শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে একবার আমার এক বন্ধু – সহপাঠী আমাকে ঢাকায় বেড়াতে যাওয়া প্রসঙ্গে এক অদ্ভুত প্রশ্ন করেছিলেন। আমার এই বন্ধু টি ভারতের গোয়ালিয়র এর মানুষ এবং আস্তিক ধরনের হিন্দু ব্রাহ্মণ।গোয়ালিয়র এর হিন্দু বা সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষদের বিষয়ে আমার কোনও বিশেষ ধারণা নেই। তবে আমার এই বন্ধুটি কোলকাতার বাঙ্গালীদের কে বলতেন “বঙ্গালী বাবু” অর্থাৎ একটা আকার বাদ দিয়ে। আরো বলতেন “বঙ্গালী বাবুরা” নাকি খুব সিরিয়াস এবং সেন্টি ধরনের। ভারত বিশাল দেশ, তাঁদের এক প্রদেশের মানুষই আরেক প্রদেশের মানুষ সম্পর্কে খুব ভালো করে জানেন না। আর সাংস্কৃতিক পার্থক্য তো আছেই।
এই ভদ্রলোক ধরা যাক তার নাম “ডাক্তার এক্স”, একজন বিশেষজ্ঞ চিকিতসক এবং ভারতীয় নৌবাহিনীতে চিকিতসক হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি একটু আক্ষেপ করে বললেন, বাংলাদেশ ভারতের সীমান্তে বহুবার তিনি জাহাজে করে গেছেন কিন্তু বাংলাদেশের কোনও শহরে ঘুরতে যাওয়া হয়নি। আমি তাঁকে বলেছিলাম – তুমি ঢাকা বা চট্রগ্রাম দিয়ে শুরু করতে পারো। এর পর পরই তিনি তাঁর বিস্ময়কর প্রশ্ন টি ছুঁড়ে দিলেন আমার প্রতি – তার সাথে আমার ইংরাজিতে আলোচনা টি বাংলায় তরজমা করলে প্রায় এই রকমের দাঁড়ায় –
ডাক্তার এক্সঃ “আচ্ছা আমি কি ঢাকা গেলে যেকোনো রেস্টুরেন্ট এ খেতে পারবো?”
আমি – সরি, আমি তোমার প্রশ্ন বুঝতে পারিনি, তোমার ওয়ালেট এ টাকা থাকলে অবশ্যই তুমি যেকোনো রেস্টুরেন্ট এ খেতে পারবে।
ডাক্তার এক্সঃ না আমি আসলে জিজ্ঞাসা করছি, খাবার আগে কি আমাকে নিজের পরিচয় নিশ্চিত করতে হবে? মানে, আমি ভারতীয় এবং হিন্দু, ঢাকায় কি হিন্দুরা সকল রেস্টুরেন্ট এ খেতে পারে?
এই প্রশ্ন টা শুনে আমি যারপর নেই বিস্মিত হয়েছিলাম। আমাদের ছোট বেলায় আমাদের থানা শহরে এবং জেলা শহরে “আদর্শ হিন্দু হোটেল” ধরনের কিছু খাবার ছিল বটে, যেখানে নিরামিষ ভোজী হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা খেতে যেতেন বা খেতে পছন্দ করতেন। কিন্তু অন্তত এই সময়ে কোনও হোটেলে খাবার আগে নিজের ধর্ম পরিচয় দিতে হবে এ আমি শুধু নই, সম্ভবত আমার বাবাও শোনেননি। যদি এরকমটা কখনও হয়ে থাকে, তা সন্দেহাতীত ভাবে একটি বিরল ঘটনা। আমি তাঁকে তাঁকে বললাম –
আমি – এটা তোমার ভুল ধারণা, খুবই ভুল ধারণা। আমি জানিনা ভারতে ভিন্ন ধর্মের মানুশকে এটা করতে হয় কিনা, কিন্তু বাংলাদেশে বা ঢাকায় আমি এ ধরনের কোনও ঘটনার কথা একটিও শুনিনি।
ডাক্তার এক্সঃ না , ইয়ে মানে আমি বলতে চাচ্ছিলাম, ওরা কি নিরামিষ মেনু বিক্রি করে?
আমিঃ করে, এবং নিরামিষ এর লম্বা তালিকা তুমি পাবে, আমি নিশ্চিত নই একদম গোয়ালিয়র এর রান্না তুমি পাবে কিনা, তবে নিরামিষ – সবজী জাতীয় খাবার তুমি অনেক পাবে। খাবার নির্বাচনের জন্যে কখনও তুমি আলাদা করে মেনুলিস্ট পাবে অথবা কেউ একজন তোমাকে মুখে বলে দেবে। খাবার পছন্দ করার দায়িত্ব যেহেতু তোমার নিজের, তাই তোমার ধর্ম নষ্ট হবার ও কোনও সমস্যা নেই।
ডাক্তার এক্সঃ না না, আমি আসলে তা মিন করিনি … ! আমার ধারণা ছিলো, বাংলাদেশ একটা মুসলিম দেশ তো …
আমিঃ হা…হা…হা… বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ, মুসলিম দেশ নয়। আমার ধারণা এশিয়ার মুসলিম প্রধান দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামিক দেশগুলর মতো নয়।যদিও একথা ঠিক আমাদের সংস্কৃতিতে দুঃখজনক ভাবে অনেক ইসলামিক প্রথা বা ট্রেন্ড প্রবেশকরছে।
ডাক্তার এক্সঃ ও আচ্ছা ! দুঃখিত, আমি ভেবেছিলাম এ ছবিটাই মূলধারা বাংলাদেশ !
আমিঃ না, তা নয়। আমি বাংলাদেশে জন্মেছি, বড়ো হয়েছি এবং পেশাগত কাজ করেছি। আমি দেশ ছেড়েছি মাত্র ছয় বছর আগে (সেই সময়ে), সুতরাং আমার অভিজ্ঞতা কে তুমি খুব পুরনো বা আউটডেটেড বলতে পারোনা। বাংলাদেশে ধর্মীয় সংঘাত এর ঘটনা আছে, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে মুসলমানদের একটা আধিপত্যবাদী ভূমিকা আছে, আমার ধারণা ভিন্নরুপে তা ভারতেও বিদ্যমান। বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদী রাজনিতি শক্তিশালী হয়েছে এটা সত্যি কিন্তু টাকার কোনও ধর্ম নেই। তাই তোমার ওয়ালেট এ টাকা থাকলে ঢাকায় হাজার খানেক বিভিন্ন মানের রেস্টুরেন্ট তুমি পেতে পারো খাবার জন্যে।
ডাক্তার এক্সঃ তাহলে হয়ত কেউ আমাকে ভুল তথ্য দিয়েছে।
আমিঃ আমার তাইই মনে হয়।
আলোচনা টি এভাবেই শেষ হয়েছিলো। এরপরে আমি তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলাম যে ঢাকা বেড়াতে গেলে আমার পরিবার ঐ বন্ধুরা তাঁকে সাহায্য করতে পারে। সে চাইলে সপরিবারে আমার বাড়িতেই উঠতে পারে, তাতে হোটেল খরচ টি বেঁচে যাবে।
এই ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতাটিকে আমি বলি “ইস্লামোফোবিয়া”-১। সারা পৃথিবীতে ইসলাম অনুসারী এবং মুসলমানদের নিয়ে এই যে আতংক এবং আতংকের কারনে, হাজার টি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক ধারণা এবং সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে থাকে তার একটা বড়ো অংশ সঠিক তথ্য ও গভীর বিশ্লেষণ প্রসুত নয়।
একজন নাস্তিক হিসাবে, ইসলাম বা কোনও ধর্মের প্রতিই আমার মৌলিক কোনও প্রীতি নেই। ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারনেই আমার বন্ধুটি জানেন, আমি একজন “হার্ডকোর নাস্তিক” (তার ভাষায়) এবং আমি খুব বেশী মাত্রায় জাতীয়তাবাদীও নই, তবুও সেদিন অনেকটা সময় নিয়েই আমি আমার এই ভারতীয় বন্ধুর সাথে আলোচনা করেছিলাম, এই জন্যে যে তার ধারনাটি ভুল তথ্যের উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, এই ভাবে আতংকিত হওয়াটা সমাজ সভ্যতার জন্যে ভালো কিছু নয়।
কিন্তু সারা পৃথিবী জুড়ে যে ইসলাম ও মুসলিম ভীতি গড়ে উঠেছে সাম্প্রতিক সময়ে, তার সবই কি ভিত্তিহীন? সে প্রসঙ্গে লিখবো আরেকদিন, যাকে আমি বলি “ইসলামোফোবিয়া – ২”।
মনে হয় না… পরের কিস্তির অপেক্ষায়…
ধন্যবাদ মুক্তমনায়। ফেসবুকে আপনার লেখা পাই। আশা করি আপনার লেখার মধ্যে সমস্যা উত্তরনের উপায়গুলো পাওয়া যাবে। ধর্মের বাইরে যে একটি পরিশুদ্ধ চিন্তার জগত রয়েছে যে তার টাসে আসতে পারেনি সে কী ভাবে বুঝবে, বোঝার কথা নয়। তেমনি একটি দেশ, সমাজ, জাতিকে বুঝতে হলে ঐ বিশ্বাসের গোন্ডীকে উপড়িয়ে আসতে হয়। তা হলে হয়তো মুক্তভাবে দেখার সুযোগ মেলে।
উদারপন্থী মুসলিমরা আদতে কোনো মুসলিম নয়। কাটা বিছানো বুড়ির গল্পের মতো বোগাস কিছু জিনিস হজম করিয়ে এদেরকে উদারপন্থী বানানো হয়। প্রকৃত ইসলাম হচ্ছে চরমপন্থা আর মধ্যযুগীয়তা। কাজেই ইসলামোফোবিয়া মোটেই অমূলক না।
সারওয়ার ভাই,
মুক্তমনায় স্বাগতম। (Y)
আপনার লেখা নিয়ে নতুন করে কিছু বলবার নেই।
পড়ছি…লেখা চলুক।
সারোয়ার ভাই, ওয়েলকাম!
বৈঠকি ঢং এর cচমৎকারlলেখা। oঅনেক ধন্যবাদ ভাই। পরের কিস্তির জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
সাধারণত মুসলিম প্রধান নন এমন দেশের নন মুসলিমরা এমন ধারনা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়, কারন পৃথিবী জুড়েই ইসলাম ভীতি কম গড়ে উঠেনি।
যাক সেটা তো বাইরের দেশেই, এই দেশেই এখনো গ্রামের অনেক হিন্দুই মুসলিমদের বাড়িতে খান না। কারন খেলে জাত পাতের ব্রেকিং হয় কি না। 🙂 😀
প্রশ্নটা অমূলক না। “ইসলামোফোবিয়া – ২” এর অপেক্ষায় আছি। 🙂
আপনার বন্ধু ডাক্তার এক্স সম্ভবত তার দেশের নিউজপেপার বা টিভি রিপোর্ট দেখতে দেখতে বাংলাদেশ সম্পর্কে এরকম ধারণা পেয়েছিলেন। আসলে পাওয়াটাই বোধহয় স্বাভাবিক ! অন্য কোন দেশে বসে বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক খবার শুনলে এরকম ধারণা আসতেই পারে।
লেখক কে ধন্যবাদ। অত্তন্ত সময় উপযোগী লেখা।
‘ আদর্শ হিন্দু হোটেল ‘বলতে আমরা পশ্চিমবঙ্গ বাসিরা বুঝি শুধু ‘ no beef’ । সেখানে অন্য মাছ মাংস পাওয়া যেতে কোণো বাধা নেই ।
ভারতে এতো ভাষা যে আমাদের পক্ষেও মাত্র কয়েকটা ভাষা শেখা সম্ভব। বেশির ভাগ ভাষা আমরা বুঝি না। বাঙলা পার হলেই – ওড়িয়া, তেলেগু, তামিল, কানাড়া, কঙ্কণী, মারাঠি, গুজরাটি এইগুলি আমাদের কাছে চীনা, জাপানি ভাষার মতো দুর্বোধ্য ।শহর অঞ্চলে ENGLISH চলে। অন্য প্রদেশের গ্রামাঞ্চলে আমাদের ভাষা গত সমস্যায় পড়তে হয়। শুধু মাত্র উত্তর ভারতের হিন্দি ভাষা আমরা বুঝি। মনে রাখতে হবে অন্য রাজ্য গুলোর গড় আয়তন পশ্চিমবঙ্গের দ্বিগুণ।
গুজরাতে বাঙ্গালির (হিন্দু হলেও) ঘর ভাড়া পেতে অসুবিধা হয় কারন বাঙ্গালিরা মাছ খায়।
ধর্মের মধ্যেও এত তফাত যে অন্য প্রদেশের লোকেরা (হিন্দু হলেও) যা মানে আমরা বাঙালি হিন্দুরা তা মানিনা। আমি একবার এক অবাঙ্গালিকে বলেছিলাম যে লক্ষ্মী পুজার বাঙ্গালিরা কেউ কেউ মাছ প্রসাদ হিসাবে দেয়। শুনে তার ভিরমি খাবার জোগাড় ।
এত কথা বললাম তার কারন হিন্দুদের মত মুসলমান দের মধ্যেও ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। তাই জানতে চাই ইস্লামফবিয়া যে কথাটা এখন খুব শোনা যায় তার সত্যি কি ভিত্তি আছে না কি পুরটাই সম্রাজ্যবাদিদের প্রচার।
পরের সংখ্যার অপেক্ষায় থাকলাম।
মুক্তমনায় স্বাগতম। নিয়মিত লিখবেন আশা করি।
@তামান্না ঝুমু,
ধন্যবাদ তামান্না ঝুমু।
আশা করছি নিয়মিত লিখবো। এই সিরিজ টি হয়ত ৩ টি পর্বে লিখবো।
স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার
কিন্তু স্বাধীনতা ততোদূর পর্যন্ত বিস্তৃত,যতদূর পর্যন্ত প্রসারিত হলে তা অন্যের অধিকারকে ক্ষুন্ন করবেনা।