প্রতিভা হচ্ছে প্রকৃতির প্রকাশের দ্বার। দেশে-কাল নির্বিশেষে তার উন্মেষ ঘটে স্বতঃস্ফুর্ততায়। প্রতিভা বন্ধ্যা নয়- বন্ধ্যা আমাদের দৃষ্টি। সেই চার যুগ আগেও পদস্থ গুরুর বিদায় মানপত্রে লেখা থাকতো- এ বিশ্ব চরাচরে স্বর্গ-মর্ত ছেয়ে সবচেয়ে পুরাতন ব্যথা………যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়। আজও মানপত্রে ঠিক তাইই লেখা থাকে। এই রুচি-স্বাদের বহুমুখী চর্চার জগতে, মননের নিত্যনতুন আহার্যের প্রয়োজনকে অস্বীকার করে একস্থানে সেটে থাকার প্রবনতা একটা বিশেষ ফেনোটাইপ বৈশিষ্ট, যা অনগ্রসরতার ইঙ্গিত বহন করে। শিল্প-কলার ভোক্তা হিসাবে, পাঠক হিসাবে আমাদের সীমাবদ্ধতা একেবারে কম নয়। সেখানেও আমরা আটকে আছি নারী-পুরুষের লৈঙ্গিক স্টেরিওটাইপে। তাই কখনও কখনও সৃষ্টিপ্রয়াসী নারীর সৃষ্টিশীলতাকে চারু দেহকলার লাবন্য-আভায় উদ্ভাসিত করে প্রচলিত জনপ্রিয়তার পথ ধরে সংখ্যাগুরু পাঠকের বিচার-বোধকে ধোয়াসাচ্ছন্ন করে দেয়। এসব তথ্য বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের ভান্ডার থেকে আহরিত, যা কিনা হবসের ‘প্রকৃতির জনপদে’ সবচেয়ে বেশী কাজ করে। বাংলাদেশও কি ‘প্রকৃতির জনপদ’? যোগ্যতমের উর্ধতনের বা চারু-তনুর রমনীয়তার প্রভাব কি এখনও আমদের যুক্তিবোধকে ভোতা করে? যদি করে, তাহলে এখনও আমরা ‘প্রকৃতির জনপদে’ই আছি। ঠিক একই ভাবে সৃজনস্পৃহ পুরুষের সৃজনশীলতাকে ‘বীর ভোগ্যা বসুন্ধরা’ প্রকৃতি স্বাভাবিক শিল্প বিচারের মানদন্ডকে এড়িয়ে জনপ্রিয়তার এক অর্থহীন মাত্রায় নিয়ে ফেলতে পারে। প্রাক্তন স্বৈরাচার হুসেন এরশাদের কাব্য চর্চার প্রয়াস এর একটা উদাহরন হতে পারে। তাই জনপ্রিয়তা এই জনপদে একটা পতনের নাম- এমন ধারনা হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। অতি-আবেগ চর্চায় এখন আমরা প্রায় স্থবির এক জাতি। নিরঙ্কুশ আবেগের এই স্থুলচর্চা থেকে আমাদের বেরোবার পথ খুজতে হবে। মানুষ শিখবে জানবে, শ্রেষ্ঠ নান্দনিক হীরক খন্ডটি তুলে নিয়ে একদিন জীবনের সাথে গাথতে পারবে এমন আশা করতে দোষ নেই। কারণ প্রযুক্তি আর শিল্প-কলায় যারা সমান উতকর্ষিত তারাই ভারসাম্যমান জাতি। তাদের সভ্যতাই টেকসই। তাদের উত্থানের ধারাবাহিক ইতিহাস আমাদের চলার পথকে আলোকিত করুক এমন আশাও করি।

তারপরেও একটা প্রশ্ন থেকেই যায় মনে। কেন আমরা খুজতে যাব শিল্প-সাহিত্যের মৌলিকতা? কেনইবা জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে যাব শিল্পের নান্দনিকতা? যা দিন কাল পড়েছে, যেখানে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার মতন বিষয় মুখ থুবড়ে পড়ছে। যেখানে পুরো জাতির উপরে চেপে বসে গেছে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা। সেখানে তো কবিতার বদলে শিখতে হবে খিস্তি-খেউড়, গিটারের বদলে প্রশিক্ষন নিতে হবে পাটকেল ছোড়ার। এসব মৌলিক প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়- এই দড়াটানাটানি একদিন থাকবে না, সেদিন নান্দনিকতার যে বিপুল চাহিদা তৈরী হবে, তা মিটবে কি দিয়ে? যুদ্ধের পরীখার ভিতরেও গর্ভবতী মা সন্তান প্রসব করে। আগ্নেয়গীরির পাশেও প্রেমিক-প্রেমিকার রোমাঞ্চের চাহিদা তৈরি হয়। আজ যদি আমরা মৌলিক শিল্প সৃজনের দিকে মনযোগী না হই তবে, সাহিত্য-ব্যবসায়ীরা ততপর হবে, মুনাফা লুটবে সস্তা বিনোদনের বদলে। বিনোদনের সাথে যে কিছু শিক্ষাও দিতে হয়, সে ভাবনা তো থাকে মৌলিক শিল্পানুরাগীর অন্তরে। উল্লেখ করতে বাধা নেই- শিক্ষা আর বিনোদনের তিন রকমের জোড়া মিশ্রন তৈরী করা যেতে পারে- এক- বিনোদন সহযোগে শিক্ষা, দুই- বিনোদন ছাড়া শিক্ষা, তিন- শিক্ষা ছাড়া বিনোদন। এই মিশ্রনের প্রথমটি উত্তম, দ্বিতীয়টি মধ্যম, তৃতীয়টি অধম। উত্তমের ব্যবস্থা আর যোগ্যতা থাকতে কেন আমরা অধমের পিছে দৌড়াব। একটা ক্ষয়িষ্ণু জাতির সর্বাত্মক ভাঙ্গন রোধে বিনোদন সহ শিক্ষার কোন বিকল্প নেই- এটা যদি আমরা বুঝে থাকি, তাহলে মৌলিক নান্দনিক শিল্প-সাহিত্যের প্রসার ও প্রতিষ্ঠায় মনযোগী হবো।

নান্দনিক শিল্পীদের ভিতরে কোন তুলনা নয়, নয় তাদের সৃষ্টিশীলতার উচু-নীচু বিচার- নিছক পাঠকের স্বভাব-বৈশিষ্টের কথা এমনিতেই উঠে আসে। কারণ অনেক সময় পাঠকও ভাল লেখক তৈরীতে অবদান রাখে। ইলিয়াস, হুমায়ুন আহমেদ দুজনেই শিল্পী। আমি ইলিয়াস পড়েছি বা আমার শেলফে ইলিয়াস আছে, এমন বললে অভিজাতের কাতারে দাঁড়ানো যায়- সেই হিসাবে ইলিয়াস জনপ্রিয়। জীবনানন্দের অবস্থাও প্রায় একই রকম। তাঁর কবিতার নান্দনিকতা আর বিমূর্ত প্রকাশে কতজন করতে পারে স্নান! কিন্তু হুমায়ুন সাহেব এমনিতেই জনপ্রিয়। এটা ঈর্ষার কোন বিষয় নয়- বিষয় পাঠকের উতকর্ষতার মানদন্ড। ঠেকায় পড়ে প্রযুক্তির উন্নতি হয়- হবে, কিন্তু নান্দনিক শিল্পের উন্নয়ন ঠেকায় পড়ে হয় না, হয় চর্চায়, অনুপ্রেরনায়, লালনে আর সাধনায়। সম্ভাবনাময় বাংলার উর্বর ভূমিতে কত ইলিয়াস, মানিকের সৃজনশীলতা উতসাহ-প্রণোদনার অভাবে শুকিয়ে মরছে তার খবর কে রাখে? যেদিন এইসব নান্দনিকতার নায়কেরা, প্রযুক্তি-বীরদের সাথে সমান তালে এই জনপদে স্বতঃস্ফুর্তভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে, সেদিন এদেশের শিল্প-সাহিত্যের তুলনা করা যাবে প্যরিস-রোমের শিল্প ভুবনের সাথে।