১৯৫০ সালে ডাচ কার্টুনিস্ট ভাইরিনগেনের (Wieringen) একটা কার্টুন জনপ্রিয় হয়েছিল। কার্টুনে দেখা যাচ্ছে ইউরোপের বিজ্ঞ প্রফেসররা ‘আইনস্টাইন-সমস্যা’র সমাধান করতে গিয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছেন। একজন মাথার চুল ছিঁড়ছেন, একজন নিজের কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যায় উদ্যত হয়েছেন। আর সাদামাটা আইনস্টাইন উদাস ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন এক কোণায় – যেন কোন কিছুতেই কিছু যায় আসে না তাঁর।


আইনস্টাইন তাঁর সার্বিক আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন ১৯১৬ সালে। ‘আনালেন ডের ফিজিক’ এর ৪৯ সংখ্যায় ৫৩ পৃষ্ঠার ঢাউস গবেষণাপত্রে আইনস্টাইন জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্বের গোড়াপত্তন করেছিলেন। আইনস্টাইন তাঁর এই তত্ত্বকে যতই প্রকৃতির স্বাভাবিক সাধারণ নিয়ম বলে প্রতিষ্ঠা করেছেন – ততই বিজ্ঞদের মাথা খারাপ হয়ে যাবার অবস্থা – তাঁর তত্ত্বের জটিলতায়।

আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব প্রকাশিত হবার এগারো বছর আগে ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন প্রকাশ করেছেন তাঁর আরো চারটি যুগান্তকারী গবেষণাপত্র – যেগুলোর মাধ্যমে আইনস্টাইন ‘আইনস্টাইন’ হয়ে উঠেছিলেন। স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব – যা থেকে স্থান ও কালের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের প্রবন্ধটি ছিল ১২১ পৃষ্ঠার। পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় সমীকরণ E = mc2 প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৫ সালে। মাত্র আড়াই পৃষ্ঠার ছোট্ট একটা পেপারে আইনস্টাইন এই সমীকরণের মাধ্যমে ভরের নতুন সূত্র দিয়েছিলেন – ‘বস্তুর ভর হলো তার ভেতরের শক্তির পরিমাপ’। একই বছরে প্রকাশিত আরো একটি পেপারে আইনস্টাইন শক্তি ও কম্পাঙ্কের মধ্যেই সমানুপাতিকতার সম্পর্ক উন্মোচন করে দেন – E = hf (যেখানে f হচ্ছে কম্পাঙ্ক, আর h হলো প্ল্যাংকের ধ্রুবক)। সতের বছর পর ১৯২২ সালে এই সূত্রের জন্যই আইনস্টাইন নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু যখন তিনি পেপারগুলো লেখেন তখন শুধুমাত্র জীবনধারণের জন্য প্যাটেণ্ট অফিসে কেরানিগিরি করছিলেন তিনি।


১৯০২ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে প্যাটেন্ট অফিসে কাজ করেছেন আইনস্টাইন। তার আগের কয়েক বছর হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজেছেন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে টিউশনি খুঁজেছেন। নিয়মিত কোন ছাত্রও পাননি পড়াবার জন্য। ক্লাস প্রতি মাত্র দুই ফ্রাংক দিয়েও কেউ পড়তে আসেনি আইনস্টাইনের কাছে। পরে আবার বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতি ঘন্টায় তিন ফ্রাংকের বিনিময়ে একজন ছাত্রকে পড়িয়েছিলেন কিছুদিন। প্যাটেন্ট অফিসের চাকরিটি পাওয়ার জন্যও তাঁকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। বন্ধুর প্রভাবশালী বাবার সুপারিশ লেগেছে একটা তৃতীয় শ্রেণির চাকরি পাবার জন্য।

প্যাটেন্ট অফিসে সারাদিন কাজ করার পর সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে ফিরে স্ত্রী আর সন্তানকে একপ্রকার বঞ্চিত করেই নিজের গবেষণা নিয়ে বসেছেন। পেপার লিখেছেন। প্রকাশ করেছেন। তার মধ্যেও সামান্য কিছু বেশি অর্থের জন্য প্রাইভেট টিউশনিও করেছেন। ১৯০৫ সালের ২৪ অক্টোবর থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত লুসিন শ্যাভেন নামে একজন ছাত্রকে চার দিন পড়ানো বাবত আঠারো ফ্রাংক নিয়ে নিজের হাতে নিচের রশিদটি লিখে দিয়েছিলেন আইনস্টাইন।

আইনস্টাইনের নিজের হাতের লেখা বা অটোগ্রাফের কোন চাহিদাই সেদিন কারো ছিলো না। আইনস্টাইন নিজেও কোনদিন বিখ্যাত হবার স্বপ্ন দেখেননি। শুধু চেয়েছিলেন শান্ত কোন পরিবেশে কোন একটা কোণে চুপচাপ বসে নিজের মনে কাজ করতে, প্রকৃতির নিয়ম কানুন বোঝার চেষ্টা করতে।


অনেক সংগ্রাম আর চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আইনস্টাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হতে পেরেছিলেন। স্বাধীন চিন্তার একটা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। প্রকৃতিকে তাঁর মতো করে আর কেউই বুঝতে পারেননি। কিন্তু শান্তিপ্রিয় মানুষটির শান্তি নষ্ট হয়ে যাবার জোগাড় হলো বিখ্যাত হয়ে ওঠার পর থেকে।

১৯১৯ সালে তাঁর সার্বিক আপেক্ষিকতার তত্ত্বের সত্যতা পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত হয়। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবজারভেটরির পরিচালক স্যার আর্থার এডিংটন সূর্যের অভিকর্ষজ ক্ষেত্রের টানে যে তারার আলো বেঁকে যায় তা পর্যবেক্ষণ করেন। এই সংবাদ প্রকাশিত হবার সাথে সাথে আইনস্টাইন রাতারাতি পৃথিবীবিখ্যাত হয়ে ওঠেন। আইনস্টাইনের তত্ত্ব যে সবাই খুব বুঝে গেলেন তা নয়। বরং তাঁর তত্ত্বের দুর্বোধ্যতাই তাঁকে আরো বিখ্যাত করে তুললো। বৈজ্ঞানিক কাজের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি নোবেল পুরষ্কার পেলেন ১৯২২ সালে। তারপর থেকেই প্রচারমাধ্যমে আইনস্টাইন নিত্য-স্মরণীয় হয়ে উঠলেন।


খ্যাতির শীর্ষে উঠে যেতে সময় লাগলো না আইনস্টাইনের। এসব ক্ষেত্রে যা হয় – নানারকম মিথ তৈরি হতে থাকে আইনস্টাইনকে ঘিরে। আইনস্টাইন অবশ্য মিডিয়ার এসব প্রচারে তেমন গুরুত্ব দেন না। (তখন অবশ্য টেলিভিশনের দৌরাত্ম্য ছিল না। আইনস্টাইনকে টিভি টকশো করতে হয়নি)। কিন্তু আইনস্টাইন কোন পাবলিক সমাবেশে গেলেই অটোগ্রাফের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন অনেকেই। (অবশ্য এখন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য যেরকম ভীড় হয় – আইনস্টাইনের ক্ষেত্রে তার শতাংশও হতো না।) এই অটোগ্রাফ সংগ্রহকারীদের হাত থেকে বাঁচতে চাইতেন আইনস্টাইন। তিনি জানতেন যে এই অটোগ্রাফ সংগ্রহকারীদের বেশির ভাগেরই তাঁর বিজ্ঞানের প্রতি কোন ভালোবাসা নেই। কেবল বিখ্যাত ব্যক্তির স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে পারলে বা পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে পারলে নিজেদের সামাজিক মূল্য খানিকটা বাড়ে বলেই অটোগ্রাফ সংগ্রহের জন্য ভীড়।

আইনস্টাইন অটোগ্রাফ সংগ্রহকারীদের ওপর খুবই বিরক্ত হতেন। ‘ভক্ত’ বলতেই ব্যক্তিগত ভক্তির প্রশ্ন আসে। ব্যক্তিপূজায় বিশ্বাসী ছিলেন না আইনস্টাইন। অটোগ্রাফ সংগ্রহের নামে গায়ের ওপর উঠে পড়াটাকে তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না। খ্যাতিমানরা প্রকাশ্যে আনন্দ প্রকাশ করতে পারেন কিন্তু বিরক্তি প্রকাশ করতে পারেন না। আইনস্টাইন অটোগ্রাফ শিকারিদের হাত থেকে বাঁচার জন্য একটা উপায় বের করলেন। তিনি ঘোষণা দিলেন তাঁর অটোগ্রাফ নিতে হলে পয়সা খরচ করতে হবে। তিনি একটা ফরম ছাপলেন অটোগ্রাফ সংগ্রহকারীদের জন্য। ফরমে অটোগ্রাফ সংগ্রহের নিয়ম বেঁধে দেয়া হলো – কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে চাঁদা দিয়ে চাঁদার রসিদ দেখালে তবেই আইনস্টাইন অটোগ্রাফ দেবেন – নইলে নয়। আমেরিকায় স্থায়ীভাবে চলে যাবার আগ পর্যন্ত এই নিয়ম চালু রেখেছিলেন আইনস্টাইন।

আইনস্টাইনের অটোগ্রাফ ফরম


১৯৩৩ সালে হিটলারের ইহুদি বিদ্বেষের কারণে উদ্বাস্তু হয়ে আমেরিকায় যাবার পর আইনস্টাইন আর কখনো ফিরেননি জার্মানিতে। কয়েক বছর পর আমেরিকার নাগরিকত্ব নিলেও মনে প্রাণে আমেরিকান হয়ে ওঠতে পারেননি আইনস্টাইন। কারো পক্ষেই সম্ভব নয় নিজের জন্মভূমিকে ভুলে গিয়ে পুরোপুরি অন্য দেশের হয়ে যাওয়া। কিন্তু কোন কিছুতেই থেমে যাওয়া আইনস্টাইনের স্বভাববিরুদ্ধ। জীবন সম্পর্কে তাঁর দর্শন ছিলো অত্যন্ত পরিষ্কার। তিনি বলতেন – ‘জীবন হলো সাইকেলে চড়ার মতো – যতক্ষণ চালাতে থাকবে চমৎকার দু’চাকার উপর বসে থাকতে পারবে, থামলেই পড়ে যাবে’।

[আজ ১৪ মার্চ, আইনস্টাইনের জন্মদিন। আজ থেকে ১৩৫ বছর আগে আইনস্টাইন জন্মেছিলেন এই পৃথিবীতে। তাঁর কাজের মাধ্যমে তিনি যে অটোগ্রাফ রেখে গেছেন পৃথিবীর বুকের ওপর তা চির-ভাস্বর হয়ে থাকবে।]