প্রতিটি রাষ্ট্রের নিজস্ব হিরোর প্রয়োজন হয়। তেমনি ৭১-এ আমাদেরও হিরোর প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজনীয়তার তাগিদ থেকে আমরা একজন বিদেশী শাসককে হিরোতে রূপ দিই। হ্যাঁ জনাব, আমি নবাব সিরাজউদ্দৌলা’র কথা-ই বলছি। একজন বিদেশী শাসক হয়ে তিনি আমাদের কাছে হিরো। মজার বিষয় হল নবাব সিরাজদ্দৌলাকে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব বলা হয়! এই বলা হয়টাও সত্য নয়। কারণ তিনি বাংলার স্বাধীন নবাব ছিলেন না। তিনি নিয়মিত দিল্লীর বাদশাহদের কর দিয়ে গদি ঠিক রাখতেন। তিনি বহিরাগত ছিলেন এই সত্যটা জানার পরও আমরা তাকে হিরো হিসেবে উপস্থাপন করি। অনেকে হয়তো ভাবছেন; হিরো নিয়ে এতো কথা বলার কী আছে? রাষ্ট্রের হিরো থাকা আসলেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘মেঘনাদ বধ’ সৃষ্টি করেছেন ভারতীয় অনার্যদের হিরো সৃষ্টি করার প্রয়াসেই। বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে গদি থেকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে ইংরেজরা। এই চিত্র এই বাংলার মানুষের কাছে একটি স্বাভাবিক বিষয় ছিল। কারণ এই দেশের সাধারণ মানুষের নবাবও ছিলেন বিদেশী। আগত মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক সাহিত্য, ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ হয়েছে, মুসলিম কবিরাও বাঙলাভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধী করেছেন তা সত্য কিন্তু এই দেশের মানুষের ভাগ্যের তেমন উন্নতি হয়নি। এর জন্য অবশ্য আগত মুসলিম শাসকদের অর্থনৈতিক জ্ঞানের সীমাবন্ধতাই দায়ী। তাই তো সামন্তবাদী সমাজ থেকে তারাও বের হতে পারেনি।

এই বঙ্গে যখন হিন্দু শাসকদের বর্ণ প্রথা, ধর্মীয় কুসংস্কার ও আগাছায় হিন্দু সভ্যতার গতি রুদ্ধ হয়ে গেল, নিন্মশ্রেণির মানুষগুলোর যখন মনুষ্য বলেও গন্য হতো না বরং ম্লেচ্ছ হিসেবে গন্য হতো তখন মুসলিম শাসকদের আগমনে ও ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলে সমাজের ম্লেচ্ছ’রা মানুষ হিসেবে অন্তত সামাজিক মর্যাদাটুকু পেল। এছাড়াও হিন্দু ধর্মের অনেক আগাছা, কুসংস্কার ধ্বংস হয়ে যায়। এতো কিছুর পরেও এই অঞ্চলের মানুষদের অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটেনি। তবে যারা মুসলিম শাসিত সাত’শ বছরের ইতিহাসকে স্বর্ণযুগ আক্ষায়িত করে মুসলিমদের অবিস্মরণীয় গৌরবের ঢোল পেটান তাদের জন্য বলতে চাই মুসলমানরা অধিকাংশ ছিলো নিন্ম বর্ণের হিন্দু ও বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী। সামাজিক ভাবে তারা ছিল অবহেলিত। তাই নিপীড়িত মানুষগুলোর অর্থনৈতিকভাবে এবং শিক্ষা-সংস্কৃতিতে বিকশিত হওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। তাছাড়া ভারতীয় সভ্যতার চেয়ে উন্নত কোন সভ্যতা মুসলিমরা নিয়ে আসতে পারেনি। বরং ইউরোপীয়ান সভ্যতা থেকে আরবীয় সভ্যতা ছিল অনেক পিছিয়ে। প্রকৃত পক্ষে ইংরেজদের হাতে ছিল ভারতবর্ষ অপেক্ষা উন্নত সভ্যতা। কিন্তু ইংরেজরা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে এই দেশের যা কিছু মহৎ ও উন্নত ছিল সব ধূলিসাৎ করে দেয়। বিখ্যাত মসলিন কাপড় শিল্প ধ্বংস করে দেয়। অথচ ফ্রান্সের পরিব্রাজক ফ্রাঁসোয়া বার্নি তার ভ্রমণ কাহিনিতে উল্লেখ করেন;- এই বাংলা ছিল আশেপাশের সকল দেশের এবং ইউরোপের কাপড়-চোপড়ের বড় আড়ৎ। এই বাংলার কাপড় শুধু ইউরোপে নয় জাপানেও চালান হতো। বাংলার অফুরন্ত সম্পদ শুধু ইংরেজরা লুট করেনি, লুট করেছে আর্যরা, মোঘলরা, মগদস্যুরা, বর্গীরা। তবে ইংরেজদের লুণ্ঠন সব শোষকদের ছাড়িয়ে যায়। ছোট বেলায় একটি ছড়া মনে হয় সবাই শুনেছি-খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাঁজনা দিবে কিসে……এছাড়াও অজস্র লোকসাহিত্যে বিদেশীদের অত্যাচারের বর্ণনা, শোষণের বনর্না ফুটে ওঠে।
এতো কিছুর মধ্যেও কলকাতায় রেনেসাঁসের জন্ম হয়। যদিও বাঙলার রেনেসাঁস নিয়েও অনেকে দ্বিমত পোষণ করে। কারণ বাঙলার নবজাগরণ মূলত কলকাতা কেন্দ্রিক শিক্ষিত এলিট শ্রেণির রেনেসাঁস। কারণ ইউরোপের মতন বাঙলার রেনেসাঁস দরিদ্র মানুষের মুক্তি ঘটাতে পারেনি। তবে যাই হোক এ কথা অস্বীকার করার জো নেই যে; এই বাংলা ছিল ইংরেজ আমলে এবং পাকিস্তান আমলে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত। কলকাতা কেন্দ্রিক জমিদাররা এই বাঙলাকে মূলত উপনিবেশিক অঞ্চল রূপেই দেখত। যদি তাই না হতো, তাহলে এই বাঙলায় শিল্প কারখানা ও বিদ্যালয় গড়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করত। এক্ষেত্রে শুধু হিন্দু জমিদারদের গালাগালি করলেই চলবে না কারণ কলকাতায় বড় হওয়া শিক্ষিত মুসলিম এলিট শ্রেণি এর ব্যতিক্রম ছিল না। যদিও ৯০% জমিদার ছিল হিন্দু। এই অঞ্চলের মানুষদের পিছিয়ে পড়ার আরেকটি কারণ ছিল ধর্মতাত্ত্বিক গোঁড়ামী। শুধু ইংরেজ শাসন আমলে নয় বিশ শতকের দেখা যায় মোল্লরা ফতোয়া দিচ্ছে- বিজ্ঞান ও ইংরেজী পড়লে আল্লাহ গজব পড়বে, জিহ্বায় ঘা হবে। তবে কিছু কিছু মানুষ এই অঞ্চলের শিক্ষার প্রসারে আগ্রহী হয়ে অনেক বিদ্যালয় নির্মান করেন। তবে বিদ্যালয় নির্মান অপেক্ষায় মসজিদ নির্মানেই এই অঞ্চলের মানুষ বেশি আগ্রহী ছিল। নানান জ্বরে আক্রান্ত, অর্থনৈতিক-সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ এই বঙ্গ; পূর্ব বাঙলা থেকে পূর্ব পাকিস্তান নামান্তর হয়ে ৪৭ সালে পাকিস্তানের উপনিবেশিক অঞ্চল হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে। উপনিবেশিক অঞ্চল হওয়ায় পাকিস্তান শাসকদের কাছে এই বাঙলা ছিল চূড়ান্তভাবে উপেক্ষিত। এই বাঙলাকে তারা ব্যবহার করত উৎপাদনের অঞ্চল হিসেবে। ১৯৬৮-৬৯ অর্থবছরে পূর্ব পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ উৎপাদন ছিল ২০,৬৭০ মিলিয়ন রূপী। আর পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ২৭,৭৪৪ মিলিয়ন। সবচেয়ে বেদনাদায়ক বিষয়ক ছিল জাতীয় বাজেটে এই বাঙলা ছিল সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত। অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকেই এই বাঙলার মানুষ স্বাধীনতার স্পৃহায় ৭১-সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। স্বপ্ন ছিল একটাই; এই অঞ্চলকে একটি স্বাধীন ভূ-খণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু হায়! স্বাধীন দেশটি বেশিদূর টলে টলে কিংবা হামাগুড়ি দিয়ে চলতে পারেনি। কয়েক বছরের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে। স্বাধীনতার তিন বছরের মাথায় ৭৪ সালে এর দুর্ভিক্ষে পতিত হয়। তেতাল্লিশের মন্বন্তরে হাজারো মানুষ মারা যায়। তেতাল্লিশের মন্বন্তরে বিদেশী প্রভুদের উদাসীনতা, ব্যবসায়ীদের লভ্যাংশের লোভ, দেশীয় কালো বাজারীদের লুণ্ঠন ছিল দায়ী। অথচ স্বাধীন দেশে আমরা দেখতে পেলাম বিদেশী প্রভু না থাকলেও তাদের উচ্ছিষ্টভোগী দেশীয় দলীয় চাটুকার বাহিনীর প্রভাবে মানুষদের ভাগ্যের কোন উন্নতি হয়নি। স্বাধীনতার ৪২ বছরপরও স্বাধীনদেশে ভিন্নধর্মালম্বীরা অনিরাপত্তায় ভোগে, আদিবাসীরা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দরজায় আহাজারি করে। প্রতিদিন বিচার বর্হিভুত রাষ্ট্রিয় হত্যা চলছে, দেশদ্রোহীরা রাজপথে গণতন্ত্রের চর্চা করছে! সাধারণ মানুষ দেশ থেকে দেশে স্থানান্তরিত হয়েছে, স্বাধীন ও সভ্য রাষ্ট্রের জন্য প্রাণ দিয়েছে অথচ স্বাধীনতার ৪২ বছরেও সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার অধরাই রয়ে গেল।

কিছুদিন আগে বর্তমান সরকারের এক নেতা সাম্প্রদায়িক হামলা প্রসঙ্গে বলেন; আপনাদের ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের পাশের দেশ ভারতেও মুসলিম ভাইয়েরা আছে। টেলিভিশনে এই বক্তব্য শোনার পর মনে হল এটা ২০১৪ সাল নয় হয়তো ১৯৪৬-৪৭ সালের কোন এক মাস। ধর্মীয় আইডেন্টির ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য ধর্ম কোন সমস্যা ছিল না। সমস্যা ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য। হ্যাঁ, অস্বীকার করছি না যে, সাম্প্রদায়িক চর্চা ছিল না। তবে মূল সমস্যা ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্যকে কেন্দ্র করে। সাম্প্রদায়িক সামাজিক চর্চাটার আলোকে পাকিন্তান আর ভারত ভূ-খণ্ডের মানুষেরা একে অপরের জিম্মি হিসেবে কাজ করত। বর্তমান সরকারী নেতার কথাটা কাঁটাছেড়া করলে এই অর্থ দাড়ায়- হিন্দুরা এদেশের নিরাপদ থাকলে ভারতেও মুসলিমরা নিরাপদ থাকবে। তা না হলে ঐ দেশের মুসলিমদের উপরও আঘাত আসতে পারে। ভাবতে কষ্ট হয় একটি সম্প্রদায় এই যুগেও আরেকটি সম্প্রদায়ের জিম্মি হিসেবে কাজ করছে। রাষ্ট্র হিসেবে এ কী আমাদের ব্যর্থতা না? একটা রাষ্ট্র কাঠামো কী আমরা আজো সুস্থভাবে তৈরি করতে পেরেছি? রাষ্ট্র নাগরিককে একচোখা দৈত্যের মতন যখন দেখতে শুরু করে তখন তা আসলেই ভয়ংকর ব্যাপর হয়ে দাঁড়ায়। কার্ল মার্কস বলে গেছেন, “একটি সমাজ কতটা উন্নত, তা বোঝা যায় এর নারীর দিকে তাকালে। আর একটি সমাজ কতটা গণতান্ত্রিক, তা বোঝা যাবে এর সংখ্যালঘুর দিকে দৃষ্টি দিলে। নানা ধরনের সংখ্যালঘু থাকে সমাজে। চিন্তার দিক দিয়ে সংখ্যালঘুরা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু। এক অর্থে এদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।” এই কয়েক মাসে আদিবাসী বসতিতে হামলা, ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িতে হামলা, রাষ্ট্র কর্তৃক নীরব সম্মতিতে বিচার বর্হিভুত হত্যায়, পুলিশ হেফাজতে আসামীর মৃত্যু, সাম্প্রদায়িক হামলা বিচারহীন থাকে তখন একজন সাধারণ নাগরিকের মধ্যে উদ্বিগ্নতা সৃষ্টি করে।

রাষ্ট্র যেখানে জনগণকে আইনের প্রয়োগ ও ব্যবহার শিখাতে উদ্দোগী হবে সেক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে আমাদের রাষ্ট্র উল্টো আইন বর্হিভুত কাজে লিপ্ত হচ্ছে। র‍্যাব-এর ক্রসফায়ারের গল্প শুরু করলেও এই গল্প এখন পুলিশে গিয়ে ঠেকেছে। পুলিশও র‍্যাবের মতন একই গালগল্প জনগণকে শুনিয়ে যাচ্ছে। একটি ভয়ংঙ্কর বিষয় হল ক্রসফায়ার নীতি জনগণ মেনে নিয়েছে। একটু তলিয়ে দেখা যাক জনগণ কেন ক্রসফায়ারে বিশ্বাসী হয়ে উঠছে! এর প্রধান কারণ বিচার ব্যবস্থার অক্ষমতা ও দূর্বলতা। যে কোন ভয়ংকর আসামী যখন আইনের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে বারবার অপরাধ করার সুযোগ পাচ্ছে এবং বিচার কার্যের দীর্ঘ মেয়াদী সময়ের ফলে অপরাধী পুনঃরায় অপরাধ করে যাচ্ছে এর ফলেই কিন্তু ক্রসফায়ার জনগণের মনে বৈধ হিসেবে স্থান করে নেয়। যেহেতু আটক করলেও সাজা হয় না বা মুক্ত পেয়ে যাচ্ছে সেহেতু ক্রসফায়ারে জনগণ সাময়িক স্বস্তি লাভ করছে। তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি ক্রসফায়ায় সুস্থ রাষ্ট্র কর্তৃক কোন সভ্য আচরণ নয়। বরং এভাবে চলতে থাকলে রাষ্ট্রের তৈরি নগ্ন ব্ল্যাকহোলে হয়তো রাষ্ট্রই একদিন তলিয়ে যাবে।

কয়েক হাজার বছর ধরে এই বঙ্গের মানুষেরা নির্যাতন-নিপীড়ন, শোষণ সহ্য করে যে রাষ্ট্র লাভ করছে সেই রাষ্ট্রটি দিনদিন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের পথেই হাঁটিহাঁটি পা-পা করে এগিয়ে যাচ্ছে। জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িক চর্চাকেন্দ্র, রাষ্ট্রিয় দমন-পীড়ন সবকিছু এই দেশের সাধারণ মানুষদের ঘাড়ে চেপে বসেছে। বাকস্বাধীনতার নামে মাঝরাতে বিভিন্ন টিভি সেটে যা হয় তা আরো ভয়ংকর। টক শো তে বাকস্বাধীনতার নামে টকশোজীবীরা বিচার বর্হিভূত হত্যার বৈধতা দিচ্ছে, আন্দোলনের নামে পেট্রোল ও বোমাবাজির বৈধতা দিচ্ছে, বুদ্ধীবিত্তিক চর্চার নামে জঙ্গিবাদের বৈধাত দিচ্ছে! তবে এতো কিছুর পরও আশাবাদী মানুষের কণ্ঠেই বলতে চাই এই বঙ্গের মানুষ হাজারো নিপীড়নে, হাজারো অত্যাচারে শেষ হয়ে যায়নি বরং প্রতিবারই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। হয়তো এই রাষ্ট্রের সু-বুদ্ধি না হলে একদিন জনগণ আবারো ঘুরে দাঁড়াবে আবারো সংগ্রামে লিপ্ত হবে আবারো সৃষ্টি করবে এক মানব সভ্যতা। জন্ম দেবে নতুন ইতিহাস।