এক
লেফ্ট রাইট, লেফ্ট! লেফ্ট রাইট লেফ্ট! এক দীর্ঘকায় তরুণ-পড়নে হাফ খাকি প্যান্ট, গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি, কোমরে বেল্ট, পায়ে খয়েরি রঙের পিটি স্যূ, হাতে একটি বেতের ছড়ি-কমান্ড দিচ্ছে, আর তার কমান্ডের তালে তালে দৃঢ় পদবিক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে কুচকাওয়াজকারী একদল টগবগে তরুণ। তাদের সকলের পড়নে খাকি হাফ প্যান্ট, গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি, পায়ে পুরু পিটি স্যূ ও হাটু অব্ধি লম্বা খয়েরি রঙের মৌজা। তাদের সম্মিলিত পদধ্বনির শব্দ আলমদের বাড়ি থেকেও শুনা যায়। এম,ই,এস, সড়ক থেকে কয়েক’শ গজ দূরে আলমদের বাড়ি। তাই শুধু শব্দ নয়, তরুণদলের সম্মিলিত পদাঘাতে সৃষ্ট রাস্তার কম্পনও আলমদের বাড়ি থেকেও অনুভূত হয়।
১৯৬৫ ইং সাল। কাশ্মির নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠেছে। তার উত্তাপ এসে লেগেছে সমুদ্রের বেলাভূমি পতেঙ্গাতেও। ছায়া সুনিবিড় গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলোর মধ্যেও হঠাৎ যেন উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। গা ঝাঁড়া দিয়ে উঠল যেন সবাই। পাড়ায় পাড়ায় মার্চ-পাষ্ট-যেন যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি। কাঠের তৈরী রাইফেল, খয়েরি রঙের খাঁকি প্যান্ট-শার্ট ও মাথায় মিলিটারী টুপি পড়ে টগবগে তরুণেরা যখন বুক চিতিয়ে লেফ্ট-রাইট, লেফ্ট-রাইট কমান্ডের তালে তালে দৃঢ় পদবিক্ষেপে এগিয়ে যায়, তখন আলমের মনে হয়-তারা যেন অনতিদূরে কোন যুদ্ধক্ষেত্রে যোগ দিতে বীরদর্পে এগিয়ে যাচ্ছে। এক ধরনের আবেগ উম্মাদনা সৃষ্টি হয় আলমের কঁচি মনেও । কী এক অজানা উত্তেজনা তীব্রভাবে টানে আলমকে। প্রতিদিন সন্ধ্যা রাতে শুরু হয় এ মার্চপাষ্ট। মার্চপাষ্টকারীদের অনুসরণ করতে করতে আলম যে অনেক দূরে চলে যায়, সে টের পায় না। এভাবে প্রতিদিন চলে একই ধরনের অনুশীলন। গ্রামে হঠাৎ যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা আলমকে চঞ্চল করে তুলেছে। লেখা পড়ায়ও যেন তার মন বসছে না। মনে মনে সে কেবলি যুদ্ধের কথা ভাবে। কখনো কখনো কল্পনার ডানায় ভর করে সে চলে যায় রণাঙ্গনে। বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে। কল্পনার রেশ কেটে গেলে নিজের অক্ষমতায় সে বিপন্ন বোধ করে। প্রতিদিন যুদ্ধের সাফল্য ও যুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাদের বিভিন্ন বীরত্বগাঁথা প্রচারিত হচ্ছে। এসব নিয়ে হাটে বাজারে দেদার বিক্রি হচ্ছে গ্রাম্য কবিদের লেখা আট পৃষ্টার কবিতা। যুদ্ধে বিভিন্ন রণাঙ্গণের ঘটনা এবং সে সকল রণাঙ্গণে পাকিস্তানী সেনারা কিভাবে বীরত্বের সাথে ভারতীয় আক্রমণকারীদের পরাস্ত করছে, তার ছন্দময় বর্ণনা থাকে এসব আট পৃষ্ঠার কবিতাতে। প্রতি রবিবার ও বুধবার হাটের দিন কৈল্লার হাটে এসব বিক্রি হয় দেদারসে । এগুলো আলমের বাবাই আলমকে বাজার থেকে কিনে এনে দেয়। আলম এসব কবিতা পুঁথির মত সুর করে পড়ে, আর তার সাথে বসে তার বন্ধুরা তা গোগ্রাসে গিলে। কি ভাবে পাকিস্তানী দেশপ্রেমিক সৈন্যরা বুকে ডিনামাইট বেঁধে চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণ ঠেকিয়ে দিচ্ছে, কিভাবে গুলি-বৃষ্টির মধ্যে পাকিস্তানী সেনারা বুক চিতিয়ে এগিয়ে গিয়ে ভারতীয় সেনাদের ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলছে, কিভাবে পাকিস্তানের একজন বিমান সেনা একা অনেকগুলো ভারতীয় বিমান কুপোকাত করে বীরত্বের সাথে দেশে ফিরে আসছে-এসব বীরত্বব্যঞ্জক গল্পে ঠাঁসা কবিতাগুলো পড়তে পড়তে আলমের কণ্ঠ আবেগে কেঁপে ওঠে। যুদ্ধের এহেন উম্মাদনা যখন দিকে দিকে, তখন এক অদ্ভূত প্রাকৃতিক ঘটনা গ্রামের মানুষদের জল্পনা-কল্পনাকে আরো ফেনায়িত করে তুলে। এক মধ্যরাতে গ্রামের মানুষ অবাক-বিস্ময়ে দেখে-উর্ধ্বাকাশে লম্বা বাঁকানো তরবারির মত একটি জিনিষ-তারার মত জ্বল্ জ্বল্ করছে । চায়ের দোকানে, চৌ-রাস্তার মোড়ে, সরগরম আলোচনা-মহান আল্লাহতা’লা পাকিস্তানের পক্ষে হিন্দুস্থানকে তরবারি প্রদর্শন করে হুশিয়ার করে দিচ্ছে, পাকভূমি পাকিস্তানের সাথে তারা কখনো যুদ্ধে পারবে না। এ ঘটনায় কুচ্কাওয়াজকারীদের বুক আরো যেন ফুলে ওঠে, হাত-পা সঞ্চালনের গতি হয় তীব্র থেকে তীব্রতর, লেফ্ট-রাইট, লেফ্ট-রাইট, কমান্ডের আওয়াজও হয়ে ওঠে বুলন্দ। তাদের দীপ্ত পদাঘাতে কেঁপে কেঁপে ওঠে সিমেন্ট ঢালাই করা এম,ই,এস, সড়ক; আর ঈমানী জোশে কাঁপছে যেন সমগ্র গ্রাম। মুসলমানদের পক্ষে আল্লাহের এ জাতীয় অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন আলমকেও অধিকতর বিশ্বাসী করে তুলে। (পরবর্তী সময় বিজ্ঞানীরা একে হেলির ধুমকেতু-যা প্রতি আশি বছরে একবার উদয় হয়-হিসাবে আখ্যায়িত করলে সে ব্যাখ্যা মেনে নিতে কষ্ট হয় আলমের।) উচ্ছ্বাসের ঢেউ গিয়ে লাগে কিশোর কিশোরীদেরও মনে। তারাও সুর করে গান ধরে। দেশাত্ববোধক গান। পাকিস্তানের উৎস কী-লা-ইলাহা ইল্লালাহ, গাইতে আছি জিন্দেগী-লা-ইলাহা ইল্লালাহ। বাজ্ছে দামামা, বাঁধরে আমামা, শীর উঁচু করো মুসলমান, ডাক এসেছে নয়া জামানার, গাইতে হবে নতুন গান, প্রভৃতি উদ্দীপনামূলক গান। আলমও তাদের দলে আছে। তার বয়সটা আরো একটু বেশী হল না কেন এ কথা ভেবে নিজের প্রতি ভীষণ রাগ হয় তার। চলবে—

* আমার কৈফিয়ত-
(বহুদিন পূর্বে স্বপ্নভঙ্গের ইতিকথা নামে আমার একটি ধারাবাহিক লেখা-যার ব্যাপ্তি সেই ১৯৬৫ ইং সালের পাক-ভারত যুদ্ধকালীন সময় থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-উত্তরকালীন সময় পর্যন্ত বিস্তৃত-লিখেছিলাম। সাধ থাকা সত্বেও সাধ্যের অভাবে অদ্যাবধি তা ছাপার মুখ দেখেনি। ইদানীং মুক্তমনায় লেখার সময়ও পাই না। হঠাৎ মনে হল মুক্তমনায় ধারাবাহিকভাবে লেখাটি দিই না। পাঠক বিরক্ত না হলে শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যাব। তবে এ লেখাটি একজন কিশোর কিভাবে একজন রাজনৈতিক কর্মী থেকে একজন মুক্তিযোদ্ধায় রুপান্তরিত হল এবং একটি নতুন স্বদেশের স্বপ্ন দেখেছিল এবং স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছিল, অনেকটা তার আত্মজৈবনিক স্মৃতি কথা-অবশ্যই কোন ইতিহাস নয়। মোটা দাগে এখানে সময়-কালের উল্লেখ থাকলেও ইতিহাসের সন-তারিখ খোঁজা সমীচিন হবে না।)