ক.
এই প্রবন্ধের শুরুতেই প্রয়োজন পড়ে সাহিত্য কি সেই বিষয়টা আবার একটু নতুন করে খোলসা করার। যদিও এক সিপি নীল জল দিয়ে সমুদ্র চেনানো আর সংজ্ঞা দিয়ে সাহিত্য বোঝানো একই ধরনের ব্যর্থ চেষ্টার নামান্তর। এতে বিষয়টি চেনাতে বা বোঝাতে গিয়ে আরো বিপদে ফেলে দেওয়া হয়। আর ‘না জ্ঞান’ যে ‘উল্টো জ্ঞান’র চেয়ে মঙ্গল সেটা কে না জানে! কাজেই সে পথে না এগিয়ে সাহিত্য নিয়ে একটু আড্ডা দেওয়া চলে। সাহিত্য বোঝার জন্য আমরা সাহিত্যবিদে¦ষী টমাস গ্রাডগ্রিন্ডের কাছে চলে যাবো। চার্লস ডিকেন্স-এর ‘হার্ড টাইম’ উপন্যাসের শুরুর অধ্যায়ে উপযোগবাদী রাজনীতিবিদ টমাস গ্রাডগ্রিন্ড তার আদর্শ স্কুলের শিক্ষকদের বলে দেন যেন, ছাত্ররা তাদের কল্পনাশক্তি ব্যবহার করতে না শেখে। ‘teach these boys and girls nothing but facts. Facts alone are wanted in life’. [‘Hard Time’] গ্রাডগ্রিন্ড সাহেব তার কথার কোথাও সাহিত্য শব্দটা উচ্চারণ না করলেও আমাদের বুঝে নিতে সমস্যা হয় না যে তিনি চরমভাবে সাহিত্য বিদ্বেষী, বিদ্বেষটা তার জীবন সম্পর্কে মাপাজোকা ধারণা থেকেই এসেছে।

গ্রাডগ্রিন্ড-এর ঠিক বিপরীত সত্যটা জানতে এবার আমরা হাজির হবো অন্য একটা স্কুলে। এই স্কুলের (‘ডেড পোয়েটস সোসাইটি’) শিক্ষক-এর ভূমিকায় থাকা রবিন উইলিয়ামস তার ছাত্রদের শোনালেন একেবারে ভিন্ন কথা। তিনি বললেন,
We don’t read and write poetry because it’s cute. We read and write poetry, we are members of the human race. And the human race is filled with passion. Medicine, Law, Business, Engineering; these are Nobel parsuits and nessary to sustain life. But Poetry, Beauty, Romance, Love; these are what we stay alive for.’

এখন এই দুই বায়বীয় স্কুল থেকে আমরা জীবন সম্পর্কে দুটো ধারণা পেলাম, এখান থেকে আমরা অনায়াশে সাহিত্যের প্রাথমিক চরিত্রটা দাড় করাতে পারি। এই চরিত্রের কতগুলো উপাদান বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট আছে। কল্পনাশক্তি তার মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে। এরপরেই আসে ভাষা। বায়বীয় গল্প বা কতগুলো বিমূর্ত জীবনকে মূর্ত করে তোলা হয় ভাষার সাহায্যে। ভাষা এখানে ইট-চুন-সুড়কির কাজ করে। কাজেই সাহিত্য হতে হলে তার একটি লিখিত রূপ থাকা অনিবার্য। সাহিত্যের ভাষাটা হতে হবে পাউণ্ড যে রকম বলছেন, Literature is language charged with meaning.’, সে রকম। মানে শব্দগুলোর শরীর বলবে এক কথা, অন্তর আরেক; যাকে বলা হয় ’মেটাফর অব লাঙ্গুয়েজ’। সাহিত্যে এর পরের কলকব্জা হল ফর্ম বা কাঠামো। এর সাথে জড়িয়ে আছে কিছু অনুসঙ্গ; যেমন: প্লট ও সেটিং। যেনতেন করে কোনকিছু প্রকাশ করাটা সাহিত্য না। সাহিত্যে কি প্রকাশ করা হল তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ন কিভাবে প্রকাশ করা হল। স্টপফোর্ড ব্রুক-এর বক্তব্যটা এখানে ধার নেওয়া যায়:
writing is not literature unless it gives to the reader a pleasure which arises not only from the things said, but from the way in which they are said’.

এতক্ষণে কল্পনাশক্তি, ভাষা ও কাঠামো এই তিনটা উপাদানের সম্পর্ক স্থাপনকে আমরা সাহিত্য বলতে পারি। কিংবা অন্যভাবে বললে, এই তিনটা উপাদানের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে সৃষ্ঠ তৃতীয় সত্তাকে সাহিত্য বলা চলে।

খ.
প্রত্যেক মানুষের একটা গল্প থাকে—খুব চিরায়ত, চিরন্তন গল্প। মোটাদাগে সেই গল্পটা লিখে ফেলা সাহিত্যের কাজের মধ্যে পড়ে না। যে গল্পটা তৈরি, সেটা সাহিত্য না। মানে দশজন লিখলে যদি দশরকম সম্ভাবনা বের হয়ে না আসে তবে সেটা গল্প বটে কিন্তু সাহিত্য না। অর্থাৎ সাহিত্যের প্রধান কাজ হল ব্যক্তির সম্ভাবনাগুলো খুঁজে খুঁজে বের করা। ব্যক্তির সেই সম্ভাবনাগুলো বাস্তবে বিদ্যমান থাকতেও পারে, নাও পারে। মার্ক টোয়েন যথার্থই বলছেন- Fiction is obliged to stick to possibilities, Truth isn’t.’ সম্ভাবনাকে খুঁজে বের করার জন্যই রবার্ট ফ্রস্টকে হাঁটতে হয়েছে যে পথে মানুষ কম হেঁটেছে সেই পথে। (Two Roads Diverged in the Wood and I’ I took one less Traveled by. And that has made all the Difference’.)

যদি সম্ভাবনা থেকেই সাহিত্য হয় তাহলে সাহিত্য জীবনের সরাসরি বা হুবহু দর্পণ না। এরিস্টটলের ‘আর্ট ইজ ইমিটেশন অব লাইফ’ এ ইমিটেশনের মাত্রা নিয়ে গ-গল দেখা দেয়। যদি অস্কার ওয়াইল্ড-এর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলি- ‘literature always anticipates life. It does not copy it, but molds it to its purpose’—তাহলে ইমিটেশনের অর্থটা এখানে বুঝে নিতে সমস্যা থাকে না। একটু ভেঙ্গে বললে, সাহিত্য হল অন্য এক বাস্তবতা যেখানে বায়বীয় চরিত্রগুলো বাস্তবের চরিত্রদের পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। তাই ক্ষেত্রবিশেষ বাস্তবের চরিত্ররা হয়ে ওঠে বায়বীয় চরিত্রদের ছায়া বিশেষ। এই অর্থে দুইটা জগত আলাদা আবার অভিন্নও। সাহিত্য ও জীবনের সম্পর্কটা এমনই দ্বন্দ্বমুখর বা প্যারাডোক্সিক্যাল।

সাহিত্য অনেকগুলো আপেক্ষিক সত্যের মাঝে যে অস্পষ্টতার প্রজ্ঞা তা থেকেই নিজের প্রজ্ঞাকে বের করে আনে। সাহিত্য প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করে চলে ব্যক্তির সম্ভাবনাকে। সত্য আবিষ্কার করা সাহিত্যের কাজ না, এখানেই বিজ্ঞানের সাথে সাহিত্যের বিরোধ। যে সাহিত্যে আবিষ্কার নেই তার প্রয়োজন মূল্য নিতান্তই কম। কুন্ডেরা তাকে বলছেন- ‘অনৈতিক সাহিত্য’ (দি আর্ট অব নভেল)। অর্থাৎ নতুন কিছু আবিষ্কার করা সাহিত্যের নৈতিকতার মধ্যে পড়ে। রবার্ট ফ্রস্টও অক্টাভিও পাজকে একই কথা বলছেন- ‘প্রত্যেক কবির জন্মই হয় নিজস্ব কিছু বলবার জন্যে। তার আদি কর্তব্য হল পূর্বজদের অস্বীকার করা…।’ (কবিকে দেখতে যাওয়া) এখন প্রশ্ন হল, সাহিত্যে বিদ্যমান জীবনকে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে? হুবহু জীবন থাকবে নাকি গল্প হবে কল্পনাপ্রসূত? যে কোনো একটির একচেটিয়া আধিপত্য সাহিত্যের জন্যে স্বাস্থ্যকর নয়। দুটোর যথাযথ বা গাণিতিক বিক্রিয়া ঘটাতে হবে। সেই কথায় জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন, “পোস্টমাস্টারটি আমার বজরায় এসে বসে থাকত। ফটিককে দেখেছি পদ্মার ঘাটে। ছিদামদের দেখেছি আমাদের কাছারিতে। ওই যারা কাছে এসেছে তাদের কতকটা দেখেছি, কতকটা বানিয়ে নিয়েছি।” অন্যত্রে লিখেছিলেন, ‘আমার গল্পে বাস্তবের অভাব কখন ঘটে নি। যা কিছু লিখেছি, নিজে দেখেছি, মর্মে অনুভব করেছি, সে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।’ ফকনার একই কথা একটু ঘুরিয়ে বলছেন- ‘গল্পটা (‘দ্য রোজ ফর এমিলি’) কল্পনা থেকে এসেছে। কিন্তু ঐ বাস্তবতা চারপাশে বিদ্যমান। গল্পটা নতুন কোনো বাস্তবতাকে আবিষ্কার করেনি। তরুণীরা কাউকে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখে, সংসার চায়, সন্তান চায়, এটা আমার আবিষ্কার না। কিন্তু ঐ মেয়েটির (এমিলি) যে নির্দিষ্ট ট্রাজিক পরিণতি সেটা আমার তৈরি।’ (অনুবাদ: বর্তমান আলোচক)

ফকনার ১৯৫৮ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি আমেরিকান ফিকশনের ওপর গ্রাজুয়েটদের ক্লাসে বলেছিলেন:
‘আমার মতে তুমি যাই অনুধাবন করতে পারো তাই অভিজ্ঞতা। এটা বই থেকেও আসতে পারে। এটা এমন বই, এমন গল্প এবং এতই জীবন্ত যা তোমাকে নাড়িয়ে দেয়। আমার মতে এটা তোমার অভিজ্ঞতা সমুহের একটি। এমন নয় যে ঐ বইয়ের চরিত্রগুলো যা করে তা করে অভিজ্ঞতা নিতে হবে। চরিত্রগুলোর কাজগুলো যদি বাস্তবসম্মত মনে হয়, এবং মনে হয় মানুষ এমনটিই করে তাহলে এটা অভিজ্ঞতার ভেতর পড়ে। তাই আমার কাছে অভিজ্ঞতার সংজ্ঞা এই, অভিজ্ঞতার বাইরে লেখা সম্ভব নয়। কারণ তুমি যা পড়, শুন, অনুভব কর, কল্পনা কর- এ সবই অভিজ্ঞতার অংশ। [তর্জমা: সাবিদিন ইব্রাহিম]

এখানেই স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, অভিজ্ঞতা ও কল্পনা এ-দুটোর বিক্রিয়া ঘটলেই সাহিত্য নামধারী তৃতীয় পক্ষ এসে হাজির হয়। কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক প্রায়ই বলেন যে তিনি দেখার বাইরে কিছু লেখেননি। এই কথা অনেকে বলেছেন। বলছেন। এই দেখা মানেই আক্ষরিক অর্থে সেই জীবনটা যাপন করা নয়। একজন লেখক তাঁর কল্পনাশক্তি বলে অনেকগুলো জীবন যাপন করেন। কাজেই দেখা যায়—একজন রিকশাচালকের জীবন ঐ রিকশাচালকের চেয়ে ভাল বোঝেন একজন লেখক। এজন্যে দেখার অনেকগুলো দৃষ্টি না থাকলে যা লেখা হবে সেটা হবে খবরের কাগজের খোরাক, সাহিত্য না। আবার সব অভিজ্ঞতা আমাদের দৃষ্টি দিয়ে আসে না। যেমন: আমরা কোনোদিন শিকারে যাইনি, শিকার করা দেখিওনি। কিন্তু শিকার করা বিষয়টা ধরতে পারি। ছোটবেলায় মুরব্বীদের কাছে শিকারের গল্প শুনে খানিকটা আন্দাজ করেছি, খানিকটা জীবজগতের স্বাভাবিক প্রবণতা দেখে বুঝে নিয়েছি। কিংবা এক্ষেত্রে ডেকার্তেস যেটা বলছেন—‘our innate ideas form the basis of our experience of reality’—সেটাকেও সত্য বলে ধরে নিতে পারি। ঘটনা যায় হোক—সাহিত্যে প্রত্যক্ষণ অভিজ্ঞতা সবসময় না থাকলেও চলে কিন্তু জ্ঞানটা প্রয়োজন।

চলবে…