এই লেখাটির বড় অংশ অভিজিৎ’দার। সুতরাং কৃতজ্ঞতায় গুরুজি

২১শে ফেব্রুয়ারি। আমাদের আবেগের দিন, আমাদের গর্বের দিন। এদিন আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি সালাম, রফিক, বরকত সহ সকল শহীদের আত্মত্যাগকে। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি আবদুল মতিন, গাজীউল হক, কাজী গোলাম মাহবুব, কামাল লোহানী প্রমুখ ভাষা সৈনিকদের অবদানকে। আমাদের হৃদয়ের অর্ঘ্য দিয়ে বরণ করি, পুষ্পমন্ডিত করে তুলি আমাদের প্রাণপ্রিয় শহীদ মিনারকে। কিন্তু এমন দিন এলেই আপনি যদি শোনেন এক কুখ্যাত রাজাকার, যার একাত্তরে কৃতকর্মের জন্য, তার মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য নব্বই বছরের সাজা দিয়েছে মাননীয় আদালত, এমন একজন লোক ‘ভাষা সৈনিক’ সাজতে চাইছে, কেমন লাগবে শুনতে?

সেটাই কিন্তু করা হচ্ছে। এ প্রচারণা শুরু হয়েছিল সম্ভবত নব্বইয়ের দশকে। হঠাৎ করেই দেখা গেলো কিছু নামগোত্রহীন পত্রিকায় আসতে শুরু করল ‘ভাষা সৈনিক’ হিসেবে গোলাম আযমের নাম। ঢাকার দেওয়াল টেওয়ালেও জামাত শিবিরের কিছু শ্লোগান দেখা যেতে শুরু করল–‘ভাষাসৈনিক গোলাম আযম’। প্রথম দিকে কেউ তেমন গা করেনি। কিন্তু পরে যত দিন গেছে ততই গোয়েবলসীয় কায়দায় জাঁকিয়ে বসেছে এই প্রচারণা। একটা উদাহরণ দেয়া যাক :

“…ভাষা আন্দোলননিয়ে আজ যারা বড় বড় কথা বলছেন, তাঁদের মনে রাখা উচিত ভাষা আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন আবুল কাশেম ও অধ্যাপক গোলাম আযম।। প্রতাপশালী প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর সামনে সাহস করে বাংলাকে রাষ্ট্র করার দাবিতে স্মারকলিপি পেশ করেছিলেন গোলাম আযম । অথচ, ইতিহাস থেকে পরবর্তীতে তার নামটি মুছে ফেলাহয়েছে। দেশের বুদ্ধিজীবীরা তো অন্তত বলতে পারেন“লোকটা খারাপ, তবে এ ভাল কাজটা ভালো করেছে (ভাষা আন্দোলন)।গোলাম আযমকে গালি দিয়ে হলেও তো তারা কথাটি বলতে পারেন। অথচ, আজ ইতিহাস বিকৃত করে নতুন নতুন ভাষা সৈনিক সৃষ্টি করা হচ্ছে…”(জনকণ্ঠ ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১১)

কথা গুলো বলছিলেন জামায়াতের আমীর মকবুল আহমাদ, জামায়াত আয়োজিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের এক আলোচনা ও দোয়া মাহফিলে। জামাতের আমীরের এই বক্তব্য ছাড়াও প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে সারা শহর ছেয়ে যায় নিচের পোস্টারের মত ভয়ঙ্কর পোষ্টারে।

এছাড়াও দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার বিভিন্ন লেখায় অহরহ গোলাম আযম কে ভাষা সৈনিক দাবী করা হয়। তারই একটি উদাহরণ,

গোলাম আজমের নিজস্ব ওয়েবসাইটেও তাকে ভাষা সৈনিক দাবী করা হয়েছে বলিষ্ঠ কণ্ঠে,

এছাড়াও জামাআতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের ওয়েবেও পাওয়া গেলো একই উচ্চারণ,

১৯৭১ সালে জামাআতে ইসলামী’র আমীর এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড গোলাম আযমকে নিয়ে বরাবরই বিভিন্ন প্রোপ্যাগান্ডা শোনা যায় তার সমর্থকগোষ্ঠীর মুখে। এর মধ্যে সবচেয়ে রসালো প্রচারণাটি হচ্ছে গোলামআযমকে ভাষা সৈনিক প্রমাণ করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। ফেব্রুয়ারি এলেই এই ইস্যু নিয়ে শুরু হয় নানা রকম রকমারি বাণিজ্য। আমাদের এই লেখার উদ্দেশ্য থাকবে সমস্ত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে খতিয়ে দেখা দাবীটির সত্যতা কতটুকু, এবং এই বিষয় নিয়ে সমস্ত বিভ্রান্তি দূর করার বস্তুনিষ্ঠ প্রয়াস।

প্রথমে উপরে দেয়া ছবিগুলোর দিকে তাকানো যাক। উপরের ছবি গুলো থেকে একটা কথা তো পরিষ্কার যে জামাত-শিবির এবং তাদের ঘরনার মিডিয়া গুলো প্রকাশ্যে প্রচার করে আসছে গোলাম আযম ভাষা সৈনিক। এখন দেখা যাক ভাষা আন্দোলনে গোলাম আযম কি কি অবদান রেখেছেন বলে দাবী করা হচ্ছে।

প্রথমেই আমরা দেখি গোলাম আযমের নিজের জবানী। তার আত্মজীবনী “জীবনে যা দেখলাম” বইটি ঘেঁটে পাওয়া গেলো ভাষা আন্দোলনে তার অবদান নিয়ে বিশাল এক ফিরিস্তি। তিন খণ্ডের বইটির প্রথম খন্ডের একাধিক অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে ভাষা আন্দোলন সম্বন্ধে।

বিস্তারিত পড়ে জানা গেলো ১৯৪৮ সালের ২৭ নভেম্বর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এক সমাবেশে ভাষণ দেন। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা একটি মানপত্র পাঠ করে। ঐ মানপত্রে বাংলা ভাষা নিয়েও কিছু দাবী জানানো হয়। এ মানপত্রটি পাঠ করেন ইউনিয়নের তৎকালীন সেক্রেটারি গোলাম আযম। যদিও এটি পাঠ করার কথা ছিল ছাত্র ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট অরবিন্দ বোসের। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে ভাষা আন্দোলনের দাবি সংবলিত মানপত্র পাঠ একজন হিন্দু ছাত্রকে দিয়ে করালে তার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে এবং মুসলিম লীগ সরকার এ নিয়ে নানা প্রকার বিরূপ প্রচার শুরু করবে¬ এ আশংকা থেকেই একজন মুসলমান ছাত্র হিসেবে সেক্রেটারি গোলাম আযমকে সেটা পাঠ করতে দেয়া হয়েছিল।

এ প্রসঙ্গে অগ্রগণ্য ভাষা সৈনিক কামাল লোহানী বলেন,

‘গোলাম আযম ভাষা সৈনিক ছিলেন না। কখনই ছিলেন না। স্বাধীনতা বিরোধীরা তাকে ওটা বানাতে চেয়েছে। এই অপপ্রচারের একটি লাগসই জবাব ভাষা মতীন ভাই দিয়েছেন এভাবে। গোলাম আজমের পিঠে চড়ে আমার তখন ভাষার দাবির পোষ্টার দেয়ালে লাগিয়েছি।
আসল ঘটনা হলো গোলাম আজম তখন ডাকসুর জিএস ছিলেন। অরবিন্দ নামে একজন ভিপি। ঢাকায় আসবেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। ডাকসু থেকে বাংলা ভাষার দাবিতে তাকে একটা স্মারকলিপি দেওয়া হবে। কৌশলগত কারণে অরবিন্দকে বাদ দিয়ে গোলাম আজমকে দিয়ে স্মারকলিপিটি লিয়াকত আলী খানকে দেওয়া হয়েছিলো। এটুকুই তার ইতিহাস। তারপর আর গোলাম আজম ভাষার লড়াইয়ের ইতিহাসে নেই’।

অথচ, গোলাম আযম তার বইয়ে লিখেছেন,


(পাঠক লাল কালিতে আন্ডারলাইন করা জায়গা গুলোর কথা খেয়াল রাখবেন, আমরা পরবর্তীতে এ নিয়ে আলোচনা করবো।)

এর পর বইটিতে গোলাম আযমের মেমোরেন্ডাম পড়ে শোনানোর রগরগে বিবরণ…

এবার আপনাদের কাছে তুলে ধরছি সেই ঐতিহাসিক (!) মানপত্রের মূল কপিটির ভাষা সংক্রান্ত অংশ,

…… We are happy to note that out Central Government, under your wise guidance, has given Bengali an honoured place. This is a step in the right direction which shall go a long way to further strengthen our cultural ties, with our brethren in West Pakistan. Interchange of thoughts and ideas and mutual understanding are essential if we have to develop a homogeneous and healthy national outlook. We have accepted Urdu as our Lingua Franca but we also feel very strongly that, Bengali by virtue of its being the official language of the premier province and also the language of the 62% of the population of the state should be given its rightful place as one of the state languages together with Urdu….

পাঠক লক্ষ্য করবেন এখানে কোন বলিষ্ঠ দাবী রাখা হয়নি বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য। কোন রকমে দায়সারা ভাবে বাংলার কথা এসেছে। উর্দুকে আন্তর্জাতিক ভাষার মাধ্যম হিসেবে (Lingua Franca) মেনে নেয়ার কথা এসেছে, আবার একথাও বলা হয়েছে ‘প্রধানমন্ত্রী’ নাকি বাংলাকে সম্মানজনক অবস্থান দিয়েছেন অথচ বাংলাকে ওই মানপত্রে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিই জানানো হয়নি। কেবল করা হয়েছিল প্রাদেশিক সরকারি কাজকর্মের ভাষা করার। আর তাই প্রধানমন্ত্রী নিজের বক্তব্যে বিষয়টি নিয়ে কিছুই বলেননি (তার স্ত্রীর অনুরোধ সত্ত্বেও)। গোলাম আযমের ভাষায়,

পাঠক লক্ষ্য করবেন, গোলাম আযম এমনি বক্তব্য দিয়েছিলেন যে প্রধানমন্ত্রী তার সব দাবিদাওয়া সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করলেন। তার বক্তব্য শুনে খুশীতে টেবিল চাপড়ে দিলেন আর ভাষার ব্যাপারে কিছুই বললেন না !!!

এবার আসুন একটু বিশ্লেষণী দৃষ্টি নিয়ে দেখি কয়েকটি পয়েন্ট, গোলাম আযম তার একই আত্ম জীবনীতে অনেকবার বাংলা ভাষা নিয়ে আক্রমণাত্মক, বিদ্রুপাত্মক এবং প্রচণ্ড বিদ্বেষ মূলক মন্তব্য করেছে। নিচে তার থেকে অল্প কয়েকটি উল্লেখ করাহলো,

বাংলা ভাষায় আপনি, তুই, তুমি এসবের জন্য আলাদা আলাদা শব্দ ব্যাপারটা গোলাম আযমের পছন্দ হয়নি;তিনি এটাকে চিহ্নিত করেছেন ‘বিরাট সমস্যা’ হিসেবে –

মজার ব্যাপার হচ্ছে, নিজেকে ভাষা সৈনিক দাবী করলেও আপন নাতী-নাতনীদের কিন্তু তিনি বাংলা শিক্ষা দেননি; অবশ্য এ নিয়ে কিছুটা ‘মেকি আপসোস’ও আছে তার –

বিভিন্ন খ্যাতিমান বাংলাভাষী সাহিত্যিকদের প্রতি তিনি ছড়িয়েছেন চরম বিদ্বেষ; বঙ্কিমচন্দ্রকে নিজের বইয়ে‘ইসলাম বিদ্বেষী’হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও তার অনেক জ্বালা। রবীন্দ্রনাথ নাকি ‘মুসলিম স্বার্থের বিরুদ্ধে’ ছিলেন, রবীন্দ্রনাথ নাকি ছিলেন স্রেফ ‘পৌত্তলিক হিন্দু’ইত্যাদি; তাই ‘বাঙালি জাতীয়তায়’ বিশ্বাসীদের কাছে রবীন্দ্রনাথ গ্রহণযোগ্য হলেও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদীদের কাছে তিনি হবেন সর্বদাই পরিত্যাজ্য:

বাংলা এবং বাঙালি জাতি নিয়ে বিদ্বেষ তার পরবর্তীকালের অনেক উক্তিতেই পাওয়া যাবে। যেমন ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসে তিনি বলেছিলেন, ‘জয় বাংলা শ্লোগান ইসলাম ও পাকিস্তানবিরোধী’। তিনি সেসময় আরো বলেছিলেন, ‘বাঙালিরা কখনো জাতি ছিল না’ (দৈনিক পাকিস্তান, ১৩ই এপ্রিল, ১৯৭০)। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এই যার বাংলা ভাষা আর বাঙালি জাতির প্রতি এতো প্রেমের নমুনা,তিনি কেনইবা প্রধানমন্ত্রীর সামনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা দাবী করলেন।

আমাদের বুঝতে হবে সেদিনের ঘটনাপ্রবাহ। তিনি নিজেই বলেছেন তিনি সে সময়ের অনির্বাচিত জি এস ছিলেন, এবং মানপত্রটা পড়ার বিষয়টি ছিলো একটা আকস্মিকঘটনা মাত্র। এমনকি, তিনি সেই মানপত্র নিজে লিখেননি, লিখেছিলেন তৎকালীন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভিপি আবদুর রহমান চৌধুরী তারপর একটি কমিটি স্মারকলিপিটি চূড়ান্ত করে। সেদিন সেইদিন স্মারকলিপি পাঠ করা ছাড়া তার কাছে আর কোন রাস্তা ছিলো না। যদি সেদিন তিনিস্মারকলিপি পাঠ করা থেকে বিরত থাকতেন, কিংবা অনাগ্রহী হতেন তাহলে সাধারণ ছাত্রদের হাত থেকে তাকে কেউ রক্ষা করতে পারতো না। কারণ ছাত্ররা তৎকালীন শাসক গোষ্ঠীর ওপর মারাত্মক বিরক্ত ছিলো। প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার, সেই বছরের মার্চেই কায়েদে আজম কার্জনে যখন বলে ওঠেন “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা” তখনই সেখানকার ছাত্ররা “না না” বলে প্রতিবাদ করে ওঠে। ধীরে ধীরে এটা হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণের দাবী। কাজেই ছাত্রদের জনপ্রিয় দাবী অস্বীকার করা কিংবা এড়িয়ে যাবার মতো সাহস বা সুযোগ কোনটাই গোলাম আযমের সেদিন ছিল না।

আর তাই ছাত্র প্রতিনিধি হয়ে গোলাম আযম যতটা সম্ভব বাধ্য হয়েই ‘যথেষ্ট নম্র ভাষায়’এই দাবী প্রকাশ করেছিলেন, যদিও উর্দুকেই মনে প্রাণেরাষ্ট্র ভাষা মনে করতেন গোলাম আযম। তিনি ভাষা সৈনিক মোটেই নন। সে সময়কার ঘটনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আব্দুল গাফফার চৌধুরী তার একটি সাম্প্রতিক কলামে বলেছেন –

‘১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার আগে পর্যন্ত ১৫ মার্চ ছিল ভাষা আন্দোলন দিবস। এই আন্দোলনে কাজী গোলাম মাহবুব, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ সকলকেই গ্রেফতার বরণ করতে হয়েছে। আবদুল মতিনকে হুলিয়া মাথায় করে আন্ডারগ্রাউন্ডেও পালিয়ে থাকতে হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের ভাষার দাবির স্মারকলিপি নিয়ে গিয়েছিলেন সলিমুল্লাহ হলের ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন ভিপি আবদুর রহমান চৌধুরী (পরে বিচারপতি হয়েছিলেন)। তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের এই প্রথম পর্যায়েও গোলাম আযমকে কোথাও দেখা যায়নি। তাকে গ্রেফতার হতে হয়নি। ভাষা আন্দোলনকারীদের সচিবালয় ঘেরাও বা রাজপথের মিছিলেও গোলাম আযমকে দেখা যায়নি। ১৫ মার্চের ভাষা দিবস উদযাপনের কোনো বছরের সভায় তাকে দেখা যায়নি। ভাষাসংগ্রাম কমিটিতেও (কেন্দ্রীয় অথবা ছাত্র কমিটি) তার নাম দেখা যায় না। একুশে ফেব্রুয়ারিতে আরোপিত ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য ভাষা আন্দোলন -সংযুক্ত প্রবীণ ও নবীন নেতাদের কোনো গোপন ও প্রকাশ্য সভাতেই তাকে অংশ নিতে দেখা যায়নি। তাহলে তিনি ভাষাসৈনিক হলেন কীভাবে? কেবল ১৯৪৮ সালে লিয়াকত আলীর ঢাকা সফরের সময় এক্সিডেন্টলি একটি মানপত্র পাঠ দ্বারা ভাষাসংগ্রামী, ভাষাসৈনিক হয়ে গেলেন? ইতিহাস বিকৃতি এবং মিথ্যা দাবি করারও একটা সীমা থাকা দরকার’।

এখন উপরের আলোচনা থেকে তাহলে আমরা কিছু সিদ্ধান্তে আসার মতো জায়গায় পৌঁছুতে পারছি এখন –

১) প্রধানমন্ত্রীর সামনে পাঠ করা মনপত্রটি গোলাম আযম নিজের হাতে লেখেন নি।
২) তার ভাষায়, এই মানপত্র পাঠ করা ছিলো একটা আকস্মিক ব্যাপার এবং স্বাভাবিক অবস্থায় এই মানপত্র তার নিজের পড়ার কথা না, এটা তিনি একটা বিশেষ “সিচুয়েশনে” পড়েছিলেন মাত্র।
৩) মানপত্রটি পাঠ করার কথা ছিলো ছাত্র ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট অরবিন্দ বোসের।
৪) তার আগেই (মার্চেই) জিন্নার সামনে ছাত্ররা ভাষার দাবীতে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জানায়।
৫) গোলাম আযম ভাষার প্রশ্নে যথেষ্ট গুরুত্ব দেননি, ফলে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পান।
৬)বাংলাকে ওই মানপত্রে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়নি। দাবী করা হয়েছিল প্রাদেশিক সরকারি কাজকর্মের ভাষা করার।

সব শেষে আমরা দেখবো ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়গুলোতে গোলাম আযমের ভূমিকা।

১৯৭০ সালের ২০ জুন একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়‘দৈনিকআজাদ’পত্রিকার পঞ্চম পৃষ্ঠায়।

“বাংলা ভাষার আন্দোলন করা ভুল হইয়াছে”শিরোনামের সেই লেখায়গোলাম আযমের বক্তব্য প্রকাশিতহয়। সেই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়,
“বাংলা ভাষা আন্দোলন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিকোণ থেকে মোটেই সঠিক কাজ হয়নি।”
(দৈনিক আজাদ, ২০ জুন, ১৯৭০)

এখানেই শেষ নয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর প্রথম দিকেই আমাদের শহীদ মিনারটি গুঁড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সেটিকে স্বাগত জানিয়েছিলেন আমাদের ‘ভাষা সৈনিক’ গোলাম আযম। তার বরাত দিয়ে মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রাম খবর প্রকাশ করে ১৬ জুলাই,

“ইতিহাস কথা বলে”সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল : আইয়ুব খানের গভর্নর আজম খান ছাত্রদের খুশী করার জন্য যে শহীদ মিনার তৈরি করলেন তাকে পূজামণ্ডপ বলা যেতে পারে কিন্তু মিনার কিছুতেই না। যাহোক সেনাবাহিনী সেই কুখ্যাত মিনারটি ধ্বংস করে সেখানে মসজিদ গড়ে শহীদদের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শনের চেষ্টা করেছেন জেনে দেশবাসী খুশী হয়েছে।
(দৈনিক সংগ্রাম ১৬ জুলাই, ১৯৭১)

কাজেই গোলাম আযম কোনক্রমেই ভাষা সৈনিক নন। এটা যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমকে মহিমান্বিত করার জামাতি অপকৌশলমাত্র।

সুত্রঃ
১) http://ghulamazam.info/
২) http://www.amarblog.com/eskimo/posts/10365
৩) http://www.shodalap.org/zia1307/8854/
৪) http://blog.priyo.com/abdul-gaffar-chowdhury/2012/03/10/13094.html
৫) http://www.somewhereinblog.net/blog/heslaseba/29778227
৬) http://www.mediafire.com/download/9xk9on4csi53095/jibone+ja+dekhlam.zip