সরকার এর আগেও টিভি চ্যানেল বন্ধ করেছে, কিন্তু এবারের মত এত বিপুল ও বর্ণাঢ্য সমর্থন কখনই পায়নি! বলা হচ্ছে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সরকারের এই সিদ্ধান্তে খুশী, প্রমান হিসেবে সোসাল মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে শত শত সাধারণ মানুষের নিঃশঙ্ক, দ্ব্যর্থহীন ও তেজোদীপ্ত মতামত শুনতে পাচ্ছি আমরা, বুদ্ধিদিকপালেরাও গরম করে রাখছেন টকশোর সাজানো ড্রইংরুম!
তবে আশ্চর্য হলেও এই চ্যানেল দুটির মূল ভোক্তাগনকে মূল সিনে একটিবারের জন্যও দেখা যাচ্ছে না; বোঝা যাচ্ছে না, অমন অসভ্য ও নোংরা চ্যানেল দুটি দেখার লজ্জায় তারা মুখ লুকিয়েছেন, নাকি, নিন্দার ভয় করছেন, নাকি এই দুর্গন্ধযুক্ত অবরোধবাসিনীদের সন্নিকটেই ঘেঁষতে চাইছে না মিডিয়ার আলোকদীপ্ত কর্মিরা!!
‘আউট অব সিন’ হওয়ার মূল কারণ নিয়ে সংশয় থাকলেও, সবাই মানবেন, আলোচ্য চ্যানেল দুটির ভক্তগণের সংখ্যাটা নেহায়েত কম নয়। গণভোট করলে সঠিক সংখ্যাটা হয়ত জানা যাবে, তবে শুধু গ্রাম-গঞ্জেই নয়, শহরের মধ্যবিত্ত ঘরের মাতা-বধু-ভগ্নি-কন্যা-ঝিকূলের একটি বিরাট অংশই যে সিরিয়ালে বেহুঁশ পড়ে থাকেন, তা স্বচক্ষে দেখেননি এমন লোক খুব কম! সুতরাং, এই বিরাট অংশের মত না নেয়ার প্রয়োজন না মনে করতেই পারে সরকার, কিন্তু এদের ছাড়াই সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন রয়েছে, এমন দাবী কি সরকার করতে পারে???
যাই হোক, আমরা ইত্যবসরে বুঝতে চাই, কি এমন ঘটল যে সরকারকে এত দ্রুততার সাথে ‘ইভিল’ নির্মুল অভিযানে নেমে পড়তে হল? দ্রত বিচার ট্রাইব্যুনালও তো এত দ্রুত সিদ্ধান্ত প্রদানে সক্ষম হয়নি! বলতে কি, আমাদের দেশের সরকারগুলোর দীর্ঘসূত্রিতার একটা পারস্পরিক ঐতিহ্য রয়েছে! তবু মনে হচ্ছে, সরকার আপাতদৃষ্টিতে আর একটি তরুনিকেও আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিতে চায় না, আর একটি সুখের ঘরকে ভাঙ্গনের মুখে ফেলতে চায় না! ভাল কথা! তবে এইস্থলে যে অবধারিত প্রশ্নটি চলে আসে, (যা অনেকের মাথায় এলেও মুখে তুলতে চান না শুধু স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার ভয়ে), তা হলঃ বাংলাদেশে প্রবাহিত হওয়ার অনেক আগেই আলোচ্য চ্যানেলগুলি ভারতে জন্ম লাভ করে কি করে এখনো টিকে আছে ওখানে, কোন ভারতীয় তরুনীকে আত্মহনন বা বিবাহ বিচ্ছেদের বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়ে???
খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই চ্যানেলগুলা ছাড়াও আরও গন্ডায় গন্ডায় ভারতীয় চ্যানেল রয়েছে যা আরও শ্বাসরুদ্ধকর, আরও উন্নত মানের উত্তেজক বা ইগো বর্ধক সিরিয়াল নির্মান করে থাকে; তবে সেগুলোর ব্যাপারে কোন কথা উঠছে না, কারণ হচ্ছে, এগুলোর দর্শক গ্রাম বা শহুরে মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা নয়, এই সিরিয়ালগুলাদের ভোক্তারা থাকেন ভদ্রপল্লিতে, শহরের উত্তর পাড়ায়!!!
কিন্তু সিরিয়ালগুলি কেন হয়ে উঠছে ‘সিরিয়াল কিলার’? ইন্ডিয়াতে এই কিলার তো কোন সুবিধেই করতে পারছে না, তাহলে বাংলাদেশে পারছে কি করে? তাও বাংলাদেশের ভদ্র পল্লীতে তো ঢোকার সুযোগ পাচ্ছে না, না পেরে হানা দিচ্ছে শুধু গ্রাম ও শহুরে মধ্যবিত্তের অরক্ষিত দুয়ারগুলিতে?
এই প্রশ্নগুলির উত্তর পাওয়ার আগে আরও কিছু বিষয়ের সুরাহা হওয়া দরকার, যেমন, যে মেয়েটি পাখি ড্রেস না পেয়ে আত্মহত্যা করছে, বা চলে গেছে স্বামীকে ছেড়ে, তা কি কোন মানসিক বৈকল্যের লক্ষ্মন? নাকি সাধ ও সাধ্যের সাথে মেলবন্ধন ঘটাতে না পারার এক অবশ্যম্মভাবি পরিণতি? আর্থিক চাপ? নাকি, নারী অবদমনের কোন নিগূঢ় সংকেত? সামাজিক চাপ?
ধরা যাক, ‘বোঝে না সে বোঝে না’ সিরিয়ালটি বাংলাদেশে প্রচারিত হয়নি, সেক্ষেত্রেও কি ঐ মেয়েটির একটি ড্রেস নেয়ার সাধ জেগে উঠতে পারত না? সামর্থ্য তাকে ঠেকিয়ে দিতে চাইলে সেক্ষেত্রেও কি সে এই পৃথিবীতে নিজেকে অপ্রয়োজনীয় ভেবে বসতে পারত না? সব কিছু ছেড়ে দিলেও, আমাদের দেশে ঠিক কত সংখ্যক নারী প্রতি বছর আত্মহত্যা করে বা বিচ্ছেদে লিপ্ত হয় এবং তার কত শতাংশ ‘সিরিয়াল কিলার’ দ্বারা দংশিত হয়? নাকি এক্ষেত্রে সুইচ টিপলেই বন্ধ করা যায় বলে অপরাধী বের করার আর কোন দীর্ঘমেয়াদি তদন্তেরও দরকার পড়ছে না???
অনেকেই আবার দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বলে বসেন, ‘সিরিয়াল কিলার’ হউক বা না হউক, ইন্ডিয়ান জিনিস আমরা কেন দেখব? যারা এমন বলেন, তারাই আবার ইন্ডিয়ান বই-পুস্তক, বিশেষ করে, ফেলুদা সিরিয়াল, কাকাবাবু সিরিয়াল, চাচা চৌধুরী সিরিয়াল দিব্যি পড়তে ভালবাসেন! প্রশ্ন করলে বলেন, বই আর সিরিয়াল তো এক জিনিস নয়; কিন্তু তাদের কে বোঝাবে, এক বৃদ্ধ মা যখন ভারতীয় বাংলা সিরিয়াল দেখেন, তখন সে ওটিকে একটি বই হিসেবেই পড়েন, আমরা যেমন একটি ফেলুদা সিরিজ পড়ি যখন, তখন একটি সিনেমাই দেখি, তাই না???
সবচেয়ে হাস্যকর সিন তৈরী করেন আমাদের সিনেমাশিল্পের সাথে জড়িত হল মালিক, প্রযোজক, পরিচালক ও কলাকুশলীরা! হিন্দি সিনেমা এদেশের হলগুলিতে প্রচারের প্রসঙ্গ এলেই বাঁধনহারা দেশপ্রেমের জোয়ার উথলে উঠে তাদের মধ্যে, যার উন্মত্ত ফেনায় বরাবরের মত ঠেকিয়ে দেন মুক্ত বাণিজ্য আর সযত্নে ধরে রাখেন প্রটেকশনের সুরক্ষিত বক্স। কিন্তু তারপর? আবার ফিরে যান এফডিসিতে, নেমে পড়েন দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে কোন কোন প্রকার সংশ্লেষহীন নকল সব এঁটো-পচা ছবি বানাতে! যা কিনা আট-দশটি হিন্দি ছবির পর্দা থেকে টুকরো টুকরো করে কেটে নেয়া হয়!! এরাই কিন্তু আবার তাদের সেই সিনেমাটি লন্ডন-আমেরিকার কোন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দিতে হন যারপরনাই ব্যাকুল!
বাংলাদেশে মত এত টিভি চ্যানেল বন্ধ হয়নি আর কোন দেশে, তবু ঠেকানো যায়নি অশান্তি, ধ্বংস, বিবাদ! আর কোন দেশের সিনেমা শিল্পে এত প্রটেকশান দেয়া হয়নি, যা বাংলাদেশ পেয়ে আসছে যুগযগান্তর ধরে! তবু সিনেমা শিল্পের হয়নি এতটুকু উন্নতি!
ইন্ডিয়াপন্থীবলে বিশ্বাস করা হয়, এমন একটি সরকার কেন একটি নয়, বরং দু’দুটি ইন্ডিয়ান চ্যানেল বন্ধ করে দিতে যাচ্ছে, তা অনেককেই ভাবিয়েছে এ পর্যন্ত! রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মুখে ঝামা ঘষে দেয়ার একটি মরিয়া চেষ্টা হিসেবে দেখছেন একে কেউ কেউ! অনেকে আবার বলছেন, ভোটারবিহীন নির্বাচন, সেভেন মার্ডার প্রভৃতি ইস্যুতে ভীষন চাপের মুখে রয়েছে সরকার, এমতাবস্থায় তারা ছোঁক ছোঁক করে খুঁজে ফিরছেন একটি সরু অথচ শর্টকার্ট রাস্তা, মুখ ফিরিয়ে নেয়া ভোটারদের হাশফাঁস করা হৃদয়-অন্দরে যদিবা খানিক প্রবেশ মেলে! স্টার জলসা ও জি বাংলা বন্ধ করার উদ্যোগ, তারই ফসল!
সমস্যার গোড়াটি অপসারণ না করে যখন বহিরাবনে প্রলেপ লাগানো হয়, তখন সমস্যা সমাধান তো দূরের কথা, নতুন একটি সমস্যারই যেন জন্ম দেয় তা! আমাদের দেশে এই কাজটি চলছে ব্যাপক সার্থকতার সাথে, গত কয়েক দশক জুড়েই, আর আমরা মুক্তির পরিবর্তে নতুন নতুন সমস্যা ও সংকটের আবর্তে আরও বেশী করে তলিয়ে যাচ্ছি! ক্রমেই!
আজ ভারতীয় বাংলা সিরিয়ালগুলিকে কিলার অপবাদ দিয়ে ঘাড় ধরে বের করে দেয়া হচ্ছে, কিন্তু আমাদের সরকারগুলোর মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা ‘সিরিয়াল কিলার’দের সযত্নে পুষেই চলছি আমরা, যারা একদিন এই দেশকে চ্যানেল শূন্য করে ছাড়বে, সংস্কৃতির কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে, কোথাও এতটুকু অক্সিজেন মিলবে না প্রাণভরে শ্বাস নেয়ার জন্য সেদিন!!
সমস্যাটা হল যে, কিছু কিছু জিনিস আমরা মনের মধ্যে স্টাক করে রাখছি। কি জিনিস ?
১ নম্বর, বিদেশী সংস্কৃতি অপসংস্কৃতি, দেশী সংস্কতি অপসংস্কৃতি নয়।
২ নম্বর, যত রাজ্যের খারাপ আচরণ বাংলাদেশী মানুষ শিক্ষা নেয় ইন্ডিয়ান চ্যানেলে দেখানো নাটক থেকে; বাংলাদেশী নাটকে কখনোই কূটনামী দেখানো হয় না। অথচ আগরদিনের ভাল নাটকগুলোর ( যেমন – সংসপ্তক, কোথাও কেউ নেই ) মধ্যেও কূটনামী ঠিকই ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের নাটক হওয়ায় এদের সাতখুন মাফ।
৩ নম্বর, দেশে তৈরী নাটকের মান অনেক ভাল। ছাই ভাল। বর্তমানকালে তৈরী দেশী নাটকগুলো যতই বস্তাপচা হোক না কেন, যতই অখাদ্য হোক না কেন সেগুলা ভাল। ছোটবেলায় লেখা একটা দেশপ্রেমমূলক কবিতা মনে পড়ে যাচ্ছে, কি যেন কবিতাটা। ঠিক মনে পড়ছে না। অনেকটা এরকম লাইন আছে কবিতাটায় – ”বিদেশের ঠাকুর ছাড়িয়া, স্বদেশের কুকুর ধরি” । কার লেখা কবিতা তাও মনে নাই। তবে কথাটা এদেশের বুদ্ধিহীন মানুষদের জন্য অত্যন্ত প্রযোজ্য। বুদ্ধিহীন মানুষেরাই এই কাজ করে বা করতে চায়। কি কাজ ? বিদেশের ঠাকুর ( বিদেশী সিরিয়াল ) ছেড়ে স্বদেশের কুকুর ( দেশী সিরিয়াল ) ধরা। নিজের দেশের নাটক যতই বাজে হোক না কেন ? এটাই সবার ভাল লাগবে। হাজার হোক দেশী পণ্য – ভাল লাগার জন্য আর কোন কারণ থাকার দরকার আছে নাকি ?
৪ নম্বর, ধর্মান্ধতা। এখন এটা ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের মা, বাবা, ভাই, বোনদের ভাল লাগা-মন্দ লাগা ব্যাপারগুলো ধর্মের মত তুচ্ছ বিষয়ের অনেক উর্ধ্বে।
৫ নম্বর, মজ্জাগত ভারত বিদ্বেষ।
৬ নম্বর, তারা আমাদেরটা দেখায় না। তাহলে আমরা কেন তাদেরটা দেখাব ?
৭ নম্বর, ভারতীয় সিরিয়ালগুলো অনেক দীর্ঘ, রাবারের মত খালি লম্বা করা হয়। এটা কোন কথা ? লম্বা সিরিয়াল দেখতেই তো আরো বেশী ভাল লাগা উচিত। ১০০০ পর্বের কম হলে সেটা কি ঘোড়ার ডিমের নাটক হল ?
৮ নম্বর, অশ্লীলতা দেখানো হয়। এটা একেবারেই ডাহা মিথা কথা। সিনেমায় দেখানো হলেও সিরিয়ালে কখনো অশ্লীলতা দেখানো হয় না।
৯ নম্বর, মনে পড়ছে না। আর কোন পয়েন্ট থাকলে কেউ মনে করিয়ে দিয়েন। কেমন ?
মনের মধ্যে একদম স্থির করে রাখা এই ব্যাপারগুলো থেকে বের হয়ে আসতেই হবে। 🙂
সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অসংগতি মানুষের মনজগতে নানা রকম জটিল সমস্যার সৃষ্টি করে।মানুষ অস্তিত্তের সংকটে বিভ্রান্ত হয়।তাই এসব সমস্যার সমাধান করতে হলে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মনজাগতিক বিশ্লেষণ করতে হবে।তা না করে দুটি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া সমস্যাকে আরও প্রকট করবে।
@রসি মজুমদার,
লেখাটার বটম লাইন তুলে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানুন, রসি!
ভাল থাকুন।
এটা অবশ্য ঠিক বলছেন যে কোন টিভি চ্যানেল বন্ধ করাই উচিত না।
আমার মনেহয় ভাষাগত কারনে এদেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ভারতীয় বাংলা চ্যানেলগুলোর প্রতি আসক্তিটা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে। ঐ চ্যানেলগুলোকে কিছু সময়ের জন্য ব্যান করে পরিস্থিতিটাকে কন্ট্রোলে নিয়ে আসা জরুরী এবং পাশাপাশি ঐ সময়ের মধ্যে দেশী চ্যানেলগুলির মান উন্নয়নের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
দেশী চ্যানেলগুলোর সবচেয়ে বিরক্তিকর অংশ হল ঘন্টায় ঘন্টায় সংবাদ প্রচার। আমি বুঝিনা সব চ্যানেলে সংবাদ দেখাইতে হবে কেন? বিনোদনের জন্য নির্ধারিত চ্যানেলে সংবাদ প্রচার বন্ধ করতে হবে। অনলাইন পত্রিকা গুলোর মত আজাইরা সংবাদ প্রচার করে বিনোদন দেওয়া যাবে না!
@তারিক,
যদ্দুর জানি, হিন্দি চ্যানেলের প্রতি আসক্তি একেবারে কম নয়, ভাষাগত কারণ ছাড়াই কি করে তারাও মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি সৃষ্টি করল?
কোন পরিস্থিতি কন্ট্রোলে আনতে চাইছেন? ভারতীয় বাংলা চ্যানেল ব্যান করলে কোন পরিস্থিতি আপনি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবেন বলে ভাবছেন?
আর যা আসক্তি তৈরি করে, মাদকের ন্যায়, তাকে মাত্র কিছু সময়ের জন্য ব্যান করতে চাইছেন কেন? স্থায়ীভাবে ব্যান করলে সমস্যা কি?
সংবাদে বিনোদন নেই?? সংবাদ রঙ্গে বিনুদিত হয় না, এমন আছে নাকি কেউ?
@গুবরে ফড়িং,
🙂 সবাই সববিষয়ে একমত হবে না। পূর্বের মন্তব্যের ব্যাখ্যা করছি:
বাংলাদেশে হিন্দী চ্যানেলগুলোর ব্যাপক প্রচার শুরু হওয়ার আগে বাংলাদেশী টিভি দর্শকেরা মুগ্ধ হয়ে বিটিভিতে বাংলাদেশী নাটক-অনুষ্ঠান দেখতো। তখন এদেশের নাটক-অনুষ্ঠানগুলো কি খুউব উচ্চ মান সম্পন্ন ছিল? নাকি দর্শকদের কাছে ঐসব প্যানপ্যানানি নাটক-অনুষ্ঠান দেখা ছাড়া অন্যকোন অপশন ছিল না? 😕
এরপর যখন হিন্দী চ্যানেলগুলো এদেশে ব্যাপক প্রচার শুরু হয়, তখন দর্শক ভিন্ন টেস্ট পেয়ে হিন্দী বুঝুক বা না বুঝুক হিন্দী চ্যানেলের দিকে ঝুকে যায়। হিন্দী চ্যানেলের সিরিয়াল/অনুষ্ঠানগুলো কিন্তু খুউব উচ্চ মান সম্পন্ন কিছু ছিল না, এগুলোতে ছিল একটু ভিন্ন স্বাদের “বালছাল”! :-O
পরবর্তীতে ভারতীয় বাংলা চ্যানেলগুলোতে এককথায় বলা যায় হিন্দী চ্যানেলের সিরিয়ালগুলোর বাংলা সংস্করন করা শুরু করলো, তারপরে তো এদেশের দর্শকদের আনন্দ আর ধরে কে? এখন আর হিন্দী বুঝার ঝামেলা নাই বাংলাতেই তারা ইন্ডিয়ার বালছাল সিরিয়াল দেখতে পারবে। 😀
আপনি ঠিকই বলেছেন ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের প্রতি আসক্তিটা হিন্দী দিয়েই শুরু হয়েছিল কিন্তু বাংলাতে প্রচার শুরু হওয়ার পর আসক্তিটা এক্সট্রিম মাত্রায় পৌছাইছে। এই আসক্তির চরম বহিঃপ্রকাশ আমাদের চোখের সামনে, সিরিয়ালে দেখানো কায়দায় পাখি ড্রেস না পাইয়া আত্বহত্যা/স্বামী-তালাক/ …!!! :-Y
অথচ ইন্ডিয়ান এসব সিরিয়ালের তুলনায় বাংলাদেশে এখন অনেক মানসম্পন্ন ও রুচিশীল সিরিয়াল/নাটক হচ্ছে, কিন্তু এগুলো দেখার দর্শক কৈ? সব্বাই স্টার জলসা আঁর জি বাংলা নিয়ে ব্যাস্ত। আমি নিশ্চিত বাংলাদেশের নতুন নাটকগুলো যদি ভারতের বাংলা ভাষাভাষীরা দেখার সুযোগ পায়, তবে তারাই স্টার জলসা ও জি বাংলা’র প্যানপ্যানানি সিরিয়াল আর দেখবে না। আমার এত কথা বলার মূল উদ্দেশ্য, বাংলাদেশী চ্যানেলগুলোতে এদেশের দর্শকদের ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে, এখন সেটা যেভাবেই হোক। আর যখন চ্যানেলগুলোর প্রতি দর্শকদের আগ্রহ বাড়বে তখন নাটক/সিরিয়ালের মান আরো ভাল হবে। 🙁
অল্প সময়ের জন্য নিষিদ্ধের কথা বলেছি যাতে ভারতীয় বাংলা চ্যানেলগুলোর প্রতি এদেশের মানুষের অস্বাভাবিক আসক্তিটা কমলে চ্যানেলগুলোর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া যায়। এবং ঐ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে টিভি চ্যানেলগুলোর সম্প্রচারের কঠোর নীতিমালা প্রনয়ন করতে হবে।
মাথা ব্যাথার জন্য মাথা কেটে ফেলা এর আগেও বহুবার হয়েছে। যেমন প্রধানমন্ত্রীর একটি ছবি যেন শেয়ার হতে না পারে তার জন্য ফেসবুক বন্ধ করে দেয়া, মহানবীর ভিডিও যেন কেউ দেখতে না পারে তাই ইউটিউব বন্ধ করে দেয়া, বাচ্চারা যেন হিন্দি না শিখতে পারে এর জন্য ডোরেমন প্রচারিত হয় এমন দুটি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া এমন শত উদাহরন।
এসব শুধুই যে মূর্খতা তাই শুধু নয়; বিপদজনকও বটে ।
যা বলতে চাই সেটা বুঝাতে একটা ঘটনা বলা দরকার।
আমাদের ঢাকা-বরিশাল রুটে তেমন কোন ভালো বাস নেই; চিটাগাং-সিলেট রুটে যে সব বাস চলাচলের অযোগ্য হয়ে যায় সেসব বাস বরিশাল রুটে নামানো হয়।
মাঝে কিছু ভলভো এসি বাস ওই রুটে নামানো হল। অন্যদের ব্যাবসা তখন গেল কমে।
বলুন তো অন্য বাস কোম্পানির তখন কি করা উচিৎ ছিল তাদের ব্যাবসা টিকিয়ে রাখতে???
তাদের উচিৎ ছিল ভালো কিছু এসি বাস নামানো।
২ ভাবে বড় হওয়া যায়; ১ নিজে ভালো করে অথবা ২ অন্যকে ভালো করতে না দিয়ে।
তারা ২ নাম্বার পন্থা অবলম্বন করলো। সামনে পেছনে ভলভো দেখলেই গুতা মাড়া শুরু করলো।
জানেন তো যে ভলভো বাসের একটা ইনডিকেটর লাইট নষ্ট হলেও ১০ হাজার টাকা লাগে নতুন একটা লাগাতে; তাই প্রতি যাত্রায় এতো এতো ক্ষতিপূরণ দিতে না পেড়ে এসি বাস সার্ভিসটাই দিতে হল বন্ধ করে।
আমরা বাঙ্গালীরা সবসময় ২ নাম্বার পথে বড় হতে চাই। নিজেরা ভালো করলেই যে অন্যদের দমন করা যায় আমরা সেটা ভুলে যাই।
স্টার জলসা বা জি বাংলা আমাদের বাংলার মানুষ কেন দেখে???
এর উত্তর জানতে বাংলাদেশী যে কোন একটা চ্যানেল ঘণ্টাখানেক দেখলেই বুঝে যাবেন কেন কেউ বাংলাদেশী চ্যানেল দ্যাখেনা।
আমার আম্মু স্টার জলসা বা জি বাংলার নিয়মিত দর্শক। একবার আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন বাংলাদেশী কোন চ্যানেলের একটা প্রোগ্রাম পুরোটা দেখতে। বিশ্বাস করুন ৪৫ মিনিটে সেই অনুষ্ঠান শুরু করতে পারেনি পর্যন্ত শেষ করা তো দুরের কথা; যেখানে ১ ঘণ্টায় অনায়াসে স্টার জলসা বা জি বাংলার ২ টি নাটকের ২ পর্ব দেখে শেষ করে ফেলা যায়।
অনেক আগে যখন কেবল বিটিভি ছিল তখনকার নাটকের উদাহরন দেয়া বোকামি হবে তাই একান্নবর্তী, বন্ধন, স্পর্শের বাইরে, এক জনমে কিংবা রোড নম্বর ৬ বাড়ি নম্বর ৯ নাটক গুলোর উদাহরন ধরুন। তখন কিন্তু অন্য ভারতীয় চ্যানেল গুলো ছিল; কিন্তু আমরা তবুও এসব নাটক দেখার জন্য অপেক্ষা করতাম। কারন কি ??? কারন হল নাটক গুলোর কোয়ালিটি। এখনকার ঈদের নাটক দেখলেই বমি পায় সেখানে বাকি মাস গুলোয় কি দেখবো চিন্তা করুন।
সরকারের আসলে যেটা উচিৎ সেটা হল অন্তত কিছু চ্যানেলকে অনুদান দিয়ে বিজ্ঞাপনের চাপ কমানো। ভালো ভালো সিরিয়াল নাটক বানানোর জন্য অনুদান দেয়া। ভালো নির্মাতা আর ভালো গল্পের কিন্তু আমাদের অভাব নেই; অভাব আছে পৃষ্টপোষকতার।
আমাদের মা বোনেরা কিংবা আমরাও কিন্তু সেধে ভারতীয় চ্যানেল দেখিনা; আমাদের বাধ্য করা হয়। যতদিন বিকল্প বিনোদনের ব্যাবস্থা সরকার না করতে পারবে ততদিন ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ করার কোন জুক্তিকতা আছে কি???
স্টার জলসা আর জি বাংলা বন্ধ করে দিলে আমাদের মা রা দেখবে কি ???
ত্বক ফর্সা করা স্নো ক্রিম আর সাবান শ্যাম্পুর অ্যাড???
বিশ্বাস করুন; অনুষ্ঠানের নামে বিজ্ঞাপন দেখানো আর অন্তত সপ্তাহে ৫ দিন প্রচারিত হয় এমন কোয়ালিটি সম্পন্ন ২ টি সিরিয়াল ই পারে আমাদের মা দের আবার বাংলা চ্যানেল দেখতে উৎসাহিত করতে।
যতদিন সেটা সম্ভব না হয় ততদিন স্টার জলসা আর জি বাংলা সহ যে কোন ইস্যুতে যে কোন চ্যানেল বন্ধ করে দেয়ার আমি ঘোড় বিরোধিতা করছি।
#SaveStarJolshaSaveZBangla
@এম এস নিলয়,
কোটি টাকার প্রশ্ন! তবে সরকার বাহাদুর, ফেবু কাঁপানো দেশপ্রেমিকগণ এবং ড্রইংরুম তাতানো বুদ্ধিজীবিগণ কিন্তু বলছেন যে, আমাদের মা-বোনদের বাঁচাতেই চ্যানেল দুটি তাড়ানো ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল! দেশ তো মাদক-শূন্য করা হল, কিন্তু আমাদের মা-বোনেরা বাঁচবে কি নিয়ে? তাদের অবসর কাটবে কি করে? কোথায় পাবে তারা একটুখানি বিনোদন?
দেখুন, সিরিয়ালগুলি দেখে নাকি আমাদের মা-বোনদের মাঝে বিবিধ কুপ্রবৃত্তি, যেমন, হিংসা, বিবাদ, লোভ, লালসা ইত্যাদির স্ফুরুন ঘটছে; সুতরাং, এখন আমরা অপেক্ষা করতে পারি, চ্যানেল দুটি বিদায়ের পর দেশের হিংসার পারদ কত ডিগ্রী অবনমন করে, তা দেখার জন্য!!!
আমাদের মা-ভাবীদের কম গঞ্জনা, নিন্দা ও উপহাস সইতে হয় না, যখন একটুখানি বিনোদনের আশায় তারা স্টার জলসার মত সিরিয়ালগুলির দিকে তাকিয়ে থাকে!! আমাদের মা-ভাবীদের আমরা বাইরে যেতে দেইনা, তারা ফেবু-ইন্টারনেট নিয়ে মেতে থাকতে পারে না, তারা আরও পড়াশুনা করুক, তাও আমরা চাই না, সেই মা-ভাবীরা যখন সারাদিন সংসারের ঘানি টেনে সন্ধ্যায় একটু স্টার জলসা নিয়ে বসে, তারা কিন্তু একট বই পাঠের স্বাদই করে, যেমন্টা, আমরা কোন সায়েন্স ফিকশান বা ডিটেকটিভ বা এ্যাডভাঞ্চার গল্প পড়ার সময়!!! হোক না এগুলি টক্সিক, এগুলো তো বিনোদন দিচ্ছে, কোন অধিকারে এগুলি থেকে বঞ্চিত করতে পারি তাদের আমরা??
কেন বন্ধ করতে হবে? যে খারাপ, সে এমনিতেই ঝরে পড়বে! এই তো মার্কেট ইকোনোমির মিরাকল! আর দেখুন, যে মেয়েগুলি মারা গেছে, তাদের কিলার সিরিয়ালগুলি, নাকি আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট??? আমরা মদ নিষিদ্ধ করার পরও আমাদের দেশের পশ্চিমের চেয়ে বেশী খুন-খারাবি-ধর্ষন-জখম হয় ক্যানো??? ভেবে দেখেছি, আমরা কখনো?
বিটিভির একঘন্টার ধারাবাহিক অয়োময়, সংশপ্তক দেখার জন্য টানা পনের দিন অপেক্ষা করতে হত, তারপরও তীর্থের কাকের মত বসে থাকত ছেলে-বুড়ো সবাই! এরপর ধারাবাহিক নেমে এল ২০ মিনিটে, সপ্তাহে দুইবার দেখানো হয়, অনেকটা ইন্ডিয়ান চ্যানেলের অনুকরনে, কিন্তু ইন্ডিয়ান চ্যানেলেও এত বিজ্ঞাপন দেখানো হয় না, যা বাংলাদেশে হত! বাস্তবতা হল, ইন্ডিয়ার কাছ থেকে বাণিজ্য শিখে ইন্ডিয়ার চেয়েও কয়েক গুণ বেশী বাণিজ্য করা শুরু করল আমাদের দেশীয় চ্যানেলগুলি! তাছাড়া, আগে মৌলিক কাহিনির এক ঘন্টার ধারাবাহিক দেখালেও, দেশীয় চ্যানেলগুলি ২০ মিনিটের যে ধারাবাহিক দেখাতে শুরু করল, তার কাহিনিগুলিও তৈরি হত ইন্ডিয়ার সিরিয়ালের অনুকরনে! সুতরাং, আমাদের মা-বোনেরা রিমোট ঘোরালেই যখন অরিজিনাল দেখতে পায়, তখন কেন কষ্ট করে আর দেশী সিরিয়াল দেখতে যাবে!!!
তবে ফারুকি, সালাউদ্দিন লাভলু কিছু ভিন্ন ধারার ও মৌলিক সিরিয়াল নির্মান করতেন, তা কিছুটা হলেও দেশী চ্যানেলগুলিকে টিকিয়ে রেখেছে এখনো! আসলে এইরকম ভিন্ন ধারার ও মৌলিক গল্প দিয়েই বেঁচে থাকতে হবে দেশী চ্যানেলগুলিকে, বিদেশী চ্যানেল তাড়িয়ে সিনেমাশিল্পের মত প্রটেকশান দিয়ে বেশীদিন বেঁচে থাকতে পারবে না তারা!
সরকারের সিদ্ধান্তে হয়ত টেলিভিশনঅলারা মহা খুশি। এফডিসিঅলাদের দেখেও যাদের শিক্ষা হয়নি তাদের অবস্থা খুব শ্রীঘ্রই ঢাকার সিনেমার মত হবে।
পোস্টের বিষয়ে সহমত। (Y)
@সুষুপ্ত পাঠক,
এমন নয় যে, আমি স্টার জলসার সিরিয়াল দেখি বা এগুলোর ভক্ত! তবে কোন অঘটন ঘটলেই কারণ ভালমত এনালিসিস না করেই বন্ধ করে দেয়ার যে কালচার আমাদের দেশে চলমান, তা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়, কারন এগুলি পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাবে, উন্নতি তো দূরের কথা!
বলা হচ্ছে, স্টার জলসা বাংলাদেশের মেয়েদের মেরে ফেলছে, মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটাচ্ছে, হিংসা ও ক্রোধের বীজ বুনে দিচ্ছে; কিন্তু কই, পশ্চিমবঙ্গে তো কোন আত্মহত্যা বা বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা শোনা যায়নি যার মূলে ছিল স্টার জলসার মত চ্যানেলগুলি?
বাংলাদেশে যে মেয়েগুলি মারা গেছে বা বিচ্ছেদের স্বীকার হয়েছে, তার মূলে কখনোই একটি প্রাইভেট চ্যানেলের একক কৃতিত্ব থাকতে পারে না, সেরকমটা ভাবা একান্তই বালখিল্যতা, শিশুসুলভ; এগুলির মূলে নিশ্চয়ই আর্থ-সামাজিক কোন কারণ থেকে থাকবে, যার অনুসন্ধান না করে আমাদের সরকার বাহাদুর সিরিয়াল-কিলারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন!