গ.
সাহিত্যের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ব্যক্তির ইন্দ্রিয় বা চেতনাকে জাগিয়ে তোলা। সাহিত্য সৃষ্টি মানেই একটা স্বাধীন সত্তার সৃষ্টি করা। সত্তা থেকেই উৎসারিত হবে অসীম সম্ভাবনাময় চেতনার। বলে রাখা ভাল নৈতিকতা আর চেতনা এক-জিনিস নয়। নৈতিকতার চর্চা করা নীতিশাস্ত্রের কাজ। সাহিত্য এখান থেকে যত দূরে থাকে ততই মঙ্গল। তার মানে কি সাহিত্যের নৈতিকতা বলে কিছু নেই? আছে, তবে সেটা ভিন্ন অর্থে। নৈতিকতা আপেক্ষিক। আপেক্ষিক সত্যকে সাহিত্য চরম সত্য বলে মান্য করে না। সাহিত্যর জন্মই অনেকগুলো আপেক্ষিক সত্য থেকে। নৈতিকতার সংজ্ঞা সবসময় নির্ধারিত হয় একটি শ্রেণির হাতে। সাহিত্য কোনো শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে না। নীতিশাস্ত্র করে। বস্তুত, সাদা বাংলায়, সাহিত্য কারোরই প্রতিনিধিত্ব করে না। উপন্যাসিক সুসান সোনটাগ তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে বলছেন, ‘একজন সিরিয়াস লেখক নিজের ছাড়া অন্য কারো মুখপাত্র নন। এখানেই সাহিত্যের মহত্ত্ব’। [অনুবাদ: বর্তমান আলোচক, সূত্র: প্যারিস রিভিউ] কুন্ডেরা বলছেন, ‘ঔপন্যাসিক কারই মুখপাত্র নন। এমনকি নিজের ভাবনারও মুখপাত্র নন।’ [অনুবাদ: দুলাল আল মনসুর, ‘দ্য আর্ট অব নভেল’, কাগজ প্রকাশন, ২০০৭] অবশ্য কিছুকাল আগের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। সাহিত্যিকরা তখন জাতির বিবেক বলে বিবেচিত হতো। ‘ডিকেন্স, দস্তয়ভস্কি এবং তলস্তয় লিখেছিলেন উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণিদের জন্যে। উনিশ শতকে গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের উপন্যাসগুলো জাতীয় দৈনিকগুলোর শিল্প ও সাহিত্য পাতায় প্রথম প্রকাশিত হতো কারণ মনে করা হতো তাঁরা সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে কিছু বলছেন।’ (ওরহান পামুক, তুমি কার জন্যে লেখো, অনুবাদ: বর্তমান আলোচক) কিন্তু বহুমুখী মিডিয়ার বিস্তারের সাথে সাথে লেখকদের দায়বদ্ধতা গেল কমে। এখন মানুষ মূল খবরটাই জানতে চায়। ঘরে বসে সমগ্র বিশ্ব দেখা যায়। তাই সাহিত্যিকরা আর সামাজিক মুখপাত্র থাকলেন না। সাহিত্যের কাজ গেল বদলে। সাহিত্যের এই কাজ বদলের মুহূর্তে সাময়িকভাবে সাহিত্যের মৃত্যু ঘোষণা করলেন কেউ কেউ। বিখ্যাত দার্শনিক-লেখক হোসে ওর্তেগা, জার্মান ভাবুক ভাল্টার বেনিয়ামিন, কথাসাহিত্যিক রোলাঁ বার্থ, গোর বিধাল, জন বার্থ—এইসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উপন্যাসের সম্ভাব্য মৃত্যু নিয়ে শঙ্কায় পড়ে গেলেন। কিন্তু সাহিত্য নতুন মোড় নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। সাহিত্য আবির্ভাব হল সত্যকে চিনবার চেতনা হিসেবে। ফুয়েন্তেস যাকে বলছেন, ‘সর্বজনীন মানবিক বৈশিষ্ট্য’কে দাড় করানো। ব্যক্তি সত্যকে নিজ আলোয় চিনে নেবে, সাহিত্য সেই আলোর যোগানদাতা মাত্র। সাহিত্য ভাল-মন্দকে প্রচলিত মানদণ্ডে বিচার না করে শুধুমাত্র ভাল বা মন্দের এসেন্সকে বা ধারণাকে তুলে ধরবে। সৌন্দর্য ও কদর্যতার ক্ষেত্রেও বিষয়টি অভিন্ন।

নীতিশাস্ত্রের মতো দর্শনের সাথেও সাহিত্যের বিরোধ আছে। সাহিত্যের কাজ দার্শনিক সত্য প্রতিষ্ঠা করা নয়। সাহিত্য দর্শনের চেয়ে অনেক সরল ও জীবনমুখী একটা মাধ্যম। এখানে পণ্ডিত ও অপণ্ডিত দুজনেরই সমান অধিকার। দর্শনের ভিত্তি হল জ্ঞান ও যুক্তি। কুন্ডেরা উপন্যাসের ভিত্তি হিসেবে দাড় করিয়েছেন ‘চিন্তাপ্রবণ প্রশ্ন’কে। যে সকল দার্শনিক শিল্পকে দার্শনিক এবং তাত্ত্বিক ধারার পরবর্তী রূপ বলে মনে করেন তাদের সাথে দ্বিমত কুন্ডেরার। কেননা তিনি বলছেন: ‘উপন্যাস ফ্রয়েডের পূর্বেই অচেতনতা নিয়ে কথা বলেছে, মার্ক্সের পূর্বে শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলেছে, ইন্দ্রিয়তাত্ত্বিকদের পূর্বে ইন্দ্রিয়তাত্ত্বিক বিষয়ে কথা বলেছে।’ [তর্জমা: দুলাল আন মনসুর, ঐ] বটেই। ফ্রয়েড তাঁর ‘ইডিপাস কমপ্লেক্স’-এর ধারণা পান সফোক্লিস পড়ে। সফোক্লিস একটা সম্ভাবনাকে দাড় করিয়েছেন, ফ্রয়েড সেখান থেকে তাঁর দর্শনের উপাদান খুঁজে পেয়েছেন। হেগেল-এর দর্শনের মূলমন্ত্র (‘the opposing poles of a dichotomy define each other, and thus constitutive of one another’s identity’) আমরা খুঁজে পাই শেকসপিয়ারের ডাইনীদের কাছ থেকে—‘সুশ্রীই হল কুশ্রী! কুশ্রীই হল সুশ্রী!’ [ম্যাকবেথ, তর্জমা: আলোচক] একইভাবে হেলমারকে নোরা যখন বলে—I don’t believe that any longer. I believe that before all else I am a reasonable human being, just as you are—or, at all events, that I must try and become one. I know quite well, Torvald, that most people would think you right, and that views of that kind are to be found in books; but I can no longer content myself with what most people say, or with what is found in books. I must think over things for myself and get to understand them.’ [A Doll’s House’]—তখন অস্তিত্ববাদী ও নারীবাদী দার্শনিকরা যে সত্য তুলে ধরতে চান সেই সত্য নোরার জীবন দিয়ে আমরা উপলব্ধি করতে পারি। এভাবেই সাহিত্যে দর্শনের নানান অনুষঙ্গ সচেতন কিংবা অবচেতনভাবেই জীবনের নানান প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। জীবনের সঙ্গে দর্শনের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। প্রয়োগের দিক থেকে সাহিত্যের সাথে দর্শনের সম্পর্ককে বোঝার জন্য দুই জগত বিখ্যাত কবির কাছ থেকে ঘুরে আসা যায়। ওয়ার্ডসওয়ার্থ তাঁর ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে করে আক্ষেপ করছেন এই বলে:
that there hath past away a glory from the earth…/
At lenth the Man perceives it die away,
And fade into the light of common day.’ [Ode: Intimations of Immortality]

কোলেরিজ উত্তরে বলছেন:
I may not hope from outward froms to win
The passion and the life, whose fountains are within.
Oh Wordsworth! We receive but what we give,
And in our life alone does nature live [Dejection: An Ode]

দেখা যাচ্ছে, ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর বেদনা বস্তুর বিদায়কে ঘিরে। কোলেরিজ বস্তুর সত্তাকে অবলম্বন করার জন্য তাঁকে পরামর্শ দিচ্ছেন। অর্থাৎ এখানে একজন বস্তুবাদী তো অন্যজন ভাববাদী। তারা সেটা দর্শন নয় কবিতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করছেন। এভাবে দর্শনে প্রাণ স্থাপন করেছেন সাহিত্যিকরা। আবার দার্শনিকরা সাহিত্য থেকে সলিড দর্শনকে আলাদা করেছেন।

ঘ.
এতো গেল বোধের জায়গা। নির্বোধের বা বিনোদনের উৎস হিসেবেও সাহিত্যের আলাদা একটা কদর আছে। অনেকে মনে করেন, সাহিত্যের আসল কাজই এটা। বিনোদন-সাহিত্যের বাজার দরও বেশি। জনপ্রিয় সাহিত্যের ধারা বলতে পপ-লিট্রেচার বা বিনোদন-সাহিত্যকেই বোঝানো হয়। এটা মনের ব্যায়ামস্বরূপ কাজ করে। অনেকে মনে করেন, চলচ্চিত্র কিংবা সঙ্গীতের মতো নির্ভেজাল বিনোদন দেওয়া সাহিত্যের কাজ না। সাথে একটু শিক্ষাও থাকা চায়। হেনরি ফিল্ডিং মেজাজ কড়া করে বলছেন– ‘অসৎ সঙ্গ শুধুমাত্র ব্যবহার নষ্ট করে। আর বাজে বই ব্যবহারের পাশাপাশি রুচিও নষ্ট করে দেয়।’ [‘অন রিডিং ফর আমুউজমেন্ট’, তর্জমা: বর্তমান আলোচক] মনোরঞ্জন করতে গিয়ে লেখকদের হেংলামি তিনি পছন্দ করছেন না। কেননা এই ধাঁচের সাহিত্য পাঠক তৈরি যেমন করে তেমন তাদের রুচিও নষ্ট করে। আমাদের দেশে হুমায়ুন আহমেদ এই ধারার প্রধান লেখক। তাঁকে নিয়েও এ বিতর্ক চলমান। অনেকে বলেন তিনি পাঠক তৈরি করেছেন, অনেকে আবার কথাটা উল্টে বলেন, তিনি আমাদের ধ্রুপদি সাহিত্যের পাঠক নষ্ট করেছেন।

সাহিত্যের আনন্দের সাথে জড়িত আছে শিক্ষা। কেননা কল্পনাশক্তি থেকে যেমন জ্ঞানকে আলাদা করা যায় না তেমন আনন্দ থেকে নির্দেশনাকেও আলাদা করা যায় না। ব্যক্তির অভিজ্ঞতা থেকে এই সত্যটা জেনে নেওয়া যাক। মালকম এক্স জেলে বসে উপলব্ধি করলেন যে নেতা হতে হলে তাঁকে ভাষায় দক্ষ হতে হবে। তারপর তিনি একের পর এক বই গিলতে থাকলেন। নতিজা তিনি স্বীকার করলেন এই বলে:
‘i had never been so truly free in my life…new world opened to me, of being able to read and understand it.’ [the autobiography of Malcolm x, 1964s]

বোধ ও বিনোদন বাদে সাহিত্যের অন্য একটি জায়গা এখানে উন্মোচিত হল, তা হল জীবন। মপাসাঁ বলছেন:
‘The serious writer’s goal is not to tell us a story, to entertain or to move us, but to make us think and to make us understand the deep and hidden meaning of events.’ (‘The Writer’s Goal’)

অর্থাৎ সাহিত্যের কাজ হল আনন্দ দানের পাশাপাশি গভীর থেকে জীবনটাকে আগলে দেওয়া। সাহিত্য করেও তাই। সমগ্র সিরিয়াস সাহিত্যজুড়ে আছে মানুষের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিকলাঙ্গতা। এ-ধাঁচের সাহিত্যের কাজ হল মানুষের রোগ নির্ণয় করা। চিকিৎসা প্রদান করা সাহিত্যশাস্ত্রের আওতায় পড়ে না। মানুষের শরীর যেমন জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ছোট-বড় নানান সমস্যার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়, মনও তেমন ছোটবড় অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে কাল অতিক্রম করে। চিকিৎসা শাস্ত্র মানুষের শরীরের রোগ নির্ণয় করে, মনের করে সাহিত্য। গোটা বিশ্বসাহিত্য জুড়েই চলে আসছে এই প্রচেষ্টা। রবার্ট লুই স্টিফেনসন (‘ডক্টর জেকিল এন্ড মি. হাইড’-এ) দেখিয়ে দিলেন—মানুষের সত্তা মূলত দুই খণ্ডের—ভাল এবং মন্দ। একটা দুর্বল হলে অন্যটা সবল হয়ে ওঠে। কিংবা একটা সবল হলে অন্যটা দুর্বল হয়ে পড়ে। ‘মেটামরফোসিস’ ও ‘ডেথ অব ইভান ইলিচ’ দেখিয়ে দিল যে আধুনিক মানুষের সংকট শরীরে না মনে, মানে অস্তিত্বে। ‘সিস দ্য ডে’ ও ‘ডেথ অব এ সেলসম্যান’ ধরিয়ে দিল আধুনিক সমাজে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সম্পর্কটা কোথায়। ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’, ‘হার্ট অব ডার্কনেস’, ‘এ প্যাসেস টু ইন্ডিয়া’ তুলে ধরলো মানুষের আধিপত্যবাদের প্রকৃতি। মানিক ও লরেন্স তুলে আনলেন যৌন ক্ষুধায় কাতর মানুষকে। ‘লিসিসট্রাটা’, ‘মাদার কারেজ’, ‘ডলস হাউস’, ‘জেন আয়ার’ ‘টেস..’, ‘হ্যান্ডসমেড’স টেল’, ‘ওয়াইভস এন্ড কুকুবাইন’ এসমস্ত নাটক ও উপন্যাসে তুলে আনা হল ভণ্ড পুরুষক্রেন্দ্রিক সভ্যতার অসুস্থ জায়গাটাকে। ‘আউটসাইডার’, ‘দ্য ডাম্প ওয়েটার’ ও ‘ওয়েটিং ফর গোডুট’ আধুনিক জীবনের নিরর্থকতার প্রতি আঙুল উঠাল। বালজাক, ফ্লবেয়ার, রিচার্ডসন, মান, দস্তয়ভস্কি, হেমিংওয়ে, হুগো, গোর্কি প্রভৃতি লেখকের সাহিত্যে মানুষ তাদের অসহায়ত্ব নিয়ে হাজির হল। এমনি করে পৃথিবীর তাবৎ মহান সাহিত্যকর্মগুলো মানুষের ভেতরের বিকল অবস্থাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখিয়ে যেতে লাগলো। সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কাজই হল এটা। এই কাজটি না করতে পারলে সাহিত্য তার গুরুত্ব হারাবে। অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের মতোই সাহিত্য হয়ে উঠবে বিমূর্ত। ভাষাহীন।

চলবে….

সাহিত্যের কাজ অকাজ, প্রথম অংশ:
https://blog.mukto-mona.com/?p=37451