যে তিনটি দল, তিনটি পক্ষ এই দেশের তাবেদারি নিয়েছে তারা এবং তাদেরই তদারকি আমলে ঠিক কতজন গার্মেন্ট শ্রমিক মারা গেছে? ঠিক কত জন আগুন আতঙ্কে পায়ের তলে পিষ্ট হয়ে মারা গেছে? কতজন ছাঁটাইয়ের পর রোগ-শোক এ ভুগে মারা গেছে? এর কোন পরিসংখ্যানই গত মহামহিম সরকারগুলোর কাছে ছিল না, এখনকার ‘নতুন সরকারেরও’ কাছেও নেই। ‘দোজখের’ আগুনে অগুনতি গার্মেন্ট শ্রমিকের পুড়ে মরা। এটাকে ঠিক পুড়ে মরা বলা যাবে না। এটা স্রেফ হত্যাকাণ্ড। বাংলাদেশে যতো পোশাক কারখানা আছে তার প্রায় সবই একধরনের দোজখ বিশেষ। আগুন লাগার পর শ্রমিকরা বেরোতে না পেরে জ্যান্ত পুড়ছে। জ্যান্ত মানুষ ধীরে ধীরে আগুনে পুড়ে কয়লা হওয়া বীভৎস। সাভার ইপিজেডে, আশলিয়ায় আগুনে পুড়ে, তাড়া খেয়ে, মালিক পক্ষের লেলিয়ে দেওয়া ভাড়াটে গুন্ডাদের হাতে এ যাবত কত জন মরেছে তার কোন সঠিক হিসেব নেই। থাকে না। এটাই নিয়ম। কেননা,গার্মেন্ট মালিক, সুশীল নাগরিক নামের সমাজের সুবিধাভোগী অংশ, সরকার, সরকারের বিভিন্ন পেটোয়া বাহিনী সবাই এক হয়ে যে ভাবনা-চিন্তাপ্রসূত সিদ্ধান্তে আসেন তা হলো,গার্মেন্ট শ্রমিকরা হয় হাফ মানুষ, নয়ত সিকি মানুষ!

মৃত্যু এমনিতেই বীভৎস, কদাকার। মৃত্যুর কোনো সৌন্দর্য নেই, আগুনে পুড়ে মরাটা বীভৎসতম। এমন অভিযোগ প্রায়শঃই উঠেছে ওইসব কারখানাগুলোতে মাসের পর মাস ধরে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হয় না। ব্যাংকের দেনা শোধ হয় না। ব্যাক ক্রোক করে নিতে পারে মনে করে মালিক গং নিজেরাই আগুন ধরিয়েছে । এরকম নিজেরা আগুন ধরিয়ে দেওয়ার চল এই দেশে যে দিন থেকে এই গার্মেন্ট নামক দর্জিদোকানে গড়ে উঠেছে, সেদিন থেকেই এস্তেমাল হয়ে গেছে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের সময় কয়েক কোটি লিখিয়ে নেওয়া গেলে ইন্স্যুরেন্স ক্লেইম ইত্যাদি করে একটা মোটা অঙ্ক রেয়াত পাওয়ার চিন্তা থেকে এ কাজ হচ্ছে তাতে এখন আর রাখ ঢাক নেই।

গার্মেন্ট শ্রমিক নামক ওইসব হতভাগা শ্রমিকদের জন্য, তাদের ছেলে-মেয়ে গুলোর জন্য মিনিমাম দরদটুকুও আসেনা ওপর তলায় বসবাসকারী নৃপতিদের। ওই কারখানাগুলোর না-খাওয়া শ্রমিক এবং তাদের সন্তান-সন্ততিরা যখন কাফনের কাপড় গায়ে চড়িয়ে রাজপথে নামে তখনো এই সব প্যারাসাইট মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চ বিত্তে লংজাম্প দিতে চাওয়া সেলিব্রেটিদের সামান্যতম অনুকম্পা হয়না। হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। সারাজীবন সমাজের ওপরতলায় বিলাসব্যাসনে কাল কাটানো এই সব কর্পোরেট টাকাঅলা ভিখিরীদের অন্তরের শানেনাজুল আমাদের খুব ভাল ভাবেই জানা আছে। আমরা আধুনিক নগর সভ্যতার মানুষেরা পরে আর খোঁজ নেওয়ারও সময় পাইনা যে সেই হতভাগারা মরে গেছে, না এখনো বেঁচে আছে শেয়াল-কুকুরের মত তাদের মেয়েগুলো এখনো পেটের দায়ে দেহ বিক্রি করে, না সিফিলিস হয়ে তিলে তিলে মৃত্যুমুখে পতিত?

আমরা লেখকরা এ ধরনের হত্যাকাণ্ডকে যতই ধিক্কার দিই না কেন, পাঠক, দয়া করে বিক্ষুব্ধ হবেন না, দ্রোহি হবেন না। প্রকৃতিতে ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ বলে একটা কথা আছে। ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য নাকি জন্মহারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মৃত্যু ঘটিত হতে হয়! এই পোড়া দেশটা মনুষ্য জন্মহারে খুবই উর্বর। ঝাঁকে ঝাঁকে, গণ্ডায় গণ্ডায় এখানে মনুষ্য পয়দা হয়। এটা ভেবেই আমরা এক ধরণের ‘রিলিফ’ পেতে পারি। পাইও।

‘র‌্যাব’, ‘চিতা’, ‘কোবরা’র ‘ক্রসফায়ারে’ আঁকাবাঁকা, ভেঙেচুড়ে, দুমড়েমুচড়ে মানুষ মরে, আর তা দেখে হাজার হাজার মানুষ আনন্দ মিছিল (!) করে, মিষ্টি বিলোয়! কামেলরা বলেন, হারামির বাচ্চাগুলো এমন সন্ত্রাস করেছিল যে তাদের মৃত্যুতে মানুষ হাফ ছেড়ে বেঁচেছে, তাই আনন্দ মিছিল! মারহাবা! ইনশাল্লাহ আমাদিগের আনন্দ মিছিল করণেঅলাদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে, কেননা সন্ত্রাসীও কমবে না, ‘ক্রসফায়ার’ও কমবে না। এটা সূত্রের কথা। ‘ক্রসফায়ারে’ সন্ত্রাস নির্মূল করতে হলে আড়াই থেকে তিন কোটি আদম সন্তানকে ‘ক্রসফায়ারে’ কতল করতে হবে। ‘ক্রসফায়ারে’ মরতে পারি, চিন্তাটা খালি পেটের মানুষের মাথায় থিতু হয় না। এটাই নিয়ম। তো যদি ধরেই নিই স্থায়ীভাবে সন্ত্রাস মুক্ত করার জন্য আড়াই কোটি মানুষ মেরে ফেলার সেমিনারজাত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো এবং ‘প্রকল্প বাস্তবায়ন’ বিপুল বিক্রমে এগিয়ে চললো, তার কাছে গার্মেন্টস কারখানায় শত শত বা হাজার হাজার শ্রমিকের না খেয়ে,আত্মহত্যা করে বা পুড়ে মরা কী খুব বড়ো কিছু?

গত দুআড়াই দশকে এই ফ্যাক্টরিগুলোতে কতো মানুষ পুড়ে মরেছে তার পরিসংখ্যান এ মুহূর্তে দিতে পারছি না। অনুমান করা যায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার মানুষ বিভিন্নভাবে মরেছে। ভুল বললাম, মেরে ফেলা হয়েছে। অপ্রশস্ত সিঁড়ি, প্রধান গেটে তিন-চার ধাপে তালাবন্ধ, শেকল দিয়ে সেই তালাকে আরো নিরাপত্তা দেওয়া। অধিকাংশ কারখানায় ফায়ার স্কেপ সিঁড়ি নেই, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নেই। কোথাও নামকাওয়াস্তে দুএকটা ফায়ার এস্টিংগুইশার থাকলেও তা অচল। পানি নেই। আগুন নেভানোর অন্য কোনো ব্যবস্থাও নেই। শুধু যদি গেটের তালাটা খোলা থাকে, অথবা গেটে তালা না দেওয়া থাকে তাহলে এই হতভাগাদের মৃত্যুটা এড়ানো যায়। কেন তা হয় না? কেন ব্যাংকে ভল্টের মতো নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা দরকার? না, ভয় আছে। পাছে শ্রমিকরা সুতো-বোতাম, টুকরো টাকরা কাপড় নিয়ে যায়! এই সকল অব্যবস্থা নিয়ে কম লেখালেখি হয়নি। এক একটা অগ্নিকাণ্ডের পর এক-দেড়শ মানুষ মরার পর, এক একটা সন্ত্রাসী হামলার পর শত সহস্র মৃত্যু আর হাজার হাজার এর নামে মিথ্যা মামলা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি, আলোচনা, সেমিনার হযেছে। রেজাল্ট শূন্য।

এবং তার নিশ্চিত বলি সাধারণ শ্রমিক। বিশেষ করে নারী এবং শিশু শ্রমিক। কেন একজন মালিক মরবে না? আজ পর্যন্ত কী কোনো একজন এমডি, ডিরেক্টর, পিএস, কমার্শিয়াল অফিসার মরেছে? না। কেন তারা মরবে না? দুর্ঘটনা তো জাতপাত বিচার করে আসে না, গরিব-ধনী দেখে না, তাহলে আজ অবধি কেন কোনো মালিক মরলো না আগুনে পুড়ে? সহজ উত্তর মালিকরা পুড়ে মরার মতো জায়গায় থাকে না। তাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে আগুন প্রবেশ করে না। কেবল অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত হাভাতে শ্রমিকরাই (নারী এবং শিশু) আগুনে পুড়ে মরার জায়গাতে কাজ করে। তাদের পুড়ে মরাটাই যেন নিয়তি।

গার্মেন্টস নামক এই দর্জির কারখানাগুলো কোনো শিল্প নয় তাই এর নিট ফলাফল ক্যাশ কারেন্সি। হয়তো এর সহায়ক হিসেবে অন্যান্য অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে। কিন্তু সবই ভাড়াবাড়ির মতো। দুমাসের নোটিশে ভাড়াটের মতো বাড়ি ছেড়ে যেতে পারে এই বিনিয়োগ। এই সেক্টর দেশের অর্থনীতিতে কী পরিমাণে সত্যিকার অবদান রেখেছে তা পরিসংখ্যান সাপেক্ষ। কিন্তু এই সেক্টরের কারণে এ দেশে একটা নব্য এলিট শ্রেনী পয়দা হয়েছে, এবং তারা প্রয়োজনে বেশ্যার দালালের মতো উভয়পক্ষের মুনাফা লুটতে কুণ্ঠা বোধ করে না, এটা পরিসংখ্যান ছাড়াই বলে দেওয়া যায়। এই শ্রেণীর কোনো কোনো বুজুর্গ মন্তব্য করেছেন গার্মেন্টস উঠে গেলে নাকি হাজার হাজার নারী শ্রমিক বেকার হয়ে বেশ্যাবৃত্তি করবে! এই সেক্টরে এক একটা দুর্ঘটনা ঘটে আর স্টুপিডবাক্সে ভেড়ুয়া দালালরা কাছা মেরে বসে পড়েন বক্তিমা ফলাতে।

গত কয়েকদিনে আশুলিয়ায় পুলিশ এবং মালিক আর তাদের দালালেরা যে বর্বরতা দেখিয়েছে সেসব জাস্টিফাই করতেই এইসব ভাড়াখাটা বুদ্ধিবেশ্যরা কণ্ঠনালী দিয়ে বিষ উগরে দিচ্ছে। বাংলাদেশে বুদ্ধিবেশ্যাবৃত্তিরও ভালো বাজার তৈরি হয়েছে সেটা জানা কথা, কিন্তু বেশ্যাদেরও তো একটা নীতি থাকে। এদের তাও নেই। যে শ্রমিকদের রক্ত ঘামের বিনিময়ে এইসব হারামির বাচ্চারা ফুটানি মারাচ্ছে সেই শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদের পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে পরিকল্পিত খুন করাচ্ছে। খুন হতে পারে যে কেউ, এটা তথাকথিত মর্ডানাইজেশনের ব্যাকফায়ার। কিন্তু সেই খুনকে জাস্টিফাই করে যারা তারা কি মানুষ? না মানুষের চামড়া গায়ে লোলচর্ম সর্বস্ব হায়েনা?

পুড়ে মরা, পুড়িয়ে মারা, আগুনের ভয়ে পায়ের নিচে পড়ে মরা, তিন-চার তলা থেকে প্রাণভয়ে ঝাঁপ দিয়ে মরা, সর্ট সার্কিটে মরা, বাড়িঅলার টাকা শোধ দিতে না পেরে তার জোয়ান ছেলেদের যৌন লালসা মেটাতে গিয়ে ধর্ষিতা হয়ে মরা, সামান্য বেতন পেয়ে বাসের বদলে খোলা ট্রাকে বাড়ি ফেরার সময় ট্রাক উল্টে মরা, রোজ কিয়ামতের ইহকালের মহড়ায় ভবন ধসে মরা, বাসস্থলে আগুন লাগিয়ে জমি দখলের সময় মরাসহ নিত্য নতুন মরার এবং মারার কায়দা-কানুন তৈরি হয়েছে এই শ্রমিকদের হত্যা করার জন্য। তার পরও এই হতচ্ছাড়াগুলো পতঙ্গের মত আগুনে ঝাঁপ দিতে আসে! পুড়ে মরেই যেন ‘আজন্ম পাপ’ মোচন করতে চায়! পেটের জ্বালা এতটাই জ্বলে যে সেই জ্বলুনির কাছে ভবন ধসে বা আগুনে পুড়ে হাজার হাজার সাথীর মৃত্যুও তুচ্ছ মনে হয়! তাই যদি না হবে তাহলে কেন এই আত্মহণন? কেন এই মৃত্যুউৎসব? এই ‘কেন’র উত্তর জানে এই দেশের বাই ডিফল্ট ক্রিমিনাল মধ্যবিত্ত আর তাদের আপগ্রেডেশন ভার্সন ধনী ভিখিরীগুলো এবং তাদের ভাড়াখাটা বুদ্ধিবেশ্যারা। সে কারণেই তারা নিশ্চিন্ত। তারা নিশ্চিন্ত যে হাজার হাজার মরার পরও গ্রাম থেকে পঙ্গপালের মত ঝাঁকে ঝাঁকে শ্রমিকরা আসবে। ভাত ছিটালে ‘কাকের’ অভাব এদেশে কখনো হয়নি, হবেও না।

ইনিয়ে বিনিয়ে মাখো মাখো স্বরে, মিহি সুরে এবং তথাকথিত সহমর্মী সাজার ছেনালি ঢঙে বহুত বাতচিত হল, অঢেল বাকোয়াজ হল। এবার থামতে হবে। বাঁচতে চাইলে লড়তে হবে। লড়তে হলে জোটবদ্ধ হতে হবে। এই দেশে শ্রমিকের হয়ে কেউ লড়ে দেবে না। শ্রমিকের হয়ে কেউ মারা যাবে না। বড় জোর নিপূণ কায়দায় অভিনয় করে কাঁদো কাঁদো ভাব নেবে সুশীলগণ। তাই যারা লড়ছে, মরছে, নিঃশ্চিহ্ন হচ্ছে, উচ্চেদ হচ্ছে, ধর্ষিতা হচ্ছে তাদেরই রুখে দাঁড়াতে হবে। কোনো বুদ্ধিবেশ্যা তাদের পাশে দাঁড়াবে না। বিদেশি প্রভুরা ধমক দিলে কাপড় চোপড় নষ্ট করে ফেলা সমাজপতিরা এই বেলা সেই প্রভুদের কথাও শুনতে নারাজ, কারণ প্রভুরা না জানলেও তারা জানে যত মরবে তত আসবে। ফার্টাইল ল্যাণ্ড মেকস মোর ফার্টিলাইজার। স্টুপিড বাক্সে খোমা দেখিয়ে বুদ্ধিবেশ্যারা সাফাই গাইছে ‘শ্রমিকের কাজের পরিবেশ উন্নত করতে হবে’! শ্রমিকরা কি তাদের কাজের পরিবেশের নিকুচি করে, নাকি আগামীদিন কাজ করার জন্য আজকে বাঁচতে চায়? এক লাইনের এই অমোঘ সত্যটি খুব দ্রুত শ্রমিকদের বুঝে নিতে হবে। আর সেটাও কোনো মৌসুমী রাজনীতিকের বুলি শুনে নয়, নিজের অস্তিত্ব দিয়েই বুঝতে হবে, কেননা এই বেজন্মা জনপদে রাজনীতিক, সুশীল, উকিল-মোক্তার, ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক-কলামিস্ট, বুদ্ধিজীবি-সংবেদজীবি, ধর্মবেত্তা-অবতার কেউ গার্মেন্ট শ্রমিকের সহমর্মী নয়। কেউ তাদের পক্ষে নেই। এমন বৈরী সময়ে বাঁচার একটি মাত্র উপায় প্রতিটি আঘাত, প্রতিটি আক্রমন প্রতিহত করা, রুখে দেয়া। আজ না হোক কাল তারা এটা পারবে। পারবেই।


২১ নভেম্বর ২০১৩

লেখকঃ মনজুরুল হক।
প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থঃ আ লিটল ফাইটার স্লিপিং উইথ আর্মস, শকুমেন্টারি শকোথেরাপি, কর্পোরেট ডেমোক্রেসি, অসমাপ্ত বিপ্লব-অমর বিপ্লবী কমরেড চারু মজুমদার ইত্যাদি।