সরকার এর আগেও টিভি চ্যানেল বন্ধ করেছে, কিন্তু এবারের মত এত বিপুল ও বর্ণাঢ্য সমর্থন কখনই পায়নি! বলা হচ্ছে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সরকারের এই সিদ্ধান্তে খুশী, প্রমান হিসেবে সোসাল মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে শত শত সাধারণ মানুষের নিঃশঙ্ক, দ্ব্যর্থহীন ও তেজোদীপ্ত মতামত শুনতে পাচ্ছি আমরা, বুদ্ধিদিকপালেরাও গরম করে রাখছেন টকশোর সাজানো ড্রইংরুম!

তবে আশ্চর্য হলেও এই চ্যানেল দুটির মূল ভোক্তাগনকে মূল সিনে একটিবারের জন্যও দেখা যাচ্ছে না; বোঝা যাচ্ছে না, অমন অসভ্য ও নোংরা চ্যানেল দুটি দেখার লজ্জায় তারা মুখ লুকিয়েছেন, নাকি, নিন্দার ভয় করছেন, নাকি এই দুর্গন্ধযুক্ত অবরোধবাসিনীদের সন্নিকটেই ঘেঁষতে চাইছে না মিডিয়ার আলোকদীপ্ত কর্মিরা!!

‘আউট অব সিন’ হওয়ার মূল কারণ নিয়ে সংশয় থাকলেও, সবাই মানবেন, আলোচ্য চ্যানেল দুটির ভক্তগণের সংখ্যাটা নেহায়েত কম নয়। গণভোট করলে সঠিক সংখ্যাটা হয়ত জানা যাবে, তবে শুধু গ্রাম-গঞ্জেই নয়, শহরের মধ্যবিত্ত ঘরের মাতা-বধু-ভগ্নি-কন্যা-ঝিকূলের একটি বিরাট অংশই যে সিরিয়ালে বেহুঁশ পড়ে থাকেন, তা স্বচক্ষে দেখেননি এমন লোক খুব কম! সুতরাং, এই বিরাট অংশের মত না নেয়ার প্রয়োজন না মনে করতেই পারে সরকার, কিন্তু এদের ছাড়াই সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন রয়েছে, এমন দাবী কি সরকার করতে পারে???

যাই হোক, আমরা ইত্যবসরে বুঝতে চাই, কি এমন ঘটল যে সরকারকে এত দ্রুততার সাথে ‘ইভিল’ নির্মুল অভিযানে নেমে পড়তে হল? দ্রত বিচার ট্রাইব্যুনালও তো এত দ্রুত সিদ্ধান্ত প্রদানে সক্ষম হয়নি! বলতে কি, আমাদের দেশের সরকারগুলোর দীর্ঘসূত্রিতার একটা পারস্পরিক ঐতিহ্য রয়েছে! তবু মনে হচ্ছে, সরকার আপাতদৃষ্টিতে আর একটি তরুনিকেও আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিতে চায় না, আর একটি সুখের ঘরকে ভাঙ্গনের মুখে ফেলতে চায় না! ভাল কথা! তবে এইস্থলে যে অবধারিত প্রশ্নটি চলে আসে, (যা অনেকের মাথায় এলেও মুখে তুলতে চান না শুধু স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার ভয়ে), তা হলঃ বাংলাদেশে প্রবাহিত হওয়ার অনেক আগেই আলোচ্য চ্যানেলগুলি ভারতে জন্ম লাভ করে কি করে এখনো টিকে আছে ওখানে, কোন ভারতীয় তরুনীকে আত্মহনন বা বিবাহ বিচ্ছেদের বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়ে???

খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই চ্যানেলগুলা ছাড়াও আরও গন্ডায় গন্ডায় ভারতীয় চ্যানেল রয়েছে যা আরও শ্বাসরুদ্ধকর, আরও উন্নত মানের উত্তেজক বা ইগো বর্ধক সিরিয়াল নির্মান করে থাকে; তবে সেগুলোর ব্যাপারে কোন কথা উঠছে না, কারণ হচ্ছে, এগুলোর দর্শক গ্রাম বা শহুরে মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা নয়, এই সিরিয়ালগুলাদের ভোক্তারা থাকেন ভদ্রপল্লিতে, শহরের উত্তর পাড়ায়!!!

কিন্তু সিরিয়ালগুলি কেন হয়ে উঠছে ‘সিরিয়াল কিলার’? ইন্ডিয়াতে এই কিলার তো কোন সুবিধেই করতে পারছে না, তাহলে বাংলাদেশে পারছে কি করে? তাও বাংলাদেশের ভদ্র পল্লীতে তো ঢোকার সুযোগ পাচ্ছে না, না পেরে হানা দিচ্ছে শুধু গ্রাম ও শহুরে মধ্যবিত্তের অরক্ষিত দুয়ারগুলিতে?

এই প্রশ্নগুলির উত্তর পাওয়ার আগে আরও কিছু বিষয়ের সুরাহা হওয়া দরকার, যেমন, যে মেয়েটি পাখি ড্রেস না পেয়ে আত্মহত্যা করছে, বা চলে গেছে স্বামীকে ছেড়ে, তা কি কোন মানসিক বৈকল্যের লক্ষ্মন? নাকি সাধ ও সাধ্যের সাথে মেলবন্ধন ঘটাতে না পারার এক অবশ্যম্মভাবি পরিণতি? আর্থিক চাপ? নাকি, নারী অবদমনের কোন নিগূঢ় সংকেত? সামাজিক চাপ?

ধরা যাক, ‘বোঝে না সে বোঝে না’ সিরিয়ালটি বাংলাদেশে প্রচারিত হয়নি, সেক্ষেত্রেও কি ঐ মেয়েটির একটি ড্রেস নেয়ার সাধ জেগে উঠতে পারত না? সামর্থ্য তাকে ঠেকিয়ে দিতে চাইলে সেক্ষেত্রেও কি সে এই পৃথিবীতে নিজেকে অপ্রয়োজনীয় ভেবে বসতে পারত না? সব কিছু ছেড়ে দিলেও, আমাদের দেশে ঠিক কত সংখ্যক নারী প্রতি বছর আত্মহত্যা করে বা বিচ্ছেদে লিপ্ত হয় এবং তার কত শতাংশ ‘সিরিয়াল কিলার’ দ্বারা দংশিত হয়? নাকি এক্ষেত্রে সুইচ টিপলেই বন্ধ করা যায় বলে অপরাধী বের করার আর কোন দীর্ঘমেয়াদি তদন্তেরও দরকার পড়ছে না???

অনেকেই আবার দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বলে বসেন, ‘সিরিয়াল কিলার’ হউক বা না হউক, ইন্ডিয়ান জিনিস আমরা কেন দেখব? যারা এমন বলেন, তারাই আবার ইন্ডিয়ান বই-পুস্তক, বিশেষ করে, ফেলুদা সিরিয়াল, কাকাবাবু সিরিয়াল, চাচা চৌধুরী সিরিয়াল দিব্যি পড়তে ভালবাসেন! প্রশ্ন করলে বলেন, বই আর সিরিয়াল তো এক জিনিস নয়; কিন্তু তাদের কে বোঝাবে, এক বৃদ্ধ মা যখন ভারতীয় বাংলা সিরিয়াল দেখেন, তখন সে ওটিকে একটি বই হিসেবেই পড়েন, আমরা যেমন একটি ফেলুদা সিরিজ পড়ি যখন, তখন একটি সিনেমাই দেখি, তাই না???

সবচেয়ে হাস্যকর সিন তৈরী করেন আমাদের সিনেমাশিল্পের সাথে জড়িত হল মালিক, প্রযোজক, পরিচালক ও কলাকুশলীরা! হিন্দি সিনেমা এদেশের হলগুলিতে প্রচারের প্রসঙ্গ এলেই বাঁধনহারা দেশপ্রেমের জোয়ার উথলে উঠে তাদের মধ্যে, যার উন্মত্ত ফেনায় বরাবরের মত ঠেকিয়ে দেন মুক্ত বাণিজ্য আর সযত্নে ধরে রাখেন প্রটেকশনের সুরক্ষিত বক্স। কিন্তু তারপর? আবার ফিরে যান এফডিসিতে, নেমে পড়েন দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে কোন কোন প্রকার সংশ্লেষহীন নকল সব এঁটো-পচা ছবি বানাতে! যা কিনা আট-দশটি হিন্দি ছবির পর্দা থেকে টুকরো টুকরো করে কেটে নেয়া হয়!! এরাই কিন্তু আবার তাদের সেই সিনেমাটি লন্ডন-আমেরিকার কোন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দিতে হন যারপরনাই ব্যাকুল!

বাংলাদেশে মত এত টিভি চ্যানেল বন্ধ হয়নি আর কোন দেশে, তবু ঠেকানো যায়নি অশান্তি, ধ্বংস, বিবাদ! আর কোন দেশের সিনেমা শিল্পে এত প্রটেকশান দেয়া হয়নি, যা বাংলাদেশ পেয়ে আসছে যুগযগান্তর ধরে! তবু সিনেমা শিল্পের হয়নি এতটুকু উন্নতি!

ইন্ডিয়াপন্থীবলে বিশ্বাস করা হয়, এমন একটি সরকার কেন একটি নয়, বরং দু’দুটি ইন্ডিয়ান চ্যানেল বন্ধ করে দিতে যাচ্ছে, তা অনেককেই ভাবিয়েছে এ পর্যন্ত! রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মুখে ঝামা ঘষে দেয়ার একটি মরিয়া চেষ্টা হিসেবে দেখছেন একে কেউ কেউ! অনেকে আবার বলছেন, ভোটারবিহীন নির্বাচন, সেভেন মার্ডার প্রভৃতি ইস্যুতে ভীষন চাপের মুখে রয়েছে সরকার, এমতাবস্থায় তারা ছোঁক ছোঁক করে খুঁজে ফিরছেন একটি সরু অথচ শর্টকার্ট রাস্তা, মুখ ফিরিয়ে নেয়া ভোটারদের হাশফাঁস করা হৃদয়-অন্দরে যদিবা খানিক প্রবেশ মেলে! স্টার জলসা ও জি বাংলা বন্ধ করার উদ্যোগ, তারই ফসল!

সমস্যার গোড়াটি অপসারণ না করে যখন বহিরাবনে প্রলেপ লাগানো হয়, তখন সমস্যা সমাধান তো দূরের কথা, নতুন একটি সমস্যারই যেন জন্ম দেয় তা! আমাদের দেশে এই কাজটি চলছে ব্যাপক সার্থকতার সাথে, গত কয়েক দশক জুড়েই, আর আমরা মুক্তির পরিবর্তে নতুন নতুন সমস্যা ও সংকটের আবর্তে আরও বেশী করে তলিয়ে যাচ্ছি! ক্রমেই!

আজ ভারতীয় বাংলা সিরিয়ালগুলিকে কিলার অপবাদ দিয়ে ঘাড় ধরে বের করে দেয়া হচ্ছে, কিন্তু আমাদের সরকারগুলোর মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা ‘সিরিয়াল কিলার’দের সযত্নে পুষেই চলছি আমরা, যারা একদিন এই দেশকে চ্যানেল শূন্য করে ছাড়বে, সংস্কৃতির কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে, কোথাও এতটুকু অক্সিজেন মিলবে না প্রাণভরে শ্বাস নেয়ার জন্য সেদিন!!