[বুয়েট ডিবেটিং ক্লাবে থাকাকালীন বিভিন্ন সময় প্রকাশনা সংক্রান্ত কাজের সুবাদে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেগুলোর মধ্য থেকে একটি আজকে সকলের সাথে শেয়ার করছি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা প্রধান কামাল লোহানীর সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়েছিল ২০০৯ এর জুলাই-এ। সে সময় তিনি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন। ‘৭১ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পরিচালনাকারী ১০ সদস্যের অন্যতম হওয়ার কারণে সে সময়কার অনেক অজানা ইতিহাস উঠে এসেছে এই সাক্ষাৎকারে-এর মধ্যে কিছু কিছু নতুন তথ্য নতুন করে বিতর্কের উন্মেষ ঘটানোর পক্ষে যথেষ্ট, উঠে এসেছে বেতার কেন্দ্রের টেকনিশিয়ানের অনুচ্চারিত কৃতিত্বের কথা এবং বর্তমানের নানা প্রসঙ্গ। প্রথমে ভেবেছিলাম ব্লগটি সংক্ষিপ্ত করার জন্য চুম্বক অংশ প্রকাশ করবো,পরে ভাবলাম একটু বড় হলেও পূর্ণাঙ্গ বক্তব্যই প্রকাশ করা উচিত। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলাম আমি এবং বুয়েট ডিবেটিং ক্লাবের সহসদস্য প্রতিতী পিয়া। সাক্ষাৎকারটি বুয়েট ডিবেটিং ক্লাবের বার্ষিক প্রকাশনা বৈদূর্য-তে প্রকাশিত হয়েছে]
বৈদূর্যঃসাধারণত কোন সাক্ষাৎকারে এ প্রশ্নটি একদম শেষে করা হয়, আমরা একদম শুরুতে করছি ; স্যার আপনি এ দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন,আমাদের সাংবাদিকতার জগতে আপনার অবদান অপরিসীম,আজ এ ৭৫ ঊর্ধ বছর বয়সে এসেও আপনি কর্মরত,শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আপনার এ জীবনকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
কা,লোহানীঃআসলে নিজে মূল্যায়ন করাটা খুব কষ্টকর, তবে যে কাজগুলো করেছি তা যদি দেশ ও দশের কল্যাণে লেগে থাকে তবে মনে হয় হ্যাঁ,সফলতা এসেছে।কিন্তু সেটি কতটুকু টিকিয়ে রাখতে পারি সেটার ওপর নির্ভর করবে পরিণতির পরবর্তী মূল্যায়ন।যেমন ধরুন ৭১ এ আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি,এর পেছনে দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রাম,সাধারণ মানুষের আন্দোলন ছিল।এবং সেখানে একটা প্রেরণা ছিল,সেটা হলো বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব।তিনি যে বলেছিলেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”-এই কথাটি আপাতদৃষ্টিতে স্বাধীনতার ঘোষণা মনে হয় না।কিন্তু এর মধ্যেই এই ঘোষণার বীজটি অন্তর্নিহিত রয়েছে।সেজন্য যখন পরবর্তীতে আমরা দেখি যে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক তোলা হয় একটি বিশেষ মহল থেকে,তখন খুব হাস্যকর বলে মনে হয় অন্তত আমাদের কাছে।মানুষকে তারা বলে যে এই স্বাধীনতার ঘোষণাটি দিয়েছেন একজন সেনানায়ক,তখনকার দিনে তিনি মেজর জিয়া নামে পরিচিত ছিলেন।হ্যাঁ,করেছেন ঘোষণা।কিন্তু মজার ব্যাপারটি হলো তিনি প্রথমে বুঝতে পারেননি এটা একটা জনগণের যুদ্ধ,জনযুদ্ধ।উনি মনে করেছিলেন এটা একটা আর্মি ক্যু হচ্ছে-তাই credit টা নেওয়ার জন্য তিনি নিজেকে প্রভিশনাল সরকারের প্রধান বলে নিজের নাম ঘোষণা করেছিলেন।যেটা নিয়ে আজকের বি.এন.পি বাঁচবার চেষ্টা করে।কিন্তু পরবর্তীতে তার ঘোষণায় On behalf of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman-our great leader এই শব্দগুলো ছিল।
বৈদূর্যঃএই প্রসঙ্গে বলি-আপনি যেহেতু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আহবায়ক কমিটির সেক্রেটারী এবং Head of the News ছিলেন,আপনি এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।আজকের এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক কি খুব অনভিপ্রেত নয়?
কা,লোহানীঃঅবশ্যই,যেখানে ১৯৭২ এর সংবিধানে বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক এবং স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে সেখানে এটা নিয়ে বিতর্ক তোলা মানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্তিত্বকে challenge ছুঁড়ে দেওয়া।দ্বিতীয়ত,সামরিক বাহিনী থেকে এসে ক্যু করা যায় কিন্তু জনগণের যে বিপ্লব সেটা করা যায় না।ওটা করার জন্য দীর্ঘদিনের অন্দোলনের ধারাবাহিকতার প্রয়োজন হয়।এটা খুব হাস্যকর চিন্তা যে সামরিক বাহিনী থেকে এসে একজন হুঁইসেল বাঁজালেন আর ওমনি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।আর জিয়াউর রহমান নিজে এ ঘোষণার জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আসতে চাননি,তাকে অনেক বুঝিয়ে আনতে হয়েছিল।এবং বুঝানোর পিছনে আমাদের বন্ধু বেলাল মোহাম্মদ ছিলেন এবং ক্যাপ্টেন রফিক,সম্ভবত তিনি তখন ইপিআর,চট্টগ্রাম যোনের প্রধান,মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন।কারণ এটা তো সবাই জানে যে,২৫মার্চ রাতে যখন crack down হল,তার পরে সোয়াত জাহাজে করে বাংলাদেশের মানুসের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য আধুনিক অস্ত্র ও সৈন্যবাহিনী চট্টগ্রাম বন্দরে আনা হয়েছিল,সেই জাহাজ এর মালামাল,অস্ত্র আর মানুস খালাসের জন্যই জ়িয়া বন্দরে গিয়েছিলেন।যাবার পথে তিনি যখন ডক শ্রমিকদের ব্যারিকেড-এর সম্মুখীন হলেন,তখন তার মুখ দিয়ে বাঙ্গালি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে আর্মিসুলভ গালমন্দই বের হচ্ছিল।এবং তার পর যখন ব্রিগ.মজুমদারকে ঢাকায় তুলে নিয়ে যাওয়ার খবর তার কাছে আসল তখন তার বন্ধুই তাকে বুঝিয়েছে যে এর পর আর এই জায়গায় থেকে ঠিক হবে না।তখন আর তার সোয়াত থেকে অস্ত্র বা মানুস খালাস করা সম্ভব হয়নি,ওখান থেকে নিজেকে খালাস করার জন্যই থাকে চলে যেতে হয়েছিল।এবং অনেক দূরে একটা গ্রামের স্কুল ঘরে মানুস জন তাকে আটকে রেখেছিল,বলেছিল দেশের এর সংকটের মূহুর্তে কোথায় পালিয়ে যাচ্ছেন?থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আমরা করছি।এটা আমি কর্নেল নুরুজ্জামানের মুখে আমি শুনেছি।সেই লোকটি,নিজে কোনদিন বলেননি যে আমি ঘোষণা দিয়েছি…সাপ্তাহিক বিচিত্রায় তিনি “একটি জাতির জন্ম” বলে বিশাল একটি লেখা লিখেছিলেন,সেখানে কোথাও তিনি বলবার চেষ্টা করেননি যে তিনি স্বাধীনতার ঘোষক।
বৈদূর্যঃতাহলে আজকে শুধু রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য বঙ্গবন্ধুর সমান্তরালে একটা ব্যক্তিত্ব দাঁড় করানোর জন্যই কি………?
কা,লোহানীঃসেটা তো সম্ভব নয়।তারা এটা করেছে নিজেরা বাঁচবার জন্য।যখন জিয়ায়ুর রহমানকে হত্যা করল তারই সতীর্থরা,বিএনপি কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং নিজেদের উত্থানের জন্য জিয়া কে ব্যবহারের জন্য তারা এই কৌশলটি ব্যবহার করল।কাজেই স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক করার কোনরকম অবকাশ নেই।বিশেষ করে আমরা যারা সাক্ষী আছি…সেই দশ জন,তাদের মধ্যে বেলাল সিনিয়র মোস্ট ছিলেন,আবুল কাশেম স্বন্দীপ,যে নাম দিয়ছিল স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র…
বৈদূর্যঃএই প্রসঙ্গেই আসতে চাচ্ছি,এই যে বেলাল মোহাম্মদের কথা বললেন,অন্যান্যদের কথা বললেন যারা কিনা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পর্দার অন্তরালেন মানুস ছিলেন,আমাদের বর্তমান মিডিয়া কি তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে আনতে পেরেছে?
কা,লোহানীঃ…আমার মনে হয়…আদৌ পারেনি…এখনও আবদুল্লাহ আল ফারুক বেঁচে আছেন,শরফুজ্জামান বেঁচে আছেন,আমিনুর রহমান বেঁচে আছেন,মোস্তফা আনোয়ার বছর তিনেক আগে মারা গেছেন,প্রধান প্রকৌশলী সাকের সাহেব-ও আজ আমাদের মাঝে নেই…আমি আসল ছেলেটির নামই মনে করতে পারছিনা…যে ছেলেটি ট্রান্সমিটারটি উঠিয়ে নিয়ে পরে ইন্সটল করেছিল…
বৈদূর্যঃরাশেদুল হোসেন কি?
কা,লোহানীঃহ্যাঁ হ্যাঁ…রাশেদ রাশেদ। young man, he was technical operator.ইঞ্জিনিয়ারও তখনও নয়…সে ট্রান্সমিটারটি খুলে নিয়ে চলে গিয়েছিল যখন পাকিস্তানিরা বোমা বর্ষণ করে ওটাকে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল কালুরঘাটে,এটাকে তখন উঠিয়ে নিয়ে ত্রিপুরা সীমান্তের নিকটবর্তি বগাফার জঙ্গল নিয়ে যাওয়া হয়।রাশেদ সেখানেই ট্রান্সমিটারটিকে স্থাপন করছিল,without looking at the copybook!!কারণ কপিবুক তো তখন তার কাছে নাই।সেগুলো কিছুই সে দেখেনি,কিন্তু তারপরও সে সেটিকে ইন্সটল করেছিল।সেটা দেখে ইন্ডিয়ার তথ্য ও বেতারের প্রতিমন্ত্রী মি.নন্দিনী অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।এবং তখনকার অল ইন্ডিয়া রেডিও-র প্রধান প্রকৌশলী অবাক হয়ে বলেছিলেন যে এই তরুণ কিভাবে এটা সম্ভব করল!আসলে দেশপ্রেম ও মাটির প্রতি আনুগত্য যদি থাকে তাহলে যেকোন মানুস যেকোন জিনিস জয় করতে পারে…এটা হল তারই একটি প্রমাণ।আর রাশেদ তাই একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র হয়ে আছে আমাদের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইতিহাসে।
বৈদূর্যঃএবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি,রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতাই কি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে এদেশে একটি পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবার সুযোগ করে দিয়েছে?
কা,লোহানীঃএই কথাটাকে আমি যৌক্তিকভাবে মানি।মুক্তিযুদ্ধের সময় এক হয়ে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে,এক দন্ডে দাঁড়ানো মানুসগুলোকে মুক্তিযুদ্ধ উত্তরকালীন রাজনৈতিক অভিযাত্রা বিভক্ত করে দিলো।
বৈদূর্যঃমুক্তিযুদ্ধের পরে গঠিত সরকারে আমরা দেখেছি যে যারা আগের সরকারের চাকুরিজীবি ছিলেন তাদেরকেই বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো।ফিডেল কাস্ট্রোর গেরিলা বাহিনীই কিন্তু পরবর্তীতে দেশে শাসনভার হাতে নিয়েছিল,আমাদের দেশে তো এমন টা হইনি,স্বাধীন বাংলাদেশ শাসনের দায়িত্ব নেন যারা তাদের পাঞ্জাবিতে কাদা লাগেনি একটুও!!
কা,লোহানীঃ (একটু হেসে)এবং ফিডেল কাস্ট্রো বলেওছিলেন বঙ্গবন্ধু কে “u can’t rely upon this colonial army”।যখন পাকিস্তান থেকে সমস্ত বাঙালি সেনারা আসতে শুরু করেছিলো তখন তাদেরকে সেনাবাহিনীতে নিয়ে নেওয়া হয়েছিলো,যার কোন দরকার ছিলো না।বিপ্লবী শক্তি থেকেই সেনাবাহিনী গঠন করা উচিত ছিলো। পৃথিবীর সর্বত্রই যুদ্ধের পরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিগুলোকে annihilate করা হয়।তাদেরকে হয় বিতারিত করা হয় বা একেবারে প্রাণে হত্যা করা হয়।এই হত্যায় অপরাধ আছে বলে আমি মনে করি না।কিন্তু যে কারণেই হোক আমরা তা পারি নি।বঙ্গবন্ধু সপরিবারে এর খেসারত দিয়েছেন এবং আমরা প্রতিদিন তা দিয়ে চলেছি।
বৈদূর্যঃস্যার,স্বাধীনতার পর আমরা যথাসময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শেষ করতে পারিনি এবং তারই ধারাবাহিকতায় আমাদেরকে ১৫আগস্টের মত এক বিভীষিকার সাক্ষী হতে হয়েছে,এই সরকার যদি আবারও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ব্যর্থ হয়,তাহলে কি আমরা আরেকটা ১৫ আগস্টের আশংকা করতে পারি না?
কা,লোহানীঃআমি ১৫আগস্টের কথা ভাবিনা,তার চেয়েও ভয়াবহ কিছুর আশংকা করি।বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এর কাজ শুরু করেছিলেন এবং সে সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল।এবং এই কাজ যখনই শুরু হল তখনি কিন্তু পরাজিত শক্তি এবং তাদের মদদদাতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,পাকিস্তান,সৌদি আরব-এরা ভাবল এই হচ্ছে মোক্ষম সময়,যদি এই সময়েই তাঁকে(বঙ্গবন্ধু) শেষ করে দেয়া না যায় তাহলে তো ঐ ১১ হাজার এর বিচারকার্য ও দন্ড প্রদান শুরু হয়ে যাবে।
বৈদূর্যঃকিন্তু পরবর্তীতে তো এই দেশগুলোর সাথেই আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছিল,যেমন,’৭৪ এ ওআইসি তে আমাদের যোগদান করা কি খুবই প্রয়োজন ছিল?
কা,লোহানীঃ (একটু হেসে)না,আমি মনে করি প্রয়োজন ছিল না।কারণ আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার স্লোগান দিয়ে লড়াই করেছি,তাই এটার কোন প্রয়োজন ছিল না বলে আমি মনে করি।কিন্তু বৃহত্তর কূটনৈতিক চিন্তা ভাবনা থেকে হয়তো বঙ্গবন্ধু তখন এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন।নতুন দেশ,সবে দাঁড়াতে শিখেছে,তার যেন পা টা ভেঙ্গে না যায়,কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে,যোগ দেয়ার পরেও আমাদের পা ভাংলো শুধু না,মাথাও ভেঙ্গে গেল।
বৈদূর্যঃঢাকায় প্রথম অনুষ্ঠিত সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচনে আপনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন,বেতার ছেড়ে সংবাদপত্রে কেন গেলেন?
কা,লোহানীঃআমি বেতারে কাজ করছি দেশের টানে,দেশের সেবা করতে ছেয়েছিলাম।এই যে প্রশ্ন গুলো জিজ্ঞেস করছেন,এগুলো আমার মনে যখন জাগ্রত হল,তখন আমি দেখলাম এ যেন দেশের সেবা নয়,মনে হল আমি যেন চাকরি করতে এসেছি,এই চাকরি তো আমি করতে চাইনা…ফিরে গেলাম খবরের কাগজে।
বৈদূর্যঃঅনেকেই বলেন যে বঙ্গবন্ধু আসলে বাধ্য হয়ে বাকশাল করছিলেন…আসলে বঙ্গবন্ধুর ভুলটা কোথায় ছিল?
কা,লোহানীঃআসলে মুক্তিযুদ্ধের পর যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের সবাইকে নিয়ে যদি একটা সর্বদলীয় সরকার গঠন করা যেত,for the time being,এবং তারপরে যদি নির্বাচন হত তাহলে বোধহয় অনেক ভাল হোত।বাকশাল করাটাকে আমি পুরোপুরি ভুল বলব না,তবে আরেকটু সময় দিলে বোধহয় ভাল হত,কারণ সমাজতন্ত্র তো চাপিয়ে দিলে হবে না।আর বঙ্গবন্ধু কিন্তু সমাজতান্ত্রিক পধহতিতেই সমাধান করতে চেয়েছিলেন,সেভাবেই সংবাদপত্র ও অন্যান্য বিষয় পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন।এটাকে একনায়কতন্ত্র বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না,অবশ্য যারা সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের তল্পিবাহক,তাদের কাছে তো এটা একনায়কতন্ত্র মনেই হবে।
বৈদূর্যঃসাংবাদিকতার প্রসঙ্গেই আবার আসি,অতীতের তুলনায় বর্তমানে আমাদের দেশের সাংবাদিকরা কতটুকু নিরাপদ বলে আপনি মনে করেন?
কা,লোহানীঃআমি বলব নিরাপদ নন অনেকটাই,তার কারণ তারা ঐক্যবদ্ধ নন।আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম বলেই ৭১এ বিজয়ী হয়েছিলাম।এবং ঐক্যবদ্ধ ছিলাম বলেই আইয়ুব খানের মার্শাল ল এর মত সরকারের কাছ থেকে আমাদের স্বাধীনতা,সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আদায় করতে পেরেছিলাম।কিন্তু ।বাকশাল হবার পর খবরের কাগজের সাথে সংশ্লিষ্ট একটা বড় সংখ্যক মানুস বেকার হয়ে গেলেন।বঙ্গবন্ধু যদিও বলেছিলেন এর পুনর্বাসন করবেন,কিন্তু সেটা তো এতো সহজ ছিল না।আমি নিজেও এটার ভিকটিম।আমি তো বাকশালে যোগদান করিনি।আমাকে বলা হয়েছিল বাকশালে যোগ দিতে,আমি দেইনি।পরে অবশ্য সরকার পরিচালিত একটা পত্রিকাতেই চাকরি পেয়েছিলাম…বাকশাল হবার পর বাকশাল এবং নন-বাকশাল এ দুটো ভাগ হয়ে বিভাজনের সূত্রপাত ঘটলো।নন-বাকশালের সাথে এসে আমি বলব যে to some extent,anti democratic force-ও মিলে গেল।ওই সময়ের সুযোগ টা তারা নিয়ে নিল।এবং তাতে হল কি,খালেদা জিয়ার মত মানুস ইউনিয়নটাকে দুটো ভাগ করে ফেললেন,যে কাজটি স্বাধীনতার আগে লোহমানব আইউব খানও পারে নি!!! এখন অনৈক্য এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে ইউনিয়ন এর শক্তি নেই বললেই চলে,শারীরিক নিরাপত্তা তো দূরে থাক,এখন সাংবাদিকদের তো মানসিক নিরাপত্তাও নেই। এখন তো মালিকপক্ষ সাংবাদিকদের ইউনিয়নও করতে দেয় না এমন কথাও শোনা গেছে।
বৈদূর্যঃবর্তমানে তো অনেক সংবাদপত্র দেশে,টিভি চ্যানেলের সংখ্যা বাড়ছেই…সাংবাদিকতার পেশাগত উৎকর্ষতা,সংবাদ সংগ্রহ,উপস্থাপন,পরিবেশনা,এসবের গুণগত মানের কতখানি উন্নতি হয়েছে?
কা,লোহানীঃএকেবারে যে হয়নি তা বলবনা,বিশেষ করে প্রযুক্তির ব্যবহার সাংবাদিকতায় গতি এনেছে,এটাকে ইতিবাচক বলতেই হবে,আর এখন তো প্রতি্যোগিতার যুগ।একজনের চেয়ে আরেকজনেরটা ভাল না হলে প্রতিযোগিতায় সে পিছিয়ে পড়বে,তাই সঙ্গত কারণেই ভাল করার প্রয়াস থাকবেই।তবে একি সাথে অনেক ক্ষেত্রেই নৈতিকতার অবক্ষয়ের একটা ইঙ্গিত দেখতে পাই।
বৈদূর্যঃকমিউনিস্ট পার্টি করেছেন অনেকদিন,বর্তমানে বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির ভবিষ্যত কী বলে মনে করেন?
কা,লোহানীঃনিখাঁদ অন্ধকার।মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টি অংশ নিলেও মুক্তিযুদ্ধের পর কমিউনিস্ট পার্টিতে বিভাজন শুরু হলো এবং পার্টির শক্তি খর্ব হলো।এখন কমিউনিস্ট পার্টির এই খন্ডগুলোর কোন শক্তিই নেই।যদিও সিপিবি এবং ওয়ার্কার্স পার্টি একতার জন্য কিছুটা চেষ্টা করছে।কিন্তু দুঃখের ব্যাপারটি হলো অনৈক্য আমাদের সমাজতান্ত্রিক দলগুলো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।আমার কথা হল সবাই যদি এক মার্ক্স এর আদর্শেরই পথিক হয়ে থাকে তাহলে তাদের মধ্যে এতো দূরত্ব কেন?
বৈদূর্যঃসম্প্রতি বেগম খালেদা জিয়া এক সভায় বলেছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে সরকার দেশকে বিভক্ত করতে চায়।আমরা বিএনপির কাছে আশা করিনা যে তারা নীতিগতভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে সমর্থন করবে,কিন্তু আওয়ামী লীগের কাজে কি আমরা আশা করতে পারি যে তাদের আসলেই এ ব্যাপারে সদিচ্ছা আছে?
কা,লোহানীঃসদিচ্ছা নেই এটাই বা কি করে বলি?আবার এটাও শোনা যায়,বঙ্গবন্ধুর সরকারে একজন মুশতাক ছিলেন,এখন এরকম কয়েকাটা কালপ্রিট শেখ হাসিনাকে ঘিরে রয়েছে।তবে সরকারের ভেতরে এখনো কিছু মানুস আছেন যারা চান বিচার টা হোক।বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন,পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান সেই আইন-ই উঠিয়া দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের এই দেশে পুনর্বাসিত করেছেন,তার স্ত্রী গোলাম আযমকে নাগরিকত্বের মালা পড়িয়ে দিয়েছেন…এইসব কান্ডকারখানার মধ্য দিয়ে জামায়াতের শক্তি দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে,তারা স্কুল,কলেজ,মাদ্রাসা,বিশ্ববিদ্যালয়,কোচিং সেন্টার,হাসপাতাল,সংবাদপত্র,টিভি চ্যানেল করছে,বিদেশ থেকে আসা অর্থে নিজেদের একটা বড় প্রভাব বলয় তৈরি করছে।ধর্মের নামে সাধারণ মানুস এই প্রভাব বলয়ে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে।গ্রামে গঞ্জে,মসজিদে মক্তবে নিয়মিত স্বাধীনতা বিরোধী আদর্শের বিষবাষ্প ছড়িয়ে তারা সাধারন মানুস ভুল পথে পরিচালিত করছে।সরকার যেই পদক্ষেপ গুলো নিয়েছে সেগুলো অসাধারণ,কিন্তু এর পেছনে মানুসকে mobilize করতে হবে।
বৈদূর্যঃসরকার বারবারই বলেছে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য একটা বড় প্রস্তুতি দরকার,সরকার ১বছরেরও বেশি সময় নিয়ে তদন্ত সংস্থা গঠন করল,অথচ এই প্রস্তুতি এমনই ছিল এ একজনকে ১ মাসের মাথায় পদত্যাগ করতে হল(সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময়কালঃজুলাই,২০০৯)…এটা কি অনিচ্ছা নাকি অদক্ষতার লক্ষণ?
কা,লোহানীঃ (হেসে)…অনিচ্ছাই বা বলি কি করে?দেখুন,আইনমন্ত্রী এক ধরণের কথা বলছেন,স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরেক ধরণের কথা বলছেন।সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতার লক্ষণ অত্যন্ত স্পষ্ট।সরকারের বোঝা উচিত এই বিচারটা যদি আমরা করতে না পারি তবে আমাদের সামনে ভয়াবহ অন্ধকার।আমি তো মনে করে জামায়াত না,আমাদের সামনের সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণ তালেবান,আর তালেবানরা জামায়াত এর হাত ধরেই এই দেশে অবস্থান তৈরি করে ফেলতে পারে যদি আমরা ব্যর্থ হই।গত নির্বাচনে আওয়ামীলীগ এর জয়ের পেছনে একটা বড় অবদান রেখেছিল আমাদের তরুণ ভোটাররা।they must recognize that.আজ আওয়ামীলীগ যদি তাদের অংগীকার পূরণে ব্যর্থ হয় তাহলে তারা তরুণদের এই বড় সমর্থন হারাবে এবং পরবর্তী নির্বাচনে যদি সেটা face করতে হয় এবং এর পর যদি আবার বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় আসে তাহলে আরও ভয়ঙ্কর রূপে জামায়াত আবির্ভূত হবে।মধ্যপ্রাচ্যের চাপ তো থাকবেই,কিন্তু ওয়াইসি যোগ দিয়েও কিন্তু আমরা বাঁচতে পারিনি,তাই এবারও সৌদি আরবকে খুশি করলেই যে আমরা খুব শান্তিতে বাস করতে পারব তা তো না,বরং আরও বড় বিপদ হবার আশংকা রয়েছে।তাই আজকে সরকারের উচিত আমাদের এই বিপুল জনসমর্থনকে শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে,যা হবার হবে,এই মনোভাব নিয়ে এই বিচারকার্যটি সম্পন্ন করতে হবে।এবং দেশের মানুস এতে সমর্থন করবে,এবং আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে এর মাধ্যমে আমরা জঙ্গি সমস্যা থেকেও অনেকংশে মুক্ত হতে পারব।
বৈদূর্যঃএবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি,আমাদের বর্তমান ছাত্ররাজনীতি নিয়ে এখন অনেক আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে,এই ছাত্ররাজনীতিকে কলুষমুক্ত করা যাই কিভাবে?
কা,লোহানীঃদেখুন,আমাদের দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছাত্রদের কিন্তু অনন্য অবদান।ভাষা আন্দোলন,১১দফা আন্দোলন,৬৯এর অভ্যুত্থান,স্বাধীনতা যুদ্ধ,স্বৈরাচারবিরধী আন্দোলন…এসব কারা করেছে?ছাত্ররা…অথচ আজ ছাত্ররাজনীতির এই দশা। জেনারেল জিয়া তার নৌবহরে ছাত্রনেতাদের নিয়ে যেতেন,সেখান থেকেই অভির মত মানুসদের সৃষ্টি।আজ ছাত্ররাজনীতির বেহাল দশা।এখন অবিলম্বে সকল জায়গায় ছাত্রসংসদ নির্বাচন দেয়াটা অত্যন্ত জরুরী…আর রাজনৈতিক দলগুলোকেও এই ক্ষেত্রে মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।
বৈদূর্যঃস্যার,সব শেষে তরুণদের উদ্দেশে কিছু বলুন…
সংগবদ্ধ হতে হবে,দেশের জন্য কাজ করতে হবে…এটা শুধু তরুণদেরকে নয়,সবার প্রতি আমার এ আহবান।
বৈদূর্যঃ স্যার আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য।
আমি কোন অভ্যাগত নই,
গ্রন্থনাটি চমৎকার। আমরা বিগত কয়েকদশক ধরে আওয়ামীলীগ আর বি এন পির ধর্মাশ্রয়ী নোংড়া রাজনৈতিক খেলা দেখে চলেছি। জনাব কামাল লোহানী এবং সমমনা দিকদর্শীবৃন্দ এখনো বাংলাদেশে প্রজ্ঞার চূড়ান্ত পর্যায়ে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি এখন আর বাঘ না হলেও হেলেপরা বটগাছ তো বটেই। কালের স্বাক্ষী যাকে বলে। অভিজ্ঞতার কমতি তো নেই। নেই রাজনৈতিক চাতুর্য্য আর কৌশলের অভাবও। আমার কেনো যেনো মনে হয় বার বারই তাঁরা একটা ছোট্ট মিট মিটে প্রদীপকে অগ্রাহ্য করে চেলেছেন। ভেবে চলেছেন আপাতঃ ব্যাঘ্র-দর্শন সারমেয় কুল গুলোকে এদেশের তাবৎ সমস্যার সমাধান হিসেবে। এই দেশটার প্রতি যদি দায়িত্ত্ব আছে বলে তাঁরা অনুভব করেন, তবে কেনো যে দেশের সমমনা বাম শক্তি গুলোকে এক কাতারে এনে একটা বিকল্প রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানোর অনু-প্রচেষ্টা তাঁদের মাঝে নেই – ঠিক বুঝতে পারিনা। অথচ আমি নিশ্চিৎ যে সেখানে এমন একটা রাজনৈতিক মেধার বিচড়ন আছে যারা দায়িত্ত্ব পেলে এদেশের তাবৎ সৃষ্টিশীলদের নিয়েই জাতিটা হয়তো চলার একটা নতুন পথ খুঁজে পেতো।
কামাল লোহানীর এই সাক্ষাত্কার থেকে বোঝা যায় তিনি চারপাশের পরিস্থিতি সম্পর্কে কতটা সচেতন ছিলেন এবং কতটা দূর দৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। বাংলাদেশ সত্যি সত্যিই কি তালেবানি রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছেনা?
সাক্ষাৎকারটা বিশেষ বড় না, কেবল চুম্বক অংশ দিলে অনেক কিছু জিনিস মিস হয়ে যেতো। ধন্যবাদ, সাক্ষাৎকারটা প্রকাশের জন্য। (F)
@প্রতিফলন, শুভেচ্ছা 🙂 (F)
সাংবাদিক কামাল লোহানীর মত মুখে কমিনিউজ্যম অন্তরে সুবিধাবাদীতা নিয়ে – বিশেষত মুক্তিযুদ্ধকালীন কলকাতায় অবস্থানরত “কলম সৈনিক” কিংবা অন্যান্য “কণ্ঠ সৈনিক” “শব্দ সৈনিক” – মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদের নিয়ে প্রশ্ন করেন তখন একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
@সংবাদিকা,
আপনার আপত্তির যায়গাটা ঠিক কোথায়? বললে বুঝতে সুবিধে হত।
@সংবাদিকা,
বিষয়টা একটু পরিষ্কার করলে ভালো হত।
@সংবাদিকা,
আপনার মন্তব্য দেখার পরে আমি কলেকবার সাক্ষাৎকারটি পড়লাম, কিন্তু কোথাও দেখলামনা যে জনাব কামাল লোহানী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারীদের ব্যাপারে বিরূপ কোন মন্তব্য করেছেন! আপনার আপত্তিটা ঠিক কোথায়? একটু বলবেন?