(1)
ক্রিকেট রক্তে ঢোকা, ড্রাগের নেশা। সেই ১৯৮৩ সালে লর্ডসে কপিলদেব বিশ্বকাপ তুল্লেন-ব্যাস, ভারতে তরুন রক্তে উঠল ক্রিকেট ঝড়। আমার বয়স তখন দশ। অলিগলিতে অত ক্রিকেট তখন কেও খেলে না। অলিম্পিকে মাঝে সাঝে হকিতে মেডেল পায় ভারত। ফুটবলে এশিয়াতে পাত্তা পায় না। ঠিক এমন একটা অদ্ভুত অবস্থা যেখানে খেলা নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই অপ্রত্যাশিত ভাবে ভারত বিশ্বজয়ী!

তবে সেই ১৯৮৩ সালে টিভি সবার বাড়িতে আসে নি। এর পরেই শুরু ভারতেঐতিহাসিক ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ। দূরদর্শনের রিলে স্টেশন ঢুকবে ঢুকবে করছে। কিন্ত খেলা দেখার উপায় নেই । টিভি থাকলেও রিলে স্টেশন না থাকলে খেলা দেখা যেত না। রেডিও সার। প্রথম একদিনের ম্যাচে শ্রীনগরে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারত দশ উইকেটে গোহারা হারল। গাভাসকর কঃ দুজো বো মার্শাল ০।
ইডেনে পরেছিল তৃতীয় টেস্ট ম্যাচ। প্রথমদিন দেখতে গেছিলাম। বাউন্ডারি লাইন থেকে মার্শাল দৌড় শুরু করলেন, পাঁচটা স্লিপ।

এবং আবার গাভাসকর ক দুজো বো মার্শাল ০।

যদ্দুর মনে আছে চাপানের বিরতির আগেই ভারত শেষ। কত করেছিল মনে নেই। তবে ভারত ইনিংস এ হেরেছিল। ৬ টা টেস্টের মধ্যে দুটোতে ইনিংসে হার, বাকীটাতে ইনিংসে হার বাঁচিয়েছিল কোনক্রমে। সেই হচ্ছে আমার প্র্রথম চাক্ষুশ ক্রিকেট দেখা। মার্শাল হোল্ডিং গার্নার রবার্টস একসাথে মুর্গী চেবাতো ভারতের ব্যাটিংকে। হোল্ডিং এবং গার্নার এত বড় মাপের বোলার ছিলেন, দুদিকে সুইং করাতেন নব্বই মাইলে। আমার মনে হয় না তেন্ডুলকার, দাদা আর দ্রাভিড় সমৃদ্ধ ভারতীয় ব্যাটিং কোনকালে ক্লাইভের সেই ভয়ংকর পেস ব্যাটারিকে খেলতে সমর্থ হত।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের হাতে একদিনের ম্যাচে ৭-০ তে হারার পর প্রমানিত হয়, ভারতের লর্ডস জয় ছিল ফ্লুক!

(2)
কিন্ত তাতে কি। সেই ৩ মাসের ওয়েস্ট ইন্ডিজ টুরের সাথে সাথে আরেকটি নীরব বিপ্লব ঘটে। রাজীব গান্ধী ক্ষমতায় এলেন। সাথে সাথে নিয়ে এলেন স্যাম পিদ্রোদা বলে এক আমেরিকা প্রবাসী দেশী প্রযুক্তিবিদ-যিনি ভারতে মিডিয়া এবং টেলিকম বিপ্লব শুরু করেন। প্রথমেই সর্বত্র টিভি রিলে স্টেশন বসানোর কাজ শুরু হয়। ফলে ১৯৮৫ সালের মধ্যে ভারতের গ্রামেও পৌছে গেল রঙীন টিভি।

এটাই ছিল সেই মিডিয়া বিপ্লব, যা আজকের ক্রিকেটের পতনের জন্য দায়ী। ১৯৮৫ সালে তখন সব মধ্যবিত্ত বাড়িতে টিভি কেনার ধুম। অস্ট্রেলিয়াতে ৭ দেশীয় বেনসন হেজেস কাপ হচ্ছে। প্রথম ডে নাইট খেলা। ক্রিকেটারদের রঙীন ড্রেস। ভারত এখানেও জিতল। একটিও ম্যাচ না হেরে। ফাইনাল পাকিস্তানের সাথে। এই ম্যাচটা সম্ভবত ভারতের ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম ম্যাচ, যেটা ভারতের সবাই সর্বত্র দেখল। তখনো সবার বাড়িতে টিভি আসে নি। গ্রামে ২০ ট বাড়ি প্রতি একটা টিভি। ফাইনালের দিন টিভিটাকে সব বাড়িতে বারান্দাতে আনতে হয়। ভারত পাকিস্তানের ফাইনাল। গ্রামের দিকেও প্রতিটা টিভিতে ৫০-৬০ জন দেখছে। মা, মাসী, কাকা, দাদু-যারা জীবনে কোনদিন ক্রিকেট দেখে নি, তাদের জীবনেও সেদিন ঢুকে গেল ক্রিকেট। শিবরামকৃষ্ণান নামে এক তরুন লেগস্পিনারের ভেলকিতে পাকিস্তান ১৭১ এ কাত! তাতে কি! ওদিকেও আছে ইমরান খান। তখনো আক্রাম আসেন নি। কাদিরের সাথে ইমরানের ঝামেলা চলাতে, কাদির বাদ! ফলে অনায়াসেই মাত্র দুই উইকেট হারিয়ে ভারত জিতে যায়।

এখান থেকেই শুরু ভারতের ক্রিকেট বিস্ফোরনের আর ভারতীয় বোর্ডের রমরমার। এর আগে পর্যন্ত ভারতীয় বোর্ড ছিল বেশ গরীব। কিন্ত যেই জেনেগেল এমন খেলা, যা এখন সব ভারতীয়রা দেখছে, মাত্র এক দশকে ভারতীয় বোর্ডের ইনকাম বাড়ে ২৫ গুন। কারন টিভি সত্ত্ব। হিসাব সোজা। একটা বলিউড ফিল্ম মেরেকেট এক কোটি ভারতীয় দেখে যদি খুব হিট হয়। আর ভারত পাকিস্তানের ফাইনাল? সাত ঘন্টা ধরে দেখবে অন্তত ত্রিশ কোটি ভারতীয়। ভারতী মার্কেটে প্রোডাক্ট মার্কেটিং এর থেকে বড় সুযোগ আর কি আছে?

ফলে ঘটনা হল এই-১৯৮৩ সালে যে বোর্ডের ইনকাম ছিল দশকোটি টাকাও না ( তখনকার মূল্যে ১০ মিলিয়ান ডলার। উপায় হত শুধু টিকিট বেচে ) , আজ সেই বোর্ডের বাৎসরিক আয় ৫৩০০ কোটি টাকা। কেও কেও বলেন ১২০০ মিলিয়ান ডলার। ত্রিশ বছরে ডলার টার্মে ইনকাম বেড়েছে ১২০ গুন। ডলার টার্মে ইনফ্লেশন এডজাস্ট করলে, দাঁড়াচ্ছে ৫০ গুন বৃদ্ধি গত ত্রিশ বছরে। তুলনামূলক ভাবে ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়া বোর্ডের বৃদ্ধি নেহাৎ অকিঞ্ছিৎকর। শুধু তাই না। আই সিসির অর্থের অধিকাংশ জোগান আসে ভারতের টিবি সত্ত্ব থেকে। পাকিস্তানের অবস্থা এতটাই খারাপ, তাদের বোর্ডের ৮০% টাকা আসতে ভারতের সাথে খেলাগুলির টিভি সত্ত্ব থেকে।

(3)

মুশকিলের সূত্রপাত এখানেই। একটা দৈত্যেকে যদি ক্রমাগত খেতে দেওয়া হতে থাকে, তার চাহিদা বাড়বেই। এইভাবে ভালোই চলছিল ভারতীয় বোর্ডের। তারাও আই সি সিতে গুন্ডাগর্দি করতে যায় নি। কারন ভাল খেতে পড়তে পেলে, কে আর ঝামেলা করতে চাইবে?

সবদিন ত আর সমান যায় না! ভারতের অর্থনীতিতে টান ধরতেই বোর্ডের লোকেদের টনক নড়ল এই অর্জিত ক্ষমতা দিয়ে, কলকাঠি নড়িয়ে কিভাবে উপায় বাড়ানো অব্যাহত থাকে। কিন্ত বোর্ডের ইনকাম কমবে কেন বা এই ধরনের হঠকারিতার কারন কি?

ভারতীয় বোর্ড কর্তা শ্রীনি ঘাঘু মাল। উনি ক্রিকেট ধ্বংস করেও ব্যবসা টেকাতে চান। কেন উনি শঙ্কায় ভুগছেন?

কারনটা একটু গভীরে বোঝা দরকার। সেই ১৯৮৫ সাল আর নেই যে বিজ্ঞাপন দিতে টিভিতেই যেতে হবে। এখন রিটেল মার্কেটিং এর অনেক উপায়। ভারতে সব থেকে বেশী টাকা যাচ্ছে মোবাইল মার্কেটং এ। মোবাইল টিউন, এস এম এস বিজ্ঞাপন অনেক সস্তা এবং তার থেকে রিটার্ন অনেক বেশী। ফলে সর্বত্র কমছে টিভির ইনকাম। এর ওপর সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং এ অনেক বাজেট চলে যাচ্ছে। কোম্পানীর মার্কেটিং বাজেট ফিক্সড। এবং এটা পরিক্ষিত সত্য মোবাইল মার্কেটিং বা সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং অনেক বেশী কার্যকরী টিভি বিজ্ঞাপনের থেকে। আর ভারতের ক্রিকেট বিজ্ঞাপনের হার এত বেশী-ওই টাকা দিয়ে অনেক বেশী মোবাইল ক্যাম্পেন চালানো যায়।

অর্থাৎ সোনার ডিম পাড়া হাঁসটা আস্তে আস্তে আর ডিম পাড়বে না। সুতরাং এখন ইনকাম বাড়নোর উপায় আই আই সির কাছে নিজের হকটা বাড়ানো। কিন্ত সেটার সাথে কেন টেস্ট ক্রিকেটে দ্বিতীয় ডিভিশন চালু করতে হল বুঝলাম না। আই সি সির কাছে নিজের হকটা বাড়ালে কেও কিছু সাড়াশব্দও করত না, ছোট্ট একটা নিউজ আসত মিডিয়াতে। কিন্ত এই গোলমেলে দ্বিতীয় ডিভিশনটা চালু করার প্রস্তাব কেন রাখল ভারত, ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার বোর্ড?

এটার পেছনেও তারা মার্কেটের যুক্তি দেখাচ্ছেন। আই সি সির বর্তমান আইন অনুযায়ী সব টেস্ট খেলিয়ে দেশকেই সব দেশের সাথে খেলতে হয়। এদের বক্তব্য বাংলাদেশ বা জিম্বাওয়ের সাথে এদের খেলা থাকলে টি আর পি ওঠে না-ফলে বোর্ডের ঘরে টাকা আসে না। এতেব এদেরকে বাদ দেওয়ার জন্য একটা স্কিম কর।

যদি আমি ভারতীয় বোর্ডের মার্কেট যুক্তিকেই ধরি, তাহলেও কোন কারন দেখি না কেন বাংলাদেশ বা জিম্বাওয়েকে দ্বিতীয় ডিভিশনে পাঠানো হবে। বাংলাদেশ টিম যথেষ্ঠ ভাল খেলছে ওয়ান ডেতে। সুতরাং তারা টেস্টেও ভাল খেলতে সক্ষম। শুধু দরকার সুযোগ দেওয়ার। দরকার বাংলাদেশের টিম যাতে ভাল টিমের সাথে আরো বেশী ৪-৫ দিনের ম্যাচ খেলতে পারে। বাংলাদেশের পরিকাঠামোর উন্নতি দরকার।

মার্কেটের যুক্তি মানলে বাংলাদেশের মার্কেট বাদ দিয়ে কি লাভ? বরং বাংলাদেশের টেস্ট পরিকাঠামো ভাল করে দেওয়াটা অনেক বেশী যুক্তিপূর্ন। তাতে মার্কেট বাড়বে। বাংলাদেশকে দ্বিতীয় ডিভিশনে পাঠানো মার্কেটের যুক্তিতেও ধোপে টেকে না।

তবে এই প্রেক্ষিতে শ্রীনির মস্তানি বেশ কুৎসিত। আজ পড়লাম উনি বাংলাদেশের কর্তাদের হুমকি দিয়েছেন ভারতকে সাপোর্ট না করলে, ভারত বাংলাদেশে খেলতে যাবে না। এতে বাংলাদেশের বোর্ডের ৭০-৮০% ইনকাম কমবে। সেটা শ্রীনি বিলক্ষণ জানেন। কিন্ত শ্রীনি এটা জানেন না, বাংলাদেশে শাহবাগ বলে একটা স্কোয়ার আছে। যদি বাংলাদেশের কর্তারা ৭০% ইনকাম কমার ভয়ে, ভারতকে সমর্থন করে যা নিউজিল্যান্ড, দক্ষিন আফ্রিকা এবং জিম্বাওয়ে করেছে টাকা হারানোর ভয়ে, ওদের চামড়া খুলে ডুগডুগি বাজাবে শাহবাগ স্কোয়ার।

এই মুহুর্তে ক্রিকেটের ভবিষয়ত শাহবাগ স্কোয়ারের হাতে। ক্রিকেটকে ধ্বংস করতে শ্রীনির দরকার আর একটিমাত্র ভোট। সেই ভোটটি আছে বাংলাদেশের হাতে। এই লোকটা নির্লজ্জ্ব ভাবে সব আইন ভেঙে ভারতীয় ক্রিকেট ধ্বংস করেছে। এখন বিশ্বক্রিকেট ধ্বংসের খেলায় নেমেছে। শাহবাগের তারুণ্যের চেতনা পারে ক্রিকেটকে শ্রীনির মতন ব্যবসায়ীদের হাত থেকে রক্ষা করতে। ক্রিকেটবিশ্ব কৃতজ্ঞ থাকবে শাহবাগের প্রতি।