তিন

এক কাক-ডাকা ভোরে দ্রিম দ্রিম গগণবিদারী শব্দে ঘুম ভাঙ্গে পতেঙ্গা বাসীর। ভূমিকম্পের মত কেঁপে ওঠল আলমদের ঘরটিও। পরিবারের সবাই হুড়মুড় করে বিছানা ত্যাগ করে। দাদীর সাথে একই খাটে শোয় আলম। তার দাদীকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুলে আলমও বিছানা থেকে ওঠে বসল। কী হল, কী হল, রব উঠল চতুর্দিকে । মুহুর্তেই খবর এসে গেল ভারতীয় একটি বোমারু বিমান পতেঙ্গা বিমান বন্দরে বোমা ফেলে গেছে। হতবিহ্বল মানুষ দল বেঁধে ছুটল বিমান বন্দরের দিকে। আলমও তাদের সাথে ছুটল । গ্রামের তরুণ তরুণীদের মত তার মনেও এক ধরণের ভয় ও আনন্দের মিশ্র অনুভূতি। বাড়ি থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে বিমান বন্দরের টার্মিনাল। সে টার্মিনাল ছিল বোমার লক্ষ্য। কিন্তু লক্ষ্যচ্যুত হয়ে সে বোমা রানওয়ে পার হয়ে সংলগ্ন দীর্ঘ সবুজ ঘাসে ঢাকা মাটিতে পড়েছে। আলম ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখে লোকে লোকারণ্য সে এলাকা। রানওয়ের পাশে পর পর দুটি বিরাট পুকুরের মত গর্ত হয়ে গেছে। তিনটি বোমার মধ্যে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয় নি-তা এমনি মাটির গভীরে ঢুকে গেছে। মুরুব্বীরা বলাবলি করছে-এ ভূমি বার আউলিয়ার । তাই বোমা সঠিক জায়গায় আঘাত করতে পারে নি। এ কথা মুখে উচ্চারণ করলেও আলম দেখল, বয়স্ক গ্রামবাসীদের মুখটা কেমন যেন ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে আছে। তারা আরো বলতে লাগল, এ বোমা যদি রানওয়ের উপর পড়ত, তা আরো ক্ষতিকর হত। আর গ্রামের উপর পড়লে কত ঘর বাড়ি যে ভস্মীভূত হয়ে যেত, কে জানে।
চার
পাক-ভারত যুদ্ধ আর বেশি দিন চলল না। মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যস্থতায় তাসখন্দে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হল ভারত পাকিস্তানের মধ্যে। পাক-ভারত যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে গিয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তাসখন্দেই মারা গেলেন ভারতের প্রধান মন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। চুক্তি অনুসারে যুদ্ধ থেমে গেল। জনগণের মধ্যে প্রচার করা হল, যুদ্ধে পাকিস্তানের জয় হয়েছে। ভারত নিদারুণভাবে পরাস্ত হয়েছে। সে কারণেই শাস্ত্রী হার্টফেল করেছে। সাধারণ জনগণ ও তা বিশ্বাস করল। যুদ্ধ শেষ। দিন, মাস, বছর যায়। গ্রাম থেকে যুদ্ধের উম্মাদনা ও যুদ্ধ নিয়ে আলোচনাও থিতিয়ে আসে ক্রমে । ফুরিয়ে যায় যুদ্ধ নিয়ে তৈরী হওয়া নানা গালগল্প ও বীরত্ব গাঁথা। গ্রামের মানুষ আবার ফিরে আসে তাদের কঠিন-কঠোর বাস্তব জীবনে। আলমও এবার মনোযোগী হয় তার লেখা পড়ায়।
বৎসর না ঘুরতেই যুদ্ধ নিয়ে ভিন্ন কথা শুনা যেতে লাগল। যে যুদ্ধ নিয়ে গ্রামের মানুষ এতদিন গর্ব করেছে, যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য হাত পা ছুড়াছুড়ি করেছে, সে যুদ্ধ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য, যা পাকিস্তানের বীর জোয়ানদের বীরত্ব গাঁথাকেও খাট করছে, ভাল লাগছে না আলমের । এতদিন চায়ের দোকানে কিংবা গ্রাম্য মজলিসে যে মানুষগুলো পাকিস্তানের বীরত্বগাঁথা নিয়ে গর্ব ভরে গালগল্প করত, যুদ্ধ জেতার জন্য ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খাঁনকে নিয়ে গর্ব করত, সামরিক তকমা পড়ে ঘোড়ায়চড়া ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খাঁনের উদ্ধত তরবারীর নীচে কুপোকাত ভারতীয় সেনা ও যুদ্ধ বিমানের বিধ্বস্ত ছবি সম্বলিত রঙিন ক্যালেন্ডার ঘরে ঘরে, চায়ের দোকানে, নাপিতের দোকানের বাঁশের বেড়ায় শোভা পেতে দেখে স্বস্তি পেত, সে মানুষগুলো বছর না ঘুরতেই বলাবলি করছে-ঐ যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। সকল সৈন্য সমাবেশ ঘটানো হয়েছিল পশ্চিমা সীমান্তে। রণাঙ্গণেও নাকি বাঙালি যোদ্ধাদের প্রতি অবিচার করা হত এবং যে সকল সেক্টর ঝুকিঁপূর্ণ, সে সকল সেক্টরে বাঙালি জোয়ানদের ঠেলে দেওয়া হত। ভারতের অগ্রসরমান ট্যাংকের নীচে বুকে মাইন বেঁধে শুয়ে পড়ার জন্য বাঙালি জোয়ানদের বাধ্য করে তাদের নামে মিথ্যা গৌরব গাঁথা প্রচার করা হত। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীরা নাকি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র করে এ যুদ্ধ লাগিয়েছে-তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য। এ সকল আলোচনা-সমালোচনার পরিধি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে লাগল। এমন কথাও বলা শুরু হয়ে গেল যে, আসলে সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যস্থতায় তাসখন্দ চুক্তি না হলে পাকিস্তানের শোচনীয় পরাজয় ঘটত এবং ১২ ঘন্টার মধ্যে ভারত লাহোর দখল করে নিত। যুদ্ধের সময় যে আইয়ুব খাঁনকে নিয়ে নানা কিংবদন্তী শোনা গিয়েছিল, সে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষিপ্ত হতে লাগল।
আলম ইতোমধ্যে পঞ্চম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছে। তখন মেধাবী ছাত্র হিসাবে স্কুলে সবার কাছে সে সুপরিচিত হয়ে ওঠে। বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে এক গাদা পুরস্কার নিয়ে সে বাড়ি ফিরে সকলকে তাক লাগিয়ে দেয়। যুদ্ধের সে সকল স্মৃতি তার মনে থেকেও ধীরে ধীরে মুছে গেছে।
পঞ্চম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হয় আলম। তার ইচ্ছা গ্রামের বাহিরে কোন ভাল হাই স্কুলে ভর্তি হবে। কিন্তু তার মা-বাবা তাকে দূরের কোন স্কুলে দিতে রাজী হল না। তারা চায় পতেঙ্গা হাই স্কুলে পড়ুক আলম। তার বড় বোনের পক্ষে আর লেখা পড়া করা সম্ভব না। কারণ আত্মীয়-স্বজন ও বিশেষভাবে পাড়া প্রতিবেশীরা তা ভাল চোখে দেখছে না। পতেঙ্গায় মেয়েদের স্কুলে যাওয়া, বাংলা লেখাপড়া করাকে এখনো ভাল চোখে দেখে না গ্রামের সাধারণ মানুষেরা। তাদের অতি সরল একটি ধারণা-মেয়েরা বিয়ের পর চুলা জ্বালবে, রান্না-বান্না করবে, তাদের আবার লেখা পড়া কেন। কেবল কুরআন শরীফ ও নামাজ-কালাম পড়তে পারলেই হল। তাই মেয়েদের পড়ার কোন আলাদা হাই স্কুল এখনো পতেঙ্গায় গড়ে ওঠেনি। গ্রাম্য কুসংস্কারের নির্মম বলি হয়ে অসময়ে বিদ্যার্জনে ছেদ পড়ে মেধাবী ছাত্রী খুরশেদার। পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত আলম সব সময় তার বড় বোনের সঙ্গ পেয়েছে, সহপাঠিনী হিসাবে, এখন থেকে সে একা। তবুও তার নিদারুন আনন্দ লাগছে । সে হাইস্কুলে ভর্তি হবে। পতেঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হল আলম। ১৯৬২ ইং সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, একটি টিনের ছালা জীর্ণ পরিত্যক্ত সরকারী দালানে। পতেঙ্গাতে এটিই প্রথম একটি উচ্চ বিদ্যালয়। আলমের সাথে প্রায় শয়ের কাছাকাছি ছাত্র ৬ষ্ট শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে। সবাই নতুন, অপরিচিত। পরিত্যক্ত টিনের ছাউনি দেওয়া এ ভবনকে দূর থেকে দেখে স্কুল বলে মনে হয় না । তাই ভর্তি হওয়ার কিছু দিন আগে স্কুল দেখতে এসে আলম স্কুলটি খুঁজে পায় নি। তবুও নতুন পরিবেশ, নতুন নতুন সহপাঠি, নতুন শিক্ষক, সবকিছু নিদারুণ ভাল লাগছে আলমের। অল্প দিনেই শিক্ষকদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয় আলম। ক্লাসে সকল ছাত্রের পরিচিত হয়ে ওঠে। তাই তাকে ক্লাস ক্যাপ্টেন এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
পাঁচ
শেখ মুজিব বাঙালিদের জন্য স্বায়ত্বশাসনের দাবী তুলেছেন। সে স্বায়ত্বশাসনের রূপরেখা হিসাবে তিনি ৬ দফা ঘোষণা করেছেন। আইয়ুব সরকার শেখ মুজিবের দাবীর জবাবে তাকে কারাবন্দী করেছেন। আপামর মানুষের মনে ক্রমান্বয়ে ক্ষোভ সঞ্চারিত হতে থাকে। মাত্র কয়েক বৎসরের মধ্যে মানুষের এ ক্ষোভ শ্লোগানে পরিণত হয়ে গেল। “ আইয়ুব খাঁনের সামরিক শাসন মানি না, মানব না। আইয়ুব যদি বাঁচতে চাও, শেখ মুজিবের মুক্তি দাও” প্রভৃতি শ্লোগান দিতে দিতে সুদূর বেগমজান হাই স্কুলের ছেলেরা হালিশহর থেকে পতেঙ্গা হাই স্কুলে এসে পড়লে পতেঙ্গা হাই স্কুলের ছেলেরা হুড়মুড় করে স্কুল থেকে বের হয়ে কেউ মিছিলে যোগ দেয়, আবার কেউ আগে স্কুল ছুটির মহানন্দে বাড়ি ফিরে। এক ধরনের উত্তেজনায় আচ্ছন্ন হয়ে আলম মিছিলেই যোগ দেয়। মিছিল শেষে সে বাড়ী ফিরে। কে এই শেখ মুজিব ? তাকে কেন বন্দি করা হল ? কী আছে তার ৬ দফাতে? ইত্যাকার বিষয়গুলো আলমের কাছে এখনো পরিস্কার না। বাসায় এসে সে তার বাবার কাছে বিষয়গুলো জানতে চায়। তার বাবা তাকে অনেক কিছু বলে । সবকিছু সে বুঝে উঠতে পারে না। তার বাবা বলে-পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানেরা পশ্চিম পাকিস্তানী অবাঙালি মুসলমানদের চেয়ে বেশী ত্যাগ স্বীকার করেছে। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ বলে তারা অনেক শ্লোগান দিয়েছে। পাকিস্তানের পক্ষে অনুষ্ঠিত গণভোটে তারা বেশী ভোট দিয়েছে। অথচ পাকিস্তানের দণ্ডমুন্ডের মালিক হল পশ্চিম পাকিস্তানীরা। ব্যবসা, বাণিজ্য, সব তাদের নিয়ন্ত্রণে। শিল্প কারখানার মালিকও তারা। সামরিক বেসামরিক উচ্চপদস্থ আমলা সব পশ্চিম পাকিস্তানী। পাকিস্তানের রাজস্ব আয়ের সিংহ ভাগ ব্যয় করা হচ্ছে কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য। নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে পশ্চিমাঞ্চলে। পাকিাস্তানী শাসক গোষ্ঠীর এ বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে শেখ মুজিব কথা বলছে। ৬ দফা কর্মসূচী দিয়েছে। তাই তাকে বন্দি করেছে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। তার বিরুদ্ধে পাকিস্তান ভেঙ্গে ফেলার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে মামলা দিয়েছে-আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। তার বাবা তাক আরো বলেন-যে পাকিস্তানের জন্য বাঙালি জাতি এত ত্যাগ করেছে সে পাকিস্তান জন্মের এক বছরের মধ্যে পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বাঙালিদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছে একমাত্র ঊর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার মাধ্যমে। পাকিস্তানীদের এ চক্রান্তের বিরুদ্ধে বাঙলার ছাত্রজনতা কিভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে, রফিক,শফিক,জব্বার সহ অনেকে জীবন দিয়েছে সেসব কাহিনী যখন আলমের বাবা তাকে সবিস্তারে বলেন, আলম তখন রুদ্ধ শ্বাসে তা শুণে। তার বাবার সব কথা তার বোধগম্য না হলেও পশ্চিম পাকিস্তানীরা যে বাঙালিদের প্রতি অবিচার করছে এবং শেখ মুজিব নামক ব্যক্তিটি তার বিরুদ্ধে ন্যায্যভাবে লড়াই করছে, এমন একটি বোধ অঙ্কুরিত হয় আলমের মনে। শেখ মুজিব নামক ব্যক্তিটির প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধামিশ্রিত মমত্ববোধ জাগে তার কঁচি মনে। এক সাহসী বীর পুরুষের কাল্পনিক অবয়ব তার মানসপটে ভেসে উঠতে থাকে । দেশের মানুষ ক্রমান্বয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠে। শেখ মুজিব ৬ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেছে। বিরোধী দলীয় পাঞ্জাবী নেতারা ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে লাহোরে বিরোধী দলীয় নেতাদের এক সম্মেলন ডাকেন। শেখ মুজিব সে সম্মেলনে ৬ দফা উত্থাপনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে তিনি সংবাদ পত্রে বিবৃতির মাধ্যমে তা প্রকাশ করেন। সর্ব-পাকিস্তান বিরোধী দলীয় ঐক্যের একটি প্রয়াস বাঙালির স্বায়াত্ত্বশাসনের দাবীতে শেখ মুজিবের অনমনীয়তার কারণে ভেঙ্গে গেল। ৬ দফায় বাঙালির স্বায়াত্ত শাসনের যে রূপরেখা উপস্থাপন করা হল, তা বাঙালি আপামর মানুষের মধ্যে যেমন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করল, তেমনি সরকার সহ পশ্চিমা কায়েমী স্বার্থবাদী মহলেও সুতীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিল। শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হল। ৬ দফার সমর্থনে ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবীতে বিক্ষোভ দিবসের ডাক দেওয়া হল। উত্তপ্ত হয়ে উঠল সমগ্র পূর্ববাংলা। বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালালো পুলিশ। নিহত হলো বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী। গ্রেপ্তার করা হলো অনেককে। দৈনিক ইত্তেফাক নিষিদ্ধ করা হল । গ্রেপ্তার করা হল তার সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিঞাকে । সরকারী দমন-পীড়নের মধ্যে আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়লেও ১৯৬৭ সালের শেষ দিকে পরিস্থিতি আবারো হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠল। সরকার শেখ মুজিবসহ গ্রেপ্তারকৃত নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করলেন। এ মামলাকে কেন্দ্র করে সরকার আরো নেতৃবৃন্দকে এলোপাতাড়ি গ্রেপ্তার করতে লাগল। কিছু সামরিক-বেসামরিক আমলাকেও এ মামলার আসামী করা হল। গ্রেপ্তারকৃতদের জামিন ও মুক্তির দাবীতে হাইকোর্টে মামলা হতে লাগলো। সমগ্র জনগণের মধ্যে চাপা উত্তেজনা । শেখ মুজিবকে উক্ত মামলার প্রধান আসামী করা হল। এ ৬ দফা নাকি বাঙালির মুক্তি-সনদ। ৬ দফা বাস্তবায়িত হলে বাঙালিরা শোষণ থেকে মুক্তি পাবে-এমন একটি ধারণা মানুষের মনে বদ্ধমূল হতে লাগল। ৬ দফা নিয়ে দাঁনা বাঁধতে লাগল আন্দোলন। শেখ মুজিবের মুক্তি ও ৬ দফার পক্ষে হাটে বাজারে সভা সমাবেশ করে বেড়াতে লাগল আওয়ামী লীগের নেতারা। পতেঙ্গার কৈল্লারহাটের সন্নিকটে বিমানঘাটি-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জঙ্গী বিমান রাখার স্থান, সেখানে জনসভার আয়োজন করা হয়েছে সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে-চেয়ার বিছিয়ে। বাজারগামী লোকজন আস্তে আস্তে বসে পড়ছে চেয়ারে। এক সময় সব চেয়ার ভর্তি হয়ে গেল। আলমও গিয়ে বসল সবচেয়ে পেছনের সারির এক কোণায়। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বক্তব্য রাখছেন এক নেতা-তার নাম এম, এ, আজিজ। অত্যন্ত জোরালো সে বক্তৃতা। খুব তীব্র ভাষায় তিনি সমালোচনা করছেন আইয়ুব খাঁনের। আইয়ুব খাঁন দেশের প্রেসিডেন্ট। দেশের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এ ভাবে সমলোচনা করা যায়, এটা জানা ছিল না আলমের। খুব মজা লাগছিল তার। এম, এ, আজীজ বক্তৃতায় বলেন, ‘মওলানা মওদুদী জামায়াতে ইসলামীর আমীর, তিনি ইসলামের কথা বলেন, অথচ তার মেয়ে কীভাবে বে-আব্রু হোয়ে টেনিস খেলে-ব্যঙ্গ-বিদ্রুপাত্মক ভাবে তার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন-ইসলামের নামে আসলে এসব ভাওতা এবং ধোকাঁবাজি। তিনি জোরালোভাবে বলেন- আসলে বাঙালিদের শাসন-শোষণ করার জন্যই পশ্চিমারা ধর্মকে ব্যবহার করছে। তিনি এসব ধর্মের কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে ৬ দফার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য সকলকে আহবান জানান। কখন যে সভা লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছিল আলম তা টেরও পায় নি। যখন সভা ভাঙ্গল, তখন সে দেখতে পেল, যেন বাজারের সব লোক এতক্ষণ বক্তৃতা শুণছিল। বক্তৃতার অনেক কথাই বুঝেনি আলম। তবে সে এটা বুঝেছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্বপাকিস্তানিদের উপর অন্যায় করছে। সভা-সমাবেশে যাওয়ার নেশা যেন ক্রমান্বয়ে পেয়ে বসল আলমকে। সভা সমাবেশও হতে লাগল প্রায় প্রতিদিন, এখানে-সেখানে, পুরানো কন্ট্রোলের মোড়, আলীর দোখান, ষ্টিলমিল বাজার প্রভৃতি স্থানে । কোন সভাই আলম বাদ দেয় না। ষ্টিল মিলের এক সভাতে আইভি রহমান আসবে বলে মাইক প্রচার করা হল। তিনি নাকি আওয়ামী লীগের মহিলা নেত্রী। প্রচণ্ড কৌতুহলে দিন গুণতে থাকে আলম। সে এর আগে কখনো কোন মহিলা নেত্রীর বক্তৃতা শুনে নি। একজন মহিলা এতগুলো পুরুষের সমাবেশে কিভাবে বক্তব্য রাখবে, তার দেখার তীব্র কৌতুহল আচ্ছন্ন করে রাখল আলমকে। বিকাল তিনটায় সে সভাস্থলে গিয়ে বসে আছে। আস্তে আস্তে লোক সমাগম হতে লাগল। বিকাল ৪-০০ টার দিকে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ আসলেন। সাথে এক সুদর্শনা মহিলা । তিনিই আই ভি রহমান। মোহাম্মদ সফি নামক এক গায়ক সভার শুরুতে গান ধরলেন– “তোমরা জান না, জান না, যুদ্ধকালীন খানের ঘটনা—”। বিগত ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে কী ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্বপাকিস্তানের ব্যাপারে চরম উদাসীন ছিল, কী ভাবে রণাঙ্গনে পশ্চিমারা বাঙ্গালীদের সাথে অসম আচরণ করেছে, গানের সুরে সুরে তা তুলে ধরতে লাগল সে গায়ক। গানের সুরে সুরে যেন সমাবেশের সমস্ত দর্শকশ্রোতা উদ্বেলিত হতে লাগল। গান শেষে নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা দেওয়া শুরু করলেন। সুতীক্ষ্ন সুললিত কণ্ঠে আইভি রহমানের বক্তৃতা থেকে যেন আগুন টিকরে পড়ছে, শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দেয় আলমের। বক্তৃতায় নেত্রী বলতে থাকেন-বাঙালি মুসলমানেরাই পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে বেশী আন্দোলন করেছিল, অথচ পশ্চিম পাকিস্তানি পাঞ্জাবীরাই আজ পাকিস্তানের দণ্ডমুণ্ডের মালিক। পূর্ব পাকিস্তানের সোনালী আঁশ পাটের টাকা দিয়ে উন্নয়ন হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের। সেখানে গড়ে উঠছে রাজধানীর পর রাজধানী, শিল্প কারখানা, বন্দর । সরকারী চাকুরীতে-কি সামরিক, কি বেসামরিক সব পশ্চিম পাকিস্তানিরা। সামরিক বেসামরিক বড় বড় আমলা সব তারাই। ব্যবসা বাণিজ্য ও তাদের দখলে। কর্ণফুলী পেপার মিলে উৎপাদিত কাগজের দাম এখানে দিস্তা বার আনা, আর পশ্চিম পাকিস্তানে মাত্র ছয় আনা। পাকিস্তানের ৫৬% মানুষ যেখানে বাংলা ভাষায় কথা বলে, সেখানে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে তারা ছাপিয়ে দিতে চেয়েছিল ঊর্দুকে। কারণ রাষ্ট্রভাষা ঊর্দু হলে বাঙালি জাতিকে শোষণের নিগড়ে আবদ্ধ করা যাবে চিরস্থায়ী ভাবে। বুকের রক্ত দিয়ে বাঙালিরা তা রুখেছে- রফিক, শফিক, সালাম, বরকত প্রমুখ বাঙালি সন্তানেরা বুকের রক্ত দিয়েছে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারের জন্য। বাঙালির এসব বঞ্চনার কাহিনী জ্বালাময়ী কন্ঠে শুণতে শুণতে পাকিস্তানের প্রতি, বিশেষভাবে পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি বিতৃষ্ণা জাগে আলমের । সেও মনে মনে ভাবতে থাকে- না, এ অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না। এভাবে আলম আস্তে আস্তে রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে থাকে। এলাকার কোন রাজনৈতিক সভা সমাবেশ সে যেমন আর বাদ দেয় না, তেমনি এলাকার বাইরেও সে যেতে লাগল। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা সে মনোযোগ দিয়ে শুনে। ৬ দফার সব দফা তার মাথায় ঢুকে না। তবে কিছু কিছু সে বুঝতে পারে। এটুকু বিশ্বাস তার মাথায় ঢুকে যে, ৬ দফা বাস্তবায়ন হলে অন্ততঃ পশ্চিম পাকিস্তানিরা আর বাঙালিদের শোষণ করতে পারবে না। নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা শুনতে শুনতে তার কাছে কিছু বিষয় পরিস্কার হয়ে উঠে। আকাশ পথে এগারশ মাইল দূরে অবস্থিত এমন দু’টি ভূখন্ড নিয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি গঠিত, যার দু’অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এক ধর্ম ছাড়া কিছুই মিল ছিল না। মুখের ভাষা, গায়ের গড়ন, গায়ের রঙ, পোষাক-পরিচ্ছদ, আহার-বিহার কোনকিছুতেই দু’অঞ্চলের মানুষের মধ্যে কোন মিল নেই। এমনকি ধর্মীয় আচার আচরনের মধ্যেও আছে তফাৎ। দু’ অঞ্চলের আবহাওয়াও ভিন্ন। আলমের ভাবতে বিস্ময় লাগে, এভাবে দু’টি ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠী নিয়ে কিভাবে একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলল সেদিনের জাতীয় নেতারা । তার কঁচি মনে একটি প্রশ্ন উঁকি মারে, ৬ দফা , স্বায়াত্তশাসন বাদ দিয়ে আলাদা একটি রাষ্ট্র হয়ে গেলে কেমন হয়? আওয়ামী লীগের নেতারা সে কথা বলছে না কেন? আলমের কঁচি মনে যেন একটি স্বপ্ন দানা বাঁধতে থাকে।