ভগ মানে স্ত্রী যোনি। গুরুপত্নী অহল্যার সতীত্ব নষ্ট করায় ইন্দ্রকে গুরুর অভিশপে সর্বাঙ্গে এক হাজার ভগ বা স্ত্রী যোনি ধারণ করতে হয় বলে তার নাম হয় ভগবান। এখানে স্ত্রী যোনিকে আরজ আলী মাতুব্বর অশ্লীল বা লজ্জাস্কর অথবা কদর্্যভাবে বর্ণনা না করে ইন্দ্রের শাস্তিটাকেই মুখ্য করে তুলেছেন। এখানে অহল্যা চরিত্রটিকে ধর্ষন করার পৌরাণিক কাহিনী সেঁচে তিনি যে উদাহরণ তুলে ধরেছেন তা যেন ইন্দ্রকে আজকালকার ধর্ষণকারীদের রূপে দেখতে পাই। নারীবাদীরা ধর্ষণের শিকার নারীর চেয়ে ধর্ষনকারীদের পরিচয় ও চরিত্র বিশ্লেষণে সচেষ্ট। অপরাধকে নির্মূল করতে এর শিকড়ের সন্ধান করতে হয়। অপরাধ ও অপরাধীর তথ্য বেশি প্রয়োজনীয়। তাই আরজ আলী মাতুব্বর নারী বিদ্বেষীদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে ইন্দ্রের ছদ্মবেশেদারী চরিত্রহীন এক পুরুষের আদ্যপ্রান্ত তুলে ধরেছেন “অনুমান” গ্রন্থের ‘ভগবানের মৃত্যু’ নামক নিবন্ধে। ভগবানের মৃত্যু নামক লেখাটিই হেঁয়ালি দিয়ে শুরু বলে এ যে পৌরাণিক ইন্দ্রের ছদ্মবেশে আমাদেরই চারপাশে বসবাসকারী ধর্ষনকারী তা সহজেই অনুমেয়। আর তার “অনুমান” গ্রন্থটির বিভিন্ন লেখা যে স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে সত্যকে ঢেকে রাখার কৌশল তা বইটির ভূমিকায় বলেই রেখেছিলেন।
ইন্দ্রের দুঃষ্কর্মের বর্ণনায় তিনি তার মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তানসহ কুন্তীর সাথে অবৈধ যৌনাচার, কিষ্কিন্ধ্যার অধিপতি রক্ষরাজের পত্নীর গর্ভে বালী রাজের জন্মদান, গুরুপত্নীকে ধর্ষনসহ সবই তুলে ধরে যেন আমাদের সমাজেরই কোন পরিচিত পুরুষ চরিত্র চিত্রণ করেছেন। আমাদের সামাজিক বলয়ে দুঃশ্চরিত্র ব্যক্তি যৌন ব্যভিচারে লিপ্ত বলে তাঁর জ্ঞান, গরিমা, বুদ্ধি,যশ, প্রতিপত্তি সবই অর্থহীন । পুরুষের যৌন ব্যভিচারের শিকার যে নারী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরজ আলী মাতুব্বর পুরুষ বা ইন্দ্র তথা ধর্ষনকারীর পরিচয়ে বলেছেন, “‘ভগবান’ হচ্ছে দেবরাজ ইন্দ্রের একটি কুখ্যাত উপাধি মাত্র।ইন্দ্র ছিলেন শৌর্য-বীর্য ও জ্ঞান- বিজ্ঞানে অতি উন্নত এবং সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা। তাই তার একনাম ‘দেবরাজ’ । , কিন্তু দেবরাজ হলে কি হব্ তাঁর যৌন চরিত্র ছিলো নেহায়েত মন্দ।’’ এ মন্দ তো নারীকে শিকার করে বলেই। মন্দের এ সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে তিনি নারীর অবস্থানকেই তুলে ধরেছেন।
নারীরা পদবী তার বাবার থেকে নেয়। অনেকে বিয়ের পর স্বামীরটা নেয়। অনেকে আবার নামের পাশে স্ত্রী লিংগবাচক বেগম সুলতানা নিয়ে থাকেন। আমাদের দেশে মায়ের নাম নিজের সাথে লাগানোর রেওয়াজ খুবই কম। তবে স্বামীর তার স্ত্রীর পদবী নেওয়ার চর্চা নেই।পদবী তো দূরের কথা, স্ত্রীর কথার গুরুত্ব দিলেই স্বামীকে স্ত্রৈণ হিসেবে সম্বোধন করে ঠাট্টা করা হয়। আরজ আলী মাতুব্বর কিন্তু গুরুত্বের সাথে স্ত্রীর নামে স্বামীর পরিচিতি পাবার বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
আরজ আলী মাতুব্বরের ভাষায়, “সহস্র ভগ অঙ্গে থাকায় ইন্দ্রদেব ‘ভগবান’ আখ্যা পেয়েছিলেন। কিন্তু মহাদেব শিবকেও ‘ভগবান’ বলা হয়, অথচ তার দেহে ‘ভগ’ ছিল না একটিও। তত্রাচ তিনি ‘ভগবান’ আখ্যা প্রাপ্তির কারণ হয়তো এই যে তিনি ছিলেন ভগবতীর স্বামী। স্বয়ং ‘ভগযুক্তা’ বলেই দূর্গাদেবী হচ্ছেন ভগবতী এবং‘ভগবতী’- এর পুংরূপে হয়তো শিব বনেছেন ভগবান। যদি তা-ই হয় অর্থাৎ ভগযুক্তা বলে দূর্গাদেবী ভগবতী হন এবং ভগবতীর স্বামী বলে শিব ভগবান হয়ে থাকেন, তাহলে জগতের তাবৎ নারীরাই ভগবতী এবং তাদের স্বামীরা সব ভগবান।”
“হয়তো’ শব্দটি ব্যবহার করে তিনি নারীর তথা ভগবতীর পুংলিঙ্গ সৃষ্টি করেছেন, যেখানে সমাজ পুংলিঙ্গের স্ত্রীবাচক শব্দ সৃষ্টিতে তৎপর, ধর্ম যেখানে স্ত্রীকে পুরুষের অঙ্গ হতে সৃষ্ট বলে ব্যাখ্যায় ব্যপৃত, আরজ আলী মাতুব্বরের বর্ণনায় সেখানে ভগবান নয়, স্ত্রীর পরিচয়ে পরচিতি লাভ যেন ভাগ্যবানের ভাগ্য। এমন কথা পড়ে নারীবাদীদের হাত স্বতঃস্ফূর্তভাবে তালির শব্দ তুলে। ভগযুক্ত স্ত্রীর স্বামী হিসেবে ভগবান শব্দের ব্যাখ্যায় নারীর অধঃস্তন অবস্থানকে উপরের দিকে সজোড়ে ধাক্কা দেবার মন্ত্র বৈ কি!
বর্তমান বাংলাদেশের সমাজে যেখানে বাবা বা স্বামীর নাম বহনই নারীদের কপালে সমাজের লিখন সেখানে স্ত্রীর নামে শিব ভগবান হয় বলে তার যে ব্যাখ্যা তা নারীবাদের উলুধ্বনিই শোনা যায়।
অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান বলেছেন, “…আরজ আলী মাতুব্বরের জীবনের জিজ্ঞাসার যে চিত্র তুলে ধরেছেন, তা পাঠকের মনে চিন্তার খোরাক যোগাতে সক্ষম।” এ চিন্তার খোরাক যোগানোতে আরজ আলী মাতব্বর পাঠ প্রতিক্রিয়া হিসেবে বর্তমান প্রজন্মের কোন নারীবাদী পুরুষ স্ত্রীর পদবী গ্রহণ করলে নারীবাদের জয়ধ্বনির অংশীদার ও দাবিদার আরজ আলী মাতুব্বরকেই যে করতে হবে।
( চলবে)
নারী শিক্ষা এবং নারী পুরুষ এর সমতার উপর নির্ভর করছে ভবিষ্যত। যেসব জাতিতে নারীদের যোগ্যতা অগ্রাহ্য করা হয়, যেসব দেশে নারীকে শুধুমাত্র প্রজনন আর পারিবারিক কাজ কামের জন্যেই যোগ্যতাসম্পন্ন মনে করা হয়, সেখানে নারীদের যোগ্যতার অবমূল্যায়ন করা হয়। নারীকে মানুষ হিসাবে বিবেচনা করা হয়না বলেই সে অকর্মন্য হয়ে থাকে। এইসব জাতি অর্থনৈতিকভাবে দারিদ্র্যের মাঝে বসবসা করে কারন তাদের সমাজে নারী সামাজিক উন্নয়নের পথে বোঝা মাত্র। – ইবনে রুশদ
ইবনে রুশদ বিজ্ঞানী, দার্শনিক হওয়ার পাশাপাশি একজন কাজী এবং শরীয়া আইন বিশেষজ্ঞ ছিলেন। আফসোস, তিনি শরীয়া আইনের যেই তরিকায় কাজ করতেন সেই তরিকা অনেক আগেই মুসলিম দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। টিকে আছে শরিয়া আইনের সেইসব ধারা ও তাদের অনুসারী যারা নারীকে পারলে হাত পা বেধে খাটের নিচে ফেলে রাখতে আগ্রহী শুধুমাত্র সঙ্গম আর ফুট ফরমায়েশের কাজের সময় বাদে।
হাহা হা; দিদি আপনিও যে মোখ্তাসার কয়া দিলেন। আপনার খবর আছে :))
@কাজী রহমান,
খবর হলে কবি কাজী সামলাবে।
@গীতা দাস,
:)) টাইপো হয়েছিল; এই বার ঠিক আছে:
চমৎকার ব্যাক্ষ্যা। ভালো লেগেছে গীতাদি। পরের পর্বের অপেক্ষায়….
@কেশব কুমার অধিকারী,
সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ , দাদা।
যতই ভাবি এই ক্ষণজন্মা, স্ব-শিক্ষিত মানুষটির কথা, শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে ততই।
@মনজুর মুরশেদ,
তাঁর নারী বিষয়ক ভাবনা আমকে মোহিত করেছে।