না, ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের খারাপ দিক গুলো কি কি,তা কিভাবে আমাদের মনস্তাত্তিক জটিলতা তৈরিতে ভূমিকা রাখছে সেরকম গতানুগতিক আলোচনায় যাওয়ার জন্য এই লেখাটা লিখছি না। এখানে ব্যাপারটিকে একটু অন্য আঙ্গিকে উপস্থাপন করতে চাই। তার আগে একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করে নিই। গত জুনে কেওকেরাডং গিয়েছিলাম। কেওকারাডং যাবার পথেই পড়ে দার্জিলিং পাড়া। দার্জিলিং পাড়ায় একটা দোকানে বসে চা বিস্কুট খেলাম। দোকানে টিভি চলছিল এবং যে চ্যানেলটি চলছিল সেটি হচ্ছে জি বাংলা। শুধু দার্জিলিং পাড়াই নয়, এর আগে বগা লেকে এক রাত থেকেছিলাম,সেখানেও দেখেছি স্থানীয়দের মাঝে জি বাংলা আর স্টার জলসা দেখার সমাহার। দার্জিলিং পাড়া থেকে এবার চলে আসি আমার নিজের ঘরের ড্রয়িং রুমে। সন্ধ্যার পর থেকে মা আর কাজের মেয়েটা একসাথে দেখা শুরু করে জি বাংলা আর স্টার জলসার সিরিয়াল। সারাদিন কাজের মেয়েটার উপর মা খিটখিট করলেও সন্ধ্যার পর এই এক জিনিসে তাদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই!


কোন সন্দেহ নেই ভারতীয় সিরিয়ালগুলো আমাদের বেডরুম ড্রয়িং রুমের প্রায় অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছে এবং দিন দিন এর বিস্তার বাড়ছে। শহুরে শিক্ষিত সমাজের অন্দরমহল থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাটবাজারের টিভিতে-সবখানেই জি বাংলা আর স্টার জলসার বিস্তৃতি। এবারে ব্যাপারটার একটু গভীরে প্রবেশ করি। প্রথম কথা হচ্ছে, বিশ্বায়নের এই যুগে শুধুমাত্র ‘দেশপ্রেম’, ‘আবেগ’, ‘ঔচিত্য-অনৌচিত্য’ এইসবের মধ্যে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। সিরিয়ালগুলোর সেটাপ-গেটাপ আমাদের সংস্কৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, ওগুলো খারাপ, আমাদের উচিত নিজেদের চ্যানেল বেশি করে দেখা-এই ধরণের গালভরা আবেগী কথা বলে সেমিনারের কক্ষ গরম করা যেতে পারে কিন্তু সত্যিকারের সমাধানে পৌছাতে গেলে আমাদেরকে দর্শকদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে হবে। প্রথমত, এটা মেনে নিতে হবে যে, প্রযুক্তি সহজলভ্যতার এই যুগে মানুষ সেটাই দেখবে যেটা তার ডিমান্ড পূর্ণ করছে। দেশি চ্যানেলগুলো যদি মানুষের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয় তাহলে শুধুমাত্র ‘দেশি পণ্য কিনে হও ধন্য’ এই শ্লোগানে উদ্বুদ্ধ করে মানুষকে ধরে রাখা যাবে না। রিমোটের বাটন টিপে সে বিদেশি চ্যানেলের দিকে ঝুকবেই। ২য়ত, এটা স্বীকার করে নিতে হবে যে আমাদের দেশি চ্যানেলগুলো দর্শক ধরে রাখতে পুরোপুরি ব্যর্থ। আগে সেই ব্যর্থতার ময়না তদন্ত করতে হবে এবং তারপর সমাধানের পথ খুজতে হবে। একটা কথা মনে রাখা দরকার, এখানে অর্থনৈতিক বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মীরাক্কেলের লাস্ট সিজনের স্পন্সর ছিল বাংলাদেশি কোম্পানি প্রাণ। মানে এখানে দেশের পুজি বাইরে চলে যাওয়ার একটা ব্যাপার আছে। প্রাণ যদিও এখন ভারতে প্রোডাক্ত রপ্তানি করে,সে হিসাবে ওখানকার প্রোগ্রামে স্পন্সর করাটা ব্যবসায়িক দিক থেকে প্রয়োজনীয়, কিন্তু দেশে যেভাবে এখন ভারতীয় চ্যানেলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো দেখা যাবে এদেশের প্রোডাক্ট এদেশের মানুষের কাছে এডভার্টাইজিং করার জন্যই ইন্ডিয়ান চ্যানেলগুলোতে এদেশের কোম্পানিকে ব্র্যান্ডিং করতে হবে। আশঙ্কাটি এই মুহুর্তে খুব অবাস্তব শোনালেও আমার কাছে মনে হয় অদূর ভবিষ্যতে এরকম ঘটার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। আর এই মুহুর্তে বিশ্বে অর্থনৈতিক আগ্রাসানের Pre-phase হিসাবে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনটি অত্যন্ত কার্যকর একটি পদক্ষেপ। যেকোন দেশের বাজার দখল করতে চাইলে আগে সেদেশের ভোক্তাদের মনস্তত্ত্ব দখল করাটা অত্যন্ত জরুরী। আর মনস্তত্ত্ব দখলের জন্য টিভি প্রোগ্রাম বেশ ফলদায়ক ভূমিকা পালন করে। যে দেশের চ্যানেলের অনুষ্ঠান মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে স্বাভাবিকভাবেই সে দেশের পণ্যের একধরণের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়, দর্শকদের মনে একটা স্থান তৈরি করা সম্ভব হয়। ফলে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় এক ধরণের এডভান্টেজ পাওয়া যায়। কলকাতার টিভি চ্যানেলগুলোর গানের অনুষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন সময়ে আমাদের রুনা লায়লা, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে বিচারক/অতিথি হিসেবে আনা হয়। মীরাক্কেলে বাংলাদেশ থেকে প্রতিযোগী নেয়া হয়। এর কারণ এপার-বাংলা ওপার বাংলা মৈত্রী স্থাপন-এরকম কোন মহৎ উদ্দেশ্য না। এর প্রধান কারণ মূলত এদেশের মানুষের মাঝে অনুষ্ঠানের আকর্ষণ বৃদ্ধি করা এবং স্থায়ী আসন গড়ে নেয়া। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। এই স্ট্র্যাটেজি সারা বিশ্বেই এখন খুবই কমন। এখন আমরা এই স্ট্র্যাটেজির শিকার হব নাকি অন্যকে শিকারে পরিণত করবো সেটাই নির্ধারণ করবে ফলাফল। কথাগুলো শুনতে খুব নির্মম শোনালেও আজকের এই বিশ্বে survival of the fittest-ই আসলে শেষ কথা। Sad but true. কাজেই ভারতীয় চ্যানেলগুলোর আমাদের দেশের জনসাধারণের মাঝে অত্যধিক জনপ্রিয় হওয়ার একটি অর্থনৈতিক কনসিকুয়েন্স আছে, যা আমাদের দেশের জন্য অবশ্যই নেতিবাচক। আর অর্থনৈতিক দিক ছাড়াও সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও অন্যান্য ব্যাপারগুলো তো আছেই। নিত্য আলোচনায় চর্বিত চর্বন বলে এগুলো নিয়ে আর কথা বাড়াচ্ছি না।


এবার আসি মূল আলোচনায়। আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোর ব্যর্থতার কথা বলছিলাম। ৮০-র দশকে আমাদের টিভি চ্যানেল বলতে ছিল শুধু বিটিভি। এই বিটিভির জনপ্রিয়তা শুধু এপার বাংলাতেই ছিল না, ওপার বাংলাতেও ছিল। দেখা গেল পশ্চিল বাংলায় দুরদর্শনের চেয়ে বিটিভির জনপ্রিয়তা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ওখানকার রাজ্য সরকার এখানকার চ্যানেলগুলো বন্ধ করে দিল সেখানে যা এখন পর্যন্ত বলবৎ আছে। আর এই আমরা কিনা এখন বিটিভি ছাড়াও গোটা পঁচিশেক টিভি চ্যানেল থাকা সত্ত্বেও কলকাতার চ্যানেলগুলোর দিকে ঝুকে পড়েছি। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে সে সময়ে বিটিভিতে সীমতি সামর্থের মধ্যেও যে ধরণের মানসম্মত ও আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান হত, এখন সেটি হচ্ছে না। দেশের চ্যানেলগুলোতে এই মুহুর্তে কোন ভাল রিয়েলিটি শো হচ্ছে না। সংগীত, নৃত্য কিংবা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান-সাম্প্রতিক সময়ে এই শাখাগুলোতে তুমুল জনপ্রিয় কোন অনুষ্ঠান তৈরি হয় নি যা দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করতে পারে। আমাদের সবেধন নীলমণি ছিল নাটক। কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবারের মত নাটকগুলো এক সময়ে যে রকমের আলোড়ন তৈরি করেছিল সেরকম নাটকও এখন তৈরি হচ্ছে না। বরং সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের টিভি নাটকগুলো এক ধরণের লুপের মধ্যে পড়ে গেছে যা শুধুমাত্র একটি বিশেষ সোসাইটিকে প্রতিনিধিত্ব করছে। ৮০-র দশকের নাটকগুলোর একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল সেগুলো জীবনমুখী ছিল,তার চেয়েও বড় কথা, সার্বজনীন ছিল। ফলে সাধারণভাবে সকলের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এখনকার অধিকাংশ নাটকের মধ্যে কোন কমিটমেন্ট নেই। কমিটমেন্ট যে থাকতেই হবে এমন কোন কথা নেই,কিন্তু নাটকের মধ্যে যদি সার্বজনীনতা না থাকে, আরও স্পেসিফিকালি বললে যদি নাটকের গন্ডী শুধুমাত্র একটি জেনারেশনের খুবই ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয় তাহলে সেটির পক্ষে সাধারণ গ্রহণযোগ্যতা/জনপ্রিয়তা অর্জন করা খুব মুশকিল। আমি বলছি না যে ভাল নাটক তৈরি হচ্ছেই না। হচ্ছে। কিন্তু প্রথমত, সেগুলোর সংখ্যা বেশ কম। ২য়ত, আমাদের চ্যানেলগুলোর বিজ্ঞাপন প্রচারনীতি অত্যন্ত কদর্য। ৩০ মিনিটের নাটক দেখার জন্য যদি সাকুল্যে ৯০ মিনিট টিভির সামনে বসে থাকতে হয় তাহলে সেটি যত মানসম্মত প্রোডাকশই হোক না কেন, সেটা দেখার ধৈর্য ধরে রাখা মুশকিল। আমি নিজে ছোটবেলায় ঈদের নাটক দেখার জন্য চাতক পাখির মত বসে থাকতাম। কিন্তু এখন আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও দেখা হয় না। ১ নম্বর কারণ হচ্ছে, আগের মত বুদ্ধিবৃত্তিক হাসির নাটক এখন খুব কম হচ্ছে। অধিকাংশই গতানুগতিক ধারার কনটেন্ট সংকটে ভরা। আর ২য় কারণ হচ্ছে, যদিও বা কোন নাটক ভাল লাগে, কিন্তু ৩০ মিনিটের কনটেন্ট দেখার জন্য বিজ্ঞাপন-খবর মিলিয়ে দেড় ঘন্টা বসে থাকার ধৈর্য থাকে না। এই দিক থেকে বিবেচনা করলে ইন্ডিয়ান চ্যানেলগুলোর বিজ্ঞাপন প্রচার অত্যন্ত দক্ষভাবে পরিচালিত হয়। অত্যন্ত আমার কাছে তাই মনে হয়। ৩০ মিনিটের সিরিয়ালে নির্দিষ্ট বিরতিতে তিন বার নির্দিষ্ট সময় ধরে বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। এবং অনুষ্ঠান-বিজ্ঞাপনের একটা অপটিমাম মিশ্রণ তৈরি করতে তারা সক্ষম হয়েছে। ফলে দর্শক ধরে রাখতে তারা সক্ষম হচ্ছে। আর বিনোদন জগতে দর্শক ধরে রাখাই হচ্ছে শেষ কথা। একটা বিষয় মনে রাখা জরুরী, ভারতের বিশাল জনগোষ্ঠীই কিন্তু ভারতের অন্যতম শক্তি। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে অভ্যন্তরীণ বাজার রয়েছে সেটিই ভারতের অর্থনীতির একটি বড় চালিকা শক্তি। কথাটা আমাদের দেশেও প্রযোজ্য হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের দেশের এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে আমরা দেশি চ্যানেলের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারছি না। এর পেছন সৃজনশীলতার অভাব এবং দর্শকদের চাহিদা অনুধাবনে ব্যর্থতা প্রধান কারণ বলে মনে করি।

অনেকে এরকম দাবি করেন যে, যেহেতু ভারতে এখন বাংলাদেশি চ্যানেলগুলো দেখানো হয় না, সেহেতু আমাদের দেশেও ওদের চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া উচিত। পাল্টাপাল্টির বিচারে দাবিতা সমর্থনযোগ্য, কিন্তু বাস্তবায়ন করা এতো সহজ নয়। আমরা মুখে,ফেসবুকে যতই ভারত বিরোধিতা করি, আসল কথা হচ্ছে, হিন্দি সিনেমা, কলকাতার সিরিয়াল আমাদের দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয়। ভারতীয় গরুর যথেষ্ট যোগান না হলে কোরবানির ঈদে হাহাকার লেগে যায়, ঈদে ভারতীয় ফ্যাশনের মাসাককালি কিংবা মুন্নী বদনাম তুমুল ব্যবসাসফল হয়, হার্টের যে চিকিৎসা বাংলাদেশে করানো সম্ভব টাকা থাকলে মানুষ সেটা মাদ্রাজে গিয়ে করায়। এটা হচ্ছে অপ্রিয় বাস্তবতা। ভারতের আগ্রাসন নীতি, সীমান্তে অনাচার এগুলো নিয়ে আমাদের সোচ্চার হওয়া শুধুমাত্র ফেসবুক আর বয়ানে বিদ্যমান, বাস্তবে ভারতীয় অনুষ্ঠান ও ভারতীয় পণ্য এদেশের মানুষের মাঝে জনপ্রিয়। কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও বাস্তবতা অন্তত তাই বলে। গত বিএনপি সরকারের আমলে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী তরিকুল ইসলাম কিছু ভারতীয় চ্যানেল বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরে নানা চাপে সেটা করা সম্ভব হয়নি। শাহরুখ খান বাংলাদেশে এসে ১৩ কোটি টাকার শো করে চলে গেল। দেশের জনসাধারণের মাঝে ভারতীয় টিভি অনুষ্ঠান/সিনেমার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে এমনটা হত না। আর এখনকার দিনে ঢাকা শহরের বিয়ের অনুষ্ঠানে হিন্দি গান চলছে না এমনটা পাওয়া মুশকিল। হলুদ কিংবা মেহেদির অনুষ্ঠানগুলো অনেকটা হিন্দি সিনেমার আদলে হচ্ছে এখন। এরকম বাস্তবতায় হঠাৎ করে ইন্ডিয়ান চ্যানেল বন্ধ করা আদৌ সম্ভব কিনা সেটা ভেবে দেখবার বিষয় বৈকি।


বুয়েট ডিবেটিং ক্লাবের বার্ষিক প্রকাশনা বৈদুর্যতে সাংবাদিক ও সাবেক বিতার্কিক মাসকাওয়াথ আহসান ‘হিন্দি ভাষার উপনিবেশ’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলেন। লেখাটির কিছু অংশ এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক। উনি লিখেছেনঃ

“এ অবস্থায় হিন্দি মিডিয়ার আগ্রাসন প্রতিরোধে র‌্যালী করে খুব লাভ হবেনা। বাংলাদেশের ফিল্ম-টেলিফিল্ম নির্মাতা্রা এক রকম অগ্নিপরীক্ষার সময় কাটাচ্ছে। এবার আর রক্ত দিয়ে লাভ হবেনা, কারণ লড়াইটা বাংলা বনাম হিন্দি মিডিয়া, পেশাদারী পর্যায়ের প্রতিযোগিতা। গ্রাফিক্স থেকে শুরু করে কনটেন্ট সব জায়গায় ফলাফল টিভি স্ক্রীণে। দুর্বলতা লুকানোর কোন সুযোগ নাই।

দর্শক এখানে উপায়হীন, ভালো না লাগলে অযথা সময় নষ্ট করে কেউ ট্র্যাশ দেখেনা।তারপর ফেসবুকের মতো মিডিয়া এসে গেছে। সেখানে বাংলায় সব ধরণের ইনফোটেইনমেন্ট এসে যায়। ফেসবুকে টের পাওয়া যায় বাংলাভাষার শক্তি। জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলা ভাষীরা গোলকে চতুর্থ।এই বাজারটা বিরাট এক বাজার। এইখানে ফিল্ম,নাটক,খবর পণ্যের খদ্দের আছে। কিন্তু খদ্দেরেরা গোটা পঞ্চাশেক চ্যানেল মুঠোর রিমোর্টে পুরে সারাক্ষণ ব্রাউজিং করে। হাতে অপশন এতো বেশী, কষ্টকল্পিত প্রোডাকশন বাতিল হয়ে যায়,সৃজনশীলতা আর পপকালচারের তীব্র আকর্ষণের সামনে হার মানে জাতীয়তাবাদী আত্মপরিচয়।”


প্রসঙ্গ ডরিমনঃ
বেশ কিছুদিন হল আমাদের দেশে ডিজনী চ্যানেল বন্ধ করা হয়েছে। মূল কারণ ছিল ছোটদের মধ্যে ডরিমন কার্টুনের ব্যাপক জনপ্রিয়তা এবং কার্টুনটি হয় হিন্দিতে। ছোট বাচ্চারা হিন্দি ভাষার দিকে ঝুকে যাচ্ছে এই কারণ দেখিয়ে চ্যানেলটি বন্ধ করে দেয়া হল। আমার মতে এটি কোন সাস্টেইনেবল সমাধান না। আমাদের শিশুরা কেন ডোরিমন দেখে? এর একটা বড় কারণ হল দেশের এতোগুলা চ্যানেলের একটাতেও ছোটদের জন্য যুগোপযোগী কোন অনুষ্ঠান প্রচারিত হয় না। আর ডরিমন কার্টুন কিন্তু অরিজিনালি হিন্দি ভাষায় তৈরি নয়। এটি ফুজিকো ফুজির একটি জাপানিজ মাঙ্গা সিরিজ। ভারতে এটি হিন্দি, তামিল, তেলেগু প্রভৃতি ভাষায় ডাব করে প্রচার করা হয়। কাজেই এদেশে ডরেমন কার্টুন বন্ধ করে দেয়াটা কোন বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হয়নি বলে আমি মনে করি। বরং সেটাকে বাংলায় ডাব করে আমাদের চ্যানেলগুলোতে প্রচারের ব্যবস্থা করাটাই ছিল সঠিক পদক্ষেপ। সেটার দিকে কারও নজর আছে বলে মনে হয় না। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশের বস্তাপচা শিক্ষাব্যবস্থার অনন্ত চাপ ও খেলার মাঠের অপ্রতুলতার কারণে এমনিতেই শিশুরা বিনোদন থেকে বঞ্চিত। অনেক শিশুর কাছে স্কুল-প্রাইভেট কোচিং এর ফাকে কার্টুন দেখাটাই বিনোদনের একমাত্র উৎস। আমরা সেটাই যদি বন্ধ করে দিই বা তাদের উপযোগী ভাল অনুষ্ঠান প্রচার না করি তাহলে সেটা কি খুব নিষ্ঠুর একটা পদক্ষেপ হয়ে যাবে না?

ভারতের কলকাতার চ্যানেলগুলোতে ইদানিং ঠাকুরমার ঝুলি নিয়ে কার্টুন হচ্ছে। লম্বু-মোটু, মোটু-পাতলু প্রভৃতি জনপ্রিয় কমিকস ক্যারাক্টার নিয়ে কার্টুন হচ্ছে। আমার ছোটভাই সেগুলা নিয়মিত দেখে। ভারতীয় চ্যানেলের প্রতি যতই এলার্জি থাকুক ওকে এগুলা দেখতে নিষেধ করাটা অযৌক্তিক মনে করি। কারণ ওর বিনোদনের দরকার আছে। লেখাপড়ার নামে যে ধরণের স্টিম রোলার ওদের উপরে চালানো হচ্ছে তাতে একটু কার্টুন দেখতে দিব না তা কিভাবে হয়?

সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে ছোটদের অনুষ্ঠানের মধ্যে একমাত্র সিসিমপুরই মানসম্মত একটি অনুষ্ঠান ছিল এবং ছোটদের মধ্যে সেটি অনেক জনপ্রিয়ও হয়েছে। কিন্তু এর ধারয়াবাহিকতায় নতুন কোন অনুষ্ঠান তৈরি হচ্ছে না যা দেখে আমাদের শিশুরা দেশি চ্যানেলের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে।

আমাদের দর্শকদের অতিরিক্ত ভারতীয় চ্যানেলপ্রীতি থেকে বের করে আনতে হবে। কারণ অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিকক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব আছে। আর এর জন্য আমাদের দেশি চ্যানেলগুলোকে যেকোন মূল্যে দর্শক ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখা দরকার যে একসময় এদেশের মানুষ দুরদর্শন থেকে বিটিভি আর আকাশবাণী থেকে বাংলাদেশ বেতারকেই বেশি প্রাধান্য দিত। কাজেই ভাল দেশি অনুষ্ঠান পেলে মানুষ বিদেশি চ্যানেল ছেড়ে দেশি চ্যানেলের দিকে ঝুকে পড়বে সেটা সহজেই অনুমেয়। কাজেই দর্শককের মনস্তত্ত্ব বুঝে অনুষ্ঠান নির্মাণ ও প্রচার নীতিমালা ঠিক করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা প্রতিযোগিতামূলক এ বিশ্বে সৃজনশীলতার ও চমকের কোন বিকল্প নেই। দর্শক ধরে রাখার জন্য দেশি নির্মাতাদেরকে এখন এই প্রতিযোগিতায় দক্ষতার সাক্ষর রাখতে হবে। নাহলে শুধু শুধু বড় বড় কথা বলে লাভ নেই।