রিভিউ লেখা সাহিত্যের একটা জরুরী ধারা। সাহিত্যের অন্য সকল ধারার মত এটাতেও আমি হাত পাকাতে পারিনি। জীবনে একবারই একটা রিভিউ লিখেছিলাম। পড়ে আমার ছোটো বোনরা বলেছে, “ভাইয়া এইটা কী লিখেছো! একদম বস্তাপচা।” কিন্তু পরাজয়ে ডরে না বীর। তাই এই দ্বিতীয় প্রচেষ্টা। এবারের শিকার অগ্রজপ্রতীম ফারসীম মান্নান মোহাম্মাদী ও তার বই “নক্ষত্র, নিউরন ও ন্যানো”।

জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখাকে মোটা দাগে দুই প্রকারে ভাগ করা যায়। যার এক ভাগের অভীষ্ট পাঠক হচ্ছেন, কৌতূহলি মুক্তমনের মানুষ যারা বিজ্ঞানের বিষয়-আসয়ে অতটা অবহিত নন। কিন্তু মজার কিছু পেলে পড়ে ফেলবেন। অর্থাৎ, যারা পটেনশিয়াল বিজ্ঞানপ্রেমী অথচ জনপ্রিয় বিজ্ঞান ঘারাণার লেখা আগে অতটা পড়েননি। এসব লেখাতে বিজ্ঞানের কোনো একটা বিষ্ময়কর বিষয় সহজ ভাষায় উপভোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়। এতে পাঠকের মনযোগ ধরে রাখতে একটু বেশিই খাটতে হয় লেখককে। আর অন্য ভাগের অভীষ্ট পাঠক হচ্ছেন, যারা ইতোমধ্যেই বিজ্ঞানপ্রেমী, জনপ্রিয় বিজ্ঞান বা উচ্চতর বিজ্ঞানের নানান বিষয়ে অবহিত পাঠক এবং বিজ্ঞান কর্মী। যারা সব সময় ভাবেন কীভাবে দেশে বিজ্ঞান চর্চা এগিয়ে নেওয়া যায়। যারা নিজ উদ্যোগেই বিজ্ঞান প্রেম ছড়িয়ে দিতে এগিয়ে আসেন।

“নক্ষত্র, নিউরন ও ন্যানো” বইটিতে দুরকম লেখাই আছে। যেমন, ‘রসায়নের দশ দিগন্ত’, ‘আদি মাতার সন্ধানে’, ‘মস্তিস্কের লিঙ্গভেদ’, ‘দূর পৃথিবীর ডাক’, ‘ইউডাসাক্সের স্ফিয়ার…’ সহ আরো কয়েকটা লেখা প্রথম প্রকারের। আর দ্বিতীয় প্রকারের লেখা হচ্ছে, ‘স্বপ্নতাড়িত ন্যানো ও প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা’, ‘বিজ্ঞান-সংস্কৃতি’, ‘ঢাকা শহরের গড় মুক্ত পথ ও পনেরকটি মানুষ’, ‘আমাদের বিজ্ঞান সাহিত্য’, সহ আরো বেশ কিছু। আমি নিজে যেহেতু দ্বিতীয় ঘারানার পাঠক সেহেতু বইটি থেকে বিজ্ঞানের সাথে সাথে, আমাদের দেশে বিজ্ঞান চর্চার হালচাল, সম্পর্কেও অনেক কিছু জেনেছি। নানান বিষয়ে চিন্তা উস্কে দিয়েছে লেখাগুলো। রিভিউ হিসাবে সেইসব চিন্তাভাবনাই লিখে ফেলি।

প্রথমেই লেখককে নিয়ে কথা। আমাদের দেশে বাস করে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মত যে দুর্লভ কিছু মানুষ এখনো টিকে আছেন ফারসীম মান্নান মোহাম্মাদী তাদের মধ্যে অন্যতম। গণিত অলিম্পিয়াডের আঞ্চলিক অনুষ্ঠানের জন্য দৌড়াদৌড়ি, বিজ্ঞান জনপ্রিয় করণ, তরুণ বিজ্ঞান কর্মীদের মেন্টরিং থেকে শুরু করে নিয়মিত বিরতিতে বিজ্ঞান নিয়ে লেখালিখি তাও বুয়েটে শিক্ষকতা করার মত একটা ব্যস্ততাময় জীবনের মাঝে নিঃসন্দেহে অনুকরণীয়। যেখানে একই রকম সামাজিক ও প্রফেসনাল অবস্থানে থেকে অনেকে স্রেফ অভিযোগই করে যায়, সেখানে লেখক একজন উজ্জল ব্যতিক্রম। এই বইএর বেশকিছু লেখাতে, তার সেই সব অ্যাক্টিভিজমের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ছাপ পাওয়া যায়। যেমন প্রথম লেখাতে ন্যানো টেকনলজি সম্পর্কে পাঠককে পরিচিত করার সাথে সাথে এই বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ হিসাবে দেশের বিজ্ঞান পলিসির ব্যাপারে তার প্রস্তাবনাগুলো আমরা জানতে পারি। জানতে পারি এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের কথা। একটা গণতান্ত্রিক দেশের প্রধান মন্ত্রীকে কোনো আশ্বাস বাস্তবায়নে জোর করতে পারে শুধুমাত্র দেশের জনগন। তাই এই লেখায় একজন বিশেষজ্ঞ হিসাবে জনগণের কাছে ন্যানোর বার্তাগুলো বয়ে আনেন লেখক। মূল লেখাটা প্রকাশিত হয়েছিলো বিডিনিউজ এ ২০১২ সালে। এই বই এর লেখাগুলো মূলত পত্রিকায় প্রকাশিত লেখকের বিভিন্ন প্রবন্ধের সঙ্কলন। যার সবচেয়ে আগের লেখাটা ২০০০ সালের। ভবিষ্যতের কোনো সাহিত্য বিশারদ চাইলে এই বই থেকে লেখকের লেখনভঙ্গির বিবর্তনের ধারাটা বিশ্লেষণ করতে পারেন। : )

‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি’ লেখাটার বিষয়বস্তু একটা বিজ্ঞানমনস্ক রুচিশীল সমাজ গড়ে তুলতে বিজ্ঞান সাহিত্যের বিকাশের প্রয়োজনীয়তা। এই উপলব্ধি থেকেই রবীন্দ্রনাথও সেকালে ‘বিশ্বপরিচয়’ নামক সুখপাঠ্য একটা বই লেখেন। যার ভুমিকাতে কবিগুরু লিখেছিলেন, “শিক্ষা যারা আরম্ভ করেছে, গোড়া থেকেই বিজ্ঞানের ভান্ডারে না হোক, বিজ্ঞানের আঙিনায় তাদের প্রবেশ করা অত্যাবশ্যক। এই জায়গায় বিজ্ঞানের সেই প্রথম পরিচয় ঘটিয়ে দেবার কাজে সাহিত্যের সহায়তা স্বীকার করলে তাতে অগৌরবের কিছু নেই। সেই দায়িত্ব নিয়েই আমি [বই লেখার] কাজ শুরু করেছি।…

মূল লেখায় কবিগুরুর কোট করা অংশটা পড়তে পড়তে এ বিষয়ে নজরুলের সংকল্প কবিতাটার কথাও মনে পড়ে।

“হাউই চড়ে চায় যেতে কে

চন্দ্রলোকের অচিনপুরে,

শুনব আমি, ইঙ্গিতে কোন

মঙ্গল হতে আসছে উড়ে।

পাতাল ফেড়ে নামব আমি

উঠব আমি আকাশ ফুঁড়ে,

বিশ্বজগৎ দেখব আমি

আপন হাতের মুঠোয় পুরে।””

যেখানে ঘরকুনো বাঙালীকে জগৎটারে দেখায় উদ্বুদ্ধ করছেন কাজী নজরুল ইসলাম। একই সঙ্গে প্রকাশ পাচ্ছে বিশ্বজগৎ নিয়ে তার অপার কৌতূহল। বাঙালিকে ঘর ছেড়ে বের করে আনার কাজ আজো শেষ হয়নি। এই মহান পুরুষদের অসম্পূর্ণ কাজ তাই তুলে নিতে হবে এযুগের সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী সহ বিজ্ঞানপ্রেমি প্রতিটি মানুষকেই। এই বইটিও সেই পথের আরেক কদম।

আমাদের দেশে বিভিন্ন পলিসি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত যারা নেন তাদের অনেকেই চর্চার মধ্যে থাকা বিজ্ঞানী নন। প্রশাসনের হাজারটা ঝামেলায় অনেক সময় বিজ্ঞানের হালচাল নিয়ে খোঁজ রাখা সম্ভব হয় না। কিন্তু পনের কোটি মানুষের দেশে প্রতিটি পরিকল্পনাকেই হতে হবে সুনিপুন, স্বল্প সম্পদে সবার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন ইত্যাদির ব্যবস্থা করা স্রেফ রাজনৈতিক কৌশল খাটিয়ে সম্ভব নয়। অবধারিত ভাবেই দরকার বৈজ্ঞানিক কৌশল। এবং তার জন্য প্রসাশনকেও বিজ্ঞানের নানান বিষয়ে অবহিত করা প্রয়োজন আছে। আমেরিকায় দেখেছি, বিজ্ঞানবক্তা নীল-ডি-গ্রেস টাইসন তাদের কংগ্রেসে বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন। আমাদের মত দেশে এই প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি। এমন একদিন আসবে যখন বিজ্ঞান পলিসি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমাদের জাতীয় সংসদেও বিজ্ঞানীদের ডাক পড়বে বক্তৃতা দিতে। কিন্তু সেটা হবার আগে এসব নিয়ে তথ্যবহুল ও অন্তর্জ্ঞান সম্পন্ন লেখা তাদের হাতের নাগালের মধ্যে রাখাটাও জরুরী। “ঢাকা শহরের ‘গড় মুক্ত পথ’ ও পনের কোটি মানুষ”, এবং “আমাদের শক্তি সংকট: নিওলিথিক মোমবাতি বনাম পরমাণু শক্তি” এগুলো সেই ধরনের লেখা। ঢাকা কেন্দ্রীক পলিসির বদলে কীভাবে বিকেন্দ্রীকরণ করা যায়, আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীদের সাফল্য, সেই সঙ্গে তরুণ প্রজন্ম নিয়ে আশাবাদ দেখি প্রথম লেখাটিতে। আর দ্বিতীয় লেখাতে পাই বহুল আলোচিত পরমাণু শক্তি কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত।

এভাবেই একের পর এক লেখায় উঠে এসেছে লেখকের অ্যাক্টিভিজমের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং তার বিজ্ঞানচিন্তা। লেখক একজন নিরলস বিজ্ঞানকর্মী হওয়ায় পড়ার ঘরের আয়েশে বসে রাজা-উজির মারা লেখার তুলনায় বহুগুণে গুরুত্বপূর্ণ মতামত ও অভিজ্ঞতা পাওয়া যায় তার লেখায়। বিশেষ করে দেশে বিজ্ঞান চর্চার বিকাশ নিয়ে যারা ভাবছেন, যারা কাদা-জলে নেমে কিছু শুরু করতে চাচ্ছেন তাদের জন্য এই বইটি একটা রত্নভান্ডার।

রিভিউ এর মধ্যে শুধু প্রশংসামূলক কথাবার্তা বললে কেমন যেন দেখায়। তাই একটা সমালোচনামুলক মন্তব্যও এখানে যোগ করি। মন্তব্যটা অবশ্য লেখা নিয়ে নয় বরং আমাদের সামগ্রিক বিজ্ঞাণ প্রকাশনীর হালচাল নিয়েই। আমাদের দেশে প্রফেশনাল বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক সম্ভবত নেই। যার একটা সুক্ষ্ম ছাপ পাই বইটিতে। পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আঙ্গিকের লেখাগুলোকে একটা বই তে একই আঙ্গিকে বেধে ফেলতে পারেন শুধু মাত্র একজন অভিজ্ঞ সম্পাদকই। এ কারণেই হয়তো কিছু লেখার টোন বেশ ফর্মাল শোনায় যেখানে অন্য লেখাগুলো ফুরফুরে মেজাজের। আশার বিষয় বিজ্ঞান সাহিত্য দেশে জনপ্রিয় হচ্ছে। খুব শিঘ্রই হয়তো, বিজ্ঞান বই এর প্রকাশকরা পত্রিকার বিজ্ঞান পাতার মত করে বিজ্ঞান সম্পাদকও নিয়োগ দিতে পারবেন। তখন এই বই এর পরবর্তী সংস্করণ সহ আগামীর সব বিজ্ঞান বই কাটিয়ে উঠবে এই সাময়িক দুর্বলতা।

সব শেষে বইটির মুখবন্ধ থেকে ধার করে বলি, এক কাপ কফি খেতে খেতে এক গভীর বোধের দিকে ধাবিত করে এই গদ্যনিচয়।