পুরো একাত্তর জুড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালী জাতিকে মেধাশূণ্য করার জন্য বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে। এই অপকর্মে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সরাসরি সাহায্য করে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনী।

পরিকল্পিতভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালী-বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে। এই উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আল-শামস, আল-বদর, রাজাকারদের মাধ্যমে বাঙালী বুদ্ধিজীবিদের তথা, শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, আইনজীবি, লেখক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, সাংবাদিকদের তালিকা প্রস্তুত করে।

এরপর, শুধুই ইতিহাসের কালো একটি অধ্যায়।
পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে আরেকটি নির্মম পরিকল্পিত গনহত্যা; একটি জাতি মেধাশূণ্য করার অপচেষ্টা।

বাঙালী বুদ্ধিজীবিদের উপর চুড়ান্ত আঘাত আনা হয় ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের বিজয়ের মাত্র দু’দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ রাজাকার-আল বদর-আল শামস বাহিনীর পূর্ণ সহযোগীতায় পনেরোশ’র অধিক বুদ্ধিজীবিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে।

স্বাধীনতার পর ঢাকার মিরপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগ, মুহাম্মাদপুর, চট্টগ্রামের পাহাড়তলী, লালখান বাজার, স্টেশন-কলোনী, গুডস হিলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় হাত-পা-চোখ বাঁধা অবস্থায় বুদ্ধিজীবিদের পঁচিত-বিকৃত মৃতদেহ পাওয়া যায়। মৃতদেহগুলোতে ছিল অকল্পনীয় নির্যাতনের চিহ্ন। অনেক বুদ্ধিজীবির মৃতদেহ খুঁজেও পাওয়া যায়নি।

বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী পাকিস্তানী মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর বঙ্গভবন থেকে রাও ফরমান আলীর একটি ডায়রী পাওয়া যায়; যাতে নিহত ও জীবিত বুদ্ধিজীবিদের তালিকা ছিল। এই ডায়রীতেই স্পষ্ট উল্লেখ আছে, আল-বদর তথা, জামাত ও ছাত্র-সংঘ বাঙালী বুদ্ধিজীবিদের তালিকা তৈরী, হত্যার উদ্দেশ্যে ধরে আনা ও হত্যাকান্ডে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে।
রাও ফরমান আলীর ডায়রী থেকে জানা যায়, সিআইএ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড সম্পর্কে জানত। কারণ, ডায়রীতে হেইট ও ডুসপিক নামে দুজন আমেরিকার গোয়েন্দার সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার ইঙ্গিত আছে।

পাকিস্তানীরা কতটা অসভ্য-বর্বর জাতি এবং এদেশের পাকি-দালালরা কতটা নিমক হারাম, তা ‘বুদ্ধিজীবি নিধন তদন্ত কমিশন’ কর্তৃক প্রকাশিত কিছু তথ্য দেখলে আরো স্পষ্ট হয়। ‘বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন’ তাদের রিপোর্টে বলছে, পাকিস্তানী মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী শুধু ডিসেম্বরে বিশ হাজার বাঙালী বুদ্ধিজীবিকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। বুদ্ধিজীবিদের তালিকা প্রস্তুতের জন্য রাজাকার-আল বদর-আল শামসকে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়। বাঙালী এইসব বিশ্বাসঘাতক নরপশুদের নেতৃত্বে ছিল চৌধুরী মইনুদ্দিন (জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য), আশরাফুজ্জামান (ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য/ বর্তমান ছাত্রশিবির)।

চৌধুরী মঈনুদ্দীন শহীদ বুদ্ধিজীবিদের তালিকা প্রস্তুত করে ও তাঁদের বাসার ঠিকানা খুঁজে বের করে এবং মূল এক্সিকিউশান প্ল্যান করে। বুদ্ধিজীবিদের নাম-ঠিকানা পাকিস্তানীর কাছে তথা, রাও ফরমান আলী ও ব্রিগেডিয়ার বশীর আহমেদকে সরবরাহ করেছিল এই চৌধুরী মঈনুদ্দীন।

আশরাফুজ্জামান ছিল মূল এক্সিকিউশান কর্মকর্তা। তার নাখালপাড়ার বাড়ি একটি ডায়রী উদ্ধার করা হয়, যাতে বুদ্ধিজীবীর নাম ও ঠিকানা লেখা ছিল এবং এই বুদ্ধিজীবিরা সবাই শহীদ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইবুনালে আশরাফুজ্জামানের গাড়ির ড্রাইভার মফিজুদ্দিন বলেন, রায়ের বাজার ও মিরপুরের শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমিতে বেশ কয়েকজন বুদ্ধজীবিকে আশরাফুজ্জামান নিজ হাতে গুলি করে মেরেছিল।

চট্টগ্রামে বুদ্ধিজীবিদের প্রধান হত্যাকারী ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং তার দুই ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গিয়াস কাদের চৌধুরী।

১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর, ‘দৈনিক আজাদে’ একটি রিপোর্টে বলা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী মনে করত, বাঙালী বুদ্ধিজীবি ও শিক্ষিত সমাজই একাত্তরের যুদ্ধের জন্য দায়ী। তাই, পাকিস্তান সেনাবাহিনী বুদ্ধিজীবিদের একটি তালিকা বানাতে জামায়াত ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘকে (বর্তমানে শিবির) দায়িত্ব দেয়। পাকিস্তানের এসব বাঙালী দালালরা রাজাকার-আল শামস-আল বদর বাহিনী পরিচয়ে বাঙালী বুদ্ধিজীবিদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে। এই তালিকা অনুসারে সারা একাত্তর জুড়ে বাঙালী বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা শুরু করে। দেশ স্বাধীন হতে আর একটি সপ্তাহ দেরী হলে, ওরা বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের সবাইকে মেরে ফেলতো।

ত্রিশ লক্ষ শহীদের মাঝে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে কতজন, তা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। ব্যাপক গণহত্যা ও দেশান্তরী হওয়া বিধ্বস্ত-বিচ্ছিন্ন জনপদে এবং চরমভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে সে সময় জরিপ চালানো সম্ভব হয়নি।

১৯৯৪ সালে ‘বাংলা একাডেমী’ থেকে প্রকাশিত ‘শহিদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’ নামে শহীদ বুদ্ধিজীবিদের একটি অসম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশিত হয়; যাতে, ২৩২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবির বর্ণনা আছে।

১৯৭২ সালে নিউজ উইকের সাংবাদিক নিকোলাস টমালিন তার একটি কলামে শুধু ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা শহরে শহীদ হওয়া বুদ্ধিজীবির সংখ্যা এক হাজার সত্তর জন বলে জানান।

বাংলাপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, শিক্ষাবিদ ৯৯১ জন, চিকিৎসক ৪৯ জন, আইনজীবি ৪২ জন, সাংবাদিক ১৩ জন ও অন্যান্য (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী এবং প্রকৌশলী) ১৬ জন।
তবে, প্রকৃতপক্ষে শহীদ বুদ্ধিজীবিদের সংখ্যা অনেক বেশি। থানাভিত্তিক জরিপ অনুসারে শিক্ষক, প্রকোশৌলী, চিকিৎসক, আইনজীবি, লেখক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক মিলিয়ে মোট শহীদ বুদ্ধিজীবি সংখ্যা এক লক্ষ হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য চলছে।
০৩ নভেম্বরে, ২০১৩; চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের ফাঁসির রায় হয়েছে। এখন শুধু অপেক্ষা এই যুদ্ধাপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসি কার্যকর করা।
চট্টগ্রামের ঘাতক সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় হয়েছে।
কবি মেহেরুন্নেসার হত্যাকারী আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাত ১০ টা ০১ মিনিটে কার্যকর করা হয়েছে। আবদুল কাদের মোল্লা ফাঁসির রায় কার্যকর করা একাত্তরের প্রথম যুদ্ধাপরাধী

গতকাল ছিল ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৩ সাল।
শহীদ বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের ৪২ তম দিবস।
পরম শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সাথে বাঙলার সকল শহীদদের স্মরণ করছি।

জয় বাঙলা…

তথ্যসূত্র:

* শহীদ বুদ্ধিজীবিদের তালিকা (১৯৭২), গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, সম্পাদনায়: সৈয়দ আলী আহসান।
* শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ (১৯৯৪), বাংলা একাডেমী।
* বাংলাপিডিয়া।