ক.
সুবীর ওর বাবাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে উঠেছে। বছরখানেক আগেই ওদের এখানে আসবার কথা ছিল। তখন বাবা বেঁচেছিলেন। সুবীরের বাবা হরিশঙ্কর কাকা লোকমারফত ভাঙা ভাঙা অক্ষরে পত্র লিখে পাঠিয়েছিলেন, আসবার কথা জানিয়ে। বাবা সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে আপ্লুত হয়ে উত্তরও পাঠালেন। এরপর বাড়ির এটা ঠিক করো, ওটা ঠিক করো– এতদিন পর হরি আসছে! বাড়ির সবাইকে অস্থির করে তুলেছিলেন। সীমান্তে যারা কারবার করতো তাদের রোজই একবার করে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতেন– দেখবি, হরির আসতে সমস্যা হয় না যেন! তারপর বাড়ি আর পথ করতে করতে একদিন নিজেই চলে গেলেন। গতকাল সুবীর যখন হরিশঙ্কর কাকাকে নিয়ে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে নিজেদের পরিচয় দিলো, তখন কেবলই বাবার কথা মনে হচ্ছিল। আমার স্ত্রী তো পেছনে দাঁড়িয়ে কেঁদেই ফেলল। হরি কাকাকে ওই ধরে নিয়ে গিয়ে বসবার ঘরে বসালো। বেশ ভারী শরীরের মানুষটা। হাঁটবার সময় বাচ্চাদের মতো দেখে দেখে পা ফেলেন। সুবীর আমার বয়সই হবে। মিরাকে হাত তুলে নমস্কার করে একটু ইতস্তত করে একটা হাত আমার দিকে এগিয়ে দিল। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে খানিকটা ফিসফিস করে বলল– মেহেরপুরে পা দিয়েই কাকার সংবাদটা শুনলাম। বাবাকে বুঝতে দিইনি। এমনিতেই অনেক ধকল গেছে; এখনই কিছু বলবেন না প্লিজ। কিছু একটা বলে ম্যানেজ করুন। বৌদিকেও একটু বলে দেন। হরি কাকার দিকে তাকিয়ে বিষয়টা বুঝতে আমার অসুবিধা হলো না। সঙ্গে সঙ্গে মিরাকে আড়ালে ডেকে বললাম– কাকাকে বলো, বাবা ক’দিন মেরেপুরের বাইরে গেছে। চলে আসবে। শরীরটা বিশেষ ভাল না, এখনই কিছু বললে বেশি আপসেট হয়ে পড়লে সমস্যা হতে পারে। হরি কাকাকে মিরার দায়িত্বে রেখে আমি আর সুবীর গেস্টরুমের বারান্দায় গিয়ে বসলাম। সুবীর লম্বা ছিপছিপে গড়নের। ক্লিন সেভড্। ফতুয়ার মতো একধরনের শার্ট আর বেগিজাতীয় ঢিলেঢালা প্যান্ট পরে আছে। হরি কাকা সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরেছেন।
চলবে? একটা গোল্ডলিফ ধরিয়ে সুবীরকে লক্ষ্য করে বললাম। আমার দাড়িভর্তি মুখ আর মাথায় টুপি দেখে শুরুতেই সুবীর খানিকটা ভড়কে গিয়েছিল, ওর কথা বলবার ধরন ধরে বুঝেছিলাম। তাই মাথার টুপিটা খুলে নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে আর একটা সুবীরকে অফার করলাম।
ওতে আমার অভ্যেস নেই। খালি আলোটা দিন। সুবীর কলকাতার একটি সস্তা ব্রান্ড বের করে লাইটারের জন্য হাত বাড়ালো।
আপনাদের এখানে বেশ গরম। কলকাতায় এখনও এত গরম পড়েনি, বুঝলেন দাদা? কিছু একটা বলে সুবীরও আলাপটা সহজ করবার চেষ্টা করছিল।
হুম। আজ গরমটা বেশি। তবে ভোরের দিকে আবার খানিকটা ঠাণ্ডা পড়বে। মার্চ মাসটা এভাবেই যাবে। দু’দেশের দু’জন অপরিচিত মানুষ এভাবে আবহাওয়া বার্তা শেয়ার করার ভেতর দিয়ে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করবার চেষ্টা করছিলাম।
খানিকটা সহজ হওয়ার মতো মনে হলে সুবীর বলল– আমরা বোধহয় আপনাদের বিরক্তের ভেতর ফেলে দিলাম। বাবা আসলে এত করে..। যাচ্ছি যাচ্ছি করে কতদিন তো আটকে রাখলাম, এবার আর পারলাম না। এভাবে হুট করে আসাটা ঠিক হচ্ছে না ভেবেও চলে এলাম। কাকা নেই জানলে হয়ত…।
না, মোটেও অমনটি ভাববেন না। আমরা আপনার বাবার পত্র পাওয়ার পর থেকেই তৈরি ছিলাম। তবে বাবা দেখে যেতে পারলেন না, এই আর কি! হঠাৎ এভাবে ভিনদেশী অচেনা অথিতি পেয়ে খানিকটা বিব্রত হলেও সেটা প্রকাশ না করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছিলাম। সেটা হয়ত সুবীর টেরও পাচ্ছিল।
আমরা বরং কোনো হোটেলে গিয়ে উঠি। আপনি সবকিছু দেখিয়ে দিন সেই যথেষ্ট। সুবীর বলল। মেয়ের পরীক্ষা চলছে, এর ভেতর এমন দুজন বাইরের মানুষ থাকলে কারও খুশি হবার কথা নয়। তাছাড়া, আমাদের বাসায় বহুদিন হিন্দুধর্মালম্বী কেউ এভাবে বেড়াতে আসেনি। তাই একটু যে সমস্যা হবে না সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছিল না। কিন্তু বাবার কাক্সিক্ষত অতিথিতে এভাবে হোটেল পাঠানোর কথা ভাববার মতো ওতটা অসামাজিক আমি নই। তাছাড়া আমি চাইলেও আমার স্ত্রী যে রাজি হবে না, সে আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছি। তাই সুবীরকে জানিয়ে দিলাম– ওসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। মনে মনে নিজেকেও বললাম একই কথা।
কাকা বাবাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। মিরা খুব ভালোভাবে সামলে নিল বিষয়টি। এতটা পথ পাড়ি দিয়ে তিনি বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। বিছানায় শরীরটা এলিয়েই ঘুমিয়ে পড়লেন। তখন সবে সন্ধ্যা নেমেছে। আমি সুবীরকেও বিশ্রাম নিতে বলে বাজারের ব্যাগ হাতে বেরুচ্ছিলাম। ও অনেকটা জোর করেই সঙ্গী হল।
বাবার মুখে বাংলাদেশের খুব গল্প শুনেছি। ইনফ্যাক্ট, এই একটি গল্পই তিনি সারাজীবন বলে এসেছেন। ভালো লেগেছে আবার বিরক্তও কম হইনি। যখন দেশ ছেড়েছেন মাত্র বার বছর বয়স। কতটুকুই বা স্মৃতি, ওই থেকে খামছা খামছা বছর বছর ঝালিয়ে যাওয়া কারই বা এত ভালো লাগে বলুন?
ওসব কথা পরে হবে। চলুন শহরটা আপনাকে দেখাতে দেখাতে বাজারটা সেরে আসি। আমি থামিয়ে দিয়ে বলি। বাজারটা সেরে নিয়ে আমরা চায়ের দোকানে বসি। পরিচিত লোকজনদের সঙ্গে সুবীর, বাবার বন্ধুর ছেলে, কলকাতা থেকে এসেছেন, বলে পরিচয় করিয়ে দিই। কেউ ঠাট্টা করে বলে, তোর বাবা আবার কলকাতায় বন্ধু জোটালো কবে?
আমরা কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করি না। সুবীর কলকাতার জেনে আমার বন্ধু সামছুল– বাম রাজনীতি করতো একসময়– মুখ্যমস্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খবরাখবর জানতে চায়, বলে– মমতাদির অবস্থান নিয়ে আপনাদের ওখানে হাওয়া কেমন? তারপর আমরা না চাইলেও আমাদের আলোচনা রাজনীতির দিকে গড় মারে। সুবীর এই এক তরফা আলোচনায় মন বসাতে পারে না। বিশেষ করে সকলে যখন কলকাতার রাজনীতি-সংস্কৃতি নিয়ে নানান প্রশ্ন করে তখন এদেশ সম্পর্কে সুবীর পাল্টা কোনো জিজ্ঞাসা জাহির করতে না পেরে বেশ লজ্জিত হয়। আমাকে আসতে আসতে সে নির্দিধায় জানালো সে কথা– দাদা, এখানে না আসলে জানতেই পারতাম না, কলকাতা নিয়ে এত ভাবেন আপনারা! সত্যি বলতে আমি নিজেও ওত ভাবিনি। আর বলতে দ্বিধা নেই, আমি আসলে বাংলাদেশ নিয়ে তেমন কিছুই জানি না। কি করে জানবো বলুন, সারাদিন কোম্পানির মালপত্র বিক্রি করার ধান্দা করি। ব্যবসাটা টেকাতে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে। বোঝেন তো দাদা, আমাদেরও তো ওখানে এডজাস্ট করে চলতে হয়। ঠাকুরদা তিন ছেলে নিয়ে একেবারে খালিহাতে এদেশ থেকে পাড়ি জমান। তারপর ঠাকুরদা না পারলেন মানতে, না পারলেন ছাড়তে– এক দুর্ঘটনায় চলে গেলেন। কেউ কেউ বলে আত্মহত্যা। এরপর বাবা আর কাকারা খুটিয়ে খুটিয়ে কিছু একটা দাঁড় করাতে চেষ্টা চালালেন। তারপর থেকেই চলছে। কখন এত জানবো বলুন?
না। ঠিক আছে। সব কিছু কি আর জানা যায়। আমি আর কথা বাড়াতে দিই না।
এবার আইপিলে কলকাতার এত বাজে খেলা মোটেও ঠিক হয়নি। আমি প্রসঙ্গ বদলাতে বলি।
তা যা বলেছেন! সুবীর এবার খানিকটা চাঙা হয়। কেউ ফর্মে ছিল না, বুঝলেন না। আর তাছাড়া, এসব দিয়ে না কিচ্ছু হবে না। শাহরুখ ওসব বোঝে নাকি। ও তো আজকাল সিনেমাতেও লস খায়। দাদাকে দায়িত্বটা দিলে না, এমনটি হতো না।
এভাবে আমরা খেলা, খেলা থেকে বলিউড, বলিউড থেকে টালিউড, এমন কি দক্ষিণ পর্যন্ত চলে যায়।
রাতে খাবার টেবিলে কিছু একটা বলা উচিত ভেবে হয়ত মিরা সুবীরকে প্রশ্ন করে ওর প্রিয় সিরিয়াল নিয়ে– দাদা, একটু পরেই রাশি শুরু হবে, দেখবেন?
সুবীর এমন প্রশ্নতে শুরুতে একটু অপ্রস্তুত হয় তারপর সামলে নিয়ে বলে– আমি ওসব দেখি যে না বৌদি।
সেকি, আপনারা দেখেন না? মিরা খানিকটা হতাশ হয়।
আমরা মানে আমি দেখি না। আপনার বৌদি মানে আমার ওয়াইফ ভীষণ দেখে।
তাই বলুন। বৌদিকে নিয়ে আসুন না একবার।
কেন? একসঙ্গে সিরিয়াল দেখবে বলে। আমি বলি।
সুবীর মৃদু হাসি দিয়ে বলে, আসবো নিশ্চয়। তার আগে আপনারা আসুন না একবার।
আপনার দাদাকে তো বলিই। তখন তো আর আপনাদের সঙ্গে এত জানাশুনা ছিল না তাই সেইভাবে জোর দিয়ে বলতে পারিনি। অচেনা একটা দেশ, কোথায় যায়, কি খাই– সেই ভয়ে।
খ.
বেশ ভোরেই কাকাকে নিয়ে বের হলাম। কাকা বাড়িটা দেখবেন বলে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। সঙ্গে সুবীরও। বড় বাজারের কালি মন্দিরের পেছনেই ছিল বাড়িটা। বাবার মুখে শুনেছি। আমি ঠিক জানি না কোন বাড়িটা। থাকলে কাকা নিশ্চয় চিনবেন– সেই ভরসা। কাকা বেশি কথা বলছিলেন না, থেমে থেমে ভালো করে সবকিছু দেখছিলেন আর বলছিলেন– ভগবান, এত পাল্টে গেছে! মাঝে মাঝে এটা সেটা জিজ্ঞেস করেন যার বেশিরভাগই আমার পক্ষে ঠিকঠাক বলা সম্ভব হয় না। কাকা মুরব্বি কাউকে পেলে থামিয়ে জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা খগেন কি বেঁচে আছে? হাসমতের বাড়িটা এদিকটাতে ছিল না? তোমরা কি মালেকের কথা বলতে পারো, আব্দুল মালেক? ওই যে মোটা করে! শুনেছিলাম রহমান নাকি এখানকার কি একটা ইলেকশনে জিতেছে? ও কি থাকে মেহেরপুর? কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তর আংশিক পান, কোনোটার উত্তর পান না। আমরা এগুতে থাকি। তবে একজনের উত্তর আমার ভাল করেই জানা ছিল। কাকা যখন হারাধন কাকার কথা জিজ্ঞেস করেছিল তখন আমার বুকের ভেতর ছড়াত করে উঠেছিল। আমি চুপ করে ছিলাম। কাকা বললেন, এই হারাধন আমি আর তোর বাবা ছিলাম জানের জিগার। আমি আর তোর বাবা যখন যে যার বাড়ি যেতাম তার মাই তখন আমাদের মা বনে যেত। কিন্তু হারাধন নিচু জাতের ছিল বলে, আমাদের বাড়ি তার আগমন অতটা সুখকর ছিল না। তবে তোর বাড়িতে কোনো সমস্যা হতো না। তখন সবাই যখন এপার ওপার করছিল। তখন হারাধনকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, তোর দাদি যেতে দেইনি। বললো, ওরা সবাই গুষ্টিশুদ্ধ যাচ্ছে, তোর তো আর আগেপিছে তেমন কেউ নেই, তুই আমার কাছেই থেকে যা। হারাধন আর যেতে পারলো না।
আমার খুব হারাধন কাকার কথা মনে পড়ছিল। কেমন মিষ্টি একটা মানুষ ছিল। কাজও ছিল মিষ্টি গড়ার কারিগর। কাকা যতদিন ছিল আমাদের মিষ্টি কিনে খেতে হয়নি। আমরা দু’ভাই সেই ছোটবেলা থেকেই স্কুলে যাবার কিংবা ফিরবার পথে হারাধন কাকার দোকান থেকে মিষ্টি হাতে করে চাটতে চাটতে স্কুল যেতাম কিংবা বাড়ি ফিরতাম। সাথে যে থাকতো তার ভাগ্যেও মিষ্টি জুটতো বলে আমাদের স্কুলসঙ্গীর কমতি হতো না।
মা প্রায়ই রাগ করতেন এ নিয়ে। বাবাকে বলতেন, হারু দাদার ব্যবসা তোমার ছেলেরাই ডোবাবে।
দোস কেবল আমার ছেলেদেরই, হারু যে সাধে, ওর দোষ কিছু নেই? আমি তো ভাবছি, ছেলেদের কারো ডাইবেটিকস হলে হারুকে দেখে নেবো। এই বলে বাবা হো হো করে হাসতেন। হারু কাকার সামনে আলাপটা ঘটলে তিনিও পাল্লা দিয়ে হাসতেন।
কলেজে পা দিয়েই মফেদুল, আমার ছোটভাই, ছাত্রশিবিরে নাম লেখালো। বাবা সদ্য হজ্জ ফেরত, তাই বাবাকে তার অবস্থান বোঝাতে অসুবিধা হল না। তখন ভোটের মৌসুম। যেই ওরা হেরে গেল, ওই রাতের হারু কাকাসহ হিন্দু পাড়ায় আরো ক’ঘর বাড়ি পুড়লো। জীবন্ত দগ্ধ হল কয়েকজন, তার ভেতর হারু কাকাও ছিল। মফেদুল এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল না বললেও বাবা বিশ্বাস করেননি। ওকে সঙ্গে সঙ্গে ত্যজ্য করেছেন সকল সম্পর্ক থেকে। ঐ ঘটনার পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর বাবা মিষ্টি ছুয়ে দেখেননি। মালোপাড়ার ঐদিকটাতেও আর কখনো যাননি। এসব কথা হরিকাকাকে বলা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
সুবীর আর আমি পালা করে কাকাকে ধরে নিয়ে হাটতে থাকি। তবে কাকা সুবীরের চেয়ে আমার সঙ্গে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সুবীর তো একবার ঠাট্টা করে বলেই ফেলল- দেখছেন দাদা, দেশে পা দিয়েই বাবা কেমন পর করে দিয়েছে আমাকে। আমি আর কাকা দুজনেই হাসলাম। কালি মন্দিরের সামনে এসে কাকা থ মেরে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। স্মৃতি আর সময় মেলাতে চেষ্টা করছিলেন বোধহয়। কাকা একপা একপা করে মন্দিরের ভেতর প্রবেশ করেন। মনে হয় যেন চোখ বাধা অবস্থায় পা গুণে গুণে ভেতরে প্রবেশ করছেন। আমি আর সুবীর বাইরে এক চায়ের দোকাকে বসি।
আজ খুব শান্তি লাগছে দাদা। সুবীর বলে। বাবা আজ প্রায় দশ বছর ধরে বাংলাদেশ আসার জন্য গো ধরে বসেছিল। আমাদেরও সময় হচ্ছিল না, একবার হলো তো বাবার ওপেন হার্ট সার্জারি করা লাগলো। আগে একবার হার্ট-এ্যটাক। হচ্ছিল না। এবারও হতো না। বাবার শরীরের যা অবস্থা, দাদারা কিছুতেই রাজি ছিল না। কিন্তু, হঠাৎ করে আমারও কি যেন হয়ে গেল। ভাবলাম, আসিই না একবার ঘুরে। শুধু আপনার বৌদিকে জানিয়ে কাগজপত্র করে সেদিন বাবাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কাগজপত্রর করার বিষয়টি বাবা তো কিছুতেই মানতে পারছিলেন না। কি করে আর মানে বলুন, আমাদের এখানকার ঘরবাড়ি তো আর কারও নামে লিখে দিয়ে যাই নি। আসবার সময় বহুবার মনে হয়েছে– কাজটা বোধহয় ঠিক হলো না। ভীনদেশে একটা কিছু হয়ে গেলে সামলাবো কি করে। এখন মনে হচ্ছে, আরও আগেই আসা উচিত ছিল। আমাদের সবার জন্যেই। সুবীর বলে চলে। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবি, একদিন এভাবে বসেই হয়ত হরিকাকা আর বাবা গল্প করতো। অন্য গল্প। আমি সেই গল্পগুলো সাজানোর চেষ্টা করি। সুবীর বলে চলে– আচ্ছা দাদা, হিন্দু আর কত ঘর আছে এখানে?
আছে। একেবারে মন্দ না।
সমস্যা হয় না? না মানে, শুনি যে মাঝে মধ্যেই ঘরবাড়ি সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ওসব শুনে মনে হয়, ঠাকুরদা ঠিকই করেছিলেন। আজ হোক কাল হোক তো আসতেই হতো। না হলে যেতামই বা কোথায়।
সমস্যা কিছু হয় না, তা না। তবে এখানে তো তেমন কিছু দেখি না। দিব্যি তো যাচ্ছে। আমি একটু আনমনা হয়ে বলি।
আমাদের দেশে আসেন না একদিন। কত বাংলাদেশী তো যায়। বাবার পরিচিত অনেকেই গেছে আমাদের ওখানে। শুধু আপনারাই গেলেন না।
হ্যাঁ। যাবো ক্ষণ। আমরা আর আলাপ না বাড়িয়ে মন্দিরে গিয়ে কাকাকে নিয়ে আসি। কাকার চোখে জল। জল খানিকটা সুবীরের চোখেও। সুবীর লজ্জা পায় আমার চোখে চোখ পড়াতে। আমরা মন্দিরের পেছন দিকে পা বাড়ায়। কাকার পা আর কিছুতেই চলে না। এতটা পথ যার জন্য আসলেন তার দেখা না পেলেই যেন বেঁচে যান তিনি। আমি আর সুবীর অনেকটা শূন্য করে উঠিয়ে নিয়ে গেলাম। মন্দিরের পেছনে দুটি ঘর মাজাঅবধি ভেঙে পড়ে আছে। পাড়ার বখাটেরা মাঝে মাঝে ভেতরে গিয়ে ওপার থেকে চোরাপথে আসা ফেনসিডিলের বোতল নিয়ে বসে। তাস খেলে। বিড়ি ফোকে। এর বাইরে কেউ এখানে আসে না। কাকা আসবার কথা শুনে বাবা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিলেন, গুড়িয়ে ফেলে একটা মাদ্রাসা তৈরির পায়তারা চলছিল অনেকদিন থেকেই। পাশে মন্দির বলে শেষ পর্যন্ত অনেকেই বাগড়া দিয়ে বসে। তারপর কি সীদ্ধান্ত হয়ে জানি না। জানার কোনো দরকার পড়েনি। কাকারা তো আর থাকতে আসেন নি। এক কোণায় ভাঙ্গা ইটের ফাক গলিয়ে একগুচ্ছ তুলসির পাতা গজিয়ে উঠেছে। কাকা তুলসি গাছটার পাতায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে– এ ঘরটাই মা থাকতো। ওদিকটাই আরো দুটো ঘর ছিল, ঐ নতুন ঘর উঠেছে ঐখানে। আমি থাকতাম ঐ ঘরদুটোর একটিতে। তোর বাবা আর আমি লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ি খেতাম। আমাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলে কাকা জোর করে হাসবার চেষ্টা করেন। সুবীর আমাকে আড়াল করে এক টুকরো ইট পকেটে তোলে। আমি দেখেও না দেখার ভান করি। কাকা হাটতে হাটতে মাটিতেই হাটু গেড়ে বসেন। একটা ইটকে আসন বানিয়ে বসে পড়ে সুবীরও। আমি অসহায়ের মতো ওদের দিকে তাকিয়ে থাকি। ওদের পাল্টা তাকানো দেখে মনে হয়, এসবের জন্য আমিই দায়ী। অপরাধ বোধে আমার মাথাটা নিচু হয়ে আসে। মাথার টুপিটা খুলে বুকপকেটে রাখি। কাকারা বসে থাকতে থাকতেই আমি মন্দিরের প্রায় লাগালাগি এক মসজিদ থেকে জুম্মার নামাজটা সেরে আসি। এই মন্দির এবং মসজিদ- দুটোই আমার আর সুবীরের দাদারা একজোট হয়ে তৈরি করেছিল। আরো দূরে আলাদা করে দুটো নির্মাণ করা যেত, কিন্তু বাবার মুখে শুনেছি, এই জায়গাটা ছিল আড্ডার কেন্দ্র। তাই আড্ডার মাঝে নামায-পুজোয় যেতে যাতে সময় নষ্ট না হয় এই ভেবে পাশাপাশি তৈরি করা। গত দশ বছরে এ দুটো আলাদা করার অনেক পায়তারা করা হয়েছে, শহরটা এখন যেহেতু মুসলমান অধ্যুষিত তাই মন্দিরটা সরানোর পেছনেই ভোট বেশি। আবার এই পাড়াটায় হিন্দু বেশি বলে জোর ওদের পক্ষেও কম নেই। তাই এক ধরনের হাঙ্গামার ভেতর দিয়েই সময় চলে যাচ্ছে। হরিকাকার এতসব জানবার কথা নয়। জানার দরকারও নেই। বাবা থাকলে এসবের কিছুই বলতেন না। আমিও যতটা সম্ভব সময়ের বাস্তবতা থেকে তাকে দূরে রাখার চেষ্টা করি। যে স্বপ্ন নিয়ে এসেছেন সেই স্বপ্নটা ভেঙে যাক, এটা সুবীরও যেমন চাচ্ছিলও না, আমিও তেমন চাচ্ছিলাম না। আমরা অনেকটা মরা বাড়ি থেকে ফিরবার মতো বিষণœভাবে বাড়ি ফিরলাম। কাকা অল্পতেই হাপিয়ে উঠছিলেন। তার জন্যে বিশ্রামের ব্যবস্থা করে আমি সুবীর আর মিলা ড্রয়িংরুমে টেলিভিশন ছেড়ে বসলাম।
কাকারা সেদিন না গেলে সুবীর দা আর তুমি প্রায় বন্ধুর মতোই হতে না? প্রশ্ন করে মিলা। তোমরা আজ আর আলাদা দেশের মানুষ হতে না।
মিলার কথায় আমি আর সুবীর কেউ স্বাভাবিক হতে পারি না। দুজনেই এক অজানা কারণে অস্বস্তিতে পড়ে যায়। বৌদি, আপনার মেয়েটি কিন্তু লক্ষী হয়েছে। সুবীর প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে। এসেই থেকেই দেখছি পড়ার টেবিলে। আর আমার মেয়ে তো বলিউডের বাইরে কিচ্ছু বোঝে না। পড়তে বললেই শরীরে জ্বর উঠে যায়।
আমার মেয়েও কম না। পরীক্ষা আর আপনারা আছেন তাই টিভির রুমে আসছে না, নয়লে তো সারাদিন হিন্দি চ্যানেলগুলো ছেড়ে বসে থাকে। বলে কি-না সালমান আর আফ্রিদি আমার হিরো। এইটুকু মেয়ে, বোঝেন?
সুবীর আর মিলা দুজনেই হাসে। আমিও হাসবার চেষ্টা করি।
কাকা উঠেই নদীতে যাওয়ার বাইনা তোলেন। শিশুর মতো বলেন, চল না বাবা, একটু নদীর দিকটা ঘুরে আসি। তোর বাবার সঙ্গে কত গেছি– মাছ ধরতে, গোসল করতে। আবার কখনও কখনও কোনো কাজ না নিয়েই।
নদী কি আর সেই নদী আছে। ওদিক থেকে পানি আটকে রেখে এদিকের সব নদী মেলে ফেলা হচ্ছে। সুবীরকে যেতে যেতে বললাম সে সব কথা। সুবীর বললো, পানির সমস্যা ওখানেও নাকি আছে। গঙ্গা শুকিয়ে যাচ্ছে। আমি আর কথা বাড়াই না। অটো নিয়ে সোজা ব্রিজের ওপর চলে গেলাম। নিচে সেচ দিয়ে ধান চাষ করতে কেউ কেউ। কোথাও কোথাও পানি কাদা হয়ে জমে আছে। কাকা অটো থেকেই একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, চল। আমার মাথাটা ঘুরছে। পরে আবার আসবো। কাকার এভাবে হঠাৎ মুড অফ হয়ে যাওয়া দেখে আমরা দুজনেই অবাক হলাম। কাকা আসতে আসতে বিড়বিড় করে বললেন– শেষ পর্যন্ত নদীটাও। তোর বাবা আমাকে ঠকিয়েছে। সবকিছু নিয়ে ভেগে গেছে। আমার আর সুবীরের বুঝতে বাকি রইল না কিছুই। ঝড় আসার আগ মুহূর্তের প্রকৃতির মতো স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলেন কাকা। কাল যত ভোরে সম্ভব রওনা দিতে পারলে ভালো হয়। সুবীর বলল।
আপনার সব লেখাই আমার অসম্ভব ভালো লাগে. এ লেখাটিও প্রাণ ছুঁয়ে গেল. দেশ ভাগের বহু বহু বছর পর জন্ম হওয়া সত্ত্বেও এসব গল্প পড়লে মনটা কেন যেন হাহাকার করে উঠে. ধন্যবাদ.
@হেলাল, ধন্যবাদ ভাই।
আপনার গল্প বলার ধরন ভাল লেগেছে। কাহিনী বাস্তবসম্মত, চরিত্রগুলো পরিচিত। ভাল হয়েছে। (Y)
@সুষুপ্ত পাঠক, ধন্যবাদ।
একটানে না পড়ে পারলাম না। চমৎকার।
@গীতা দাস, ধন্যবাদ দিদি।