‘না, আমি তোমার আবেগকে ডিনাই করছিনা, আবার এন্‌জয়ও করছিনা’।

রিয়া এই একঘেঁয়ে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে ক’দিন ধরে। এরকম গোঁয়ার্তুমির জন্য আমি প্রস্তুত ছিলামনা। সে কিছুতেই কনসিভ্‌ড হতে চাইছেনা। মাতৃত্ব সে চায় না তা নয়, কিন্তু আট নয় মাসের ক্রিটিক্যাল এবং প্রথাগত মাতৃত্ব সে এভয়েড করতে চাইছে। সে প্রযুক্তির সহায়তা নিতে চায়। আমি যতোই ওকে কনভিন্স করার চেষ্টা করছি, ততোই সে জটিল সব যুক্তি দিচ্ছে। আমি যতোই তাকে বলি এভাবে একটি শিশুকে পৃথিবীতে আনলে তার প্রতি যে মমতা, যে ফিল, সৃষ্টির যে আনন্দ সেটা প্রভাবমুক্ত হবে না; সে তার সিদ্ধান্তে অটল।

‘তুমি অন্য শিশুদের যে মমতা দেখাও, বাচ্চাদের স্নিগ্ধতায় আপ্লুত হও, কোমলতা কিংবা সঙ্গ পছন্দ করো সেটি কি মেকি? আরোপিত?’ রিয়ার যুক্তি। নিজেকে অসহায় লাগে। রিয়া বলে চলে- ‘দেখো, তুমি কিংবা আমি সম্রাট শাহজাহান কিংবা মমতাজ নই যে উত্তরাধিকার দরকার, সমাজটাকে আমরা সেভাবে দেখিওনা। সে প্রশ্ন বাদ, উত্তরাধিকার প্রশ্নে আমরা সন্তান নিতে চাইছিনা, চাইছি ভালোবাসার সৃষ্টি, এখানে সৃষ্টিটা গুরুত্বপূর্ণ, পদ্ধতিটা নয়। বিজ্ঞান যেটিকে সহজ করে দিয়েছে সেটিতে ছেলেমানুষের মতো যুক্তি তোমাকে মানায়না সৌম্য’।

‘তুমি মেয়ে তাই এভাবে বলছো বা ভাবছো, কারণ প্রাকৃতিকভাবে ধারণটা তোমাকেই করতে হবে, কষ্টটা তোমাকেই করতে হবে, প্রকৃতি সে অধিকার আমাকে দেয়নি। যে অসাধারণ ক্ষমতা তোমার আছে সেটা ডিনাই করা প্রকৃতিকে অবহেলা করা’।

‘না, আমি মেয়ে বলে এভাবে ভাবছিনা। বিষয়টি সত্য, বিষয়টি বিজ্ঞানকে গ্রহণ করার মানুষিকতার তাই এভাবে ভাবছি।’
খেয়াল করলাম, সে বলেনি তুমি পুরুষ তাই এভাবে ব্লেইম করছো, চাপিয়ে দিচ্ছো। তার যুক্তিবোধ প্রবল। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যখন রাজনীতির সক্রিয় কর্মী, সে তখন ডিবেইটিং সোসাইটির সদস্য, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত। আমরা পরস্পরকে প্রভাবিত করে দলে ভিড়ানোর চেষ্টা করিনি। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেছি। সময় পেলে প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছি, সমালোচনা করেছি, তর্ক করেছি, বিরোধিতা করেছি। এভাবেই আমরা নিজেদের আবিষ্কার করেছি। বুঝতে পেরেছি কাছে থাকার আকুলতা। রিয়া ছবি আঁকতে পছন্দ করতো, আঁকেও ভালো, যদিও এটি তার ব্যাকগ্রাউন্ড না। সে বিপণন বিদ্যার ছাত্রী। আমি বাষ্ট্রবিজ্ঞানের। ছাত্রজীবন শেষে বেশ কিছুদিন আমি রাজনীতিতেই সক্রিয় থেকেছি হোল-টাইম। রিয়া জয়েন করেছে একটা বিজ্ঞাপনী সংস্থায়।

আমরা একসাথে থাকা শুরু করলাম বছর চারেক হলো। রিয়া কর্মজীবনে প্রবেশের একবছর পর থেকে, আমি তখনো রাজনীতিতে। হ্যাঁ, একসাথে থাকা। ভালোবেসে থাকা, নির্ভর করে থাকা, দুজন দুজনকেই প্রচণ্ড ভালোবেসে আঁকড়ে থাকা। প্রথাগত বিয়ে আমরা করিনি; না আইনগত ভাবে, না মাইথলজি অনুসারে। কিন্তু মূল্যবোধের অবমূল্যায়ন আমরা কেউই করিনি। রিয়া কিংবা আমার পরিবার প্রথম দিকে মেনে নেয়নি, এখনো নিয়েছে বলা যায়না, শুধু দূরত্ব কিছুটা ঘুচেছে।

‘তোর কোন আত্মমর্যাদা বোধ নেই, সে জন্যই ভেগাবন্ড হয়ে বেলেল্লাপনা করছিস। তুই শ্রমিক না, হবিও না, ডিক্লাসড তোর ধাতে নাই। তাই মিছিমিছি বিপ্লবী রোমান্টিসিজম দেখাতে শ্রমিক রাজনীতি করার ভণ্ডামি বাদ দে’। বাবা তীব্র ভৎসনা করেন রিয়ার সাথে থাকা শুরুর পর। আয়-হীন আমার সেই রাজনীতির মানে ওনাদের কাছে ভেগাবন্ডের জীবন। উপার্জনরত রিয়ার সাথে থাকাটা আত্মমর্যাদা বিকিয়ে থাকা। রিয়ার সাথে বসবাসটা ওনাদের কাছে বেলেল্লাপনার মতো। মা’র মতো মুখ গুঁজে পড়ে থাকাটা শাস্ত্রসম্মত, বৈধ, সামাজিক। আমি বাবাকে ডিফেন্ড করেছিলাম। বলেছিলাম পশু নিয়ে কাজ করতে গেলে কিংবা গবেষণা করতে গেলে নিজেকে পশু হতে হয়না। রাজনীতিকে আয়ের উৎস বানানো- রাজনীতি ও দেশের জন্য ভয়ানক এসবও বলেছিলাম। বলেছিলাম মাইথলজির সাত পাঁকে ঘুরে মা’কে যে কেবল পুনোৎপাদন কিংবা সেবা দাসীর কাজে ব্যবহার করে জীবনটা পার করে এসেছেন সেই সব কথা। ফল হয়েছে উল্টো। বাবার সাথে মাও তেড়ে এসেছেন। রিয়াকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলে মাথা ধরিয়ে দিয়েছেন। এই অপদার্থকে ধারণ করেছেন বলে আক্ষেপ করেছেন। অথচ এই মা’কেই আমি দেখেছি বাবার অবহেলায় দিনের পর দিন ফুঁপিয়ে কাঁদতে, বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি গিয়ে উঠতে।

অবস্থার সামান্য উন্নতি হয়েছে আমি যখন ইউএন’এর মানবাধিকার বিষয়ক একটি প্রজেক্টে যোগ দেই এবং একবছরের মাথায় এদেরই অন্য একটি প্রজেক্টে ডেপুটি হিসেবে পদোন্নতি পাই। সেও প্রায় বছর খানেক হতে চলেছে। আমি বুঝতে পারি সম্পর্কের সূচকটা অর্থনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছে। কিংবা আমার কর্মজীবনে প্রবেশকে ইনারা হয়তো মতি ফেরা হিসেবেই বুঝেছেন। মা এখন কখনো সখনো ফোন দেয়, এটা ওটা জিজ্ঞেস করে।

‘দেখো, সমাজটাকে তুমি আমি যেভাবে দেখি, অন্যরা সেভাবে দেখেনা, পরিবারতন্ত্রের উৎপত্তি তোমার অজানা নয়। তুমি যে সমাজের স্বপ্নে রাজনীতি করতে এবং এখনো মানসিক ভাবে সাপোর্ট কর সেটির সাথে তোমার এই ধারণাগুলো যায়না। সমাজের প্রতিটি শিশুকে সমভাবে ফিল করা উচিৎ। নিজের নয়, ধারণ করা নয় এইসব ছেলেমানুষির কোন মানে হয়না। তুমি নিজের নয় বলে গ্যাপ রেখে যে মমতা দেখাচ্ছো সেটি আরোপিত’। রিয়া বলে চলে। ‘আমার কাছে সব শিশুই সমান, সব শিশুই সমাজের। শিশুকে জন্ম দিয়েই কেবল সৃষ্টির কৃতিত্ব নেয়াটা স্ববিরোধীতা। আমি স্বপ্ন দেখি শিশুরা সামাজিক ভাবে বড় হবে, সেই স্বপ্নের পথে আমি এই শুরুটা করতে চাই’।

‘তুমি ভুলে যাচ্ছো সমাজ বাস্তবতা এখন সেই স্তরে নেই। তুমি একা এটাকে ভাঙতেও পারবেনা। এটার জন্য প্রথমত যেটা দরকার সেটি হচ্ছে সাংস্কৃতিক ভাবে সমাজের মান উন্নয়ন। রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন। সেটার জন্য সময় দরকার। তাছাড়া তোমার এই বড় করাটা সামাজিক ভাবে বড় করা নয় মোটেই, ব্যক্তিগত ভাবে বড় করা’। আমি রিয়াকে বুঝানোর চেষ্টা করি। ‘তাছাড়া নাড়ির টান তুমি উপলব্ধি করবে কিভাবে রিয়া, তুমি যদি ধারণ না করো?’

রিয়া হাতে ভর করে বালিশ থেকে মাথাটাকে উঁচু করে অবাক দৃষ্টিতে নিস্পলক তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।

‘এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?’

‘সৌম্য, কোনো বাবা কি তাঁর সন্তানকে ধারণ করে? বাবার কি নাড়ির টান থাকে? সন্তানের প্রতি গভীর মমতা কি বাবারা অনুভব করে?’ রিয়ার প্রশ্নে আমি হকচকিয়ে যাই।‘আমি কি বলেছি আমার এই প্রযুক্তি গ্রহণেই সমাজ পরিবর্তন হয়ে যাবে? আমরা সমাজকে এই প্রযুক্তি গ্রহণে উৎসাহিত করবো এই পদক্ষেপের মাধ্যমে’। রিয়া আবার শুয়ে পড়ে পাশ ফিরে। ‘লাইটটা নিভিয়ে দিও, ঘুম পাচ্ছে’।

আমি কথা খুঁজে পাইনা। নাকি সাহস? নিজের মাঝেই অনেক গুলো দ্বন্দ্ব কাজ করে আমার। স্রেফ ভালোবাসার টানেই আমরা একসাথে আছি। সামাজিক কোন লেবাস আমাদের নেই, ইচ্ছেও নেই। শুধুই জৈবিক চাহিদা আমাদের ভালোলাগায় মুখ্য নয়, ছিলোওনা। ওর স্বাতন্ত্র্য উপস্থিতি আমাকে রোমাঞ্চিত করেছে বারেবারে, যুক্তিশীল এবং কুসংস্কার মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি ওরপ্রতি মুগ্ধতা বাড়িয়েছে। কিন্তু আজ কেনো এটা আমি মনে নিতে পারছিনা? কেনো মনে হচ্ছে নাড়ির টানছাড়া সন্তানের প্রকৃত মোহ আমাদের স্পর্শ করবেনা। বাবার কি নাড়ি ছেড়ার টান আছে? রিয়ার প্রশ্নটা অস্থিরতা বাড়ায় আমার।

আমি হাত বাড়িয়ে রিয়াকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করি, সাড়া পাইনা। অনেকটা দাঁতাল ভাবেই মুখ ঘষি রিয়ার মুখে। রিয়া বাধা দেয়না, আমন্ত্রণও জানায়না। আরেকটু এগুতেই অস্ফুট শব্দ করে “উহু”। বুঝি সহ্য করেছে এতক্ষণ, উপভোগ নয়। নিজেকে গুটিয়ে নিই। নিজেকেই খুঁজতে থাকি নিজের মাঝে।

‘আড়াল বাহানা’ নামটি প্রয়াত শওকত ওসমানের একটি প্রবন্ধের থেকে নেয়া ।