এই দুই দশকের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যান্য আধুনিক জীবিকার দিকে ঝুঁকবে। যেমন সফটওয়ার প্রোগ্রামিং, বিপিও, কেপিও, বায়োটেক ইত্যাদি।

বাংলাদেশে বৃহৎ পুঁজি নেই। বিদেশীরাও বিনিয়োগে ভয় পায়। এর ভাল দিকটাই বেশী। এর কারনে বাংলাদেশে এই নব্য আই টি ফিল্ডে অসংখ্য ছোট ছোট উদ্যোগী। এই মার্কেটে টিকে থাকতে গেলে, একদম লেটেস্ট “স্কিল” দরকার। ভারতের ইনফোসিস, টিসিএসের একটা বড় অংশই ২০ বছরের পুরাতন আই বি এম মেইন ফ্রেইম -ইত্যাদি মেইন্টেনেন্সের কাজ করে। বাংলাদেশের এই সব ছোট কোম্পানীগুলিকে টেকার একটাই পথ। লেটেস্ট এন্ড গ্রেটেস্ট স্কিল। মূলত ওপেন সোর্স প্রোগ্রামিং স্কিল ছোট কোম্পানীর ব্যবসার জন্য ঠিকঠাক। এই জন্য বাংলাদেশের আই টি মার্কেটে বুদ্ধিমান, দক্ষ প্রগ্রামারদের দড় বাড়বে। পৃথিবীর সর্বত্রই এই শ্রেনীর বুদ্ধিমান প্রোগ্রামাররা লিব্যারাল সমাজের অংশ। যাদের মাথায় বুদ্ধি আছে, মহম্মদের কাল্পনিক চরিত্রদিয়ে তাদের বুদ্ধু বানানো মুশকিল। অর্থনীতির নিয়মে বাংলাদেশে এদের সংখ্যা আস্তে আস্তে বাড়বে। টাকার জোরে বাড়বে এদের সামাজিক প্রতিপত্তি, ইনফ্লুয়েন্স।

সব থেকে বড় কথা-এই উন্নত অর্থনীতির শরিক হতে গেলে আগের মত-জাস্ট ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি আছে যথেষ্ঠ না। মাথায় বুদ্ধি এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতাও থাকতে হবে। গয়ংগচ্ছ জ্ঞানে চলবে না। আমি জানি অনেকেই বলবেন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে মৌলবাদি বেশী। সেটা আস্তে আস্তে কাটবে,বিশেষত ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে। কারন চোখ কান খোলা রাখলে দেখা যায় এই সব গয়ংগচ্ছ ইঞ্জিনিয়ারদের, মধ্যমমেধার উচ্চডিগ্রীধারীদের মধ্যেই মৌলবাদের প্রভাব বেশী। সেটা কমবে-কারন ডিগ্রির মূল্য হবে অর্থহীন। অটোমেশনের যুগে যেখানে প্রোগ্রাম ও লিখে দেবে মেশিন-সেখানে মানুষ তার বুদ্ধির সেরাটা না দিলে, চাকরিই পাবে না।

এই বৌদ্ধিক বিকাশ হবে মার্কেটের দাবী। এবং কে না জানে-এই যুগে মার্কেটের শক্তিই সর্বশক্তিমান। মানুষের মনে বুদ্ধির বিকাশ হলে, সে আধ্যাত্মিক থাকতেই পারে। কিন্ত কৃষ্ণ মহম্মদের গাঁজাখুরী গল্পে বিশ্বাস করবে না।

(২) দ্বিতীয় আশার কারন রাজনীতি। বাংলাদেশ ভারত বেষ্ঠিত। ভারতের স্বার্থের বিরোধি কিছু হওয়া বাংলাদেশে মুশকিল। এর ভাল খারাপ দিক দুটোই আছে।

ভালটাই লিখি। সেটা হচ্ছে ভারতের কারনে মৌলবাদিদের প্রতি আমেরিকার ফোকরদালালি বাংলাদেশে চলবে না। সেটা সাম্প্রতিক ইতিহাসে সুস্পষ্ট। বি এন পি কোন সাহসে ভোট বয়কট করেছিল ? তার ধারনা ছিল, আমেরিকাতে লবিস্টদের টাকা ঢেলে, তারা হাসিনার বৈধতা নষ্ট করবে। আমেরিকা অদ্ভুত জাত। অদ্ভুত এই ডিসির রাজনীতি। এখানে টাকা দিয়ে সেনেটর কেনা বৈধ ব্যবসা। পোষাকি নাম লবিং। বি এন পির লবিস্টরা আমেরিকা, ইংল্যান্ডকে দিয়ে এই নির্বাচনের বিরুদ্ধে নেতিবাচক স্টেটমেন্ট বাড় করেছিল। কিন্ত ভারতের বিরোধিতায় সফল হয় নি সেই চক্রান্ত। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে কখনো যাবে না আমেরিকা বা ইউরোপ। কারন ভারতের বিশাল মার্কেটের টান। ফলে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের মৌলবাদিরা চেকমেট। তাদের পক্ষে পাকিস্তান। মধ্যপ্রাচ্যও যাবে না ভারতের বিরুদ্ধে যেহেতু ভারত তাদের তেলের বৃহত্তম ক্রেতা। সব কাটাকুটি-সাপ লুডো শেষ। পড়ে রইল পাকিস্তান!

সাধে ম্যাডাম জিয়া দিল্লীতে গিয়ে নাকখঁত দিয়ে বিজেপি নেতাদের দূর্গাপূজোতে বাংলাদেশে আমন্ত্রন দিয়েছেন? উনিও বুঝছেন দিল্লীর কৃপা না হলে, তারপক্ষে মসনদ ফিরে পাওয়া মুশকিল!

(৩) তৃতীয় আশার কারন ডেমোগ্রাফি এবং শিক্ষা । বাংলাদেশের ফার্টালিটি রেট এখন দুই দশমিক পাচ। অর্থাৎ মা প্রতি আড়াই জন সন্তান । পঁচাত্তর সালে এটা ছিল ৬ এর কাছাকাছি। মাত্র তিন দশকে ! শিশুশিক্ষা এবং শিশুমৃত্যর হার কমাতে বাংলাদেশ ভারতের চেয়েও বেশী সফল। ফ্যামিলি সাইজ দুই এর কাছে হলে, বাবা মা ছেলে মেয়ের শিক্ষার প্রতি যত্নবান হবেই, তারা চাইবেন ছেলে মেয়েদের জন্য ভাল জীবিকা।

ছেলে মেয়ে থাকুক দুধে ভাতে-এই চাওয়াটা উদার সমাজের ভিত্তিভূমি। কারন এখান থেকেই বস্তুবাদি, যুক্তিবাদি মননের শুরু। ছেলেমেয়ে আছে ১০ জন-খাওয়ানোর ক্ষমতা নেই। পড়ানো দূরের কথা। সুতরাং আল্লা জানে, আল্লা খাওয়াইবে-এই ধরনের চিন্তা থেকেই ভাববাদ-সেখান থেকে মৌলবাদ আরো বেশী গভীরে ঢোকে।

ছেলে মেয়েকে দুধে ভাতে রাখতে সমাজ চাইবে উন্নততর শিক্ষা, উন্নত অর্থনীতি। তারা ভালোই জানে মৌলবাদি সমাজে এসব পাওয়ার না।

(৪) চতুর্থ কারন পরিবেশ বিপর্যয়। বাংলাদেশে ভূর্গভস্থ জলের অবস্থা খারাপ। আর্সেনিকে ভর্তি। বরিশালের জলে নুন। আস্তে আস্তে বাংলাদেশের অনেক জমিই বসবাসের অযোগ্য হবে। এই টুকু মাত্র দেশ। এত লোক। যাবে কোথায়? খাবে কি?

পরিত্রানের উপায় কি? উপায় একটাই। আরো বেশী বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি নির্ভর সমাজ। যে সমাজ শিখবে জল বাঁচাতে, বৃষ্টির জল বাঁচাতে-আর্সেনিক মুক্ত করতে ফিল্টারিং করতে। বিজ্ঞান কখনোই বই পড়ে জীবনে আসে না। তা আসে জীবনের সাথে যুক্ত হলে। শ্রেফ বেঁচে থাকার জন্য বাংলাদেশের মানুষ বাধ্য হবে আস্তে আস্তে বিজ্ঞানভিত্তিক জীবনে ঢুকতে।

(৫) পঞ্চম কারন- যৌন জীবনের নয়া বিন্যাস। এই ফেসবুকে যুগে, মোবাইলের যুগে ছেলে মেয়েদের মেলামেশা বোরখা দিয়ে আটকানো যায়? বোরখা দিয়ে বুকের খাঁজ কাটকানো যায়-কিন্ত ফেসবুক আর মোবাইলে বুকের হৃদপিন্ডের আদান প্রদানের সুযোগ ত কেও আটকাতে পারবে না!! কোন মেয়ে চাইবে মৌলবাদি বর ? পার্টনার সিলেকশনের প্রশ্নে কেও হয়ত নাস্তিক ছেলে বা মেয়ে নাও পছন্দ করতে পারে-কিন্ত মৌলবাদি দের ও কেও পছন্দ করবে না প্রেমের এই ওপেন মার্কেটে। প্রকৃতির নিয়মে এখানে উদার মনের ছেলে মেয়েরাই জিতবে। এখন হয়ত একজন মৌলবাদির বিয়েতে অসুবিধা হয় না। বোরখা পড়া বিবি জুটেই যায়। আর কবছর বাদে জুটবে না। সেটা হবে মৌলবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে সব থেকে বড় প্রতিরোধ।

সমাজ, তার চাহিদা বদলায় দ্রুত। বিবর্তন হয় সেই দিকে-যেদিকের উৎপাদন শক্তি বেশী। সবাই ভাল থাকতে চায়। এই চাওয়াটাই বস্তবাদি উদার সমাজের ভিত্তি। বাংলাদেশ সেই দিকেই এগোচ্ছে। আস্তে না-দ্রুত। মৌলবাদ ধ্বংসের ক্ষেত্রে হয়ত ভারতকেও দ্রুত ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ।