প্রাণী নিজেকেই সবথেকে বেশী ভালবাসে। প্রাণী হিসাবে মানুষেরও এই বৈশিষ্ট্য থাকাটা দোষের কিছু নয়। তবে মানুষের অবচেতন (subconscious mind) আর অচেতন মনে (Unconscious mind) আত্মপ্রেম স্বতঃস্ফুর্ত হলেও সচেতনে (Conscious mind) তার নিজস্ব কিছু পছন্দের স্বাধীনতা রয়েছে। ইচ্ছে করলে সে ভালবাসার ব্যপারে নিজের উপরে অন্যকেও প্রাধান্য দিতে পারে। অন্যের জন্যে নিজের জানটাও দিয়ে দিতে পারে। তাই আত্মহত্যা শুধুমাত্র মানুষই করে। তবে অন্যের কারনে নিজের অস্তিত্বকে বিপন্ন করাকে আত্মহত্যা না বলে আত্মবলীদান বলা হয় শহীদের সন্মানার্থে। তাছাড়া আত্মহত্যা আর আত্মোতসর্গের ভিতরে মৌলিক তফাতটা হলো- আত্মহত্যায় পাত্র নিজেই হন্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, কিন্তু শহীদ তা করে না। সে যাই হোক, নিজেকে উতসর্গ করতে হলে কঠিন মাদকে বুদ হয়ে সচেতন মনকে মাতাল করা লাগে। দেশপ্রেম, জাতিয়তাবাদী প্রেম, ঈশ্বর প্রেম, রোমান্টিক প্রেম সেইসব কঠিন মাদক, যা দেশ-কাল-পাত্র নির্বিশেষে মানুষকে আত্মবলীদানে অনুপ্রেরণা যোগায়। এই প্রসঙ্গে একটু ইতিহাসে দিকে ফিরে যাই। ১৮৫৭ সালে মানুষ (সেপাইও মানুষ) স্বতঃস্ফুর্তভাবে দেশপ্রেমের মহুয়া নেশায় নিজেদের উতসর্গ করেছিল, ফলাফল যাই হোক। সাতচল্লিশ আর একাত্তরেও সেই সাধারন মানুষ দেশপ্রেমের তীব্র নেশায় ধরাশায়ী হয়েছিল। শহীদেরা যদিও বিজয়ের কোন ফল আস্বাদন করতে পারে নাই, কিন্তু তাদের ছেলেমেয়েরা কেউ কেউ করেছিল। জীবিত বিজয়-সংগ্রামীদের ভাগ্যে কি হয়েছিলো? তারাও বিজয়ের ফল কেউ খেল, কেউ খেল না। হিসেব কষে দেখা গেল এই না-খাওয়া বঞ্চিতদের সংখ্যাই বেশী। প্রত্যেক রক্ত-মাংশ পানি করা সংগ্রাম-যুদ্ধে কিছু ধুর্ত-শুভাঙ্কর এই জটিল অংকগুলো সাজিয়ে রাখে বারবার, আর সেই অংকের ধাঁধাঁয় ধরা পড়ে যায় এই সব প্রেম-মাতাল সাধারন মানুষেরা। এইভাবে যুগের পর যুগ চলতে পারে না। নিঃস্বার্থ মাতাল মানুষেরাও প্রতিশোধ নিতে জানে। তাই তারা তাদের প্রতারিত হবার অভিজ্ঞতা-গল্প তাদের নিস্ব উত্তারিধিকারদের কানে ঢেলে দিয়ে যায়। ইতিমধ্যে বাজারে এসে যায় নতুন পণ্য- ভোগ-বিজ্ঞাপন, যার নেশা সবকিছুর নেশাকে ছাড়িয়ে যায়। তাই প্রতারিত নিঃস্ব মানুষগুলো বড় নেশায় সাড়া দেয়, বোতল বোতল কর্পোরেট-ভোগ গেলার খোয়াবে ভুলে থাকে প্রতারণা আর নিঃস্বতার জ্বালা। আগে যেখানে এক আসাদের অন্যায় হত্যার প্রতিবাদ করতে হাজারে হাজার স্বদেশ-মাতাল মানুষ অনাহুত রাস্তায় নেমে আসতো, আজ সেখানে শীতলক্ষার পানিতে অগুনিত শব ভেসে উঠলে, অথবা বিদ্ধস্ত ইমারতের নীচে হাজার মানুষ চাপা পড়ে গেলেও তাদের নেশা ছোটে না। ওদের নেশা হয়তো আর ভাংবে না। যুগ যুগ ধরে এইসব নিঃস্ব মাতালদের রক্ত-ঘামে ভিজে উঠে এসেছে বিপ্লব, কিন্তু তার ফলের স্বাদ নিয়েছে কিছু খল-শুভাঙ্করের দল। মানুষ এসব ফাঁকি ধরে ফেলেছে, তাই নিজেকে খুশি করার ভয়াল নেশায় ধরা দিয়েছে তারা।

যেদিন থেকে মানুষ তার দুই পায়ের উপর ভর দিয়ে হাটা শিখলো, আগুনকে কাজে লাগাতে শিখলো, সেদিন থেকে প্রকৃতি মানুষের পরিবর্তন, পরিমার্জনের ভার তার উপরেই ছেড়ে দিলো। সেই থেকে মানুষ সয়ম্ভর। সেই থেকে মানুষ নিজেকে রচনা করে চলেছে নিজের মতন করে। এই আত্মরচনায় যখনই ছেদ পড়েছে, তখনই সে ফুঁসে উঠেছে আত্মপ্রকাশের অশুভ প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে। একে বিপ্লব, রেভ্যুলুশন যে নামেই ডাকা হোক তাতে মানব চরিত্রের এই অপ্রতিরোধ্য পরিবর্তন পিপাসু দিকটাকে চিনে নিতে কারও এতটুকু ভুল হয় না। এই আলোচনার আলোটুকু যদি আমারা আজকের বাংলাদেশের উপরে নিক্ষেপ করি তাহলে স্পষ্টই দেখতে পাবো- পৃথিবীর ধারাবাহিক সভ্যতা-প্রয়াসের আলোর মাঝখানে আমরা এক টুকরো প্রগাঢ় অন্ধকার, যে অন্ধকার স্বাভাবিক পরিবর্তনের স্রোতধারাকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে সব কিছু ঠিকঠাক আছে, কিন্তু সব কিছুর ভিতরে কি যেন নেই এবং তা অনুভব করা যায় প্রকট ত্রিমাতৃকতায়। এর জন্যে মানুষের দোষ দিয়ে লাভ নেই। বলতে দ্বিধা নেই এই জনপদের গণচরিত্র একেবারে পালটে দিয়েছে এক আপাত দৃশ্যমান অপশক্তি, যার নাম ভোগ-বিজ্ঞাপনের অমর দানব। রূপকথার দানবদের জীবন কৌটাবদ্ধ ভ্রমরের দেহে থাকলেও এই দানবের জীবন-মরন কোথায় আছে তা কেউ জানে না। এই অমর-ভোগ ক্ষয়িষ্ণু এই জনপদে অনেকটা নতুন সংযোজন। তাকে অস্বীকার করে কোন পরিবর্তন প্রয়াস হালে পানি পাবে না। পৃথিবীতে সমাজবাদের পতন আমরা দেখেছি, দেখছি পুজিতন্ত্রের লেজেগবুরে অবস্থা। আরো দেখছি এই ভুগোলকে অনেক দেশ পুজিবাদ আর সমাজবাদের শুভ মিশ্রন ঘটিয়ে একধরনের কল্যান রাষ্ট্র গড়ে মানবতার পুলসেরাত পার হবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের আরো দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, লক্ষ লক্ষ পরিবর্তন প্রত্যাশি আধুনিক মানব শাহবাগ নামের এক মিলন মেলায় এসে কিছু বলতে না পেরে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে কেমন করে অবলা প্রাণীর মতন আবার ঘরে ফিরে যায়। এইসব তাবত অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় এনে, রক্তে মিশে যাওয়া ভোগ-বিজ্ঞাপণের কথাটা মাথায় রেখে ঠিক করতে হবে আমাদের পরিবর্তনের বিপ্লবটা আসলে কেমন চেহারার হবে।