(১)

’৯৬ সালের ডিসেম্বর মাস। সুদীর্ঘ ২১ বছর পর মুক্তিযুদ্ধে নের্তৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ আবারো নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেছে। স্বাভাবিকভাবেই সে বছর বিজয়ের মাসের উদ্দীপনা ছিল ব্যাপক। মাসাধিককাল ব্যাপী নানান অনুষ্ঠান চলেছিল শাহবাগ থেকে শুরু করে শহীদ মিনার পর্যন্ত নানান পয়েন্টে। কোথাও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কোথাও মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি স্মৃতিচারন, এ জাতীয় নানান কর্মসূচী চলছে। ক্লাসের ফাঁকে কিংবা পরে সময় পেলেই প্রান ভরে উপভোগ করতাম এসব অনুষ্ঠান।

বিজয় দিবসের কাছাকাছি কোন এক সন্ধ্যায় দুই বন্ধু ঢুঁ মারছিলাম। সে সন্ধ্যায় আর্ট কলেজের সামনে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা কয়েকটি পয়েন্টে বিভক্ত হয়ে বর্ননা করছিলেন তাদের কিছু দূঃসাহসিক অভিজ্ঞতা। নাট্যাভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদের কথা মনে পড়ে, উনি বর্ননা করেছিলেন ’৭১ সালের তাদের দলের রোমহর্ষক ডিআইটি ভবন অভিযান। আরেকটি পয়েন্টে লক্ষ্য করলাম একজন খুব কম বয়সী ছোটখাট গড়নের চটূল গোছের ব্যাক্তি হাসি হাসি মুখে কি যেন বলে যাচ্ছেন। কৌতূহলী হয়ে গেলাম সেখানে, কিছুটা বিস্ময়ের সাথে জানতে পারলাম যে সেই কম বয়সী ভদ্রলোকের নাম জালাল, উনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা, কম বয়সের কারন মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নিতান্তই কিশোর, মাত্র ১৩ বছর বয়সে অনেকের মত তিনিও বাসা থেকে পালিয়ে ভারতে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। পেছনে আছে পূর্নাংগ সমর সজ্জায় হাতে এলএমজি হাতে সে সময়কার সেই ১৩ বছরের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জালালের ছবি।

ভদ্রলোক বর্ননা করছিলেন পালিয়ে যুদ্ধে যোগ দেবার গল্প, ভারতে ট্রেনিং এর অভিজ্ঞতা, সেখানকার নকশালীদের সাথে কিছু সঙ্ঘর্ষ, এরপর ঢাকায় তাদের দলের কিছু অভিযান। একটি গল্পের হুবহু মনে দাগ কেটে রয়ে গেছে। ডিসেম্বর মাসের প্রথমেই ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে যাবার প্রথম দু’দিনের মাঝেই ভারতীয় বিমান হামলায় পাক বিমান বাহিনী সম্পূর্ন গ্রাউন্ডেড হয়ে যায়। সে সময় ঢাকার অধিবাসীরা রাতে আকাশে ডগ ফাইট দেখার সৌভাগ্যও অর্জন করেন। বিমান বাহিনী কার্যত অকেজো হয়ে গেলেও পাক সেনাবাহিনী ভূমি থেকেই এন্টি-এয়ারক্রাফট চালিয়ে যাচ্ছিল। তার দু একটা মাঝে মাঝে ভারতীয় বিমান আঘাত হানতেও সমর্থ হচ্ছিল। তেমনই একটি ভারতীয় বিমানে গোলার আঘাতে আগুন ধরে যায়, ভারতীয় পাইলট স্কোয়াড্রন লিডার নেহরা (যতটা মনে পড়ে নাম ছিল নেহরা) কোন উপায় না দেখে এঞ্জিন বন্ধ করে সফল ভাবে বেইল আউট করে প্যারাসুট খুলে আকাশে ভেসে পড়লেন। কিন্তু বেইল আউট সফল হলে কি হবে, যে এলাকায় তিনি পড়তে যাচ্ছেন তা তখনো সম্পূর্ন ভাবে শত্রু পাক বাহিনী অধিকৃত।

ভারতীয় পাইলটের বেইল আউট দৃশ্য ভূমি থেকে প্রত্যক্ষ করেছিল পাক বাহিনী। যুদ্ধবন্দী হিসেবে একজন ফাইটার পাইলট খুবই দামী। তাদের সেই পাইলটকে যেভাবেই হোক চাই। রওনা হয়ে গেল পাহ বাহিনী। এদিকে বেইল আউট করা ভারতীয় পাইলটকে লক্ষ্য করেছিল মুক্তিযোদ্ধা জালালদের ক্ষুদে গেরিলা দলটিও, স্থানটি ছিল সাভারের কোন একটি গ্রাম। ভাগ্যক্রমে নেহরা প্রত্যন্ত গন্ডগ্রামে ল্যান্ড করার পর পর পাক বাহিনী পৌঁছার আগেই মুক্তিযোদ্ধার দলটি তাকে উদ্ধার করে নিতে সমর্থ হয়। কিন্তু এরপর দেখা দিল অন্য বিপদ। পাক বাহিনী যেভাবেই হোক সেই ভারতীয় পাইলটকে ছিনিয়ে নেবেই। মুক্তিযোদ্ধার ক্ষুদে দলটি গেরিলা কায়দায় লড়ে, সামনা সামনি পাক বাহিনীর ট্রেইন্ড বাহিনীর সাথে লড়ার সামর্থ্য নেই। শুরু হয়ে গেল ইঁদুর বেড়ালের মত লুকোচুরি খেলা।

পাক বাহিনী হন্যে হয়ে হানা দিচ্ছে গ্রামকে গ্রাম, মুক্তিযোদ্ধারাও পণ করেছে ভারতীয় পাইলটকে কিছুতেই পাক বাহিনীর হাতে তুলে দেবে না। এভাবেই চলল ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস পর্যন্ত। এরপর সেই ভারতীয় পাইলটকে সসম্মানে তুলে দেওয়া হল ভারতীয় বাহিনীর হাতে। ভারতীয় সেই পাইলট নেহরা ’৯৬ সালেও ভারতীয় বিমান বাহিনীতে ছিলেন, তিনি তখন এয়ার ভাইস মার্শাল। ২৫ বছর পর অনেক বড় অফিসার হলেও যুদ্ধের ময়দানে প্রান রক্ষাকারী সেই গেরিলা বন্ধুদের তিনি ভোলেননি। নিয়মিত শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন, কার্ড পাঠাতেন।

জালাল ভাই পকেট থেকে সেই বিধ্বস্ত ভারতীয় বিমানের চাবিটি বার করে আমাদের দেখালেন। দলের কনিষ্ঠতম সদস্য হিসেবে তিনিই আবদার ধরে সেটি আদায় করেছিলেন, সযত্নে রক্ষা করেছেন দীর্ঘ ২৫টি বছর।

ছোটখাট গড়নের ভদ্রলোকের কথা বলার ষ্টাইল ছিল খুবই সরল সাধারন, বয়সের কারনেই হয়ত সারাক্ষন মুখে একটি চটূল হাঁসি লেগেই রয়েছে, সামান্য একটু খূড়িয়ে হাঁটেন। সে সময় হিসেব অনুযায়ী বয়স ৩৮ হলেও ২৫ বলে অনায়াসে চালানো যাবে। ’৯৬ সালে উনি মোহাম্মদপুরে শেয়ারে একটি মটর গ্যারাজ চালান। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বলে তেমন কোন অতিরিক্ত চাওয়া পাওয়া নেই। হাসিমুখেই সব বলছিলেন। এক পর্যায়ে হঠাতই সে হাঁসি অনেকটাই ম্লান হয়ে এলো। অপ্রাপ্তির কথা বলতেই বলে ফেললেন; কোন চাওয়া পাওয়া নেই শুধু যখন দেখি ’৭১ সালের রাজাকাররা জাতীয় পতাকা উড়িয়ে বেড়ায়, আজ গনভবনে দাওয়াত পায়……এরপর আবারো চলে গেলেন ’৭১ এ।

১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হবার পর ভয়াবহ রাজাকার মাওলানা মান্নান (ততকালীন মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির নেতা, শহীদ বুদ্ধিজীবি D: আলিম চৌধূরী হত্যার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত, পরবর্তিকালে এরশাদের মন্ত্রী, দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা) পালানোর সময় ওনাদের দলের হাতেই ধরা পড়ে। মান্নানের নির্দেশে ধরে নিয়ে যাওয়া বহু মানুষ তখনো নিরুদ্দেশ, তার মাঝে কিছু মহিলাও আছে। ধরা পড়া মান্নান রাজাকারের পেট থেকে কথা আদায়ের উদ্দেশ্যে শুরু হল কিছু শারীরিক নির্যাতন, তার পায়ে বেয়োনেট কেটে হলুদ মরিচ ঢালা হয়েছিল, সেই হলুদ মরিচ জালাল ভাই নিজে সংগ্রহ করেছিলেন স্থানীয় আজিমপুর কলোনীর এক বাসা থেকে। এরা স্বাধীন দেশে মন্ত্রী হয়……বলে কিছুটা আবগ্লাপুত জালাল ভাই এরপর থেমে গেছিলেন।

(২)
আজ জালাল ভাই কোথায় আছেন, কেমন আছেন জানি না। আশা করি ভালই আছেন। আশা করি যুদ্ধপরাধীদের চলমান বিচার প্রক্রিয়ায় তার দূঃখবোধ কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে। বিজয়ের দিনে জালাল ভাই কি ভাবছেন? জালাল ভাইরা ’৭১ দূরে থাক, ’৯৬ সালেও নিশ্চয়ই ভাবতে পারেননি সেই যুদ্ধপরাধী বিচার নিয়ে কি তুলকালাম কান্ড ঘটে যাবে বাংলার মাটিতেই; তার লেজুড় ধরে নানান রাজনৈতিক জটিলতায় দেশ পতিত হবে এক রকম গৃহযুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে।

দেশে বর্তমানে যা চলছে তাতে গভীর হতাশায় নিপতিত হওয়া ছাড়া তেমন কিছু দেখি না, গনতন্ত্র রক্ষার নামে চলছে গনতন্ত্রের জানাযা পাঠ, দাফনের অবস্থা সময়ের ব্যাপার মাত্র। দেশ মোটামুটিভাবে দুই শিবিরে বিভক্ত, দুই পক্ষই চরমপন্থী অবস্থানে। আমার মনে হয় না পরিস্থিতির ভয়াবহতা সেভাবে কোন পক্ষই অনুধাবন করতে পারছে বলে। কার দায় কতটা সে নিয়ে অনন্তকাল তর্ক করা যায়, তাতে সমস্যা সমাধানের পথ খুলছে না কিংবা খুলবে না।

আশা ছিল আওয়ামী লীগ এক দলীয় নির্বাচনের ফাঁদে পড়বে না, সে আশায় আপাতত জলাঞ্জলি। যুদ্ধপরাধী বিচারের কার্যক্রমে উদ্দীপ্ত এবং আওয়ামী সমর্থকরা এখনো যুদ্ধপরাধী বিচারের বাইরে আর তেমন কিছু ভাবছেন না বলে এক দলীয় নির্বাচনের বিপদটা টের পাচ্ছেন না। আর আওয়ামী লীগের ভেতরের ভাবনা কি তা বোঝার সাধ্য আমার নেই। তারা কি সত্য সত্যই সূস্থ মস্তিষ্কে আশা করেন যে যদু মধু জাতের কাউকে ধমকে কিংবা লোভ দেখিয়ে এক দলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে আরেক মেয়াদ তারা সরকারে থাকতে পারবেন?

দেশের অতীত ইতিহাস তেমন বলে না। দেশে এ জাতীয় এক দলীয় নির্বাচন করে সরকার গঠন করা কোন দলই বেশীদিন টেকেনি। আওয়ামী লীগও যতই পোড় খাওয়া, রুট লেভেলের এবং জনপ্রিয় দল হোক তারাও টিকবে না তা বলে দিতে পারি। সে পতনের ধাক্কা সামাল দূরের কথা, মাত্রা পরিমাপের ক্ষমতাও এই দলের আছে মনে হয় না। জানি, এর মাঝে নানান তর্ক আসবে, জামাত বান্ধব বিএনপির নানান কার্যক্রম, আলোচনার ব্যাপারে আন্তরিকতা……কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে এক দলীয় নির্বাচন ঘটে যাওয়া মানে রাজনৈতিক হিসেবে বিএনপিরই জয়লাভ। এক দলীয় সরকার অবৈধ বলে বিদেশীরা রায় না দিলেও সে সরকারকে সহজভাবে নেবে না, সরকার পরিচালনায় তার প্রভাব পড়বে। দেশের ভেতর চলতে থাকবে অব্যাহত গতিতে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস, তার প্রতিক্রিয়ায় বিরোধী দলের ওপর পাল্টা হামলা, গ্রেফতার নির্যাতন…চক্রবৃদ্ধি হারে এই চক্র চলতে থাকা। ব্যাবসা বানিজ্য হতে থাকবে স্থবির। বাংলাদেশে থাকি না, কিন্তু বাংগালী মানসিকতা আমি যতটা বুঝি তাতে বলতে পারি যে দায় যার যতটুকুই থাকুক চুড়ান্তভাবে সরকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ওপরেই লোকে বীতশ্রদ্ধ হতে থাকবে। এ ছাড়া সে নির্বাচনে যেন লোকে ভোট দিতে না যায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে আরো চরম সন্ত্রাস সে কথা বাদই থাকল। যত যাইই ইস্যু থাক, যেভাবেই হোক বিএনপিকে নির্বাচনে রাজী করাতে না পারাটা আওয়ামী লীগের জন্য বড় ধরনের ব্যার্থতাই আমি বলব। বিএনপির ইতিহাস থেকে শুরু করে যুদ্ধপরাধীদের সরাসরি সহায়তা করা নিয়ে বহু সমালোচনা করা যাবে কিন্তু তাতে লাভ তেমন হবে না।

এখানে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য কার কতটা দায় সে আলোচনায় যাচ্ছি না, সত্য বলতে এ প্রশ্নের পরিষ্কার জবাব আমার কাছে নেই। শুধু জানি যে এবারকার পরিস্থিতি খুব একটা অচিন্ত্যনীয় কিছু ছিল না, গনতন্ত্র মুক্তি পেয়েছে বলে এরশাদ সরকার পতনের পর আমরা উদ্বেলিত হলেও আদৌ আমাদের মাঝে গনতান্ত্রিক চেতনা কতটা আছে সেই প্রশ্ন আমরা কোনদিন ভাবিনি। এ ধরনের কথাবার্তা আপাতত অতি আঁতেলীয় শোনালেও এ প্রশ্ন ভাবা হয় না বলেই আমাদের গনতন্ত্রের অবস্থা হয়েছে সেই তৈলাক্ত বাঁশ এবং বানরের গল্পের মত।

গনতন্ত্রে উত্তরনের পর বোঝা গেল যে দলীয় সরকাররে অধীনে নির্বাচন করার যোগ্যতা আমাদের নেই, আবিষ্কৃত হল কেয়ার টেকার সরকার। সকলে ধন্য ধন্য। এরপর আবিষ্কৃত হল যে এই কেয়ার টেকার ব্যাবস্থাও আসলে যতটা পোক্ত ভাবা গেছিল ততটা পোক্ত নয়, বাংগালী বুদ্ধি খাটিয়ে এই আপতঃ নিরীহ নিষ্কলুষ ব্যাবস্থার মাধ্যমেও জাল জোচ্চুরির বন্দোবস্ত সফল ভাবে করা যায় তা গতবারের বিএনপি জোট সরকার দেখিয়ে দিয়েছিল। এর পথ ধরে গনতন্ত্র রুদ্ধ থাকল ২ বছর, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কেয়ার টেকার বদলে সর্বদলীয় ফর্মূলা দিল, যা বিএনপি মহল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার এভিল ইন্টেনশন হিসেবে দেখলেন। এটা ঠিক যে কেয়ার টেকারেরও দূর্বলতা দেখা গেছে, সর্বদলীয় সরকার ধারনা হয়ত খুব একটা মন্দ নয়। কিন্তু এই মৌলিক পরিবর্তনটা প্রধান বিরোধী দলের সম্মতিতে করা গেলে সবচেয়ে ভাল হত, আমাদের ব্যাবস্থায় সে হবার নয়। তার ফলাফল আজকের অবস্থা। এর জের কোথায় এবং কতদিন থাকে সে প্রশ্নের জবাব ভবিষ্যতই দিতে পারবে। সেই পরিবর্তন হঠাত এ বছর নির্বাচনের আগে হয়েছে এমন নয়, আজকের অচলাবস্থা যে হতে যাচ্ছে সেটা নিশ্চিত ছিল বহু আগ থেকেই, তবুও দেশের সুশীল সমাজের তেমন টনক নড়েনি।

কেয়ার টেকার পরিবর্তনের জন্য অনেক আপতঃ নিরপেক্ষ ব্যাক্তিবর্গ সুশীল প্রকারন্তে আওয়ামী লীগকেই বর্তমান অচলাবস্থার জন্য দায়ী করছেন। অভিযোগ একেবারে ফেলনা নয়। যত যাইই বলি আজ আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলে এবং সরকারী দল হিসেবে বিএনপি কেয়ার টেকার বদলাতে চাইলে আওয়ামী লীগও নিশ্চয়ই সহজভাবে নিত না, বিএনপি জামাতের মত চরম সহিংস কায়দায় হয়ত না হলেও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ত। তক্ত্বাবধয়ক ব্যাবস্থা কায়েম করার দাবীতে প্রথম আন্দোলন করেছিল তারাই। এতে কি খুব বেশী দ্বি-মতের অবকাশ আছে? অন্যদিকে কেয়ার টেকার ব্যাবস্থা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি যে বিএনপিরই অবদান তাইই বা ভুলি কেমন করে? কাজেই এই ব্যাবস্থা পরিবর্তনের দায় তারাই বা কতটুকু এড়াতে পারে? আরো কথা হল বিএনপির জন্য যদি কেয়ার টেকার পছন্দনীয় হতে পারে তবে আওয়ামী লীগের নির্দলীয় ব্যাবস্থা চাওয়াতে ঠিক কিভাবে আপত্তি করা যায়? এখানেই আমি থমকে যাই। এই প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই। নিঃসন্দেহে দুয়ের মাঝামাঝি কোন এক সমাধানে আসতে হবে, তা কিভাবে? সংসদ নির্বাচনের আগে কেয়ার টেকার/নির্দলীয় প্রশ্নে রেফারেণ্ডামের বন্দোবস্ত করতে হবে? তাতে নাহয় এবারকার মত কোন জবাব পাওয়া যাবে, ভবিষ্যতে কি হবে? এ চক্র চলবেই? নির্বাচনের আগে কোন পদ্ধুতিতে ভোট হবে তার জন্য সেমি ফাইনাল খেলার মত রেফারাণ্ডাম? রাজনীতি পছন্দ করি না, সব দলই খারাপ এসব কথা বলে নিজেকে বাইরে রাখার উপায় আর তেমন নেই। রাজনীতি পছন্দ করেন আর না করেন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাই আপনার দৈনন্দিন জীবনের সূখ স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ন্ত্রন করে। রাজনৈতিক সচেতনতা নাগরিক মাত্রেরই দরকার, নাঁক সিঁটকে দূরে থাকার উপায় নেই।

হতাশার আরো বড় কারন হল এহেন সমস্যা যে অন্যান্যবারের মত এবারকার প্যাঁচও খুলে গেলেই ভবিষ্যতে আর হবে না এমন নয়। ভবিষ্যতেও হবে, ট্র্যাক রেকর্ড বলে ভবিষ্যতে অবস্থা আরো খারাপ হবে। বড় দুই দলের মাঝে অমিমাংসিত রাজনৈতিক বিষয় এত বেশী রয়েছে যে অন্য আর দশটি গনতান্ত্রিক দেশের মত আমাদের দেশে সূস্থ রাজনীতির আশা করা বাতূলতা মাত্র। তারানকো সাহেব, নিনিয়ান সাহেবরা (’৯৪ সালে তক্ত্বাবধয়ক আন্দোলনের সময় মধ্যস্ততার উদ্দেশ্যে অষ্ট্রেলিয়া থেকে এসেছিলেন) কোনদিনই দুই দলের মাঝে সমঝোতা আনতে পারেননি। সমাধান বার করতে হবে দেশের নাগরিকদেরই। দুদিন পর পর বিদেশীরা দুনিয়ার অপর প্রান্ত থেকে আসবে কয়েক মাইল দুরে থাকা ভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতাদের বৈঠকে বসাতে এমন কিছু নিশ্চয়ই জাতি হিসেবে খুব গৌরবের কিছু নয়। সবচেয়ে বড় কথা হল দলীয় পরিচয়ে দায় যার যতটুকুই হোক না কেন ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষের দলীয় পরিচয় নেই। এবারকার গুরুতর সমস্যা কোন ভাবে সমাধা হলে এমন ধরনের পরিস্থিতি যেন ভবিষ্যতে আর সৃষ্টি হতে না পারে সে জন্য নাগরিকদেরই চিন্তা করতে হবে।

এবারকার অচলাবস্থা কিভাবে মেটে তার কিনারা পাচ্ছি না, তাও ধরে নিচ্ছি অন্যান্যবারের মতই কিছু একটা হয়ে যাবে। হতাশার আরো কারন ভোট গ্রহন সম্পর্কিত জটিলতা মিটে গিয়ে নুতন নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হলেও সহজে শান্তি শৃংখলা ফিরে আসবে এমন সম্ভাবনা অতি নগন্য। যে অবিশ্বাস, তিক্ততা, হানাহানি শুরু হয়েছে তার জের এত সহজে স্তিমিত হবে না। যে দেশে জন্ম গ্রহন করেছিলাম, বড় হয়েছিলাম সে দেশ মাঝে মাঝে ভয় পেতাম পাকিস্তানে পরিবর্তিত হতে যাচ্ছে, এখন পাকিস্তানকেও টপকে এক্কেবারে সিরিয়ায় পরিনত হচ্ছে তেমন দূঃস্বপ্নও আজকাল দেখতে হয়। সকলের সূস্থ বিবেক জাগ্রত হোক এমন সরল আশাবাদ ব্যাক্ত করা ছাড়া বলার কিছু দেখছি না। তাও স্বপ্ন দেখতে দোষ নেই কোনদিন সকালে পত্রিকার পেজ খুলে দেখবো দুই দলের নির্বাচন ব্যাবস্থা নিয়ে ঐক্যমত, যুদ্ধপরাধী জামাত শিবিরের সাথে অতীতে সম্পর্ক রাখার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যাবহার নিষিদ্ধকরনের ব্যাপারে ঐক্যমত……আশা করতে তো দোষ নেই।