মানুষ হয়ে জন্মানোর অনেক ঝক্কি আছে, ঝামেলাও কম না। এই ঝামেলা তৈরী হয়েছে মানুষের বুদ্ধিমত্তা, যুক্তি, তর্ক, পর্যবেক্ষন, ও রুচি থাকার কারনে। আমরা চাইলেও এইগুলো থাকবে, আবার না চাইলেও থাকবে। এ ব্যপারে আমাদের করার কিছু নেই। আমাদের করার যা আছে তা হলো সার্বজনিন কল্যানে এই বুদ্ধিমত্তাকে অনুসরন করা। প্রশ্ন হলো, স্থান কাল পাত্র ভেদে তা কি আমরা করি? না, করি না। তার একটা জলন্ত উদাহরন জ্বলজ্বল করে জ্বলতে দেখি ঈদুল আযহা এলে। কোরবানীর আভিধানিক অর্থ হলো আত্মত্যাগ, অথচ নিজেকে অক্ষত রেখে হত্যা করি পশুদের। ফুডচেইনের দোহাইটা একেবারে খারাপ না। খাবারের প্রয়োজনে হিংস্র পশুরা একে অপরকে হত্যা করে। ক্ষিদে মিটে গেলেই তাদের হত্যাস্পৃহা বন্ধ হয়ে যায়। উতসব, দান, পূণ্য অথবা মৃগয়ার দোহাই দিয়ে তারা হত্যা করে না। এসব ক্ষেত্রে পশুরা যে অনেকটা মানবিক তা যুক্তিতেই টিকে যায়।

ফুডচেইনের কথায় ফিরে আসি। খাদ্যশৃঙ্খলের কথা মনে হলে জীবন বৃক্ষের কথা স্মরণ হয়, যে বৃক্ষের গোড়া একটাই। এই প্রতিকী বৃক্ষের অর্থ- জীবের আবির্ভাবের শুরুতে আমরা সবাই এক। সেখান থেকে বিবর্তিত হয়ে আমরা বৃক্ষের ভিন্ন ভিন্ন শাখায় বসে আদি স্বজাতিদের ধরে ধরে খাচ্ছি। এ যেন পূত্র খায় প্রপিতামহের দেহ- সবই সেই খাদ্যশৃঙ্খলের নামে। বিবেক, বুদ্ধিমত্তা, প্রযুক্তি কি বলে? সব থেকে বড় শর্বনাশ ঘটিয়েছে প্রানীদেহে স্নায়ুতন্ত্রের জাল। সব প্রানীকে বেঁধে ফেলেছে একই অনুভুতির স্বাদে। স্পর্শ, ব্যাথা, কষ্ট, আনন্দ এইসব কিছুর ত্রিমাতৃক অনুভুতির ধারক আর সংবাহক এই স্নায়ু। নিজের গায়ে শক্ত করে একটা চিমটি কেঁটে দেখুন কেমন কুকড়ে যাওয়া ব্যাথার অনুভুতি এনে দেয় শরীরে। জীবনবৃক্ষের প্রতিটি প্রানীর বেলায়ও তাই। যে যন্ত্রনা নিজের জন্যে চাই না তা অন্য প্রানের উপরে চাপিয়ে দেই কিভাবে? বিবেক, বুদ্ধিমত্তা কিছুইতো সায় দেয় না। আগেই বলেছিলাম বুদ্ধিমত্তা ঝামেলার। সেই ঝামেলাই এক সময় যুক্তি-তর্ক দিয়ে আপনাকে পশুনিধন বিরোধী করে তুলতে পারে। পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বলেন শরীরে প্রানীজ আমিষের দরকার আছে। বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে সেই চাহিদারও যোগান দেয়া যেতে পারে। দুধ, ডিম এগুলো শতকরা শতভাগ প্রানীজ আমিষ। শুনেছি মরুদেশে রয়েছে দুম্বা জাতীয় প্রানী, যাদের শরীর থেকে বর্ধিত মাংশ কেটে নিলেও প্রানী মরে না। রয়েছে প্রানীজ আমিষের খুব কাছাকাছি উদ্ভিজ আমিষের সরবরাহ। আপন ভাল কে না চায়। কখনও কখনও সেই ভালর পথে বাঁধা হয়ে দাড়াতে পারে প্রানীজ আমিষ। প্রানীজ আমিষ শরীরে আত্মিকরনের জন্যে যকৃত আর বৃক্ককে পরিশ্রম করতে হয় অনেক এবং পরিশেষে এদের বর্জ সঠিকভাবে নিস্কাসন করতে না পারলে দেহ রোগগ্রস্থ হয়। তাহলে কথা উঠতে পারে, উদ্ভিদের তো প্রাণ আছে; তাদের কেন নিধণ করা হচ্ছে। তারা কি ব্যাথা পায় না? এই প্রশ্নেরও উত্তর আছে। আমরা ফল খাই, বীজ খাই না। বীজ রোপণ করে আবার উদ্ভিদের জন্ম দেই। কিছু কিছু উদ্ভিদের বীজও খেয়ে থাকি আমরা- যেমন, শীম জাতীয় উদ্ভিদ। তবে উদ্ভদের স্নায়ুতন্ত্রের গঠন আর প্রানীরটা এক নয়, পার্থক্য আছে বিস্তর। আমদের মতন স্নায়ুতন্ত্রের বিস্তার তাদের নেই। তাদের কোন কেন্দ্রীয় স্নায়ু বা ব্রেইন নেই। শরীরের কোন আকষ্মিক পরিবর্তন, তা যদি পরিবেশের কারনেও ঘটে থাকে তবু তার প্রতিকৃয়া তারা কেমিকেল এনজাইমের মাধ্যমে উদ্ভিদ দেহের সব জায়গায় সঞ্চালিত করতে চেষ্টা করে। ঠিক আমদের মতন ব্যাথাবোধ প্লান্টের দেহে কাজ করে না। এখানে উল্লেখ করতে হয়, পশ্চিমের সাধারন মানুষও খুব বেশী বনের মোষ তাড়ায়। একটু গুগল সার্চ দিলে দেখতে পাবেন অনেক এমেচার গবেষক প্লান্ট নিউরোলজীর উপরে কাজ করছে এবং তারা তাদের পরস্পরের অভিজ্ঞতার আদান প্রদান করে নিজেরা আনন্দ পাচ্ছে আবার পৃথিবীর জ্ঞান ভান্ডারকেও সমৃদ্ধ করছে। এরপরেও প্লান্ট নিউরোলজী সম্পর্কে আরো জানতে চাইলে এখানে ক্লিক করুনঃ
(http://en.wikipedia.org/wiki/Plant_perception_%28physiology%29)।

হোমো সেপিয়েন্সদের দাতের বিন্যাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে- তারা ঠিক তৃণভোজীও (Herbivores) না, আবার মাংশাসীও (Carnivores) না। উইজডাম টীথ বা আক্কেল দাতের অবস্থাও তথৈবচ। তৃণ চর্বনে তা ব্যবহৃত না হওয়ায় নষ্ট হয় দ্রুত। একজন দন্তচিকিতসকের কাছে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতে পারবেন বছরে কতগুলো আক্কেল দাত তিনি তুলে থাকেন। এমন হয়, কারন আমরা তৃণভোজী না, তবে খানিকটা নিরামিষভোজী। অপরপক্ষে মানুষের ক্যানাইন টীথগুলো (কুকুরে দাত বলে অনেকে) বেশ ছোট এবং ভোতা, মাংশাসীদের তুলনায়। তারমানে আমরা মাংশাসীও না। তাহলে কেন এই সৌখিন পশু নিধন। দশাসই কুকুরে দাত নিয়ে পুরা সুন্দরবনের ব্যাঘ্র সমাজ এক বছরে যতগুলো পশু হত্যা করে, আমারা শীমের বিচির মতন ছোট্ট চারটে কুকুরে দাত নিয়ে তার শতগুন বেশী সংখ্যক পশু নিধন করে এটাই প্রমান করি- বাঘ আমাদের থেকে বেশী মানবিক।

মাথা থাকলেই মাথাব্যাথা রোগ হবে। আর এই মাথাব্যাথার একমাত্র মহৌষধ মাথাটাকে খাটানো। কোরবানী আসলে জিনিসটা কি, তা কি আমরা একবারো সেভাবে ভেবেছি? কোরবানী আসলেই একটা মহত কাজ এবং সমাজ সংসারের অনেক বড় উপকার সাধিত হয় তাতে। কিন্তু সেটা করার আগে আমাদের প্রিয়বস্তু নির্বাচন করতে হবে। অধিকাংশ স্বাভাবিক মানুষের প্রিয়বস্তু তাদের স্বামী, স্ত্রী, সন্তান এবং পিতামাতা। কিন্তু কেউ কি আল্লাহ-সোবহানা-তা’আলার উদ্দেশ্যে তাদের হত্যা করে? ঠিক বলেছেন, মানুষ তা করে না। করা উচিতও নয়। আল্লাহ যথার্থ বুদ্ধিমান বলে তিনি এমন আদেশ দেননি। তার বদলে তিনি আদেশ করলেন প্রিয় বস্তু বা প্রিয় সম্পদকে তার নামে উতসর্গ করতে। তাই এটা আবশ্যকীয় কাজ হলো তাদের জন্যে, যারা সক্ষম। এখানে খুব সহজে স্থান-কাল-পাত্রের ব্যপারটা চলে আসে। যখন আব্রাহামকে কোরবানীর আদেশ করা হয়েছিল তখন সে সরাসরি পশু পালন থেকে জীবিকা নির্বাহ করতো এবং এই পেশা দ্বারা কোরবানীর জন্য উদবৃত্ত সম্পদও তার ছিল। তখন থেকে অবস্থাপন্ন পশুপালকেরা তার এই কাজকে অনুসরণ করতে থাকে। তারপরে কালের চাকা বহুদূর গড়ালো। মানুষের জীবিকা আর আটকে রইলো না লাইভস্টোকে। তারপরেও কি মুমিনেরা প্রিয়বস্তু বলতে শুধুই গরু ছাগলকে বুঝবে? জটিল কোন বুদ্ধি না, সাধারন বুদ্ধিতে কি বলে? ধরা যাক বাংলাদেশের কথা। শতকরা কতজন মানুষ সরাসরি লাইভস্টোক থেকে জীবিকা নির্বাহ করে কোরবানীতে সক্ষম হয়ে উঠছে? শুধু পশু কোরবানীতে সক্ষম হলে চলবে না। কারন কোরবানীর একটা বড় উদ্দেশ্য চেরিটি বা দান। পশু কোরবানীর যে ফাইনাল প্রডাক্ট, অর্থাত সেই মাংশের চাহিদা মানুষের আছে কি না তাও দেখতে হবে। কমনসেন্সে বলে চেরিটি করতে হলে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে মানুষের চাহিদা মেটাতে হয়। আমার জানা মতে বাংলাদেশের বহু মানুষের মূল চাহিদা বাসস্থান, চিকিতসা, শিক্ষা। গরু-ছাগলের মাংশ এইসব মৌলিক চাহিদা কতটা মেটাতে পারে, তা ভাববার বিষয়। আবার বাংলাদেশে যারা এই লাইভস্টোক পেশার বাইরে রয়েছেন, যেমন- কৃষক, প্রবাসী শ্রমিক, গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ইত্যাদি, তাদেরও প্রিয় বস্তু কি গরু-ছাগল, না অন্য কিছু? শ্লেষের সুরে বলতে পারেন- তুমি বাপু মানুষকে বছরে একটা দিন আমোদ আহ্লাদ করতে দিতে চাও না। তুমি লোক ভালো না। জনে জনে, প্রকাশ্যে হত্যা-উতসব এই যুগে, এই চিন্তার বল্গাহীনতার যুগে কতটা গ্রহনযোগ্য তাও ভাববার বিষয়। কাল চলমান আর আমরা দাড়িয়ে আছি ঠায়, জিনিসটা কেমন দাঁড়াবে তাহলে?


রহিম সাহেব একজন বিখ্যাত কবি। তিনি ভাবতেই পারেন না এই প্রানীটি তার সবচেয়ে প্রিয়বস্তু। তিনি মনে করেন, তার প্রিয়বস্তু তার খ্যাতি, প্রতিপত্তি।

একটা উদাহরন দিলে বিষয়টা আরো পরিস্কার হবে আশা করি। ধরা যাক জনাব আব্দুর রহিম একজন খুব বড় কবি। তার সমান কবি বাংলাদেশে আর একজনও নেই। তার কাব্য প্রতিভা দেশের সীমান্ত ছেড়ে আরো বহুদূরে চলে গেছে। কবিতা তাঁর পেশা-নেশা, ধ্যান-জ্ঞান। কবিতা তাকে দিয়েছে খ্যাতি ও প্রতিপত্তি। এখন যদি রহিম সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হয়- জনাব, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো আপনার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটা কি? যথার্থ সত্যবাদী হিসাবে রহিম সাহেব বলবেন, আমার কাব্য প্রতিভা এবং তার মাধ্যমে গড়ে উঠা আমার খ্যাতিই আমার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু। রহিম সাহেব এই যুগের যুধিষ্টির। কজন হতে পারে তার সমান? এবার আপনারাই বলুন তার কি বস্তু কোরবানী দেয়া উচিত? নিশ্চয়ই গরু বা ছাগল নয়। রহিম সাহেব তাই ঠিক করেছেন, আগামী কোরবানী ঈদে তিনি দশ জন প্রতিশ্রুতিশীল দরিদ্র কবিকে বৃত্তি প্রদান করবেন, যাতে তারা উজ্জল কাব্য প্রতিভা হিসাবে ভবিষ্যতে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। আমার মনে হয়, রহিম সাহেব উতকৃষ্ট একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কবি আব্দুর রহিম একজন আলোকিত মানুষ। তিনি ঠিক ঠিক ধরে ফেলেছেন, এই আত্মত্যগে তার খ্যাতি আর প্রতিপত্তির উপরে জাগতিক আসক্তি কিছুটা হলেও কমবে। তিনি এও জানেন শিল্প-সাধনায় অমন আসক্তি কতটা ক্ষতিকর। কোরবানীর দার্শনিক উদ্দেশ্য হলো, ব্যাক্তির সবথেকে প্রিয় বস্তুর উপরে জাগতিক আসক্তি কমিয়ে ফেলা, যাতে মূল কর্তব্য কাজে ডিভোশনটা দেয়া যায়। আর সেই আসক্তি কমাতে গিয়ে যে সম্পদ তৈরী হয় তার সর্বোতকৃষ্ট ব্যবহার নিশ্চিত করা হলো জাগতিক উদ্দেশ্য। সুতরং ভিন্ন পেশা, চিন্তা ও রুচীর লোকের জন্য কোরবানীর ধরন ভিন্ন হতে বাধ্য।

অপেক্ষা করুন, আর কিছুদিন পরেই বাজারে আসছে সিন্থেটিক মাংশ, যা বানানো হবে কারখানায় যৈব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে। ইতিমধ্যে বিফ-বার্গারের মাংশের চাকতি বানানো হয়েছে ল্যবেরোটরিতে। প্রানীর জন্ম না দিয়ে, প্রানী হত্যা না করেই প্রানীর মাংশ। এরপরেও যারা প্রানী-হত্যা উতসবে অংশ নিয়ে পূণ্য অর্জন করতে চায় তাদের হেদায়েত করতে পারবে একমাত্র সেই আল্লাহ-সোবহানা-তায়ালা যিনি এই হত্যার হুকুমটি দিয়েছিলেন। তবে শুধু ক্ষুধার প্রয়োজনে, শরীর রক্ষা বা খাদ্যশৃঙ্খলের ন্যুনতম তাগিদে প্রানী হত্যাকে আমি মহাপাপ বলবো না, বলবো স্থুল বা তৃমাত্রীক কাজ, যা একটা সাধারন স্তরের প্রানীই করতে পারে। পাপ মার্সি কিলিং-এ, হত্যা উতসবে। প্রকাশ থাকে যে, হত্যা-উতসব শুধু ইসলামে নয়, সকল ধর্ম বিশ্বাসের জন্য লজ্জার। মানুষের মাথার ভিতরে আছে উতকৃষ্ট মানের বুদ্ধিমত্তা। যে বুদ্ধিমত্তা নিয়ে একটা বাঘ ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্যে অন্য প্রানীর রক্তে যে প্রকৃয়ায় হাত রাঙায়, তার থেকে শতগুন উর্বর বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আমরা সেই একই কাজ করবো কিনা সেটা ভেবে দেখার দায়িত্ব আমাদেরই।