বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ১৯৯৭ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে এসেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নেলসন মেন্ডেলা। সফরকালে ম্যান্ডেলা তার ঐতিহাসিক ভাষণে জানিয়েছিলেন, এদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের বন্ধু।

এটিই ছিল ম্যান্ডেলার এ দেশে প্রথম ও শেষ সফর। তিনি ছাড়াও ফিলিস্তিনের নেতা ইয়াসির আরাফাত ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট সুলেমান ডেমিরেল সে সময় বাংলাদেশে আসেন। ২৬ মার্চ সকালে শিখা চিরন্তনকে ঘিরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন তিনি। এর আগে সকাল সাড়ে ৯টায় ম্যান্ডেলাসহ তিন রাষ্ট্রপ্রধান হেলিকপ্টারে করে স্মৃতি সৌধে পৌঁছান। পুষ্পার্ঘ অর্পণের পর নেলসন ম্যান্ডেলা স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে একটি বৃরোপন করেন।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে আয়োজিত ‘শিখা চিরন্তন’ ও ‘স্বাধীনতার স্তম্ভের’ ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ উর্দ্ধতন ব্যক্তিবর্গ নেলসন মেন্ডেলাকে উষ্ণ অভিবাদন ও স্বাগত জানান।

ম্যান্ডেলা তাঁর ভাষণে বলেন

স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে, এমন একটি জাতিকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্যই আমি বাংলাদেশে এসেছি। বাংলাদেশের একজন বন্ধু হিসেবে আমি এখানে দাঁড়িয়ে বলতে চাই, ক্ষুধা, দারিদ্র ও অন্যান্য সমস্যা সমাধানে আমরা একসঙ্গে কাজ করবো।

২৬ মার্চ দুপুরে ম্যান্ডেলা বঙ্গভবনে রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় যোগ দেন। লিখিত বক্তব্য শেষ করে পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে সমবেত অতিথিদের সামনে ম্যান্ডেলা কিছু কথা বলেন। ম্যান্ডেলার সে কথা উপস্থিত সবাইকে অনুপ্রাণীত ও মুগ্ধ করে। বর্ণবাদের অভিশাপে জর্জরিত দণি আফ্রিকার উন্নয়ন ও পুনর্গঠনে তিনি কীভাবে সবাইকে নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছেন, সে কথা এসেছিল তার ভাষণে।

নিপীড়িত মানুষের মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক এই নেতা বলেন,

আমাদের দেশে আমরা কীভাবে জাতি গঠনে মতৈক্যে পৌঁছেছি, সে বিষয়টি আজ আপনাদের জানাতে চাই। আমরা আমাদের শত্রুর সঙ্গে আপস আলোচনায় বসেছি তিনটি মৌলিক নীতির ভিত্তিতে। আমরা সেই শত্রুর সঙ্গে আলোচনায় বসেছি, যারা দক্ষিণ আফ্রিকার হাজার হাজার নিরীহ বেসামরিক নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করেছে। তবে আমরা রক্তের উন্মাদনায় কোনো অশুভ শক্তির প্রতি সাড়া দেইনি। আমরা যা কিছু করেছি, দেশের স্বার্থে সাহসের সঙ্গে করেছি।

ম্যান্ডেলা বলেন,

গণহত্যা এড়াতে, নিরীহ জনগণকে রায় এবং অনেক পরিবারকে খণ্ডিত করা থেকে রোধের জন্যই আমরা তিনটি আদর্শ গ্রহণ করি। আলোচনার সময় আমাদের মাথায় এই ভাবনা ছিল, এই আপোস আলোচনায় আমরা বা আমাদের শত্রুরা কেউ বিজয়ী হবে না, বিজয়ী হবে সমগ্র দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ। আমরা ভেবেছিলাম, কোনো একটি রাজনৈতিক দল নয়, সমগ্র দণি আফ্রিকার জনগণকে জিততে হবে।

বর্ণবাদ বিরোধী এই কৃষ্ণাঙ্গ নেতা বলেন,

আমরা যে রাজনীতিতে বিশ্বাস করি ও মেনে চলি, সেটি হলো সব সম্প্রদায়ের মধ্যে ভালো নারী ও পুরুষ রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ, ভারতীয়, শ্বেতাঙ্গ বা অশ্বেতাঙ্গ, যার কথাই বলি না কেন, সব সম্প্রদায়ের ব্যাপারে এটি সত্য। আমরা বলতে চেয়েছিলাম, সব রাজনৈতিক দলের ভালো নারী ও পুরুষ রয়েছে।

ম্যান্ডেলা বলেন,

নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর আমরা ঠিক করেছিলাম, সবাই মিলে সরকার গঠন করবো। আমাদের মন্ত্রীসভার সদস্য সংখ্যা ২৭ এবং দেশের তিনটি রাজনৈতিক দলের সদস্যই রয়েছেন আমাদের সরকারে। আফ্রিকার ন্যাশনাল কংগ্রেস বিংশ শতাব্দীর স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য গর্বিত। আমরা নিঃসঙ্গ নই। আমাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সমর্থন রয়েছে। কিন্তু আমরা এর অপব্যবহার করতে চাই না। এ কারণেই আমরা একদলীয় সরকার গ্রহণ করতে পারি না।

__
ছবি ও তথ্য সূত্র: ১৯৯৭ সালের একাধিক জাতীয় দৈনিক।