সকাল ১০টা বেজে গেছে। আজ বেলীর ঘরের দরজা এখনো বন্ধ। এর মধ্যে ফুলী বু এসে দু’বার ডেকে গেছে বেলীকে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। দরজা খোলার কোনো নামগন্ধ নেই। কী হয়েছে আজ তার? কোনো অসুখ-বিসুখ করেনি তো? হয়ত সে মজা করছে ফুলী বু’র সঙ্গে। চুপটি করে তামাশা দেখছে ঘরের ভেতর থেকে ফুলী বুর, আর ফিকফিক করে হাসছে তার জন্য ফুলীর উৎকণ্ঠা ও ব্যাকুলতা দেখে। মাঝেমাঝে বেলী এমন রসিকতা করে থাকে ফুলীর সাথে। বাপ-মা মরা এই মেয়েটিকে বিশেষ স্নেহ করে ফুলী। তার খবরাখবর নেয় প্রতিদিন। খুব ছোটবেলায় হতদরিদ্র বাবা-মা দুজনই মারা যায় বেলীর। তারপর এক বিত্তশালী আত্মীয়ের কাছে গৃহপরিচারিকা হিসেবে আশ্রয় পেয়েছিল সে। বড় হয়েছে তাদের ছত্রছায়ায়। তারা বেলীর বিয়ে দিয়ে তাদের নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব পালন করেছেন। বেলীর মনিবের পরিবার থাকে শহরে। শহরে তাদের বিশাল বাড়ি, বিরাট অবস্থা। গ্রামের বাড়িতে মাঝেমাঝে বেড়াতে আসেন। গ্রামের বাড়িটি ঝকঝকে রাখার জন্য ও জমি-জমাগুলিতে চাষাবাদ করে তাদের জন্য শহরে ফসলাদি, পুকুরের মাছ, চালের গুঁড়ো, হলুদ-মরিচের গুঁড়ো, পিঠে-চিঁড়ে করে পাঠানর জন্য বেলী ও তার স্বামী বাবুলকে তাদের গ্রামের বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। বাবুলও অতি দরিদ্র। তার নিজের কোনো বাড়িঘর নেই। বৌকে নিয়ে সে আর যাবেই বা কোথায়।

প্রতিদিন মোরগডাকা ভোরে ঘুম থেকে ওঠে বেলী। ঘরদোর ঝাঁট দেয়, উঠোন ঝাঁট দেয়। তারপর কয়লা দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে কলসী নিয়ে পুকুরের ঘাটের দিকে যায়। হাত-মুখ ধোয়, ছাই দিয়ে এলুমিনিয়ামের কলসীটাকে মেজে রুপোর মত চকচকে করে জল ভরে নেয়। ঘাটে দেখা হয় তার ফুলী বু, আলেয়া, কলি, মিনুর মা ও অন্যান্য সখি ও প্রতিবেশিনীদের সাথে। বেলী জলকেলি করতে করতে সবার সঙ্গে গল্প করে কিছুক্ষণ। খিলখিল করে হেসে হেসে পুকুরের শান্ত নিস্তরঙ্গ জলে তরঙ্গ তোলে কয়েকটি রমণী মিলে। তারপর জলভরা কলসী কাঁখে নিয়ে কলকল কথা, ছলছল হাসি ও টলটল চলার ছন্দে চারদিক মুখরিত করে দিতে দিতে সবাই যার যার বাড়ি ফিরে যায়।

বেলী ঘরে ফিরে এসে মাটির চুলোয় আগুন জ্বালে। সকালের নাশতা বানায়, চা বানায়। বাবুল ততক্ষণে হাত-মুখ ধুয়ে আসে। দু’জনে নাশতা খেতে বসে। বাবুল চলে যায় দূরের ক্ষেতে কাজ করতে। ফেরে বিকেলে বা সন্ধ্যায়। বেলী তার জন্য দুপুরের ভাত দিয়ে দেয়। একটা বড় বাটিতে ভাত তরকারি একসাথে দিয়ে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে তা গামছা দিয়ে বেঁধে দেয় যত্ন করে। বাবুলকে বিদায় দিয়ে বেলী সংসারের কাজকর্ম শুরু করে। বাটনা বাটে, কুটনা কুটে, রাঁধে, হাঁস-মুরগিদের খাবার দেয়, ধান সেদ্ধ করে, খেশারি ও মুগের ডাল শুকোতে দেয়, বাড়ির আশেপাশে ফল ও শাকসব্জির গাছ লাগায়।
গাছের মগডালে বসে কাঁচা আম খায় বেলী। কোমরে আঁচল বেঁধে শাড়ি হাঁটুর ওপর তুলে ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে মাঠে ছুটোছুটি করে, বড় রাস্তার দিকে দৌড় দেয় যখন-তখন। সে নাকি রাস্তার মানুষ দেখতে যায়, মোটর গাড়ি দেখতে যায়। তার মাথায় ঘোমটা থাকে না। চুল উড়তে থাকে বাতাসে, কোমর দেখা যায়, পায়ের অনেকখানি দেখা যায়। হাসে খলখল করে। সখিরা আসে তার সাথে গল্প করতে, সেও যায় ওদের বাড়ি।

বেলীর বিয়ে হয়েছে তিন বছর। এখনো বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। সবাই বলে, মেয়ে মানুষ অমন টইটই করে পাড়া বেড়ালে, অত জোরে হাসলে, অত গলা চড়িয়ে কথা বললে, মাথায় সব সময় কাপড় না রাখলে তাদের ওপর জ্বীনের আছড় পড়ে, পুরুষ মানুষ ও ভূতের বদ নজর পড়ে। এমন সৃষ্টিচ্ছাড়া উড়নচণ্ডি মেয়েলোকের বাচ্চা হবে কেমনে। বেলী খিলখিল করে হেসে বলে, জ্বীনভূত সবই তোরা দেইখা ফেলাইলি। আমি যে কিছুই দেখলাম না। আমারও দেখবার বড় সাধ হয় রে। ওরা বলে, ঠিকমত পর্দা ক্যান করস না, মাঠে মাঠে ক্যান দৌড়াস, পুরুষ মাইনষের চোখ পড়ে না? বেলী বলে, আমার শইল্যের দিকে যাগোর চোখ পড়ে হ্যেরা তাগো নিজের চোখের পর্দা ক্যান করে না, আগে হেইডা কও। ফুলিবু তো আমার মত ঢেংঢেং করে না, বেপর্দা চলে না। তার ক্যান বাচ্চা অইলো না কও দেহি। ওরা বলে, পোড়াকপালি, আগুনমুখী তুই মর।

আজ ভোরে কেউ বেলীকে পুকুরঘাটে দেখেনি।হয়ত সে আজ আরো ভোরে পুকুরঘাটে এসে চলে গেছে। আজ সকালে বৃষ্টি হয়েছিল বেশ। তাই হয়ত সে তাড়াতড়ি ফিরে গেছে ঘরে। ফুলীবু দু’বার ডেকে গিয়েও সাড়া পায়নি। আবার এসেছে সে বেলীর খোঁজ নিতে। ঘরের চারপাশ ঘুরে উচ্চঃস্বরে ডেকে যাচ্ছে তাকে। সাড়া নেই এখনো। ফুলী বলে চলেছে, ও বেলী, রাজরানী হইয়া গেলি নি আইজ? বেলা অইছে, এহনো উডনের নাম নাই। মাইয়া মানুষ এত বেলা পর্যন্ত ঘুমাইলে সংসারে কুফা লাগে। লুকাইয়া থাইকা আমার লগে ঢং করস ক্যা, উইডা যা, দুয়ার খোল। তর লাইগা পিঠা বানাইয়া আনছি, দ্যাখ। সাড়া নেই বেলীর। ফুলীর খুব রাগ হয় বেলীর ওপর। গজগজ করতে করতে দরজায় সজোরে ধাক্কা মারে সে। দরজা খুলে যায়। দরজাটি শুধু ভেজান ছিল। ভেতর বা বাইরে থেকে কোনো ছিটকিনি লাগান নেই। ফুলী রান্নাঘরের দিকে গিয়ে বেলীকে খোঁজে। দেখতে পায়, চায়ের চাপ, কয়েকটি থালাবাসন ও ভাত-তরকারির পাতিল নামান রয়েছে রান্নাঘরের মেঝেতে। ফুলী বলে, সকালে নাশতা খাইয়া, জামাইরে ভাত বাইন্ধা দিয়া কই পালাইলি রে বেলী? শব্দ নেই কোনো। এবার ফুলী আসে বেলীর শোবার ঘরের দিকে। দরজা বন্ধ। ফুলী ধাক্কা দেয়। দরজা খুলে যায়। ফুলী বিকট চিৎকার দেয়। ফুলীর চিৎকার শুনে চারপাশ থেকে লোকজন ছুটে আসে।

বেলীর গলায় দড়ি লাগানো। বেলী ঘাড় কাত করে খাটের উপর হাঁটু মুড়ি দিয়ে বসে আছে। দড়িটি ঠিক তার গলায় নয়, এবং টাইট নয় মোটেই। তার থুতনির কাছে ঢিলেভাবে বাঁধা দড়িটি, ওপরের আড়ার সাথে ঝুলানো। তার গায়ের ব্লাউজটি ছেঁড়া চারদিক থেকে। হুক কয়েকটি খোলা। শাড়ির আঁচল পড়ে আছে খাটের উপর আলুলায়িতভাবে। তার বুক ও গায়ের অনেকখানি তাই দেখা যাচ্ছে অনায়াসে। শাড়িটিও ছেঁড়া কয়েক জায়গায়। মাত্র ক’দিন আগেই সে এই শাড়িখানা কিনেছে ফেরিওলার কাছ থেকে। এই শাড়ি ছিঁড়ল কিভাবে। তার বুকে, গলায়, হাতে, পিঠে, গালে টাটকা আঁচড় ও দাঁতের দাগ।ওসব দেখে মনে হচ্ছে, কোনো হিংস্র পশু তাকে বিষাক্ত নখ ও দাঁত দিয়ে খাবলে খেতে চেয়েছিল। তাকে এই অবস্থায় দেখে চারদিক থেকে চিৎকার, চেঁচামেচি, হট্টগোল ও নানান মন্তব্য শুরু হয়ে গেল। স্বভাব-চরিত্র ভালো ছিল না মোটেই, গায়ে মাথায় কাপড় থাকতো না, পুরুষদের গা দেখিয়ে বেড়াত, জোরে জোরে হাসত ও কথা বলতো, মেয়েমানুষের অত চেটাংচেটাং ভালো না, একটা বাচ্চাও তো হলো না, চরিত্রদোষে ইহকাল পরকাল সবই হারালো, গলায় দড়ি দিয়ে মরে সবার মুখে চুনকালি দিয়ে গেল। ইত্যাকার মন্তব্যের কোনো অন্ত রইলো না।
থানায় খবর দেয়া হলো। পুলিশ এসে বেলীর দংশিত ক্ষত-বিক্ষত নিথর দেহটি নিয়ে গেল ঠেলাগাড়িতে করে, ময়নাতদন্তের জন্য। ঠেলাগাড়িতে একটি ছেঁড়া চাটাই বিছিয়ে তার ওপর বেলীর লাশটি শুইয়ে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে থানায়। পথ দিয়ে যাবার সময় যে-ই দেখেছে সে-ই বলেছে, কোন পাপীষ্ঠা মরলো গলায় দড়ি দিয়ে। ছি! ছি! ছি! পাপে ভরিয়ে দিলো পাপীরা দুনিয়াদারি। এ সকল পাপীদের পাপের দায়ে ভালো মানুষদেরও দুনিয়ায় সুখেশান্তিতে থাকবার উপায় নেই।

পরদিন পুলিশ এলো বাড়িতে, জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তের জন্য। বেলীরা যে বাড়িতে থাকত সে বাড়িতে কয়েকটি ঘর। বেলী যে ঘরটিতে থাকতো সেটি তার মনিব কলিম সাহেবের। বাকি পাঁচটি ঘর কলিম সাহেবের পাঁচ ভাইয়ের। কলিম সাহেব ছাড়া তার বাকি ভাইয়েরা গ্রামেই থাকে। তাদের বৃদ্ধ বাবা-মা পালা করে সব ভাইদের কাছে থাকে। ওসি সাহেব বলছেন, কে খুন করতে পারে মেয়েটিকে। আপনাদের ধারণা কি?
– আমরা হগলে যার যার ঘরে আছিলাম। আমরা ক্যামনে কই ওসি সাব। তয় মাইয়া ত নষ্ট চরিত্রের আছিল। হ্যেল্লাইগা গলায় দড়ি দিয়া মরছে।
– মেয়েটি হাঁটু গেড়ে পড়ে ছিল খাটের ওপর। সে ঝুলন্ত ছিল না। গলার দড়িটি টাইট করে বাঁধা ছিল না। খুবই লুজ ও হেরঢের করে থুতনির কাছে কোনো রকমে লাগানো ছিল।তার গলায় ফাঁসই পড়েনি। কাজেই গলায় দড়ি দিয়ে সে মরেছে, এ প্রশ্নই অবান্তর। তার সাথে কখন আপনাদের শেষ কথা হয়েছে, তার ঘরে সকালে আপনাদের মধ্য থেকে কেউ বা অন্য কেউ কে গিয়েছে, বলুন।
– আমরা জানি না স্যার। কাইল সকালে বৃষ্টি ওইছিল। আমরা কোনো আওয়াজ পাই নাই। কে আইছে, কে গেছে, কিছু কইতে পারুম না। তয় সে গলায় দড়ি দিছে তাতে কোনো সন্দেহ নাই। একে ত চরিত্র নষ্ট, গায়ে কাপড় রাখত না। তার ওপর পোলাপাইন হয় নাই নষ্ট চরিত্রের কারণে। হ্যের লাইগা গলায় দড়ি দিয়া আত্মহত্যা কইরা মরছে। কী করবো আর।
– তার সারা শরীরে নখের আঁচড়, দাঁতের চিহ্ন। শাড়ি-ব্লাউজ ছেঁড়া। মেয়েটিকে কেউ ধর্ষণ করার পরে মেয়েটি হয়ত আইনী ব্যবস্থা নেবে বা সবাইকে ধর্ষকের নাম বলে দেবে বলেছিল। তাই তাকে হত্যা করে যেনতেন ভাবে গলার মধ্যে একটা দড়ি বেঁধে দিয়ে খুনী ধর্ষক পালিয়েছে।
– বদমাইশ মাইয়াপোলা আছিল ত স্যার। গা দেহাইয়া বেড়াইত ব্যাডাগোরে। খিলখিলাইয়া হাসতো। গরুর লাহান হাম্বা হাম্বা ডাক ছাইড়া কথা কইতো। কোনো পর্দা মানতো না, শরিয়ত মানতো না, যহন তহন রাস্তায় দৌড় মারতো। বদমাইশ মাইয়াছেলে মরছে বদমাইশের লাহান।
– আপনাদের ছেলেদের দেখছি না যে! কী ব্যাপার তারা গেল কই।
– হ্যেরা শহরে বেড়াইবার গেছে। খান্দানি পরিবার আমগোর। আমগোর পোলারা শিখ্যিত। কলেজে পড়ে। হ্যেরা দাসীবান্দির লগে কথাও কয় না।

– সবাই একসাথে বেড়াতে গেল যে! তাদের কলেজ তো খোলা। কলেজ রেখে সবাই একই সাথে বেড়াতে চলে গেল? খান্দানি বংশের ছেলেদের কি কলেজে ক্লাস করতে হয় না? তাছাড়া পরশু সন্ধ্যা পর্যন্ত নাকি তাদেরকে এলাকার লোকজন দেখেছে।

কলিম সাহেবের বাবা অতিশয় বৃদ্ধ মানুষ। কয়েক বছর আগে পবিত্র হজ্জব্রত পালন করে এসেছেন। এলাকার সকলের বিশেষ শ্রদ্ধাভাজন। তিনি বললেন, ওসি সাব, মাইয়া মানুষ তো, হ্যের লাইগা দড়ির গিট্টু ঠিক মতন টাইট কইরা বানবার পারে নাই। আর পাও ঝুলাইন্যা থাকলে যে মরবো না, এইডা গলায় দড়ি দেওনের আগে বুঝবার পারে নাই। এর লাইগা দড়িডা আছিল লুজ। নষ্ট চরিত্রের মাগীডা খাটের উপ্রে আঁডু গাইড়া পইড়া গলায় দড়ি দিয়া আত্মহত্যা কইরা মইরা আমগোর মুখে চুনকালি দিয়া গেছে। বান্দি আছিল তো। বান্দিগো কি কোনো জাত আছে? কোনো মানসম্মান আছে? গলায় দড়ি দিলে হ্যেগো কি? সম্মান তো যায় আমগোর।
– আপনার ভাষ্য মোতাবেকও তো মেয়েটির গলায় ফাঁসই লাগে নি। তার হাঁটুও ছিল খাটের উপর মোড়ান। তবুও আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। আপনাদের ছেলেদের কেন হদিস নেই তাহলে?

ফুলি বু’র বাড়ি অনতিদূরেই। এ বাড়িতে সে কাজ করে। পুকুর থেকে পানি নিতে, ও গোসল করতে আসে। সেও উপস্থিত ছিল পুলিশের জেরার সময়। এই বাড়িতে কাজ করে সে জীবিকা নির্বাহ করে। বলতে গেলে এ বাড়ির অন্নে সে প্রতিপালিত। সে অতি দরিদ্র। কিন্তু সত্যবাদী, প্রতিবাদী। কোথাও অন্যায় দেখলে সে নিরপেক্ষ সত্যি কথাটি বলবেই বলবে। সে বললো, ওসি সাব, আমারে জিগান। আমি সব জানি। কারা কারা বেলীরে ছিড়া খাইছে, কারা হ্যের গলা টিপ্যা মাইরা ঝুলাইছে, আমি জানি সব। বেলীর হাত ধইরা টানাটানি করতো ভদ্দরলোকের শিখ্যিত পোলারা। তারে বাজে কথা কইত। সে আমারে সব কইতো। একদিন সন্ধ্যায় পুকুরঘাটে বেলীর গায়ে হাত দিতে চাইছে কয়েকডা ভদ্দরলোকের পোলা। বেলী কইছিল, কুত্তার বাচ্চা হাত কাইট্টা ফেলাইয়া দিমু। হ্যেরা কইছে, বান্দির এত তেজ কীসের? একদিন যাইয়া তেজ বাইর কইরা দিমু নে। আমি চিনি বেবাকরে। বেবাকের নাম জানি। সব কইয়া দিমু। একটা নিষ্পাপ মাইয়ারে বলাৎকার কইরা মইরা গলায় দড়ি বাইন্ধা দিছে হারামির জাতেরা। আমি নামাজ পইড়া তাগোরে অভিশাপ দিমু। মসজিদে টেকা দিমু। নির্বংশ হইবো হ্যেরা।
ওসি সাহেব ফুলিকে বললেন, আপনি চলুন আমার সাথে থানায়। আপনার জবানবন্দি নেওয়া হবে। অনেক তথ্য পাওয়া যাবে আপনার কাছ থেকে। যেতে যেতে বলে গেলেন, ধর্ষক ও খুনীদের উপযুক্ত বিচারের ব্যবস্থা আমি করবই, সে যে-ই হোক না কেন।

পরের দিন কলিম সাহেব এলেন শহর থেকে। গেলেন থানায় ওসি সাহেবের সাথে দেখা করতে। উনারা পূর্ব পরিচিত। এলাকার বিত্তশালী ও সম্ভ্রান্ত মানুষ হিসেবে কলিম সাহেবের সাথে ওসি সাহেবের বিশেষ খাতির। কলিম সাহেব গ্রামে এলে ওসি সাহেবকে দাওয়াত করে খাওয়ান। ওসি সাহেব বললেন, এই দরিদ্র অসহায় মেয়েটিকে এভাবে রেইপ করে খুন করা হলো। এই বর্বরতার সাথে যে বা যারা জড়িত আছে আমি তাদের সবার আইনী শাস্তির ব্যবস্থা করবই। কলিম সাহেব বললেন, নিশ্চই। তবে আপনি আমার বন্ধু মানুষ। ভাবীকে কখনো কিছু উপহার দেয়া হয়নি। এই তিন লাখ টাকা দিয়ে যদি ভাবীকে কিছু কিনে দিতেন বড় তৃপ্তি পেতাম মনে।
– কী! আপনি আমাকে ঘুষ দিতে চাইছেন?
– আচ্ছা চার লাখ।
– টাকা দিয়ে আইন কিনতে চাইছেন আপনি? থানায় এসেছেন টাকার গরম দেখাতে? একটা গরীব অসহায় মেয়েকে রেইপ করার পর মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে এসেছে, তাকে রেইপ করার পর গলা টিপে খুন করা হয়েছে। মেয়েটি আপনার আশ্রিত ছিল। আপনি তার খুনী ও ধর্ষকদের বিচার চান না?
– আমরা খান্দানি মানসম্মান সম্পন্ন মানুষ। ছোটলোকেরা সব সময় নিমকহারাম হয়। ওদেরকে মাথায় তুলতে নেই, প্রশ্রয় দিতে নেই, গুরুজনেরা সব সময় বলে থাকেন। ওই বান্দির বাচ্চাকে আমি মাথায় তুলেছিলাম। ঘরবাড়ি সঁপে দিয়েছিলাম তার হাতে। তার উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে গেছে আমাকে। আমার ও আমার খান্দানি বংশের সম্মান ধূলিসাৎ করেছে। পাঁচ লাখ। কী বলেন।
– আরে কলিম ভাই, আমি মজা করছিলাম আপনার সাথে। আপনি ঘনিষ্ঠ বন্ধু মানুষ। একটু রসিকতাও করা যাবে না? ওই বাঁদি মরেছে তো গলায় দড়ি দিয়ে। মেয়ে মানুষের বুদ্ধি তো কম। তাই টাইট করে গলায় দড়ি বাঁধতে পারেনি। খাটের উপর হাঁটু গেড়ে থাকলে যে মরবে না, এই সাধারণ জ্ঞানটুকু পর্যন্ত ছিল না। একে তো মেয়ে মানুষ। তার উপর মূর্খ ও বাঁদি। আবার চরিত্রও ছিল নষ্ট। চলুন পান করি। আপনি আমার বিশেষ বন্ধু, এতদিন পরে এসেছেন। বাঁদিটির চময়নাতদন্ত ক’রে যে ডাক্তার রিপোর্ট বার করেছেন, তার অনেক খাটাখাটনি হয়েছে। বেচারাকে আবারও খাটতে হবে আগের ভুল রিপোর্টটি বাতিল করে সঠিকভাবে নতুন রিপোর্ট বানাতে। তার বউয়ের জন্যও তো কিছু উপহার লাগে।
– তা আর বলতে!
বেলীর ছিন্নভিন্ন বিকৃত পচাগলা দেহ ফিরিয়ে আনা হলো ক’দিন পর থানা থেকে। ময়নাতদন্তের জন্য তার শরীর ছিন্নভিন্ন করা হয়েছে। তার শরীর পচে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।সুন্দর সদা হাস্যময় মুখটি পচে ভয়ানক হয়ে গেছে। কেউ তাকে শেষ গোসল দিল না। সে আত্মহত্যা করেছে তাই তার জানাজাতে কেউ এলো না। কোনো রকমে আবর্জনার স্তূপটা মাটিতে পুঁতে ফেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গেল। তার চারদিন পর কলিম সাহেব বেলীর কুলখানির আয়োজন করলেন। সাতটা গরু, দশটা ছাগল ও অনেকগুলো মরগি জবাই করা হলো তাতে। লোকে খেয়ে বাহবা দিতে লাগলো। সামান্য বাঁদি, তার উপরে গলায় দড়ি দিয়ে মরা। এর জন্য এত খরচ করে কুলখানি! লোকে তো আপনজনের জন্যও এত করে না। সত্যি, টাকা-পয়সা ও মনের পরিধি অনেক বেহিসাবে আল্লাতালা দিয়েছেন তাঁকে। এলাকায় ধন্য ধন্য পড়ে গেল তাঁর। শুধু ফুলি এককোণে ব’সে ডুকড়ে ডুকড়ে কাঁদতে লাগলো। ও বেলী তোরে কোন পিশাচে এমন কইরা মারলো রে। কলিম সাহেবের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো, আপনের মাইয়া মিতার লগে এই রকম অইলে আপনে খুনীর বিচার চাইতেন না? আপনে পুলিশের মুখে টেকা ভইরা, ডাক্তরের মুখে টেকা ভইরা তাগোর মুখ এমনে বন্ধ কইরা দিতেন? এই ভিডায় আল্লার গজব পড়বো, এই ভিডা শ্মশান অইবো।

বেলীর স্বামী বাবুলকে কলিম সাহেব ডেকে বললেন, বেলী যখন গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে, তুই আর আমার বাড়িতে থেকে কী করবি। অন্য কোথাও বিয়ে-শাদী করে ঘর-সংসার কর। ফুলীকে আর দেখা যাচ্ছে না। বাড়িঘর ফেলে সে উধাও হলো কোথায় কে জানে। লোকে বলাবলি করছে, ফুলীটাও বেলীর মতোই কুলটা ছিল, চরিত্র নষ্ট ছিল। নইলে কি আর বেলীর মত নষ্টা মেয়েছেলের সঙ্গে তার খাতির থাকতো।