হয়ত ভাগ্যদোষেই আজ তারা ছারপোকা। দেহাকৃতিতে অবিকল মানুষ হলেও জীবিকার ঘরে এরা দ্বিপদী কোন কীট। “ছারপোকা” শব্দটি তথাকথিত ভদ্র সমাজের কাছে একটি আতংকই বটে। ঘরের কোন এক কোনে জন্ম হয়েছে শুনলেই তৎক্ষণাৎ তা ধ্বংস করবার পায়তারা শুরু হয়ে যায়। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে কীট ছারপোকার পাশাপাশি মানব ছারপোকার আবির্ভাব ঘটে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আজ অবধি বাংলার আনাচে-কানাচে এর বিস্তৃতি।

তবে কীট ছারপোকা আর মানব ছারপোকার মাঝে ব্যবধান মাত্র দু-তিনটে ক্ষেত্রে। কীট ছারপোকা ছয় পায়ে চলাফেরা করে, সেখানে মানুষ দ্বিপদী। কীট ছারপোকা যেখানে-সেখানে অবাধে বিচরণ করতে পারলেও মানব ছারপোকার বিচরনক্ষেত্র সীমিত। মজার ব্যাপার হল, কীট ছারপোকা রোগ ছড়ায় কিন্তু মানব ছারপোকা নিজেই রোগে আক্রান্ত হয়ে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে থাকে। স্রষ্টার সৃষ্ট এত বড় দুনিয়ায় ছারপোকার অবস্থান বরাবরই সংকটাপন্ন। কীট ছারপোকা আমাদের ঘরের কোনে জায়গা পেলেও মানব ছারপোকার অবস্থান তথাকথিত ভদ্র সমাজ থেকে অনেকটাই দূরে। তাদের অবস্থান কখনও রাস্তায়, কখনও নালা-নর্দমার পাশে আবার কখনও ফুটপাতের ওপরে। কিন্তু সেখানেও তাদের জন্য সীমানা নির্ধারিত। নির্ধারিত বেষ্টনির বাইরে তাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে হাজারো বঞ্চনা।তাদের চাহিদাও সমাজের আর দশটা মানুষের মতনই স্বাভাবিক। তিন বেলা পেট পুড়ে খাওয়া, শরীরের লজ্জাস্থান রক্ষা আর থাকার জন্য একটু খানি জায়গা। যার কোনটিই তাদের কপালে ঠিক মতন জোটে না। তারা অশিক্ষিত, তাদের ভালো কোন পোষাক নেই আর নেই পুঁজি। বিভিন্ন স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছনে, রেললাইনের পাশে, রাস্তার ফুটপাতে এরা গড়ে তোলে এদের বসতি। সারা জীবন দুটি চোখ মেলে শুধু দেখেই যায় আপনার শিক্ষাঙ্গন, কিন্তু ভাগ্য হয় না সেথায় পা রাখার। ভাগ্য হয় না দামী গাড়িতে চড়ে আপনার মতন ঘুরে বেড়ানোর।

হবে কি করে? আজ আমি-আপনিই তো তাদেরকে ছারপোকা বানিয়ে রেখে দিয়েছি ভদ্র সমাজের বাইরে.
কীট ছারপোকা তাড়াতে আজকাল স্প্রে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু মানব ছারপোকা তাড়াতে ব্যবহৃত হয়২ মানুষেরই বুদ্ধি। পুঁজিবাদী সমাজের রোষানলে চাপা পড়ে যায় গরীব-মূর্খ সমাজ। প্রতিযোগিতার এই সমাজে পেটের তাগিদে অসময়েই তারা বাধ্য হয় সংসারের চাকা ধরতে। শিক্ষার আলো দেখবার আগেই তাদের সামনে উদিত হয় কষ্টের সূর্য। সে সূর্যের তাপে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় তাদের স্বপ্ন। কষ্ট করতে করতে একটা সময় তারা ভুলেই যায় যে তারা মানব-প্রাণী। মানুষ হিসেবে তারও অধিকার আছে মাথা তুলে দাঁড়াবার। পুঁজিবাদীদের ক্ষমতার দাপটে মাথা গোজার শেষ ঠাঁইটুকু যেখানে হারিয়ে যায়, সেখানে মাথা তুলে দাঁড়াবার চিন্তা কোথা থেকে আসবে?
মানুষের মৌলিক চাহিদার অভাবগুলো তাদের জন্মসঙ্গী। জন্মের পর যে শিশু তার মাকে ডাস্টবিনের খাবার খেয়ে জীবন ধারন করতে দেখে, সে কিভাবে আপনার মতন স্বপ্ন দেখবে বড় হয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবার? সারা জীবন যে মানুষেরা কাকের মতন ডাস্টবিনের ময়লা খাবার খেয়ে দিন কাটায়, সে কিভাবে জানবে ভদ্রতা কাকে বলে? কারন, ভদ্রতা আর ঈশ্বর থাকেন তো ঐ পুঁজিবাদী সমাজে। ভদ্র সমাজের বেষ্টনী ডিঙ্গিয়ে কখনোই তিনি এদিকে উঁকি দিয়ে দেখেন না। যদি কখনো উঁকি দিয়ে থাকেন, তাহলে বোধ করি লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজে পাবেন না তিঁনি।

এই গোষ্ঠিটা যে তাদের ভাগ্য বদলানোর চেষ্টা করে না- সে ধারণা ভুল। তারা প্রতিনিয়ত যুদ্ধে করে যায় তাদের ভাগ্য ফেরাতে। স্বাভাবিকভাবে আপনার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, “তাহলে কেন তাদের ভাগ্য ফিরছে না?” তাদের এই দুরাবস্থার জন্য আমাদের সমাজ কাঠামোটাই মূলত দায়ী। সব সমাজেই ধনী-গরীব আছে। কিন্তু বাংলাদেশে এই রেষারেষিটা একটু বেশি। এখানে পুঁজিবাদীরা আরো পুঁজি বিনিয়োগ করে রাতারাতি ধনী হয়ে উঠেন। কিন্তু তাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারায় মধ্যবিত্তরা ধীরে ধীরে তাদের সহায়-সম্বল সব কিছু হারাতে থাকে। ক্রমেই এই চাপটা গিয়ে দাঁড়ায় সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষদের উপর। যে চাপ সহ্য করতে পারার ক্ষমতা তাদের নেই। ফলে অচিরেই তারা গরীব থেকে আরো গরীব হয়ে পড়ে। একটা সময় টিনের দো-চালা ছেড়ে দিয়ে বাস করতে হয় খড়ের তৈরী ঘড়ে। সমতল ভুমি ছেড়ে থাকতে হয় নিচুঁমাটির বস্তিতে।

এছাড়া আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, মানবতাবোধের অবক্ষয়ও এর আরেকটি কারন। আমরা মানুষেরা জন্মগত ভাবেই একটু হিংসুক হয়ে থাকি। এই হিংসার তাড়নায় পথে বসে যাওয়া এসব মানুষদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে আমাদের আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। এদেরকে দেখলেই আমাদের অন্তরে একটা ডিজিটাল ঘৃণা জন্ম নেয়। মন বলে- “আরে! এরা তো বস্তি, এদের সাহায্য করার দরকারটা কি? এরা মরুক,পঁচুক তাতে আমার কি? এরা কি আমাকে কোনো সাহায্য করে?”
আপনি চাইলেই উপরের কথাগুলো অস্বীকার করতে পারবেন না। কারন, কথাগুলো সত্য। এরা আপনাকে হয়ত কোনদিন সাহায্য করেনি, কিন্তু তাই বলে আপনি সাহায্য করবেন না- এটা তো কোথাও লেখা নেই। মানুষই মানুষের সঙ্গী। বিপদে পরস্পরকে সাহায্য করার মধ্যেই তো মানবতা। যদি আপনি সাহায্য নাই করবেন, তাহলে আপনার মানবতার দাম রইল কোথায়? কি দরকার আছে আপনার এই বিবেকবোধের? ছুড়ে ফেলে দিন নর্দমায়। কারন, নর্দমার কীটদেরও কোন বিবেকবোধ নেই। আমি এমনও মানুষ দেখেছি, যে বা যারা ধানমন্ডি ৩২ নম্বর লেকের নোংরা পানি পান করে নিজেদের তৃষ্ণা নিবারন করেন। সে পানিতে গোছল করতে দেখা তো নিত্যদিনের ঘটনা।

যে মানুষ কাজের অভাবে পেটের ঘরে তালা লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তার সেই উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরা কি চাইলেই আমরা বন্ধ করতে পারি না? অবশ্যই পারি। কিন্তু এখনই আবার প্রশ্ন তুলবেন, “এরা অধিকাংশই তো চোর-বদমাস হয়। কাজের সময় কোন কিছু চুরি করে নিয়ে গেলে কি তার দায়-দায়িত্ব আপনি বহন করবেন?” এর উত্তরটা আমি একটু পরে দিচ্ছি। তার আগে আসুন জেনে নিই কেন তারা আজ চোর, কেনই বা বদমাস? কথায় আছে – পুত্র শোকের চেয়ে ক্ষুধার জ্বালা বেশি কষ্টের। জন্মের পর থেকে নষ্ট খাবার, ঝুটা খাবার, ডাস্টবিনের খাবার খেতে খেতে একবার কি এদের শখ হয় না ভালো কিছু খেতে? সেই শখ পুরণ যতক্ষন হচ্ছে না ততক্ষন সে নানাভাবে চেষ্টা করতে থাকে সে শখ পুরণের। আর বস্তির মানুষ বলে এদেরকে কেউ কাজও দেয় না। আর তখনই পেটের ক্ষুধা আর শখের খোরাক জোগাতে শেষমেষ করতে হয় চুরি। তাহলে এবার আপনিই বলুন, তাদের দোষটা কোথায়? আর চুরির দায় কি আমার নাকি আপনার? আপনি যদি আপনার বাবাকে বলে যখন-তখন নান্নার বিরিয়ানী খেয়ে আসতে পারেন, তাহলে তাদের কি সামান্য ভালো কিছু খাবারের আশা করাটা পাপ হবে?
আশা করি আপনি আপনার প্রশ্নের উত্তরটা পেয়ে গেছেন এতক্ষনে।

“যে প্রাণী মানুষ হয়ে মানুষের কাছ থেকেই প্রতিনিয়ত ঘৃণা, বঞ্চনা-গঞ্জনা আর ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তার কি মানুষ হয়ে জন্মানোর কোন দরকার ছিল?” নাকি প্রশ্নটা এভাবে বলব, “যে প্রানী মানুষ হয়ে প্রতিনিয়ত মানুষকেই ক্ষতি, বঞ্চনা আর গঞ্জনা করে এসেছে, তার কি কোন দরকার ছিল মানুষ হয়ে জন্মানোর?” কোন প্রশ্নটা করলে আপনি খুশি হবেন, আর কোন প্রশ্নটা করলে রাগ করবেন, তা তো আপনিই ভালো জানেন। মানুষ হয়েও যখন তারা মানুষের মতন বাঁচতে পারবে না, মানুষের মতন স্বপ্ন দেখতে পারবেনা, মানুষের খাদ্য খেতে পারবেনা, তখন তাদেরকে আমি মানুষ বলি কি করে? তাদেরকে পৃথিবী-রাজ্যের কোনায় কোনায় দুমড়ে মুচড়ে পড়ে থাকা ছারপোকা বললে কি খুব ভুল হবে? বোধ করি, না।