রোম নগরী যখন পুড়ছিল, রোম সম্রাট নিরো নাকি তখন নিরাপদ দূরত্বে বসে বাঁশী বাজাচ্ছিল। কথাটি শুনে আসছি সে ছোট বেলা থেকে। এটি কি সত্যই কোন ঐতিহাসিক ঘটনা, নাকি ফিকশান, তা আমি জানি না। সত্যি হলে তা কবেকার ঘটনা, ঘটনার প্রেক্ষিত কী, তাও জানার সুযোগ হয় নি। তবে বাক্যটি একটি বহুল প্রচলিত ঐতিহাসিক প্রবচনে পরিণত হয়ে গেছে। কোন ভয়াবহ কিংবা দু:খজনক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় কেউ আনন্দ উল্লাস করলে, এ বাক্যটি উচ্চারিত হয়ে থাকে। উক্তিটি শুনে প্রায়শ: ভাবতাম-এটাও কি সম্ভব? একটি রাজ্য পুড়বে, আর তার সম্রাট মনের আনন্দে বাঁশী বাজাবে?
বলা বাহুল্য, সে ঘটনা যদি সত্যও হয়ে থাকে, নিশ্চয় তা কোন বর্বর যুগের ঘটনা। কিন্তু আধুনিক স্বাধীন বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ, যারা ক্ষমতায় আছেন এবং যারা ছিলেন বা ক্ষমতায় যাবার স্বপ্নে বিভোর , তাদের আচরণ দেখলে মনে হয়, সত্যিইতো, রাজ্য পুড়লেও কোন কোন সম্রাট বা সম্রাজ্ঞীরা বাঁশী বাজাতে পারেন। আজ আমাদের দেশের আম জনগণ যখন অকারণে, বিনা দোষে বোমার আঘাতে প্রাণ দিচ্ছে, জীবন্ত অগিদগ্ধ হচ্ছে, পিষ্ঠ হচ্ছে যানবহনের চাকার তলে, রাজপথ, রেল পথ যখন অবরুদ্ধ চোরাগুপ্তা সন্ত্রাসী হামলায়, রোম নগরীর মত কেবল ঢাকা নগরী নয়, পুড়ছে যখন সারা বাংলাদেশ, তখন আমাদের তথাকথিত মূল দলের আপোষহীন দু-নেত্রী-যারা ইতোমধ্যে এদেশের অবিসংবাদিত সম্রাজ্ঞীর আসনে নিজেদের অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন-যাদের পদতলে এদেশের বড় বড় ডিগ্রিধারী তাবত রাজনীতিবিদরা কৃপা ভিক্ষায় নতজানু হয়ে জুহুকুম মহারাণী বলে গলা শুকিয়ে ফেলছেন-সে সম্রাজ্ঞীদের একজন মহানন্দে বিভিন্ন প্রকল্পের শ’য়ে শ’য়ে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে যাচ্ছেন, নিত্য-নতুন সুশোভিত পোশাকে, সভার পর সভায়, ঘন্টার পর ঘন্টা বক্তৃতা দিয়ে উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে। আর অন্যজন লোকচক্ষুর অন্তরালে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে জনবিচ্ছিন্ন গণআন্দোলনের একের পর এক ওহি নাজিল করে যাচ্ছেন। এত মৃত্যু, এত কান্না, এত আহাজারী, তাদের প্রাত্যহিক জীবনের সুখ-শান্তি ও ভোগ-বিলাসে এতটুকু ব্যাঘাত ঘটাতে পেরেছ বলে মনে হয় না। বরং একে অপরের প্রতি তীর্যক বাক্যবাণ বর্ষণ করে নিজেকে নিষ্কলুষ গণতন্ত্রী ও দেশপ্রেমিক ও জনদরদী দাবী করছেন। যে কোন ভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার এক নির্মম নিষ্ঠুর খেলা খেলছেন। পুনর্বার নির্বাচিত হওয়ার কলা-কৌশল নির্ধারণ করছেন। বোমাবাজী নাশকতার মাধ্যমে নিরীহ জনগণের জীবন হরণ করে দিনের শেষে প্রেস ব্রিফিং করে স্বত:ফূর্ত আন্দোলনের জন্য হাঁদারাম জনগণকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। কেহবা জীবন বলিদানকারী জনতাকে তাদের জীবনের বিনিময়ে আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য ধন্যবাদ জানানোর মত মশকারা করছেন। অথচ জনগণ প্রতিদিন প্রাণ দিচ্ছেন আমাদের নেত্রীদের ক্ষমতারোহন কিংবা ক্ষমতা রক্ষার বেদীমূলে। বোকারাম(?) জনগণ যেন ঐ সমস্ত সম্রাজ্ঞীদের ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতির বলির পাঠা।
এর পরও কি আমরা জনগণ চুপ করে সবকিছু সহ্য করে যাব? ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ণ ইউনিটের চিকিৎসাধীন অগ্নিদগ্ধা গীতা সেনের মত আমরা কেন জ্বলে ওঠে বলতে পারব না, আমরা তোমাদের খাই না, আমরা তোমাদের পড়ি না, আমরা তোমাদের বানাই। আমরা সুস্থ সরকার চাই।

প্রিয় জনগণ-দেশ মানে তো একটি ভূখণ্ড নয়। জনমানব ছাড়া কোন ভূখণ্ড দেশ হয় না। তাই দেশপ্রেম মানে দেশের মানুষের প্রতি প্রেম। আর সে মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে যারা ক্ষমতায় যেতে চায় কিংবা ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়, তারা কেহ দেশপ্রেমিক হতে পারে না। তারা ভণ্ড, তারা প্রতারক, তারা স্বার্থপর, লোভী। তাই রোমের মত কেবল ঢাকা নগরী নয়, সমগ্র বাংলাদেশ আজ যখন পুড়ছে, আমাদের জননেত্রী ও দেশনেত্রী দু’জন নিরুর মত বাঁশি বাজাচ্ছেন নিরাপদ দূরত্বে বসে।
কিন্তু আমরা জনগণ কেন সেটা মেনে নেব ? এ দেশতো কারো বাপ-দাদার মৌরসী সম্পত্তি নয়। এদেশ যোল কোটি মানুষের। আমরা যুদ্ধ করে এদেশ স্বাধীন করেছি-ইতিহাসের নজিরবিহীন আত্ম-ত্যাগের মাধ্যমে। এখানে কেউ রাজা-রাণী, আর কেউ প্রজা নয়। আমরা ষোল কোটি মানুষ এদেশের মালিক। দু’জন অবিবেচক, আত্মম্ভরী, মুখরা রমনীর জেদাজেদীর কাছে আমরা সবাই কেন এত অসহায় হয়ে পড়ব ?
কেহ কেহ দুই নেত্রীর মধ্যে সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনের কথা বলছেন। কিন্তু সংলাপ-সমঝোতার ফলে উভয় পক্ষের অংশ গ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই কি সমস্যার সমাধান হবে? নাকি নতুন করে সমস্যার শুরু হবে? যারা নির্বাচনে হারবে, তারা কি সে নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেবে? তারা কি সংসদের যাবে? জাতি কি চলমান রাজনৈতিক সংঘাত থেকে, আদর্শহীন পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে মুক্তি পাবে? ইতিহাস বলে, না, তা কখনো হবার নয়।
তাই আসুন, আমরা জনগণ প্রত্যেক জেলায় জেলায় শহীদ মিনারে গণজাগরণ মঞ্চের মত সমবেত হয়ে আওয়াজ তুলি-যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। এবার তোমরা বিদায় হও! দুই জোট এর বিপরীতে জনগণের একটি বিকল্প জোট, যার নাম হতে পারে গণজোট, জনজোট বা এজাতীয় অন্য কিছূ, গড়ে তুলি। পরিবারতন্ত্রের বিপরীতে সত্যিকার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ কায়েমের দিকে দেশকে এগিয়ে নিই। এ ছাড়া মুক্তির কোন বিকল্প নেই।